গুডবাই ফ্রিটাউন

অ+ অ-

 

ওয়াটার ট্যাক্সির বোট থেকে নেমে জেটির কাঠে তৈরি বেজায় দীর্ঘ ব্রীজ ধরে হাঁটি। সমুদ্রজল ছুঁয়ে ভেসে আসা নোনা-হাওয়ায় হ্যাট সামলানো কঠিন হয়। মাথা থেকে খুলে স্ট্র্যাপে তা পিঠে ঝুলিয়ে কী যেন ভেবে থেমে পড়ি। আজ আমি সিয়েরা লেওনের রাজধানী ফ্রিটাউনে পেশাগত কাজে তিন বছর কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছি যুক্তরাষ্ট্রে। আমার এক পাশ দিয়ে ক্যারিঅন ব্যাগ-বোঁচকা-ব্যাকপ্যাক নিয়ে প্যাসেঞ্জাররা দ্রুত হেঁটে যায় মাইক্রোবাসের গুমটির দিকে। আমি পিছন ফিরে তাকাই। সবুজাভ জলরাশি ছড়িয়ে চ্যানেলের ওপারে ফ্রিটাউনের বাতিঘর, পাহাড় ও বিনতুমানি হোটেলের রেখা কেমন যেন আবছা হয়ে ফুটে আছে। বাতাসের তোড়ে জলের সারফেসে ওঠে দারুণ তরঙ্গ। মনে হয়, ঊর্মির তীব্র তাড়নে দালানকোঠা, গল্ফ ক্লাব, আবারডিন পেনিনসুলার সাথে যুক্ত ব্রীজ ও সৈকত নিয়ে ফ্রিটাউন ভেসে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে।

জেটি সংলগ্ন ব্রিজটির গোড়া থেকে মাইক্রোবাস ধরে আরো খানিকটা গ্রামীন পথ উজিয়ে গিয়ে পৌঁছতে হয় লুঙ্গি নামক এয়ারপোর্টের পার্কিংলটে। জায়গার নাম হিসাবে লুঙ্গি শব্দ আমাদের কানে বেমক্কা শুনালেও সিয়েরা লেওনের মানুষজন লবজটি শ্রুতি মধুর মনে করেন। মাইক্রোবাস এখনো এসে পৌঁছেনি। জানতে পারি, তাড়াহুড়ার কিছু নেই, প্যাসেঞ্জারদের মিনিট তিরিশেক অপেক্ষা করতে বলা হয়। এ সুযোগে পোর্টারের জিম্মায় ক্যারিঅন ব্যাগটি রেখে আমি রওয়ানা হই, কাছাকাছি সৈকত সংলগ্ন একটি বয়োবৃদ্ধ বৃক্ষকে চাক্ষুষ করতে।

শিলাপাথর ফাটিয়ে জন্মানো কটন ট্রি নামের তরুবরটি আগের মতোই আছে, তবে তার কিছু পত্রালি ঋতু বদলের পয়গাম নিয়ে ছড়াচ্ছে বাদামিতে লালচে আভা। মাস আষ্টেক আগে আমি মিসেস জেনিফার ওয়ারেন এর সঙ্গে ঘুরতে এসে এ বৃক্ষকে খুঁজে বের করেছিলাম। ফ্রিটাউনে বসবাসের শেষ বছর দেড়েক আমাকে ইবোলা রিকভারি প্রোগ্রামের কোর্ডিনেটর হিসাবে রোগের প্রকোপে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত গ্রামগুলোতে ত্রাণ তথা ধান ও সব্জি-বীজ এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার মূলধন ইত্যাদি সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। ব্যক্তিগত উদ্যোগে হাজার তিরিশেক ডলারের ফান্ডস্ সংগ্রহ করে মিসেস জেনিফার ওয়ারেন ছয়টি ছোট্ট ছোট্ট গ্রামের রিকভারিতে সহায়তা করেছিলেন।

