প্রেমিক রাজার সমাধিতে

অ+ অ-

 

বাদাম চিবুতে চিবুতে আমি প্রশ্ন ছুঁড়লাম, বিলেতের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তো ছিলেন সিংহাসনের দৌড়ে বেশ পেছনে, তাই না? সহপাঠী এমি সোনালি কেশঝাড়ে আঙুল চালিয়ে কথা বলল রয়ে সয়ে, ব্রিটিশ রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড ডিভোর্সি নারী ওয়ালিস সিম্পসনের জন্য সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হলে এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জ রাজা হলেন। সেই ১৯৩৬ সালের ঘটনা। এতে ভাগ্য খুলে গেলো রাজকুমারি এলিজাবেথের। প্রেমিকার জন্য রাজা এডওয়ার্ডের যে ত্যাগ এরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। কিছুটা অভিমান হয়ত প্রেমিক প্রবরের ছিল। তবে অসম প্রণয় আর সিংহাসনত্যাগ নিয়ে রাজপরিবারের সাথেও সম্পর্কের যে চিড় ধরেছিল তা আর কখনই জোড়া লাগেনি। রাজকুমারি এলিজাবেথের বিয়েতে এডওয়ার্ড দাওয়াত না পেয়ে বেশ মুষড়ে পড়েছিলেন। রানি এলিজাবেথের অভিষেকেও সাবেক রাজা দাওয়াত পাননি। ওই  সময় নাকি সাবেক রাজা এডওয়ার্ড মন্তব্য করেছিলেন, উত্তরপ্রজন্মের রানির অভিষেকে একজন ভূতপূর্ব রাজার হাজির থাকার নজির নেই আর ব্রিটিশ রাজতন্ত্র তো চলে প্রথা-নজির- আনুষ্ঠানিকতার ধারায়! আমি মন্তব্য করলাম, তবে পৃথিবীর তাবৎ আশিকদের কাছে তিনি নমস্যহৃদয়ের রাজা। তাদের হৃদয়ের অলিন্দে-নিলয়ে তাঁর জন্য ভালোবাসার রোজ দাওয়াত। কে পারে সূর্য অস্ত না যাওয়া রাজ্যের সোনার সিংহাসন-রাজমুকুট অবলীলায় পায়ে দলে সাধারণ এক নারীর কাছে ফিরে  যেতে। এমির কণ্ঠ ধরে এলো যখন সে বলল, ঠিক তাই, রাজতখত ছাড়ার আগে বিদায়ী রাজা যে সংক্ষিপ্ত অভিভাষণ দেন তা চিরায়ত ভালোবাসার আপ্তবাক্যই—‘যে নারীকে আমি ভালোবাসি তার সমর্থন আর সহায়তা বিনে রাজা হিসেবে এই গুরুদায়িত্ব পালন করা আমার পক্ষে একবারেই অসম্ভব

এই কাহিনি শুনে আমি আপ্লুত হয়ে গেলাম। এমি হেঁয়ালি করে বলল, চলো, সুযোগমতো এক সাধকপুরুষের সমাধি দেখে আসি, দেখা যাবে তোমার কোনো উন্নতি হয় কী না। বলা বাহুল্য, পূর্বদেশীয় প্রেমিকদের নিষ্ঠা নিয়ে সফেদ তরুণীর বেশ অবিশ্বাস। 

বাদাম চিবুতে চিবুতে আমি প্রশ্ন ছুঁড়লাম, বিলেতের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তো ছিলেন সিংহাসনের দৌড়ে বেশ পেছনে, তাই না? সহপাঠী এমি সোনালি কেশঝাড়ে আঙুল চালিয়ে কথা বলল রয়ে সয়ে, ব্রিটিশ রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড ডিভোর্সি নারী ওয়ালিস সিম্পসনের জন্য সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হলে এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জ রাজা হলেন। সেই ১৯৩৬ সালের ঘটনা।

সিংহাসনত্যাগী রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড ও ফুলের সাজি হাতে লেডি ওয়ালিস সিম্পসন

