শব্দের হিম, আলোর ওম

অ+ অ-

 

করম খাঁর শীতকাল পছন্দ না একদম। অবশ্য শীত ভালো লাগে না বলে যে গরমকাল, অথবা বৃষ্টিবাদলার দিন তার সবিশেষ পছন্দ, এমন নয়। তবে বছরের ঐ দিনগুলোর প্রতি তার কোন বিরক্তি কিংবা অভিযোগ নেই, যেমনটা আছে শীতের প্রতি। তার এই বিরক্তি অবশ্য নতুন আমদানি। টেনেটুনে বছর দুয়েকের।

শীতকালকে যদি সবমিলিয়ে গোদ ধরা হয়, তবে সে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হল শীতের রাতগুলো। নিশুতি, একাকী, কনকনে ঠাণ্ডা, শিশিরে ভেজা লেপকাঁথা-বিছানার চাদর, আর বিচিত্র সব শব্দমণ্ডিত। করমের ঘুমে সমস্যা। সে সমস্যা আরও প্রকাণ্ড হয়ে দেখা দেয় শীতের রাতে। কষ্টের কোন সীমা থাকে না। রাত দ্বিপ্রহর পেরুলেই বরফের মতো ঠাণ্ডা বিছানায় এপাশ-ওপাশ তরে সে। কোরান শরীফে দয়াল নবীর বর্ণনায় একটা লফজ আছেনূরুন আলা নূর। নূরের উপরে নূর। আলোয় আলোকিত সত্তা। দোজখের একাংশে নাকি শীত হবে প্রচণ্ড।  হাবিয়ান আলা হাবিয়াদোজখ নিবাসীদের অবস্থার বর্ণনায় এমন কোন লফজ কি কোরআন হাদিসে কোথাও আছে? যদি থেকে থাকে, তবে সেটা হতো শীতের রাতে খাটে শোয়া করমের অবস্থার নিখুঁততম বর্ণনা। করম সচেতনভাবে চেষ্টা করে মনে এ নিয়ে কোন অভিযোগ, অনুযোগ না পুষে রাখার। অভিযোগ থেকেই বা লাভ কি, করবেই বা কার কাছে? পোক্ত একটুকরো লোহা মাটিতে ফেলে রাখলে তাতে জং পড়ে কয়দিনে? সোঁদা মাটিতে পড়ে থাকা পাথরের গায়ে শ্যাওলা জমতেই বা সময় লাগে কতোদিন? হাড় জিরজিরে শরীরটায় চামড়ার নীচে অল্প কয়েকপ্রস্থ মাংস, বুকের খাঁচার আবডালে ধুকেপুকে হৃদপিণ্ড, আর শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর বয়স আজ গুনেগুনে দু'বছর কম চারকুড়ি। তারা যে এখনো কাজ করে, এতেই করম সন্তুষ্ট। শরীর তার ল্যাগবেগিয়ে গেছে, কণ্ঠনালী দিয়েও স্রেফ খোনাস্বর বেরোয়, তবে এখনো তার চোখের জ্যোতি অস্বাভাবিক রকমের তীক্ষ্ণ, কানের শ্রুতিও মারাত্মক রকমের সজাগ। আফসোসের ব্যাপার, বয়স্কালে তার দৃষ্টিশক্তির তীক্ষ্ণতা নিজের জন্যে তেমন উপকার বয়ে নিয়ে না আসলেও তার আশপাশের অনেকের জন্যই সমস্যা সৃষ্টি করে। বুড়োহাবড়া লোকচোখে দেখে না কানে শোনে না মনে করে যেই না আশপাশ দিয়ে কলাটা মুলাটা আস্তে করে কোঁচে গুঁজে রওনা দেবে, তক্ষুনি তা চোখে আটকায় করমের। ফলে এই বুড়ো বয়সেও কম শাপশাপান্তের মধ্য দিয়ে যেতে হয় না তার। শীতের এই রাতে অবশ্য করমের প্রধান শত্রু তার কানজোড়া। মানুষ যা দেখতে চায় নাচোখের পাতি ফেলে স্বচ্ছন্দে তা এড়িয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু সে যা শুনতে চায় নাতা এড়াবার জন্যে কানের ওপরে পাতি ফেলবার উপায় নেই।