ফ্রিটাউনের লুঙ্গি এয়ারপোর্ট

তাঁর পাঠানো অর্থসম্পদ ব্যবহারের শেষ দিকে তিনি সয়ং এসেছিলেন গ্রামগুলো সরেজমিন করতে। মহিলা সস্তায় সিয়েরা লেওনে ট্র্যাভেল করার বাসনার কথা জানিয়ে আসার আগেভাগে আমাকে ইমেইল করেন। ফ্রিটাউনের হোটেলেগুলো ভাড়া বাবদে খুবই এক্সপেনসিভ, তাই তাঁকে আমাদের ভদ্রাসনের দিন কয়েক থাকার বন্দোবস্ত করে দেই। একত্রে গ্রাম পরিদর্শনে যাওয়ার সময় জানতে পারি, জেনেফারের মা-বাবা কোন এক খ্রিশ্চিয়ান মিশনের প্রতিনিধি হিসাবে পঞ্চাশের দশকে সাত বছর কাজ করেন ফ্রিটাউনে। তাদের মিশনটি ছিলো লুঙ্গি এয়ারপোর্টের লাগোয়া মদিনা নামে মুসলিম অধ্যুষিত একটি গ্রামে। এ গ্রামের একটি বাংলোতে কাটে শিশু জেনেফারের সাতটি বছর। তিনি মদিনা গ্রামটি একবার চাক্ষুষ করতে চেয়েছিলেন, তাই আমি তাঁকে নিয়ে এসেছিলাম এখানে।

গ্রামটি এখনো আছে, কিন্তু তার ঘরদুয়ার, সব্জিখেত ও মসজিদ তাবৎ কিছু এমন বদলে গেছে যেজেনেফার দৃশ্যত কিছুই শনাক্ত করতে পারেন না। যে সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তিনি খেলতেন, আমরা তাদের নাম উল্লেখ করে খোঁজখবর করি, কিন্তু কারোরই তালাশ পাওয়া যায় না। হতাশ হয়ে অবশেষে জেনেফার চলে আসেন সৈকতের পাড়ে। বয়োবৃদ্ধ কটন ট্রি নামক বিরাট তরুবরটি আগের মতো আছে, দেখতে পেয়ে যেন বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া কোন কুটমখেশের তালাশ পেয়েছেনছুটে গিয়ে এমন অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে তিনি তাকে জড়িয়ে ধরেন। ইউ মেড মাই ডে, সুলতান, বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তিনি জানান, এ কটন ট্রির শিকড়ের খোঁড়লে বাসা বেঁধে বাস করতো একটি আর্মাডিলো। পিটে স্কেলওয়ালা সরিসৃপ জাতীয় প্রাণীটি নাকি তাকে দেখতে পেলে ভয় পেতো না, কাছে এসে ছুড়ে দেয়া খাবার শুঁকতো।

অনেক বছরের ব্যবধানে বৃক্ষটির কাণ্ডে তৈরি হয়েছে ছোট্ট একটি গর্ত। জেনেফার তাঁর গলা থেকে সাদা স্কার্ফটি খুলে নিয়েতা দিয়ে জড়িয়ে গর্ত আড়াল করে বুকে ক্রুশ চিহ্ণ এঁকে প্রার্থনা করেন। আন্দাজ করি, বৃক্ষনিধনের সম্ভাবনার কথা ভেবে, বোধ করি মহিলা গাছটির আয়ু বৃদ্ধির জন্য যিশুখ্রিষ্টের কাছে প্রার্থনা করলেন। ওয়াটার ট্যাক্সির গুমটির দিকে ফেরার পথে কাণ্ড বাঁকানো আরেকটি নারিকেল গাছকেও শনাক্ত করে জেনেফার দারুণ খুশি হয়ে জানান, শিশু-বয়সে পড়ালেখার ফাঁকে সুযোগ পেলেই সৈকতে ছুটে এসে তিনি বাঁকানো গাছটিতে চড়ে তাকিয়ে থাকতেন সমুদ্রের দিকে। একই পথ ধরে ফিরতে গিয়ে আজ দেখি, নারকেল গাছটির বঙ্কিম কাণ্ডে চড়ে বসে হাওয়া খাচ্ছেন মাঝবয়সি এক নারী, পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তার মেয়ে।

