অনলাইনে বইয়ের বাজার কোন পথে?

অ+ অ-

 

একটা সময় ছিল, যখন একটি কবিতা বা গল্প বা প্রবন্ধ প্রকাশ করতে সাহিত্য সম্পাদকের দ্বারে দ্বারে ঘুরতেন লেখকেরা। সে সময় লেখা ছাপানো নিয়ে নানা গল্প চালু আছে বাজারে। অস্বীকার করার উপায় নেই, লেখকের লেখার ক্ষমতা প্রকাশ বা বিকাশের একমাত্র মাধ্যমই ছিল ছাপা পত্রিকা। ব্যক্তি বা সংগঠনের উদ্যোগে নানা ধরনের ছোট কাগজও প্রকাশিত হতো। পত্রিকা থেকেই ধীরে ধীরে লেখকের নাম পরিচিত হয়ে উঠত পাঠকের কাছে। এমনকি বই ছাড়া বিখ্যাত লেখকদেরও একমাত্র প্রকাশমাধ্যম ছিল পত্রিকা।

বর্তমান সময়ে এসে বদলে গেল সবকিছু। ছাপা পত্রিকার জায়গা দখল করল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইন পত্রিকা। মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই হয়ে উঠল কারও সাহিত্যকর্ম প্রকাশের বিকল্প মাধ্যম। নিজের একটি লেখা প্রকাশের জন্য সম্পাদকের দুয়ার তো দূরের কথা, জানালায়ও উঁকি দিতে হয় না আর। যার যা খুশি, নিজের প্রোফাইলে প্রকাশ করলেই হলো। অনলাইন পত্রিকাও বেড়ে গেল বিপুল পরিমাণে। বরং সে অনুযায়ী ভালো লেখক পাওয়াই হয়ে উঠল দুষ্কর।

এমনকি এই সময়ে এসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিজেই একধরনের মাফিয়া হয়ে উঠল বলা যায়। তারা কোনো কারণে রিচ কমিয়ে দিলে লেখকদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাটিও লেখক আগে নিজের ওয়ালে শেয়ার করেন এখন। কেউ কেউ তো লিংক শেয়ার করার পাশাপাশি নিজের লেখাটিও সরাসরি কপিপেস্ট করেন ওয়ালে। সব কেমন পাল্টে গেল।

কিন্তু এই পাল্টে যাওয়ার ইতিবাচক একমাত্র ব্যাপার হলো সাহিত্য সম্পাদকদের ক্ষমতা অনেকাংশে লোপ পাওয়া। বিপরীতে যেটা হলো, নিজের ওয়ালে প্রকাশিত প্রায় সব লেখাই উপস্থাপিত হতে লাগল প্রায় অসম্পাদিত অবস্থায়। ভালো লেখক হতে হলে যেমন অনেক পড়াশোনা করতে হয়, ভালো পাঠক হতে হলেও পড়াশোনা করতে হয়। যেহেতু আমরা পড়াশোনায় খুব আগ্রহী নয়, ফলে একটি বাজে লেখা আর ভালো লেখার পার্থক্য কেউ ধরতে পারি না। যে লেখাটিকে আমরা বাহ্‌বা দিয়ে ফাটিয়ে ফেলি, আদতে সে লেখাটিতে থাকে নানান খুঁত। যেহেতু কোনো সম্পাদনার মধ্য দিয়ে যেতে হয় না, ফলে কোনো দিনই উত্তরণ ঘটে না সেই খুঁতগুলোর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিরিয়ানি ভেবে আমরা যা খাচ্ছি বা আমাদের খাওয়ানো হচ্ছে, তা আদতে সাধারণ চালের ভাতও নয়, নষ্ট ভাত। তবু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে অনেক লেখক জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। পরবর্তীকালে তাঁদের বই পেয়ে যাচ্ছে বেস্ট সেলার তকমা।

স্বাভাবিকভাবেই সাহিত্যের মতো বইয়ের প্রচারণাবিপণন হয়ে উঠছে অনলাইনকেন্দ্রিক। একদিকে বইয়ের দোকান বন্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে বই বিক্রির অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্মগুলো শুধু বই বিক্রির দায়িত্বই নিচ্ছে না, ক্ষেত্রবিশেষে অনেকের কাছে তারাই হয়ে উঠছে বিপণনের একমাত্র মাধ্যম। প্রচারণার মাধ্যম তো বটেই। তবে অনলাইন বইয়ের মার্কেট দিনদিন বড় হয়ে উঠলেও যেটি আরও বড় হতে হবে, সেটি হলো ভোক্তার পরিমাণ। ভালো ভোক্তার পরিমাণ।