কুচকুচে কালো মশারির মতো ঝুপ করে সাঁঝের আঁধার ঘনিয়ে আসতে না আসতেই কাজবাজ সব থামিয়ে গাঁয়ের লোকেরা ঘরের ভেতর গিয়ে সেঁধোয়। তারপর ঘণ্টাখানেক রান্নাঘরে চটচট আওয়াজে লাকড়ি পোড়া, ছ্যাঁতছ্যাঁত শব্দে সালুন-সবজি পাকানো, হাঁড়িকুঁড়ির ঠনঠন ঝনঝন আওয়াজ। এরই মধ্যে মুয়াজ্জিনের আল্লাহু আকবর! আল্লাহু আকবর! মাইক হাঁকিয়ে শীতের রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে শেষবারের মতো একবার মসজিদের দিকে ডাক। তারপর বাতি নেভানোর আগে গৃহস্থালির মৃদু খুটখাট। সবশেষে কুপি নেভানোর ফুঁ। তারপর থেকেই এই অবস্থা, করম আলী এখন যেমন আছেকামরার অর্ধেকটা জুড়ে থাকা চৌকীর মাঝে একা, গুটিসুটি পাকিয়ে। ঘরের শেষ বাতিটা নেভানোরও ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে গেছে। আঁধারও ইতোমধ্যে সয়ে গেছে চোখে।                 

গেলো দুদিন বাতাসের তোড় ছিল প্রবল, দিনে কিংবা রাতে। আবহাওয়া অফিসের পরিভাষায় এর নাম শৈত্য প্রবাহ। সংবাদে বলা হয়েছিল, গোটা সপ্তাহ জুড়েই থাকবে এ হিমেল বাতাসের স্রোত। কোন এক অজানা কারনে আজ তৃতীয় দিনের মাথায়ই বাতাস বেশ পড়ে গিয়েছে। চামড়া, মাংস ভেদ করে হাড়ে কাঁপন ধরানোর মতো অবস্থা আজ আর নেই। তবে বাতাস না থাকলে যা হওয়ার, কুয়াশা চারদিকে জাঁকিয়ে বসছে ধীরে ধীরে। সবকিছুর এক নিজস্ব শব্দ আছে। বাতাসেরও। এমনকি কুয়াশারও। করম আলীর কান এড়ায় না কিছুই। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ তো কান পাতলেই যে কারো কর্ণকুহরে ধরা দেয়। কুয়াশার শব্দ শোনা বেশ মুশকিল, এবং ধৈর্যসাপেক্ষ কাজ। মিহিন সুতোয় বোনা কাপড়ের ওপর খুব মৃদুভাবে ক্রমাগত হাত বোলালে যে আওয়াজ হয়, এমনতরো আওয়াজে কুয়াশা তার রাজ্য বিস্তার করে চলেছে চরাচর জুড়ে, এ নিষুতি রাতে। জলডিঙ্গি গ্রামে ঘুমঘোর ঘুমঘোর শব্দে কুয়াশার বিস্তারের শব্দ করমের মন্দ লাগে না। তবে টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার মতো করে, কিংবা শুকনো পাতার ওপর যে টুপটাপ শব্দে যে শিশির পড়া আরম্ভ হয়েছে, সে আওয়াজ তার কানে হাতুড়ি পেটার শব্দের মতো এসে লাগে। পাতলা ঘুম ভেঙে যায় হুট করে। তারপর আর ঘুম আসে না। তখন থেকেই সে শব্দের হিমে জর্জর।

শনশনে বাতাসের তোড়ে গাছের শাখাপ্রশাখার বাড়ি খাওয়ার আওয়াজ, পাখির বাসায় ডিমফুটে বেরুনো পক্ষীসাবকের অস্থির নড়াচড়া, হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিয়ে কর্কশ স্বরে কোন রাত জাগা পাখির ডেকে ওঠা, তাদের বাড়ির অদূরে যে বিলতার পাশ দিয়ে রাত বিরেতে হেঁটে যাওয়ার সময় নিজেকে নিজে সাহস দেয়ার জন্য পথিকের বাজানো শিস, ঘরের ভেতর ধেনো ইঁদুরের ছোটাছুটি, বাইরে চিকার মাটি খোদাই করা, ঘাসের ওপর দিয়ে সরসরিয়ে সাপের চলাচল থেকে নিয়ে পাশের ঘরে ছেলে ছেলের বৌয়ের সন্তপর্ণে শরীর থেকে কাপড় সরাবার আওয়াজনা চাইতেও করমের কানে এসে ধরা দেয়। এমনকি ঝিঁঝিঁ পোকাও যে ক্রমাগত ডাকাডাকির পর রাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে এসে একদম ঝিম মেরে যায়, এটা অনেকে না জানলেও করম জানে। তারপর, রাত তিনপহর পেরিয়ে চতুর্থ প্রহরে এলে সবকিছু ছাপিয়ে বাতাসে ভেসে আসে ফজরের আজান। মনে ঘুমাবার আকাঙ্ক্ষা, আর চোখের পাতাদের এক হতে না চাওয়া জনিত বিদ্রোহএই দুইয়ের ধ্বস্তাধস্তিতে বিস্রস্ত করম প্রায় রাতেই না পারতে উঠে বসে খাটের ওপর। তবে, ঐ যে বললাম, তার কোন অভিযোগ নেই। দিনমান চুপচাপ বসে থাকা করমের আওয়াজ নিয়েই যত কারবার।