নারকেল গাছটিতে চড়ে বসে মা ও মেয়ে

আমি তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ি। মা-এর নির্লিপ্ত মুখ উপেক্ষা করে বাচ্চা-মেয়েটি হাসিমুখে আমাকে ওয়েভ-ব্যাক করে। এক পা-দুপা করে সামনে বাড়তে বাড়তে মা ও মেয়ের সমুদ্রতীরের অকৃত্রিম আবহে অবসর যাপনের কথা ভাবি। আমি একটু পর হাওয়াই জাহাজ পাকড়ে ক্রিস্তফার কলোম্বাস আবিষ্কৃত যে ভুবনে যাচ্ছি, ওখানকার দিনযাপনে প্রাধান্য পায় কাজ, অবসর বিবেচিত হয় গৌণ হিসাবে। আমার প্রতিফলন দানা বাঁধার সুযোগ পায় না, জেনেফারের সাদা স্কার্ফ সংক্রান্ত একটি স্মৃতি ফিরে আসে মনে। ওয়াটার ট্যাক্সি ধরে ফ্রিটাউনে ফেরার পথে তিনি জানিয়েছিলেন, বছর দেড়েক আগে তার জেরুজালেম ভ্রমণের কথা। ফিলিস্তিনে বেথেলহামের বিখ্যাত গির্জায় ক্রিসমাচ উদযাপনের পর তিনি আশীর্ব্বাদ-ঋদ্ধ সফেদ স্ফার্ফটি সংগ্রহ করেছিলেন। তার বাসনা, এর কল্যাণে যদি বৃক্ষটি রেহাই পায় তরুবর ঘাতকের করাত থেকে। ভাবি, যাত্রাপথে এক সুযোগে জেনেফারকে এক ছত্র ইমেইল করে জানিয়ে দেবো, মন্ত্রপুত স্কার্ফটি খোয়া যায়নি, তা আবহাওয়া বিধৌত হয়ে এখনো জড়িয়ে আছে বৃক্ষটির বিক্ষত কাণ্ড।

মাইক্রোবাসটি এসে পড়েছে, তবে ফিরে যেতে আরেকটু দেরি হবে। আমি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে কম্পিউটার ব্যাগ থেকে বের করি ডায়েরি। স্কার্ফ জড়ানো বৃক্ষটির লকেশন সংক্রান্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে করতে ভাবি, আজ থেকে বছর কয়েক পর আমি যখন দৈহিকভাবে থাকবো না, তখন হয়তো আমার কন্যা বা অন্য কোন উত্তর-পুরুষ সিয়েরা লেওনে বেড়াতে এসে স্রেফ কৌতূহলবশত তালাশ করবে  কটন ট্রি নামে এই তরুটির, হয়তো মহান এ মহিরুহ তখন অব্দি বেঁচেবর্তে থাকবে।

অবশেষে মাইক্রোবাস এসে পড়ে। তাতে চড়ে পাথর ছড়ানো লাল মাটির মেঠোপথ ধরে মিনিট বিশেকে এসে পৌঁছি লুঙ্গি বিমান ঘাঁটিতেযার পোষাকি নাম ফ্রিটাউন ইন্টারন্যাশনেল এয়ারপোর্ট। জোড়া বন্ধনির মতো দেখতে আধুনিক কেতার ছোট্টমোট্ট বিমান বন্দরটির পার্কিংলটে লোকজন নেই একেবারে, শুধু একটি মালটানা ট্রলি অলসভঙ্গিতে আগ বাড়ছে। ইবোলা ছড়ানোর প্রথম বছরে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য বাতিল হয়ে গিয়েছিলো, এবং যেহেতু সিয়েরা লেওনে ডমেস্টিক এয়ার ট্রাভেল বলে কিছু নেই, তাই বিমান বন্দরটিকে দেখাতো মড়কে উজাড় হওয়া গ্রামের মতো বিরাণ। তারপর মারাত্মক এ রোগের প্রাদুর্ভাব খানিক নিয়ন্ত্রিত হলে পর ডাক্তার, মেডিকেল সাপ্লাই ও এইড ওয়ার্কারদের নিয়ে দু-চারটি ফ্লাইট আসতে শুরু করে। তখন এ পার্কিংলট থেকে ডিপার্চার লাউঞ্জ অব্দি বসে ছিলো পুলিশ ও হেল্থ ওয়ার্কারের সমন্বয়ে গঠিত অনেকগুলো চেক পয়েন্ট। যাত্রীদের কোন চেক পয়েন্টে থেমেতাদের শরীরে গেল মাস দুয়েকে কী কী সমস্যা হয়েছেতার বিবরণ দিয়ে ফিলাপ করতে হতো একাধিক ফর্ম। তারপর অন্য চেকপয়েন্টে থার্মমিটার দিয়ে নেয়া হতো তাদের দেহের তাপমাত্রা। কারো গায়ে জ্বরজারি থাকলে, তাকে পুলিশ প্রহারায় পাঠিয়ে দেয়া হতো ইবোলা হোল্ডিং সেন্টারে। তবে শরীর জ্বরমুক্ত হলে তাদের পরবর্তী চেক পয়েন্টে হেল্থ ওয়ার্কারের তত্ত্বাবধানে ক্লোরিন মিশ্রিত জলে হাত ধুতে হতো। এয়ারপোর্টের প্রাঙ্গনকে আজ অনেক পয়-পরিষ্কার দেখায়। কোথাও কোন চেকপয়েন্ট নেই দেখেশরীর সয়ংক্রিয়ভাবে রিলাক্স হয়ে আসে।