বইয়ের পাঠকদের নিয়ে একটি বড় অভিযোগ হলো, নতুন প্রজন্ম বই পড়ে না। অভিযোগটা অনেকাংশে সত্য। তাহলে বই পড়ছেন কারা? অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ব্যক্তিরা। সমস্যা হলো, বয়স্ক ব্যক্তিরা আবার সেভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম নন। হাতে হাতে মোবাইল থাকলেও আমরা কজন এর প্রতিটা ফিচার ঠিকভাবে ব্যবহার করি, বা করতে পারি? ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব ব্যবহার এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুএকটি পত্রিকা পড়া ছাড়া অন্য সাইটও নিয়মিত ব্রাউজ করেন কম সংখ্যক মানুষই। ফলে দেখা যায়, অনলাইনে একটি পণ্য অনেকেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কিনতে পারেন না। ধাপগুলো সহজ হলেও নানা ধাপে এসে তারা আটকে যান। তাদের অনেকে হয়তো ফোন করে অর্ডার দেন। অনেকে আর কখনো অনলাইনে বই কিনতে আসেনই না।

বইয়ের পাঠকদের নিয়ে একটি বড় অভিযোগ হলো, নতুন প্রজন্ম বই পড়ে না। অভিযোগটা অনেকাংশে সত্য। তাহলে বই পড়ছেন কারা? অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ব্যক্তিরা। সমস্যা হলো, বয়স্ক ব্যক্তিরা আবার সেভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম নন। হাতে হাতে মোবাইল থাকলেও আমরা কজন এর প্রতিটা ফিচার ঠিকভাবে ব্যবহার করি, বা করতে পারি?

তাহলে তাদের বই কেনার মাধ্যম হয়ে উঠবে কোনটি? আপাতত অবশ্যই বইয়ের দোকান। কিন্তু বইয়ের দোকান তো কমছে দিনদিন। রাজধানীতে যে দোকানগুলো আছে, জ্যাম-ট্যাম ঠেলে সেগুলোতে আসা মানে একটি দিন নষ্ট করা। তবু হয়তো তারা আসেন, অন্তত ছুটির দিনগুলোতে। কিন্তু একটি বইয়ের দোকানে আর কতগুলো বই রাখা যেতে পারে? মানুষের পাঠের রুচি হয়ে উঠছে বৈচিত্র্যময়। এই বৈচিত্র্য একমাত্র ধারণ করতে পারে অনলাইন মাধ্যমগুলোই। কিন্তু বই বিক্রির অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর নানা সীমাবদ্ধতা আছে। সব মিলিয়ে এই সেক্টরটির চিত্র শাঁখের করাতের মতো হয়ে উঠছে অনেক সময়।

একদিকে অনলাইনে কেনাকাটায় অভ্যাস নেই, অন্যদিকে সীমিত অভ্যস্ত অংশটির মধ্যেই আছে নানান সমস্যা। যেমন অনেক ক্রেতা আছেন, একটি বই অর্ডার করে তিন দিন চার দিন ফোন ধরেন না। তত দিনে হয়তো তার অর্ডারকৃত বই ফেরত চলে এসেছে, তখন ক্রেতা বলেন বই পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন না যে বইটা পাঠাতে একটি বড় অর্থ খরচ হয়ে যায়। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বুঝতে চানও না তারা। ক্ষেত্রবিশেষে একটি বই পাঠাতে হয়তো প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ক্ষতিই হয়। তবু, ভবিষ্যতের স্বার্থে সেই ক্ষতিও তারা বহন করেন।

অনেক সময় দেখা যায় কিছু ফেক আইডি খুলে বই অর্ডার করা হয়। পরে অর্ডারের বইগুলো পাঠিয়ে দেখা যায় ওই নম্বর থেকে কেউ ফোন রিসিভ করছে না। যেহেতু একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সব বই কিনে রাখা সম্ভব হয় না, ফলে অর্ডারের পর অনেক বই প্রকাশনীগুলো থেকে কিনে আনা হয়। দিনের পর দিন বইগুলো পড়ে থাকে। আর বিক্রি হয় না। ওদিকে ডেলিভারির টাকা কুরিয়ার কোম্পানি ঠিকই কেটে রাখে।