আজ রাতের একদম গোড়া থেকেই করমের ঘুম আসছে না। সামনে পড়ে আছে রাতের প্রায় বাকি অর্ধেক। ঝিঁঝিঁপোকারা এখনো তারস্বরে ডেকে চলছে। একটু পর, রাত তিনপহরে পা রাখা মাত্রই তাদের তেজ কমতে কমতে একসময় একদম স্তিমিত হয়ে পড়বে। করম মড়ার মতো ঠায় শুয়ে আছে বরফ ঠাণ্ডা খাটে। তার নট নড়নচড়ন অবস্থার পেছনে মূল কারণ শিশিরে ভেজা বিছানা নয়, বরং বেশ কিছুদিন ধরে গড়ে তোলা করমের এক অভ্যেস। আজ প্রায় দুবছর যাবত বিছানায় শুয়ে করম পাশ ফেরে না। মশারির ভেতর ঢুকে যেভাবে শোয়, চৈতন্য থাকলে ঠিক সেভাবেই ঠায় শুয়ে থাকে বাকি রাত। খাটে এপাশ-ওপাশ ফিরে শোয়ার শব্দ করমের খুব পছন্দের এক আওয়াজ। নানারকম শব্দই করমকে তার কর্মহীন জীবনে শোনা লাগে, কিন্তু তার সবচে পছন্দের শব্দগুলো একে একে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে আজকাল।

নিজের অজান্তে খানিকটা নড়ে ওঠা মাত্রই করমের অতিপুরনো এই খাট ক্যা অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁচ করে উঠলো। আর এই এক শব্দের ধাক্কাতেই করম বুঝল, ঘুম আর আসবে না মোটেও আজ রাতে। সন্তর্পণে খাট থেকে নামার ফাঁকেও বস্তুটি বিচিত্র সব স্বরশব্দে ককিয়ে ওঠে থেকে থেকে। পুরনো, পরিচিতি আওয়াজ। খুব পছন্দের এই শব্দ আজকাল আর স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে ধরা দেয় না তার কানে।

বিলের দিকে মুখ করা তার কামরার দরজাটা খোলা মাত্রই কুয়াশা বহুদিন পরে দেখা হওয়া বন্ধুর মতো করে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। নিয়মিত মাটির লেপনে মসৃণ সিঁড়ির ওপর শিশির পড়ে তা একদম পেছল হয়ে আছে। কোনক্রমে একবার পা হড়কালে সেটাই হবে এই দুনিয়ায় করমের শেষ কৃতকর্ম। জীবনের খাতেমা নিয়ে করমের তেমন মাথাব্যাথা নেই, তাই বলে এমনভাবে পৃথিবী থেকে সে বিদায় নিতে চায় না। তাই সে সন্তঃপর্ণে পা ফেলে সিঁড়িতে। অদূরে বিলমুখী আঁকাবাঁকা পথ শুরু হবার পূর্বে যে সামান্য একটুখানিক উঠোন, তাতে দাঁড়িয়ে কান মাথা মুখ আর শরীর চাদরে জড়িয়ে নেয় সে ভালো করে।

পায়ে পায়ে বিলের দিকে যখন এগিয়ে চলে করম, ঘড়ির কাঁটা তখন রাত চারটা ছুঁই ছুঁই। ফজরের আজান দেবে যে মুয়াজ্জিন সেও বোধয় এ মুহূর্তে ঘুমের ঘোরে কোহেকাফ নগরে জাদুই সফর দিয়ে বেড়াচ্ছে। ঝিঁঝিঁর ডাক থেমে গেছে কিছুক্ষণ হল। কুয়াশার চাদরে মোড়া গোটা পৃথিবী যেন এক বিশাল তশতরি, আর তাকে হেলে ধরার ফলে আকাশের চাঁদও হেলে পড়েছে একদিকে। জ্যোৎস্নার আলো কুয়াশার সঙ্গে মিলে এমন এক অপরিচিত আলোক সন্নিবেশের জন্ম দিয়েছে, যাকে এ মর্ত্যের অভিজ্ঞতার জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এক দৃশ্যকল্প মনে হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রবল কুয়াশার চাদর ভেদ করে ভূমি স্পর্শ করবার আগে বেগ পেতে হচ্ছে চাঁদের আলোর। এই ভুতুড়ে ঘোলাটে আলোছায়া করমের বিস্তৃত ললাটে কোন কুঞ্চন সৃষ্টি করতে পারে না। এই রাস্তা দিয়েই জন্মাবধি তার আসা যাওয়া। হাঁটবার কালে তার মাটিতে চোখ পর্যন্ত ফেলা লাগে না। অভ্যস্ত পা ঠিক টেনেটুনে পৌঁছে দেয় জায়গামতো।      