লুঙ্গি টাউনের ফলমূলে সাজানো দোকানপাট

আমি পাশ্চাত্যের যে দূতাবাসের সঙ্গে কর্মসূত্রে যুক্ত আছি, ওখানকার দুজন এক্সপিডাইটার এসে আমাকে গুড আফটারনুন বলেন। এ দুই কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ আমার পরিচিত। এরা ব্যবহারে অমায়িক, এদের কাজ হচ্ছে ভ্রমণরত ডিপ্লোম্যাটদের কাস্টমস্ ও ইমিগ্রেশনে সহায়তা করা। অনেক বছর আগে যখন সিয়েরা লেওনে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী হয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশী সৈনিকরা, তখন এরা তাদের সঙ্গে গাইড কাম ইন্টারপ্রেটার হিসাবে কাজ করেন। এ সুবাদে এরা শিখে নিয়েছিলেন সুপ্রভাত, আপনি কেমন আছেন প্রভৃতি ছুটখাট্ কিছু বাংলা শব্দ ও বাক্য। মঝেমধ্যে এরা পরিষ্কার বাংলায় ধন্যবাদ বলে আমাকে চমকে দেন! এক্সপিডাইটারদের একজন আমার ক্যারিঅন ব্যাগটি তার দায়িত্বে নিয়ে জানান, বসম্যান, ফ্লাইট হ্যাজ ডিলেইড ফর টু আওয়ার্স। এতে আমি অবাক হই না। তবে হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিতভাবে হাতে এসে যাওয়া সময়ের সুযোগ নেই। আমি কোকাকোলা পানের জন্য তাদের হাতে যৎসামান্য টিপস্ ধরিয়ে দিয়ে লুঙ্গি টাউনটি আরেক দফা দেখার উদ্যোগ নেই।

লুঙ্গি নামে বিমানবন্দর সংলগ্ন জনপদটিকে টাউন বলা হলে হলেও আদতে তা একটি বাজারের মতো। আমি তাজা ফলমূলে সাজানো দোকানপাঠের সামনের সড়ক দিয়ে হাঁটি। বেলা পড়ে আসছে, তাই সব্জি, আনাজ ও মাছের বাজার জমে উঠছে। আফ্রিকান গ্রামীন হাট-বাজারে এক ধরনের সরগরম ব্যাপার আছে, আমি হেঁটে যেতে যেতে পিটে শিশুবাঁধা মাঝবয়সী মহিলা, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা আওয়ারা বালক প্রমূখের দিকে তাকিয়ে কেনাবেঁচায় কর্মচঞ্চল পরিসরটির একটি হদিস করি। আর কেন জানি মনে হয়, পশ্চিম আফ্রিকার এ অঞ্চলে আর হয়তো আসা হবে না।

বাজার পেরিয়ে আমি ঢুকে পড়ি লাগোয়া পল্লীতে। প্রকল্পসূত্রে পরিচিত দাউদা ও আব্দুল-রুলকে খুঁজে পেতে কোন সমস্যা হয় না। তিমনি গোত্রের কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ দুজন গাছতলায় বসে তাদের বানানো মূর্তি ও মুখোশে ফিনিশিং টাচ দিচ্ছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে তারা বসার জন্য পিঁড়ি পেতে দেন। দাউদা ও আব্দুল-রুল মাস কয়েক আগে বিবাহিত হয়েছেন। দাওয়াত পেয়েও আসতে পারিনি, তাই দুঃখ প্রকাশ করে তাদের সংসার সম্পর্কে খোঁজখবর নেই।

