গারো গীতিকবিতায় সংস্কৃতি-পুরাণ
গীতিকবিতা, এ নিয়ে আমার কিছু বলার নাই। যারা এ বিষয়গুলোতে মুন্সি, মুন্সিয়ানা দেখানো তাদের মানাই। তবে পাঠক হিসেবে আমার ভেতরে এ নিয়ে ভাবনার বুদবুদ তৈরি হয় এবং হয় বলেই কখনো-সখনো এ ভাবনা প্রকাশের অদম্য বোধ তৈরি হয়। অতঃপর আমি চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না। যে টেকনিক, কৌশল, ধী শক্তি দরকার, সেই সঙ্গোপন ব্যাপার আমার ভেতরে নাই। তখন কেউ কেউ ভুল বুঝে। ভুল বুঝে, কারণ তারা চায় এবং আকাঙ্ক্ষা করে আমিও তাদের জন্য কিছু করে দিই। এই কিছু করে দেওয়া আর হয়ে ওঠে না। তারপরও আমি নিরাশ করি না। পথের সন্ধান দিই। এর চেয়ে উৎকৃষ্ট বিকল্প আর হয় না। যথা—
দ’ও বিপানি গিসিকাবা
যখন ‘দ’ও বিপানি গিসিকাবা/ইনদিনারিদে গিসিকজানা’ পড়ি চিত্রকল্পে সেই ছোটবেলার কথা, গাও গেরামের কথা তুমুল এসে যায়। যদি-না আমি এটা না-পড়তাম ওই মুহূর্ত অব্দি ভুলেই গিয়েছিলাম খুব ভোরে মোরগ ডেকে ওঠে এবং দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন কারণ তাৎপর্যে ডেকে ওঠে। এই ডেকে ওঠা, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন কারণ তাৎপর্যে, সে যে এমনি এমনি ডেকে ওঠে না, এই কারণ ও ঘোষণা এবং প্রকৃতির অমোঘ সত্য আমার অজ্ঞাতই ছিল।
অজ্ঞাত ছিল সময় ক্ষণ বুঝে, ঠিক সময়ে, মোরগ ডেকে ওঠে। এই ডাক শুনে গৃহস্থরা, লোকেরা, গৃহিণীরা জেনে যায়, বুঝে যায়, দিনের এখন কোন সময়, কোন প্রহর, কি করণীয়। তাকে ঘুম হতে জাগতে হবে, গোয়ালঘর হতে গরু বের করতে হবে, উঠোন ঘরদোর ঝাঁট দিতে হবে, চুলোই রান্না বসাতে হবে, মধ্যাহ্নে গোসলে আহারে বিশ্রামে ও কাজে লেগে যেতে হবে। একইভাবে বিকেলেও কখন কি করণীয় জেনে যাবে।
প্রকৃতির এই চিরাচরিত বিষয় নিয়েই চমৎকার ছন্দবদ্ধে রচিত হলো গান, গীতিকবিতা। তৈরি হলো লিরিক।
দ’ও বিপানি গিসিকাবা
ইনদিনারিদে গিসিকজানা।
সাল সময় সকজোকোনোসা
পাকপাকারি গিসিককানা।
ওয়ালো দ’ও গিসিকোদে
ওয়াল সেকনা আমজকনা।
নকরাংনি মান্দে চাকাথিসা
কাম জাম রিমমানা।
আনথামচি বাক দ’ও গিসিকোদে
মি বিজাক সংআনি সময়না।
দ’ও বিপানি গিসিকজোকোনোসা
মিচিকরাং গিসিং ক্রেংআনা।
সময়’গ্রি দ’বিপা গিসিকোদে
উয়া দ’বিপাকোদে দনজানা।
উকো রিম’মে রা’সথিসে
জাবা সং’ই চা’আনা।
[দ’ও বিপানি গিসিকাবা: তর্পণ ঘাগ্রা]
সওরে নমিল মেথ্রাকদে
গারো পুরাণ অনুযায়ী সেই ‘মিৎদে মান্দেনি চাসংও’ বা ‘সত্য যুগে’ সওরে নমিল মাৎগ্রিক বানডির সাথে একদিন বন পাহাড় জঙ্গল কেটে জুম জমি তৈরি করছিল। ওই সময় সওরে নমিলকে দ্রকপা মাৎচা (বাঘের রাজা) হঠাৎই দেখে এবং রূপমুগ্ধ হয়ে সুন্দরী সওরেকে সে যেভাবেই হোক তার আস্তানায় নিয়ে যাবে সংকল্প আঁটে। দ্রকপা যখন সওরেকে ছোঁ মেরে, পিঠে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, অদূরে মাৎগ্রিক বানডি জুম জমি পরিস্কার করছিল। তখন সওরে চিৎকার করে কেঁদে বলে, বানডি, তুমি কি আমাকে উদ্ধার করবে না, আমাকে খুঁজবে না, আমাকে ভুলে যাবে? বানডি চিৎকার দিয়ে সওরেকে বলে, সাতটি পাহাড় পার হয়ে গেলেও, সাতটি দেশ পার হয়ে গেলেও, আমি তোমাকে খুঁজে উদ্ধার করে নিয়ে আসবো বলে লাফ দিয়ে দ্রকপার পেছনে দৌড়ায়।