এক ছুটির দিনে বাস থেকে নেমেই হচকচিয়ে গেলাম। হ্যাঁ, এটি তো রাজকীয় উইন্ডসর এলাকা। চিনতে একটুও অসুবিধে হয় না। বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে সারবন্দি দীঘল গাছ। সবুজ মখমলে বাহারি ফুলেল নকশা। অদূরে নীলাভ পাহাড়ের ঢেউ। অবতল মাঠে ভেড়ার দল খুদে খুদে পায়ে হেঁটে বেড়ায় আনমনে। ঘোড়াশালে দেখা যায় যূথবদ্ধ ঘোড়ার পাল। হঠাৎ বিক্ষুব্দ হ্রেষাধ্বনি শুনি। একটু থমকে গিয়ে আবার হাঁটি। দুয়েকটা বাসিপাতা ইতস্তত শুয়ে আছে মাটির বুকে। এদিকে এর আগে একবার এসেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিষেক উপলক্ষে। দ্বিতীয়বার এসেছিলাম রবি ঠাকুরের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। মনে পড়ে, ঐ অভিজাত সাহিত্যসভায় হাজির হয়ে নিজেকে  হংস মাঝে বক যেথা মনে হয়েছিল। উঁচু মার্গের সাহিত্যসভায় আমাকে নির্বাচিত করতে কুইনমেরি ইউনিভার্সিটি সম্ভবত কিছুটা অনিচ্ছুকই ছিল। ইন্টারভিউতে কিছুটা চাতু্র্যের আশ্রয় নিয়ে বলেছিলাম, আমি রবি ঠাকুরের প্রতিনিধিত্বশীল প্রায় সকল রচনা পড়েছি আর প্রতিশ্রুতিশীল ফিকশন রাইটার! শর্টলিস্টেড অন্যান্য প্রার্থীর মাঝে আমিই একমাত্র বাঙালি। সেজন্যই হয়ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শেষমেষ রাহাখরচ দিয়ে আমাকে সেখানে পাঠিয়েছিল। সাহিত্যসভার তারকা আলোচক অক্সফোর্ডের প্রথিতযশা অধ্যাপক সুসাহিত্যিক কেতকি কুশারী ডাইসনের সাথে হালকা চালে তর্কযুদ্ধও করেছি। তিনি আলোচনার এক পর্যায়ে বলেছিলেন, রবিবাবুর লেখায় মানবিকতা আর প্রেমের কথা যেভাবে পরিস্ফুট হয়েছে, সেভাবে দ্রোহ কিছুটা অনুপস্থিত। আমি এর বিরুদ্ধে জোরগলায় আপত্তি জানিয়ে বলেছি, আমাদের সকল আন্দোলন-সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা সরাসরি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এখন এই বয়সে বুঝি, মিজ ডাইসনের মতো মহীরুহের সাথে বাহাস করতে শুধু হেকমত বা হিম্মত নয়, মাঝে মাঝে আহাম্মকিও লাগে!

কিন্তু কোথায় সহপাঠী এমির কথিত সাধু-সন্তের আশ্রম? একজন সাধকের সমাধি দেখবার প্রলোভনে পড়ে তার সহযাত্রী হয়ে লাল দ্বিতল বাসে চেপে এখানে এসেছি। চারপাশে  ভালো করে তাকালাম, প্রাণময় বৃক্ষশোভিত বিজন এলাকা। এদিকে একটা নাইটিংগেল দূরে থাক, কোথাও একটা পায়রার বকবকানিও নেই। সতীর্থ আমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে, তাই হয়ত কিছুটা লুকোচুরি। সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশ করতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, বেঢপ টুপিপরা ও টকটকে ইউনিফর্মধারী কুইন্স গার্ডের সদস্যরা নিশ্চল দাঁড়িয়ে। আর সন্দেহ রইল না। হ্যাঁ, এটি একদম খাস রাজকীয় এলাকা। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টির গুঁড়ো পরম মমতায় মিহি ঘাসের বুকে ভালোবাসার অর্ঘ্য ঢেলে দিয়েছে। চারদিকে বর্ণাঢ্য ফুলের কেয়ারি। এমি ঈশান কোণে তর্জনী নির্দেশ করে বলল, ঐতো সেন্ট জর্জেস চ্যাপেল, এখানেই রাজকীয় মানুষদের শেষকৃত্য হয়। প্রাগৈতিহাসিক গির্জাটির সূচালো মাথা যেন ঊর্ধ্বমুখি হয়ে দিগন্ত ছোঁবে। আমি সেদিকে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে বললাম, রাজরাজড়ার ইতিহাস তো মূলত ভোগের ইতিবৃত্ত, এখানে আবার ত্যাগী মানুষ কোথায় পাব? কোথায় তোমার পুরোহিতের  মাকাম? সাদা তন্বী ঠোঁটের হাশিয়ায় হেঁয়ালি এঁকে লঘুপদে হাঁটে। ঝলমলে রোদ তেরছা হয়ে তার কপোলে-ওষ্ঠে সোনার ছোঁয়া দিয়ে আবার সন্তর্পণে পালিয়ে যায়।