ঝিরিঝিরি জলে ধওয়া-পাকলা

আজ থেকে বোধ করি বছর আড়াই আগে আমি প্রথম এ পল্লীতে এসেছিলাম। ইবোলার প্রকোপের খুব বাড়াবাড়ি যাচ্ছিলো। আমি বিমান ঘাঁটিতে এসেছিলাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত সিডিসি বা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের একজন বিশেষজ্ঞকে পিকআপ করতে। সড়ক পথে ফ্রিটাউনে যাওয়ার আগে বিশেষজ্ঞ মহোদয় বাজারটি দেখতে চেয়েছিলেন। তো পায়ে হেঁটে সওদাপাতির বিকিকিনি দেখতে দেখতে আমরা এসে পড়েছিলাম এ পল্লীটির প্রান্তিকে। সাইরেনের তীব্র আওয়াজে আমাদের অন্তরাত্মা চমকে দিয়ে কাছাকাছি এসে থেমেছিলো একটি এম্বুলেন্স। বীজাণু প্রতিরোধক হলুদ হেজমত স্যুট পরা স্ব্যাস্থকর্মীরা রোগাক্রান্ত একজন মানুষকে স্ট্রেচারে করে এম্ভুলেন্সে তুলে ফের সাইরেন বাজিয়ে ছুটে গিয়েছিলো।

অতপর শর্টকাটে পল্লীর ভেতর দিয়ে এয়ারপোর্টে ফেরার পথে একটি কুটিরের আঙিনায় দুটি লাশ দেখতে পাই। বছর খানেক পর এ গ্রামে ইবোলা রিকভারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে এসে জানতে পেরেছিলাম যেএকটি লাশ ছিলো আমার সামনে এ মুহূর্তে বসে মূর্তিতে পালিশ দেয়া দাউদার বড়ভাইয়ের। অন্য লাশটি ছিলো তার চাচাত ভাই আব্দুল-রুলের স্ত্রীর। পরবর্তীতে ওই মানুষ দুজনও আক্রান্ত হয়েছিলেন ইবোলায়। তবে কপালগুণে চিকিৎসায় সেরে ওঠেন।

এরা দুজনে পেশায় কাঠমিস্ত্রী, ইবোলার প্রাদুর্ভাবের আগে মাঝেসাজে মূর্তি বা মুখোশ তৈরি করে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করতেন। ইবোলা রিকভারি ফান্ডের অনুদানে তারা ফের আগের পেশায় ফিরে গেছেন। দাউদা তার প্রয়াত ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন এবং এতিম হওয়া ভাতুষ্পুত্র দুটির লালনপালনের ভার নিয়েছেন। আব্দুল-রুলের স্ত্রী রেখে গেছেন ছোট্ট একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান। একা এদের পালনপোষণ করা কঠিন হলে তিনিও বিবাহিত হন। ইবোলার দুর্বিষহ দিনে বছর দেড়েকের মতো বন্ধ থাকে স্কুল-কলেজ। তখন অনেক স্কুলছাত্রী প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ে অযাচিতভাবে। এরা সামাজিক সংস্কারের কারণে স্কুলে ফিরে যেতে পারছে না। তো আব্দুল-রুল একটি প্রেগন্যান্ট স্কুল-গার্লকে বিবাহ করে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। এ সূত্রে তার সংসারে যুক্ত হয়েছে ছয় মাসের আরেকটি শিশুকন্যা। পিতার পরিচয়হীন এ শিশুকে তিনি নিজের কন্যার মতো ট্রিট করছেন। বাচ্চাটির নাম আয়েশাতু, সে তার মেয়ে হিসাবে সমাজে পরিচিতি পাবে বলে তিনি আশা রাখেন।

মুখোশ নির্মাতা ইবোলা সারভাইবার

আমার হাতে সময় সীমিত, তাই হাতটাত মিলিয়ে বিদায় নিয়ে উঠে পড়ি। সড়কে ফেরার পথে মনে মনে শিশুকন্যা আয়শাতুর কথা ভাবি। সিয়েরা লেওনের রক্ষণশীল সমাজে সে কী পালক-পিতা আব্দল-রুলের পরিচয়ে দাঁড়াতে পারবে? নিশ্চিত হতে পারি না। জোর কদমে পল্লীর অন্য দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, আয়শাতু একদিন বড় হবে, হয়তো সে স্কুলে যাবে, তবে কোন দিন জানতেও পারবে না, তার ভবিষ্যত নিয়ে দূর দেশ থেকে ফ্রিটাউনে আগত একজন অচেনা মানুষ উদবিগ্ন ছিলো।

একটি প্রকল্প আমার চাক্ষুষ করা হয়নি, তাই জোর কদমে চলে আসি পল্লীর প্রান্তিকে। বালুকাময় খালের ঝিরিঝিরি জলে ধওয়া-পাকলা সেরে নিচ্ছেন গাঁয়ের কয়েক জন নারী। একটি উপাত্ত ফিরে আসে করোটিতে। এ পল্লীতে মাত্র সাত জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে ইবোলায়। এ তথ্য নথিভুক্ত হয়েছে সরকারি জাবেদা খাতায়। কিন্তু যা গুরুত্ব পায়নি, তা হলোম্যালেরিয়ায় শিশুসহ নয় জন মানুষ মারা যান ধুকে ধুকে চিকিৎসাহীন। ইবোলার তীব্র আক্রমণের কথা আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে চাউর হয়েছিলো, জোগাড় হয়েছিলো ত্রাণ সম্পর্কিত সম্পদের। কিন্তু ম্যালেরিয়ার ব্যাপারটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামানোর ফুরসত পায়নি। ইবোলা রিকভারি প্রোগ্রামের চাহিদা যাচাই করতে এসে কাদাজলে থিকি থিকে মশকের বীজাণুতে ভরপুর এ খালটি চাক্ষুষ করেছিলাম। খালের গোড়া সংস্কারের অভাবে বুঁজে গিয়েছিলো। যাক, অনুদানের কড়িতে ইরিগেশন চ্যানেলের মতো করে খালটির সংস্কার করা হয়েছে। মানুষ পরিচ্ছন্ন পানি ব্যবহার করতে পারছে দেখে ভালো লাগে। আন্দাজ করি, ধান ও সব্জিখেতে সেচের মাধ্যমে কিছু জল ব্যবহৃত হচ্ছে। ফেরার সময় মনে হয়, দূর দেশের যে সব মানুষরা দাতা সংস্থার কাছে পাঠিয়েছিলো তাদের বিশ বা পঞ্চাশ ডলারের ডানেশন, তাদের সহানুভূতি ও সহায়তার কথা এ গ্রামের মানুষরা কখনো কী অনুভব করতে পারবে?

এ এলাকাটা আমার চেনা। তাই, শর্টকাটে বিমানঘাঁটির দিকে ফিরতে কোন অসুবিধা হয় না। এসে পড়ি আরেকটি মেঠোপথে। দূর কোন গাঁয়ের মানুষজন, শিশু ও বালক-বালিকারা মাথায় সওদা নিয়ে সারি বেঁধে হেঁটে যাচ্ছে বাজারের দিকে। এ দৃশ্যপটের মাঝে এক ধরনের টাইমলেসনেস, এক ধরনের চিরায়ত ব্যাপার আছে, মনে হয়, শতাব্দী কয়েক আগে যখন এ ভূখণ্ডে পুর্তগীজ অভিযাত্রীকরা পাল তোলা জাহাজে এসে নেমেছিলো, তারাও অবলোকন করেছিলো ঠিক একই ধরনের যাত্রা-দৃশ্য। এদের দিনযাপনে পরিবর্তন এসেছে অতিসামান্য। লালচে ধুলোমাটিতে এদের পায়ে চলার রেখা ধরে হাঁটতে গিয়ে কেবলই মনে হয়, ইট ইজ টাইম ফর মি টু সে গুডবাই।

এয়ারপোর্টের পার্কিংলটে ফিরে ভাবি, পথ চলতে আবেগপ্রবণ হওয়া অস্বাভাবিক না, তবে যা পাওয়া যায় না, তা হচ্ছে ভাবালুতার ফুরসত। এক্সপিডাইটার দুজন আমাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে জানান, বসম্যান, আপনার মাল-সামান পিকাপে করে এসে পৌঁছেছে। ওজনটজন করে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। আমি তাদের সাথে কথা বলতে বলতে এয়ারলাইন্সের চেকইন কাউন্টারের দিকে হাঁটি।