ভালো ক্রেতার অভাব ছাড়া অনলাইন বইয়ের বাজারে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বই সঠিকভাবে পাঠকের হাতে পৌঁছানো অর্থাৎ ডেলিভারি। মূলত এই ক্ষেত্রটির জন্য একটি বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান এখনো তৃতীয় পক্ষের ওপরে নির্ভর করে থাকে। ওই পক্ষটিই অর্থাৎ কুরিয়ার কোম্পানি বইগুলো পৌঁছে দেয় পাঠকের হাতে। অনেক সময় দেখা যায়, তাদের গাফেলতি বা সীমাবদ্ধতার কারণে বইগুলো সময়মতো পৌঁছায় না। এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ অর্ডারই বাতিল হয়ে যায়। অনেকে অর্ডার বাতিল না করলেও অনলাইন প্রতিষ্ঠানটির প্রতি অসন্তুষ্ট হন, যদিও প্রতিষ্ঠানটির আসলে কোনো দায়ই হয়তো থাকে না। কিন্তু ক্রেতা তো এটা বুঝতে নারাজ।

এ ছাড়াও কুরিয়ার কোম্পানিগুলো বইকে অন্য পণ্যের মতো দেখে বলে দেখা যায় অনেক সময় পাঠকের কাছে যেতে যেতে বইটি নষ্ট হয়ে গেছে। সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত বইও কিন্তু পাঠক নিতে চান না, যেহেতু তিনি বইয়ের জন্য টাকা দেবেন। ফলে তারা অর্ডারটি ফেরত পাঠিয়ে দেন। তখন নতুন করে বই পাঠাতে হয় তাদের কাছে।

একটি ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয়, বাংলাদেশে ইকমার্সে সবচেয়ে উত্থানের সময়টা আশ্চর্যজনকভাবে মহামারিকাল। করোনা মহামারির ঠিক শুরুর দিকে বড় একটা ধাক্কা খেয়েছিল সবাই। কিন্তু দুচার মাস পরই ইকমার্স সাইটগুলোর ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে। ওই সময়টিতে প্রায় নিয়মিতভাবেই অনলাইন কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে শুরু করে মানুষ। তবে এর পরপর অভিশাপ হিসেবে অবতীর্ণ হয় অনেকগুলো ইকমার্স সাইটের স্ক্যামে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা। একের পর এক ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে থাকে। ফলে ভরসা হারাতে শুরু করেন ক্রেতারা।

আসলে অনলাইন ব্যবসায় আপাতদৃষ্টিতে একজন ক্রেতা যেটি দেখতে পান, সেটি হলো একটি ওয়েবসাইট। কিন্তু এই ওয়েবসাইটের পেছনে কতজনকে যে শ্রম দিতে হয়, তার ইয়ত্তা নেই। একটি আইটি টিম লাগে। বইয়ের অর্ডার রিসিভ, সেটি সংগ্রহ, কুরিয়ারকে বুঝিয়ে দেওয়া, নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, ক্রেতার সমস্যার সমাধান করা, বিভিন্ন ক্যাম্পেইন পরিচালনা, মার্কেটিংসব মিলিয়ে বড় একটি টিম চালাতে হয়। বিশাল খরচের ব্যাপার। প্রকাশকেরা যে দামে বইটি বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেন, সেখান থেকে ক্রেতার কাছে বিক্রির পর লাভ সামান্যই থাকে। এত সব ধাক্কা কাটিয়েও এই সামান্য লাভ এবং বইয়ের প্রতি ভালোবাসার কারণেই বলা যায় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে টিকে থাকার।

অনলাইনে বইয়ের আরেকটি বিকল্প হয়ে উঠছে ইবুক। এই ক্ষেত্রটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, মাঝখানে কোনো তৃতীয় পক্ষ নেই। সরাসরি বিক্রেতার কাছ থেকে ক্রেতা কেনেন। কিন্তু আমাদের প্রকাশকদের বেশির ভাগেরই একধরনের প্রযুক্তিভীতি রয়ে গেছে। ফলে প্রায় ৬৭ বছর আগেই ইবুকের কার্যক্রম শুরু হলেও সেটি এখনো সফলতার মুখ দেখেছে বলে দাবি করা যায় না।