পাথুরে পথ মাড়িয়ে আমরা এখন পাশাপাশি হাঁটি। ঘাসফুলের বন্যা এড়িয়ে একটা কালছে গাছের পাশে একটা কিছু দৌড়ে গেল? চিনতে পারলামএটি দুষ্ট কাঠবিড়ালি, এখন আমাদের পায়ে পায়ে ঘোরে। আমি আঁতকে উঠে বললাম, এদের উৎপাতে আমাদের গাঁয়ে কোনো নারকেল ঝুনা হবার জো ছিল না। তাই সুযোগ খুঁজতাম কখন এদেরকে বাগে পাওয়া যায়। এমি জিভ কেটে বলল, প্রাণীর প্রতি  নিষ্ঠুরতা দণ্ডনীয় অপরাধ আর  নিরীহ পশুপাখির প্রতি মমতা প্রদর্শন ব্রিটিশদের সংস্কৃতির অঙ্গ। আমিও সহপাঠীর একদম কাছ ঘেঁষে বললাম, আমি বেশ নিরীহ মানুষ, আমার প্রতিও দয়া কর। ব্রিটিশ তন্বী সটকে গিয়ে লাজুক ঠোঁটে হাসে। নিঃশঙ্ক কাঠবিড়ালিদের আনন্দমুখর চিঁহি চিঁহি ডাক শুনি। সব ছাপিয়ে সারিবদ্ধ গাছের শোঁশোঁ ভেসে আসে ঢেউয়ের মতন। বেশ মনখারাপ করা বিষণ্ণ সেই সুর। ঠিক যেন শোকার্ত মায়ের হাহাকারমাখা কান্না। এমি জানিয়ে দিল, ঐগুলো উইলো গাছ। এই নির্জন জনপদে এসে আজ বুঝলাম, এই ঝালরযুক্ত গাছগুলোকে কেন উইপিং উইলো বলে। উইলো গাছটির গা ছুঁয়ে বললাম, এই কাঠের ক্রিকেট ব্যাটের কথা শুনেছি, এর কাতরতা বা ধর্মগ্রন্থ সংশ্লিষ্টতার বয়ান আগে কখনও শুনিনি। এমি প্রশ্ন করল, তুমি কি ক্রিকেট খেল? আমি বললাম, আমি এখন খেলতে নয়, বরং খেলাতে বেশি পছন্দ করি। সহপাঠী হেসে বিশুদ্ধ ককনি মাখরাজে বলল, সো হিউমরাস। একটা ছোট্ট পাখি কেঁদে কেঁদে আমাদের গল্পে ছেদ টেনে আবার পাখা ঝাপটে হাওয়ায় উড়ে। ব্রিটিশ নারী ভ্রূ কুচকে দ্রুতলয়ে পথ চলতে শুরু করে।  ব্যতিক্রমী ছন্দে আগুয়ান সহপাঠিনীর দেখাদেখি আমি হাঁটি এবার মেঠোপথে। শোভন তৃণদল, ভূপাতিত পাতা বা বাসি পাপড়ি আমাদের জুতোর নীচে পড়ে মিইয়ে মিইয়ে যায়। বিলেতি সুরভির অচেনা রেশ পাই। একটু থেমে একটা তেড়াবেড়া গাছে হেলান দিয়ে শ্বেতাঙ্গী ললনা ঠোঁটের ফাঁকে কোক ঢেলে দেয়। আমিও তৃষ্ণার্ত বোধ করি। সহপাঠীর লিপস্টিক রাঙা আধ-খাওয়া ক্যানে চুমুক দিয়ে এবার ক্লান্তি দূর করি।