বানডি দ্রকপার কাছাকাছি যায় কিন্তু ধরতে পারে না। দ্রকপা পেছনে তাকিয়ে হাসে, মজা করে। বলে, আরেকটু জোরে দৌড়াও। এতে বানডির চরম জিদ ওঠে। বানডি এক লাফে ক্ষিপ্র গতির দ্রকপা যেদিকে ছুটছে সামনের উঁচু পাহাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। দ্রকপা হঠাৎ বানডিকে দেখে জোরে লাফ দিয়ে বানডির ওপর দিয়ে অতিক্রম করতে চায়। বানডিও লাফ দিয়ে পেট বরাবর দা চালায় কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। দা দ্রকপার লেজে আঘাত হানে। লম্বা লেজ মাটিতে পড়ে যায়। দ্রকপা প্রাণপণ দৌড়ে, পেছনে একবার তাকিয়ে, সওরেকে নিয়ে আস্তানায় চলে আসে। সব জেনে দ্রকপার স্ত্রী ও অন্যান্য বাঘেরা সওরেকে ফিরিয়ে দিতে বারবার অনুরোধ করে। তারা বলে, সওরে সাধারণ লোকের প্রিয়তমা না, মিৎদে পাকসা মান্দে পাকসা (অর্ধেক মানুষ অর্ধেক দেবতা) মাৎগ্রিক বানডির প্রিয়তমা। কিন্তু দ্রকপা জেদ করে, সে সওরেকে ফিরিয়ে দেয় না।
ওদিকে মাৎগ্রিক বানডি শপথ করে—যে আমার পেটে প্রথম বিলনি ভাত দিয়েছে তাকে আমি খুঁজে নিয়ে আসবোই, তার হাড়টি হলেও খুঁজে আনবোই। (মাৎগ্রিক বানডি আজন্ম ভাত কি জিনিস, বিলনি কি জিনিস, আগে দেখেনি, খায়নি। তাদের গ্রামে ধান হয় না। আজন্ম থামা থারিঙ মিগারো ও বনের বিভিন্ন ফল-ফলান্তি খেয়ে তারা বড় হয়েছে।
একদিন বানডির মা-বাবা দিংরি বাবেরা থেওয়া ও সসিম কালকামে সন্ধ্যায় থামা থারিং খেয়ে ঘুমানোর আগে ছেলেমেয়েদের নিয়ে খোশগল্প করছিল। তখন মা দিংরি বাবেরা বলছিল, আমরা থামা থারিং খেয়ে দিনযাপন করি, বেঁচে থাকি, কিন্তু আমার বড় বোন রাওয়াকমা ও দুলাভাই কাওয়াকপা সারাবছর ভাত খেয়ে শেষ করতে পারে না। তারা প্রতিদিন সকালে বিলনি চালের ভাত খায়। শুনে বানডি সেই আজং-পাজংয়ের বাড়িতে, বিলনি চালের ভাত খেয়ে দেখতে, দিলমা দিলজং গ্রামের দামদারি এলাকায় যেতে চায়। বাবা সসিম বলে, তোমার আজং-পাজংয়ের বাড়ি অনেক দূর। যেতে সাতদিন সাতরাত লাগে। তাছাড়া পথ নেই। পাহাড়ের বন-জঙ্গল লতা-পাতা কেটে, পরিষ্কার করে, যেতে হবে। বানডি এই বিপদ সঙ্কুল সঙ্গিন পথ একদিনেই, বেলা থাকতেই, পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে প্রথমে তার আজং-পাজংয়ের সাথে দেখা হয় না। তিনদিন তিনরাত ওই গ্রামে যাপনের পর সওরের সাথে দেখা হয়। সওরে গ্রামের সবার সাথে জুম জমি পরিস্কারের জন্য রওনা করে পেছনে পড়েছিল। পেছনে বানডিকে দেখে সওরে বারবার পেছনে তাকিয়ে দেখছিল, ভাবছিল, এই যুবক দেখতে কেমন জানি! এই এলাকার না। কাছে এলে বলে, তোমাকে তো আগে কখনো দেখিনি। তুমি কোন এলাকার? নাম কি? মা-বাবার নাম কি? এসব জিজ্ঞেস করে। উত্তর দিয়ে বানডি বলে, আমি এখানে আজং রাওয়াকমা ও পাজং কাওয়াকপার খোঁজে এসেছিলাম কিন্তু গ্রামের যুবকেরা আমাকে আজং-পাজংয়ের সাথে দেখা করতে দেয়নি।)