অনলাইনে বইয়ের আরেকটি বিকল্প হয়ে উঠছে ইবুক। এই ক্ষেত্রটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, মাঝখানে কোনো তৃতীয় পক্ষ নেই। সরাসরি বিক্রেতার কাছ থেকে ক্রেতা কেনেন। কিন্তু আমাদের প্রকাশকদের বেশির ভাগেরই একধরনের প্রযুক্তিভীতি রয়ে গেছে। ফলে প্রায় ৬৭ বছর আগেই ইবুকের কার্যক্রম শুরু হলেও সেটি এখনো সফলতার মুখ দেখেছে বলে দাবি করা যায় না। প্রকাশকেরা ভাবেন যে বইটা ইবুক করা হলে সহজেই কপি করা যাবে। আবার প্রিন্ট বইয়ের ব্যবসাতেও এর প্রভাব পড়বে। কিন্তু এগুলো একদম ভুল ধারণা। পাওলো কোয়েলহোর একটি ঘটনা পড়েছিলাম কোথাও। প্রকাশের পর তার আলকেমিস্ট বইটি নাকি খুব বিক্রি হচ্ছিল না।লেখক তখন নিজ উদ্যোগে সেটির পিডিএফ ছেড়ে দেন। আশ্চর্যজনকভাবে বই বিক্রি কমেনি মোটেই। বরং বেড়ে যায় হু হু করে।

এই ঘটনার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে আমি জানি না। সত্যি না হলেও বলা যায়, একটি বইয়ের পাঠক বাড়ে পাঠক থেকে। পাঠক যত গুণগান করবেন, বই তত বিক্রি হয়। যেকোনো প্রকাশকের প্রথম উদ্দেশ্য হওয়া দরকার একটি বইকে যত বেশি সম্ভব পাঠকের কাছে পৌঁছানো। তাদের পড়ানো।

আগেই বলেছি, একরকম যুদ্ধ করে এগিয়ে যাচ্ছে ইকমার্স সাইটগুলো। বিশেষ করে বইয়ের প্ল্যাটফর্মগুলোকে নানা চড়াইউতরাই পার হতে হচ্ছে। প্রথমত বইকে আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে দেখি না। বই এখনো বিলাসি পণ্য। ফলে প্রবল মূল্যস্ফীতিতে প্রথম খাঁড়ার ঘা বইয়ের ওপরেই পড়ে।

আপাতদৃষ্টে ছোট মনে হলেও একটি প্রসঙ্গ উপস্থাপন করা প্রয়োজন। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ কেউ ফেসবুকে একটি পেজ খুলে এক-দুজন মিলে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেন। এসব ক্ষেত্রে বিশেষ করে বইয়ের ব্যবসায় দেখা যায়, যেহেতু একজন ব্যবসা করেন, তাই হয়তো এক-দু টাকা লাভ করে তারা বই ব্যবসা করছেন। ক্রেতাও কম দাম দিয়ে ওখান থেকেই কিনছেন। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা যায়, ওই ব্যবসায়ী ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। অনেকে আবার নীলক্ষেত থেকে পাইরেটেড বই সংগ্রহ করে ক্রেতাকে পাঠিয়ে দেন। অনেক ক্রেতা বিষয়টি ধরতেই পারেন না। অনেকে হয়তো একবার ঠকার পর আর আসেন না ওই পেজে। তখন আবার অন্য পেজে যান। আবার ঠকেন। এভাবে বইয়ের মার্কেট নষ্ট হয়।

তবু এতকিছুর পরও আমরা দিনদিন আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠছি অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপরেবিক্রি, বিপণন বা প্রচারণায়। এই নির্ভরশীলতা আরও বাড়বে। যদিও বই বিক্রির অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর মালিকদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত আড্ডায় আমাকে বলেছেন যে তাদের কাজ বইয়ের প্রচারণা নয়। তারা প্রচারণায় ওভাবে আগ্রহীও নন। কিন্তু যেহেতু প্রচারণার জন্য আলাদা কোনো সেক্টর নেই, তাই বাধ্য হয়ে অংশ নিচ্ছেন প্রচারণার কাজে।

অন্যদিকে প্রকাশনা সংস্থাগুলোও দেখছে, একটি বই বিপণন বা প্রচারণায় অনলাইন মাধ্যমগুলোর ওপরে নির্ভর করলে খরচ তুলনামূলক কমে যায়, আবার বইয়ের দোকানগুলোও ঠিকভাবে প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ করে না, বরং অনলাইন মাধ্যমগুলোর লেনদেন খুব ভালো, ফলে তাদের সমস্ত পরিকল্পনা হয়ে উঠতে থাকে অনলাইননির্ভর। একটি বইয়ের প্রডাকশনের পেছনে তারা যতটা পরিশ্রম করেন, বিপণনপ্রচারণার ক্ষেত্রে তার একটি ভাগও করেন না।