উইন্ডসর ক্যাসেল

ঝোপের ওপাশে মানুষের ছায়ার মতো কিছু দেখি। লতাপাতার ফাঁকে লক্ষ করলাম, কিশোরী কন্যাসহ এক তরুণ দম্পতি অপলক তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। খাঁটি ব্রিটিশ ভব্যতা অনুযায়ী তারা এগিয়ে এসে মুচকি হেসে মাথা ঈষৎ ঝুঁকে সম্ভাষণ জানাল। আমরাও তাদের হাসির প্রত্যুত্তর উপহার দিলাম নিঃশব্দ হেসে। তাদের দেখানো পথে আমরা ধীরলয়ে হাজির হই একটা কবরের পাশে। শ্বেতপাথরের গায়ে বৃহৎ ক্রসচিহ্ন, এর নীচে খোদাই করে লেখারাজা অষ্টম এডওয়ার্ড! আমার শিরদাঁড়ায় শিহরণ খেলে যায়। এমিকে জিলিয়ন কৃতজ্ঞতা জানালাম। জিলিয়ন শব্দটা কিছুদিন আগে জেনেছি এই ব্রিটিশ তরুণীর কাছে। এর মান বিলিয়নের চেয়েও বড়। আপ্লুত আমাকে এমি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, প্রাণময় তৃণের মাঝে শয্যা পেতেছে আরেকটি শ্বেতকবর। হ্যাঁ, রাজার কবরের বাঁয়ে দুখিনী রাজবধূ ওয়ালিসের কবর। কিশোরীর গালের মতো সমাধিদুটির মসৃণ পিঠ। খুব একটা দর্শনার্থী চোখে পড়লো না এদিকটায়। আমি হেসে বললাম, যা হোক, মরণে হলেও ওয়ালিস বিলেতের শ্বশুরবাড়িতে একটু স্থান পেলেন! এমি ম্লান হাসি হেসে বলল, আসলেই এই মহিলার প্রতি এডওয়ার্ডের ভালোবাসা সবকিছু কাঁপিয়ে দিয়েছিল, সবরাজসিংহাসন, পার্লামেন্ট, কেবিনেট, এমনকি গির্জা পর্যন্ত। উগ্র সনাতনপন্থীরা এডওয়ার্ডকে নিন্দিত মনে করলেও তামাম দুনিয়ার আশেকানের কাছে তিনি নন্দিত; হৃদয়ের রাজা, প্রেমের পুরোহিত।