তবে বেশি দূর চলে যাওয়ার আগেই সে কি মনে করে যেন পেছনে ফিরে তাকায় একবার। ফিরে তাকায় তার বাড়ির দিকে। চরাচর জুড়ে অনন্ত নৈঃশব্দ্যের সমাহার। তার বুক চীরে পাতার ওপর শিশির পড়বার টুপটাপ শব্দ। দু'হাতে সাঁতার কাটার মতো করে কুয়াশার চাদর সরালে গাছের শাখা প্রশাখাবেষ্টিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটা দৃশ্যমান হয়। বহু ঝড়ঝঞ্ঝা, খরামঙ্গার আছর পেরিয়ে এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তা টিনের চৌচালা কাঠামোয়। করমের কামরার পাশেই লাগোয়া ছোট আর একটা রুম। ওতে বাইরের কোন দরোজা নেই। জানালা আছে একটা, ভেতর থেকে বন্ধ। কিছু সময় স্থিরদৃষ্টিতে সেই জানালার দিকে তাকিয়ে থেকে কি মনে করে যেন সে আগের চে দ্রুতগতিতে হেঁটে ফিরে আসতে থাকে। ফিরে চলে তার বাড়ির দিকে।

ছোট্ট সে কামরার দরজা ভেজানো ছিল। হালকা ধাক্কা দিতেই তার একটা পাল্লা খুলে গেলো হাঁ করে। ভেতরে পা রাখতেই আগরবাতির ঘ্রাণ করমকে বরন করে নেয় আঁধারের মাঝে। খুব পরিচিত এ ঘ্রাণ, খুব পরিচিত এ কামরা। খানিক হাতড়ে দেয়ালে, সাঁঝিতে পাওয়া গেলো কেরোসিন ভেজা কুপি আর দেশলাইয়ের বাক্স। কাঁপা কাঁপা হাতে বাক্সের কর্কশ শরীরে বারুদ ঠাসা দেশলাইয়ের মাথা ঠোকা মাত্রই নীল কমলা আগুনের ক্ষীণ এক রেখা হেলেদুলে জেগে ওঠে। আগুনের সে ম্রিয়মাণ কায়া দেখলে মনে হয়, শীতের রাতের এই স্থবির শেষ প্রহরে দেশলাইয়ের কাঠি চাইছে না নতুন করে কর্মঠ হয়ে উঠতে। তার একান্ত কামনা - তার কাছে নয়, কক্ষের জমাট বাঁধা আঁধার সমর্পণ করুক ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফোটার অপেক্ষায় থাকা দিনের আলোয়। করম সবই বোঝে, তবুও কুপির সলতে পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যায় সেই ক্ষীণ অগ্নিরেখা। চিড়বিড়, ছ্যাঁতছ্যাঁত শব্দে কুপি জ্বলে উঠলে ক্রমশ রুমের আঁধার কাটে।

 একজন মানুষ কোনক্রমে পাশ ফিরে শুতে পারে এমন একটি খাটিয়া। কোন জাজিম, তক্তপোষ নেই তার উপর। একটা পাতলা মাদুর বেছানো কেবল। মাদুরের ওপর যত্নের সঙ্গে ভাঁজ করে রাখা একটা জায়নামাজ। যেন কেউ কিছুক্ষণ আগেই নামাজ পড়া শেষ করে যত্ন করে ভাঁজ করে রেখে গেছে সেটা এখানে। পানের পিকদানের কোনে এখনো শুকনো পিকের লাল দাগ। খাটিয়ার পাশে, এক কোনে ওজিফা-দোয়াকালামের বই গুছিয়ে রাখা। তার পাশেই তসবিহ। যেন কেউ ভেতর বাড়ি থেকে ওযু এস্তেঞ্জা সেরে এসে এখনি বসবে বিছানায়। হাতে তুলে নেবে অবিন্যস্ত তসবিহ। তার আগে, কামরার একপাশের আলনার ওপর ভাঁজ করে রাখা দুতিনটি লম্বা চাদরের যেকোনো একটি টেনে জড়িয়ে নেবে সারা শরীরে। তারপর, শরীরের আর চাদরের ওমে সৃষ্টি হবে যে নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ, তার আরামদায়ক প্রতিবেশে সে মশগুল হবে শেষ রাতের প্রার্থনায়। এরপর, পূবাকাশের পেট এক লম্বা সাদা দাগ চীরে দিলে আধো আলো আধো আঁধারির মাঝে সে ডেকে তুলবে ছেলের বৌদের, পানি জ্বাল দেবার জন্য। মাটির চুলোয় চাপানো হাঁড়ির পানিতে যখন বলক উঠছে, এমন সময়, ধীরেসুস্থে সে জাগিয়ে তুলবে করমকে, ফজরের নামাজের জন্য।