এদিকে দ্রকপা যখন পেছনে তাকিয়েছিল বানডি দ্রকপার উদ্দেশ্যে বলে দিয়েছিল, তোমাকে সাতদিন সাতরাত অপেক্ষা করতে হবে না, তার আগেই আমি পৌঁছে যাব। পরদিনই বানডি তার দুই সহোদর ছোট ভাই থেংকি ও বালওয়াকে নিয়ে দ্রকপার আস্তানার কাছে গিয়ে হুংকার দেয়, ‘কা গয়রা, সূর্য মেঘের দেবতা, আমি বীর বানডি, আমি কার সাথে যুদ্ধ করিনি, কাকে হত্যা করিনি, গতকাল বিকেলে বলে দিয়েছি, দ্রকপা তোমাকে সাতদিন সাতরাত অপেক্ষা করতে হবে না চাল্লাং!’
হুংকার শুনে সবচেয়ে শক্তিশালী যে বাঘ সাংগ্রা দ্রকপার স্ত্রী দ্রকমার কাছে যায়। শুনে দ্রকমা বলে, কেন যে এই বীরদের মেয়েকে তুলে এনেছে? বারবার বলেছি, ফিরিয়ে দিয়ে আসতে। কিন্তু বিরাট দম্ভ, সিংহের মতো শক্তি দেখায়।
সাংগ্রা বলে, ভয় নেই, আমি একদল শক্তিশালী চৌকস বাঘেদের পাঠিয়ে দিয়েছি।
আক্রমণ করতে আসা সব বাঘকেই থেংকি বালওয়া নিমিষেই হত্যা করে। এই দেখে শক্তিশালী বাঘ সাংগ্রা অগণিত বাঘ নিয়ে আক্রমণে আসে। থেংকি বালওয়া অন্য বাঘগুলোকে আর বানডি সাংগ্রার মোকাবেলা করে। বানডি এক কোপেই সাংগ্রার ধর আলাদা করে। ওদিকে থেংকি বালওয়া নিজেরা লাফ দিয়ে, বাঘেদের সামনে হাজির হয়ে, বাঘেদের আক্রমণ করে। দুই ভাই মিলে অসংখ্য বাঘ মেরে আহত করে। এই দেখে অন্য বাঘগুলো পালাতে থাকে।
বানডি দ্রকপার সামনে হাজির হলে দ্রকপা বলে, তোমার স্ত্রী সওরেকে আমি খাওয়ার জন্য নিয়ে আসিনি। আমাদের সোনা-রোপা হিরে-মুক্তো দেখে রাখার জন্য এনেছি। তবে সওরেকে আমি এমনি এমনি ছেড়ে দেব না। আগে আমাদের দু’জনের শক্তি পরীক্ষা হোক। শক্তিতে জিতলে তবে নিয়ে যাও। আর যদি হারো তবে তুমিও মরবে, তোমার স্ত্রী সওরেও মরবে। শুনে বানডির রাগ হয়। মাটিতে মিল্লাম ফেলে, দ্রকপার কান দু’টি ধরে, ধাক্কা দিয়ে, দু’টি পাহাড় পার করে নিয়ে যায়। দ্রকপা বড় পাথরে পা ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। বানডি দ্রকপাকে আর নড়াতে পারে না। এবার দ্রকপা বানডির হাত দু’টো ধরে, সব শক্তি প্রয়োগ করে বানডিকে ধাক্কা দেয়। কিন্তু সে এক কদমও বানডিকে পেছনে নিতে পারে না। বানডি দ্রকপার কান দু’টো আরো জোরে ধরে দ্রকপাকে মাটিতে আছাড় দিয়ে জোরে লাথি মারে। দ্রকপা দূরে চিত হয়ে পড়ে। সে আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। এভাবে বানডি শক্তিতে দ্রকপাকে পরাজিত করে সওরেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। আর এদিকে গারোদের এই পুরাণ কথা-কাহিনী নিয়েই গান রচিত হয়ে গেল।