কিন্তু একটি ইন্ডাস্ট্রি তো কখনো কোনো একমাত্র মাধ্যমের ওপরে নির্ভর করে টিকে থাকতে পারে না। তার ওপরে যদি সে মাধ্যমটি হয় একদম নতুন, আনকোরা এবং অনেক ক্ষেত্রে অপেশাদার। ফলে শুধু অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরও পেশাদার হওয়া এবং প্রকাশকদের ব্যবসায়িক বুদ্ধি ও সদিচ্ছাই নয়, ক্রেতাদেরও সচেতন হতে হবে এই সমস্যা সমাধানে। আর এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে।

আমার জানামতে বিশাল এই ক্ষেত্রটির জন্য কোনো সঠিক নীতিমালা নেই। নীতিমালা যা আছে, তাতে শুধু ব্যবসায়ীদের পক্ষকেই টার্গেট করা হয়েছে। অন্য পক্ষের জন্যও যে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তারা, তা নিয়ে কোনো নীতিমালাই নেই। এটা করা খুবই জরুরি।

ডিজিটাল কমার্স পরিচালনাবিষয়ক একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়েছে ২০২১ সালের ৪ জুলাই। এই নীতিমালাটি পড়লে ধারণা হবে যে এ ব্যাপারে কোনো বিশেষজ্ঞ বা অভিজ্ঞ কারও সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি, কিংবা হলেও তাদের মতামতকে আমলে নেওয়া হয়নি। অনেক নির্দেশিকা একরকম জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার এতে শুধু ব্যবসায়ীদের পক্ষকেই টার্গেট করা হয়েছে। অন্য পক্ষ অর্থাৎ ক্রেতার জন্যও যে ব্যবসায়ীরা নানাভাবে বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন, তা নিয়ে নীতিমালায় কোনো নির্দেশিকা নেই।

তা ছাড়া বইয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই প্রিঅর্ডার [আগাম অর্ডার] নেওয়া হয়। অনেক বই নতুন সংস্করণে পরিবর্তিত হয়। দাম পরিবর্তিত হয়। যেহেতু বাংলাদেশে বইয়ের বাজার সীমিত, হঠাৎ কোনো বইয়ের চাহিদা বেড়ে গেলে হুট করে বইটি স্টক আউট হয়ে যেতে পারে। সব মিলিয়ে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে বইকে একভাবে দেখলে সেটিও নানা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, করবে।

মূলত জরুরি এই সেক্টরটির প্রতি সরকারের সহযোগিতার হাত বাড়ানো। একটি সঠিক সহযোগিতামূলক নীতিমালা তৈরির পাশাপাশি বই নিয়ে আরও অনেক প্রচারের প্রয়োজন। সরকারসমর্থক লেখকদের বই নানা প্রজেক্টে নানা মাধ্যমে কিনলেও দেখা যায়, বেশির ভাগ ভালো বইই রয়ে যায় উপেক্ষিত। তবু হয়তো কিছু বই বিক্রি হয় এসব প্রজেক্টের কল্যাণে। কিন্তু দেখা যায়, সেই প্রজেক্টেও মাথার ওপরে বসে আছেন সরকার সমর্থক ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠান। আর এমন হলে ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুদ্ধ করে যেতে হয় দিনের পর দিন।

অনলাইনে বই বা লেখকের জন্য নেই কোনো আর্কাইভ। এটিও খুব জরুরি। ব্যক্তিগতভাবে কারও পক্ষে এগুলো নিখুঁতভাবে করা প্রায় অসম্ভব। একমাত্র সরকারই চাইলে পারে এসব উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে। তাহলেই দেখা যাবে, বইনির্ভর আরও অনেক স্টার্ট আপ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। 

এমনকি ইবুক নিয়েও সরকারি কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি এখনো। জাতীয় আর্কাইভ ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তরের মাধ্যমে এটা করা খুব সহজ হবে। তারা এটা ভেবে দেখতে পারে। প্রতিটি বইয়েরই যদি ইবুক থাকে, তাহলে গবেষক বা আগ্রহী পাঠকেরা ভীষণ উপকৃত হবেন। উপকৃত হবেন প্রকাশকেরাও। মূলত পাঠক ও লেখক বাড়লেই তাদের ব্যবসা বাড়বে।