বলে রাখি, রয়্যাল প্রিমোজিনেচার আইন অনুযায়ী, ইংল্যান্ডের রাজার অবর্তমানে জ্যেষ্ঠ সন্তান সিংহাসনের মালিক। এলিজাবেথের জ্যেষ্ঠ পিতৃব্য অষ্টম এডওয়ার্ড এক সাধারণ নারীর জন্য সিংহাসন ছাড়লে তার পিতা ষষ্ঠ জর্জ হঠাৎ করেই এডওয়ার্ড রাজা হয়ে গেলেন। সেই নারী ছিলেন দুই বারের তালাকপ্রাপ্তা। মার্কিন নাগরিক ওয়ালিস সিম্পসন এর আগে এক স্বামীকে তালাক দিয়েছেন আর সে সময় দ্বিতীয় স্বামীকে দেয়া তালাকের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন। একে বিয়ে করা রাজার জন্য প্রথাসিদ্ধ ছিল না। সাংবিধানিক রীতির লঙ্ঘন ছাড়াও রাজা গির্জার প্রধান বলে নীতিবাগীশ যাজকরা বললেন, এই বিয়ে একেবারেই নীতিসিদ্ধ নয়। বিশেষত হবু রানীর দুই স্বামী যে আটলান্টিকের দুই পাড়ে জীবিত। কেবিনেটের সদস্যরা ঘোর আপত্তি জানালেন। ব্রিটিশ ডোমিনিয়নের রাজনীতিকগণ ছি ছি করলেন। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী প্রেমিক রাজাকে সাফ জানিয়ে দিলেন, হয় রাজ সিংহাসন, নয় ওই পাতকীকে বিয়ে। ক্লান্ত রাজা এবার বিকল্প প্রস্তাব রাখলেন, ওয়ালিসকে তিনি বিয়ে করবেন, তবে তাকে রানীর জন্য নির্ধারিত খেতাব না দিলেও চলবে। প্রধানমন্ত্রী রাজী না হলে এডওয়ার্ড নতুন প্রস্তাব করলেন, রাজার প্রস্তাবিত বিয়ে নিয়ে গণভোটের আয়োজন করতে, জনরায় তিনি নতমস্তকে মেনে নেবেন। প্রধানমন্ত্রী এসব প্রস্তাব গ্রাহ্যই করলেন না। দুপক্ষই অনড়; কোনো সুরাহা হলো না। কিন্তু মা কুইন মেরি বড় ছেলে  এডওয়ার্ডের ভালোবাসার পথে অগম্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়ালেন। তাই রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড এগার মাস রাজত্ব করে রাজ-মসনদ ছেড়ে বিশুদ্ধ সাধারণ মানুষ হয়ে গেলেন।

এমি ম্লান হাসি হেসে বলল, আসলেই এই মহিলার প্রতি এডওয়ার্ডের ভালোবাসা সবকিছু কাঁপিয়ে দিয়েছিল, সবরাজসিংহাসন, পার্লামেন্ট, কেবিনেট, এমনকি গির্জা পর্যন্ত। উগ্র সনাতনপন্থীরা এডওয়ার্ডকে নিন্দিত মনে করলেও তামাম দুনিয়ার আশেকানের কাছে তিনি নন্দিত; হৃদয়ের রাজা, প্রেমের পুরোহিত

আমি স্বগতোক্তি করলাম, না, সাধারণ হতে গিয়ে রাজা আসলে অসাধারণই হয়ে গেলেন। কে পারে এভাবে ক্ষমতা ছাড়তে? এমি সায় দিলো, তুমি ঠিক বলেছ। এরপর এডওয়ার্ড আর প্রেমিকা ওয়ালিস মিলে সিভিল ম্যারেজ করেন। তারা ফ্রান্সে নির্বাসিত জীবনযাপন করতেন। রাজপরিবারের হাজার বছরের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র সাবেক রাজা যিনি রাজকোষাগার থেকে নিয়মিত পেনশন পেতেন। তবে কখনও ইংল্যান্ডে আসতেন না। শুধু একবার রাজমাতা কুইন মেরির ও পরে আরেকবার ছোটভাই রাজা ষষ্ঠ জর্জের শেষকৃত্যে হাজির হয়েছিলেন। অবশ্য এরপরেও এডওয়ার্ড লন্ডনে এসেছেনচিরতরে কফিনবন্দি লাশ হয়ে।

এমি জানালো, কেন যেন বিবাহিত নারীদের প্রতি এডওয়ার্ডের এক দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল। ওয়ালিস ছাড়াও এর আগে থেলমা নামের বিবাহিতা তাঁর রক্ষিতা ছিল। এর আগে নৌবাহিনীতে কমিশন নিয়ে পিতার ইচ্ছেয় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলেন। কয়েক বছর অক্সফোর্ডে থাকলেও প্রিন্সকে বইখাতা কাছে টানে নি, বরং এসময়টায় তিনি তরুণীমহলে প্লেবয় হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। কিন্তু অক্সফোর্ডের ডিগ্রি অর্জিত হয়নি। ব্রিটিশ যুবরাজের অকৃতকার্য হওয়া থেকে এই অক্সফোর্ডের উঁচু মান ও নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়ন সম্পর্কে আঁচ করা যায়। আমার আরেক প্রশ্নে এমি বলল, আনুষ্ঠানিক অভিষেক আয়োজনের সুযোগ করে উঠতে পারেননি বলে এই রাজা কখনও বিশেষ রাজমুকুট বা কোহিনুর পরেননি। তবুও তিনি আসলে ভালোবাসার মুকুটহীন রাজা।

রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড ও লেডি ওয়ালিস সিম্পসন চিরনিদ্রায় পাশাপাশি শুয়ে আছেন উইন্ডসরে © ছবি: লেখক

আবার তাকালামকী শাদামাটা গোর! কোন রাজ-আড়ম্বর নেই, আশেপাশে কোন সান্ত্রী নেই, কোন ধুপ-লোবানের ধোঁয়া নেই, এমনকি একটা ফুলের স্তবক পর্যন্ত নেই। ঝিরঝিরে হাওয়া বয়। সবুজ পাতারা গোরের দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে চামরের দোলা দেয়। অদূরে কাঁঠালচাপার মতো দেখতে বড়সড় হলদেটে ফুল ফুটে রয়েছে। এমনিতে ব্রিটিশ ফুল নির্গন্ধই। এদিকটায় কেমন যেন বনজ গন্ধ টের পাই। বাতাসে ভেসে এসে কয়েকটা মেপল পাতা কবরের গায়ে থামল। সবুজ ফরাসে জেগে থাকা পাথুরে গোরে মুকুটরূপ-মেপলপাতা ভালোবাসার ছোঁয়া দেয়। সূর্যের আলো এসে ঠিকরে পড়ে আদিগন্ত সবুজ প্রান্তরেশীতল কবরে। এমি ঝুঁকে মনে মনে প্রার্থনা করল।

এমি এখন রোদচশমা পরে  গর্বের সাথে বলল, এডওয়ার্ড যখন ব্রিটিশ তখত ছেড়ে দেন, সে-সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এতো বড় ছিল যে সেখানে একসাথে সূর্য অস্ত যেত না, কোথাও না কোথাও সূর্য আকাশে থাকতই। আমি এবার টিপ্পনী কাটলাম ভারতীয় লেখক-বাগ্মীপুরুষ শশী থারুরের বরাতে। তিনি অক্সফোর্ডের বিতর্কসভায় ব্যঙ্গ করে বলেছেন, স্বয়ং ঈশ্বরও হয়ত অন্ধকারে ঔপনিবেশিক শাসকদেরকে বিশ্বাস করতেন না!  এমি হেঁয়ালি করে, আমাকে নির্ভর করতে পার, আমি কিন্তু ওল্ড ভিক্টোরিয়ান ব্রিটিশ নই, আমার কাছে শোষণ নিষিদ্ধ। আমি রবি ঠাকুরের দ্বারস্ত হয়ে মনে মনে আউড়াই, রমণীর মন, সহস্রবর্ষেরই, সখা, সাধনার ধন। ইস, কেন যে এসব সোনালি শস্যের অনুবাদ হয় নি। আবার বললাম, তুমি শোষণ ছাড়তে পার, কিন্তু শাসনের কী হবে? এমি খিলখিল করে হাসে: তোমরা প্রাচ্যদেশীয়রা কাব্য কর ঠিকই, কিন্তু ব্রিটিশ প্রেমিকের মতো এরূপ ত্যাগ কি করতে পার? আবার চোখে কটাক্ষ হেনে গর্বিত ভঙ্গিতে যোগ করল, দেখো, তোমাদের প্রেমিককূল শিরোমনি গোপাল মাত্র কয়েকশ একরের জমিদারির লোভে রাধার মতো প্রেমিকাকে একদম ভুলেই গেলেন; আর আমাদের রাজা এডওয়ার্ড এক সাধারণ নারীর জন্য কত বিশাল রাজত্ব অবলীলায় ছেড়ে দিলেন!

সত্যিই, ওই সময়টায় বিশ্বের ছাব্বিশ শতাংশ জায়গার সার্বভৌম মালিকানা ছিল রাজা এডওয়ার্ডের। ব্রিটিশ উর্বশীর কাছে বুঝি এবার হার মানার পালা। ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী কিছু যুক্তি অবশ্য পেশ করতে পারতাম, কিন্তু এরূপ প্রিয়ংবদার সাথে বাহাস করার ধাত আমার আদপেই নেই।