সওরে নমিল মেথ্রাকদে
দ্রকপা মাৎচা বাললাংআনা।
চামে থাংকো বাললাং’আ নাসা
মাৎগ্রিক বানডি চাং’আনা।
মাৎগ্রিক বানডি দ্রকপাকোদে
নাচিলকো রিমমে সিকগানা।
আব্রি দামবংআ সিকরো’রো আংওসা
দ্রকপা রংথিও গা’চানানা।
দ্রকপা মাৎচা বানডিকোদে
জা’গামসান থিলেৎনা মানজানা।
মাৎগ্রিক বানডি দ্রকপাকোদে
নাচিলকো রিমমে গসথাপানা।
দানাং! মাৎচা দ্রকপাদে
গাংগি’লে গাংপি’লে দংআনা।
মাৎগ্রিক বানডি চামে থাংকো
রিম’মে সাল’লে রাবানা।
[সওরে নমিল মেথ্রাকদে : তর্পণ ঘাগ্রা]
গারো রাংনি নকপান্থিকো
চেংও মানে আগে, প্রতিটা গারো গ্রামেই গ্রামের যুবকদের জন্য আলাদা ঘর ছিল। এই ঘরকে গারোরা বলতো ‘নকপান্থি’। সাধারণত গ্রামের মাঝখানে এই ঘর নির্মাণ করা হতো। বেওয়াল বা রীতি অনুযায়ী গারোদের কাছে এটি কোন সাধারণ বা যেনতেন ঘর ছিল না। এই ঘরে যুবতি ও মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ ছিল। বস্তুত এই ঘর বর্তমানের পাঠশালার সাথে তুলনীয় ছিল। এখানে যুবকেরা সামাজিক রীতি-নীতি, হাতের কাজ, ঘর বানানো, বাদ্য-বাজনা, রণকৌশলে নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তুলতো। গারো যুবকদের এই নকপান্থি নিয়েও চমৎকার শব্দ গাঁথুনিতে গান তৈরি হলো, লিরিক তৈরি হলো, তৈরি হলো গীতিকাব্য।
গারো রাংনি নকপান্থিকো
সং জাংচিওসা রিকগানা।
মি’আ বিসা গানদু গানবাও
নকপান্থিও দংনা নাংআনা।
পান্থি রাংনি দংগিপা নকদে
রামরামারি নক অংজানা।
সংনি মেথ্রা মিচিক রাংদে
নকপান্থিও নাপনা মানজানা।
গারো রাংনি নকপান্থিদে
পড়াইগিবা স্কুল গিদানা।
নক রিগনা ওয়াথনা চিথনা
স্নিং নাসা নাং’আনা।
দামা দাদি দকগা কদে
দকপা জলনা নাং’আনা।
মিল্লাম স্পি রিম’আকবা
স্নিং পানা নাংজলজলানা।
[গারোরাংনি নকপান্থিকো: তর্পণ ঘাগ্রা]
গারো মান্দে সিজকনদে
মৃত্যু কি? মানুষ তখনো এ বিষয়ে জানতো না। পশু-পাখি, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ—কোনকিছুই তখনো মৃত্যুবরণ করেনি। এমন কি স্বর্গের দেবতাদের কাছেও মৃত্যু অজানিত ছিল। তখনো স্বর্গ-মর্তে মৃত্যু ছিল না, মৃত্যু জ্ঞান ছিল না। সব জীবের মাঝেই বন্ধুভাব ছিল। স্বর্গের দেবতারা মর্তের সাংসারেক গারোদের কাছে বেড়াতে আসতো, থাকতো, খাওয়া-দাওয়া করতো, আলাপ-আলোচনা করতো, আনন্দ-ফূর্তি করতো। সাংসারেক গারোরাও স্বর্গে, দেবতাদের কাছে চলে যেত, অবস্থান করতো। স্বর্গ-মর্তের মাঝে তখন কোন ভেদ ছিল না।