হঠাৎ পূবদিক থেকে ধেয়ে আসা আচমকা বাতাস বাড়ির সামনে জমে থাকা কুয়াশার পালকে ধেয়ে নিয়ে যায়। বাতাস পুনরায় স্থির হবার পর করম কুপিটা জানালার পাশে থুয়ে, গায়ের চাদর খুলে আলনার চাদরগুলো থেকে একটি টেনে নিয়ে আবারো পায়ে পায়ে নেমে আসে বাহিরে। তারপর সে হাঁটতে থাকে। গুটিগুটি কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে সে ফিরে চায় পিছে। নিশ্চিত হয় কুপিটা এখনো জ্বলছে কিনা, কুপিটাকে এখনো দেখা যাচ্ছে কিনা। তারপর এভাবে আবারো কয়েক পা সামনে এগিয়ে যাওয়া, আবারো ফিরে চাওয়া, আবারো নিশ্চিত হওয়া যে কুপির অতি ক্ষীণ আলোকরশ্মি এখনো স্পষ্ট কিনা। এই করতে করতে করম হেঁটে বিলের পাড়ে চলে আসে। দূর নক্ষত্রের মতো মিটমিটিয়ে জ্বলতে থাকা কুপির আলো করমের খর চোখে এখান থেকেও ধরা পড়ে। তার গায়ে মাথায় জড়ানো আলনা থেকে তুলে আনা চাদর। সে চাদরের গন্ধ আর ওমের চে প্রিয়, জগতে আর কিই বা আছে এখন তার? এই চাদরই এখন তার শেষ অবলম্বন, হারিয়ে যাওয়া প্রিয় ঘ্রাণ আর উষ্ণতার আলিঙ্গন লাভের। বিলের ধারে এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গিয়েছে সদরে। এই রাস্তা ধরেই সদর থেকে হাটবারে ফলফসল বিক্রি করে, বা সালিশে অংশ নিয়ে, অথবা যাত্রা-পালাগান-কবিগানের আসর ভাঙার পর, কিংবা কোন রাজনৈতিক সভাসমাবেশ শেষে রাতগহীনে কতবার, কত কতবার যে মোকাম ফিরে এসেছে বাড়ি, কড়গুনে তার হিসাব বের করা যাবে না। বিলের ধারে এসে প্রতিরাতে সে নির্ভুলভাবে দেখতে পেতো, তার বাড়ির ঐ ছোট কামরার জানালায় রাখা কুপিটি জ্বলছে টিমটিম করে, আশ্রয়-উষ্ণতা-ভরসা-ভালোবাসার পরম চিহ্ন হয়ে, শেষরাতের শুকতারার মতো। করম টের পেতো, সে একা নয়। কেউ আছে তার অপেক্ষায়। কেউ থাকে তার অপেক্ষায়। সে আলো আর জ্বলে না আজ বছর দুই হতে চলল।

বিলের পাড়ে, শিশিরভেজা ঘাসের ওপর গামছা বিছিয়ে বসে করম। এইটুকু কাজ করতেও তার বেশ সময় লাগে। খুব দ্রুত কিছু করবার মতো বয়স তার আর নেই। ঠাণ্ডায় বিলের জমাট বাঁধা বরফশীতল পানির ওপর টুপটাপ শব্দে শিশির ঝরে পড়তে থাকে। গায়েমাথায় শালের ওম আর ঘ্রাণ, পেছনে ফিরে তাকালে দূর বাতায়নে প্রজ্বলিত কুপির আলো। অতীত আর বর্তমানের সংযোগরেখা হিসেবে কাজ করে চলা সেই ক্ষীণ আলোকরশ্মির দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ মোকাম ভাবে, ভাবার চেষ্টা করেবদলায়নি কিছু। সবকিছু আগের মতোই আছে। ঠিকঠাক।

ঠিকঠাক।