ঠিক সেরকমই একসময়ে একদিন দেবতা সুসুমি’মা আই’মা খেয়াল করে দেখলেন সবকিছুই বেড়ে যাচ্ছে। এই বেড়ে যাওয়া নিয়ে তিনি গভীর চিন্তায় পড়লেন, ভাবলেন, উপলব্ধি করলেন, এভাবে বেড়ে গেলে একসময় কোনকিছুরই ভারসাম্য থাকবে না। ভারসাম্য রাখতে তিনি করণীয় উপায় নিয়ে চিন্তা করলেন। ঠিক করলেন সবকিছুরই একদিন মৃত্যু হতে হবে। কিন্তু কিভাবে এই মৃত্যু আসবে, কিভাবে শুরু হবে? ঠিক করলেন, মৃত্যু কি, কিভাবে আসে, এই বিষয়টা সবাইকে জানাতে হবে এবং জানাতে হলে, সবার আগে নিজেকেই মৃত্যুবরণ করে দেখাতে হবে। হঠা্ৎই একদিন তিনি মরে দেখালেন। মৃত্যুর পর তার দেহ নিথর নিষ্প্রাণ হয়ে গেল, প্রাণ আত্মা হয়ে অদৃশ্য, নিঃসঙ্গ, একাকী হয়ে গেল। পরপারে এই নিঃসঙ্গ একাকী আত্মার যাতে বন্ধু-বান্ধব হয়, থাকে, এ জন্য স্বর্গের দেবতারা ও মর্তের সাংসারেক গারোরা মিলে, আলোচনা করে, ঠিক করলো পরপারে তার আত্মার বন্ধু হয়ে ষাঁড় গরুর আত্মারা সাথে যাবে। এ উদ্দেশ্যে শবদেহ সৎকারের আগে তখন এক পাল ষাঁড় গরু হত্যা করা হলো।
সে থেকে গারোরাও বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর তাদের দেহ অসাড় হয়ে গেলেও প্রাণ ‘আত্মা’ বা ‘মিমাং’ হয়ে ‘মিমাং আসং’ বা ‘আত্মার দেশ’ ‘মাংরু মাংরামে’ চলে যায়। এই আত্মা কখনো মরে না। মৃত্যুর পর আত্মা যাতে নিঃসঙ্গ না হয় এ-উদ্দেশ্যে ষাঁড় গরু মারার রীতিও গারোরা সে থেকে মানে। তাদের বিশ্বাস মৃত্যুর পর আত্মা ‘মাংরু মাংরাম আসং’-এ ষাঁড় গরুর আত্মার সাথে একসাথে বন্ধুর মতো চলে যায়। সেখানে গিয়ে তারা বন্ধু হয়ে থাকে। আর মাংরু মাংরামে স্বাগতম জানানোর জন্য যে আত্মারা আগেই সেখানে গিয়ে রয়েছে, অবস্থান করছে, তারা দামা দাদি বাজিয়ে নবাগত আত্মাকে আগাতে এগিয়ে আসে, আর আদুরু বাংশি বাজিয়ে পথ দেখাতে দেখাতে নিয়ে চলে। গারোদের এই পুরাণ কথা কাহিনী ও বিশ্বাস নিয়েও রচিত হলো গান, রচিত হলো লিরিক।
গারো মান্দে সিজকনদে
জাংগি মিমাং পিললানা।
মাংরু মাংরাম আ’সংচিসা
সংদং আ’চানা রি’য়ানা।
সিগিপানি জাংগিনাদে
মাৎচু কসা দেননানা।
মান্দি মাৎচু জাংগি আপসান
বাজুগিদা রি’য়ানা
দামা দাদি দকগিসা
মিমাং রাংবা রিবানা।
আ’দুরু বাংশি সিগগেসা
মান্দি জাংগিকো রি’মমানা।
মি বিজাকো চিননেসা
মিমাং রাংনা অননোদে
উকো চা’আই রিং’এসা
মিমাং রাংবা রি’পেলানা।
[গারো মান্দে সিজকনদে: তর্পণ ঘাগ্রা]
এভাবে অসংখ্য গান গীতিকবিতা নিয়ে বাতচিত তোলা যায়। যে গানগুলো, কথাগুলো গারোদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পুরাণ, বিশ্বাসকে স্বতন্ত্র ও স্বকীয় সৌন্দর্যে মেলে ধরে। একটি জাতিসত্তার ভেতরের সমস্ততাকে, আকড়কে উদ্ভাসিত ও ভাস্বর করে। নিখিলের কাছে হাজির করে। আর যিনি এই সৃষ্টিতে মেতে অবলোকনের নয়া চোখ ও ম্যাজিক তৈরি করে চলেছেন, গারো গান গীতিকবিতাকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন, অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন, এখানে তাঁকে নিয়ে তাঁর স্তুতি করে কি হবে, ভবিষ্যৎতের দিকেই তিনি হাঁটছেন। ভবিতব্যই নির্ণেয়। তবে ‘গ্রেট’ এই বিস্ময়ে তিনি অপার।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন