নীল দংশনে

অ+ অ-

 

সকালের দিকটায় এ বাড়ির সবাই মোটামুটি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কর্তা অফিসে যান, বড় মেয়ে যায় ইউনিভার্সিটিতে। ছোট দুই ছেলে আর মেয়ে স্কুল ও কলেজে যায়। এমনি করেই গতানুগতিকভাবে এগিয়ে চলেছে এ বাড়ির মানুষগুলো। সকাল হলেই কারোরই আর তর সয় না। কার আগে কে বেরিয়ে যাবে এমনি অবস্থা।

ছোট মেয়ে রোজির ঘর থেকে গানের সুর ভেসে আসছে। মা চিৎকার করে উঠলেন, কী হলো রে? এত গান কিসের? রোজি ততক্ষণে চুপ করে গেল। মা আস্তে করে এসে রোজির ঘরে ঢুকলেন। অবাক চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখের পলক পড়ছে না। হঠাৎ করে মেয়েকে খুব অচেনা মনে হচ্ছে। সেদিনের সেই এক রত্তি মেয়েটি কেন যেন সুন্দর আর পুষ্ট হয়ে উঠেছে। রংটা আরও ফর্সা হয়েছে। জামার নিচে উদ্ধত যৌবন টের পাওয়া যাচ্ছে। ওর চোখ, চুল, মুখ সবকিছু মিলিয়েই এক পূর্ণ বয়স্কা নারী। তাকিয়ে থাকতে যেমন ভালো লাগছে, তেমনি আবার আতঙ্ক বোধ করছেন।

মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কি ভাবল রোজি, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মাকে এখন কেমন পরপর মনে হয়। সবটাতেই বাড়াবাড়ি। একটু শান্তিতে গানও গাওয়া যায় না। আজ বাবলির বাসায় ওরা বান্ধবীরা সবাই একসঙ্গে হবে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবাই এসে গেছে। সেখানে যদি যাওয়া যেত তাহলে খুব মজা হতো। কিন্তু সেখানে যাওয়া সম্ভব না। মায়ের নিষেধাজ্ঞা আছে। মা বলেছেন, মেয়ে মানুষের বেশি বাইরে ঘোরা ভালো নয়। তাহলে এখন সে কোথায় যাবে?

ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। সে ফজলু স্যারের বাসার দিকে এগিয়ে চলল। শহরের কোলাহল মুক্ত নির্জন মাঠের এক কোণায় বাড়ি। জীর্ণ-শীর্ণ শ্যাওলা পড়া ফজলু স্যারের বাসায় যাওয়াটা আদৌ উচিত কি অনুচিত, এটুকু রোজির চিন্তায় আসছিল না। রোজি আনমনে হাঁটতে লাগল। হঠাৎ মনে হলো এভাবে স্যারের বাসায় যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। আবার কি মনে করে এগিয়ে চলল। ইদানীং তার মনের মাঝে দোদুল্যমানতা বাসা বেঁধেছে। কোথাও গেলে সবাই কেমন করে তাকিয়ে থাকে। সেদিন স্কুলে যাওয়ার পথে বাসে ভিড়ের মধ্যে একটি লোক গায়ে পড়ে পিষে দিলো। আরেকটু হলে কেঁদেই ফেলতো। ইচ্ছে হচ্ছিল লোকটির গালে ঠাস করে চড় কষিয়ে দিতে। পুরুষ মানুষ হলে তার গায়ে জোর হয় বটে, কিন্তু সে জন্তু-জানোয়ার হয়ে যায় না। সেদিন ঘরে ফিরে বড় আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখছিল। দিনে দিনে শরীরের কী আশ্চর্য পরিবর্তন হচ্ছে। সমস্ত শরীরের বাঁকে বাঁকে অদ্ভুত সব পরিবর্তন। স্বপ্নেও কেমন শিহরণ জাগে। রক্তের গতি দ্রুত হয়। শরীরে জৈবিক চাহিদা সৃষ্টি হয়। সবকিছু কেমন ঘোলাটে মনে হয়। ভাবলে মাথা ঝিমঝিম করে। শরীর ভার হয়ে থাকে। শরীরের এই আলোড়ন তাকে বিহ্বলিত করে। নিত্যনতুন ভালোলাগার মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করতে থাকে রোজি। এ আবিষ্কারের কাহিনি কাউকে বলা যায় না।

এক বছরের ছোট ভাইটাও বেশ শক্তসামর্থ্য হয়ে উঠেছে। ভাইয়ের সঙ্গেও দূরত্ব দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে। ওর বন্ধুদের কথা চিন্তা করতেই মুখে এক ঝলক রক্ত চলে আসে।

আজকে আর স্যারের বাসার দিকে যেতে খারাপ লাগছে না। প্রথম যেদিন ফরিদার সঙ্গে স্যারের বাসায় গিয়েছিল সেদিনের কথা মনে পড়ল।

স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম তোমার?

রোজি।

কোন্ ইয়ারে পড়?

প্রথম।

স্যার হেসে ফেললেন। ও আচ্ছা।

রোজি হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।

স্যার ভিতরে গিয়ে একটা পিরিচে করে কয়েকটা টোস্ট বিস্কিট এনে রাখলেন। ফরিদা হাত বাড়িয়ে একটা বিস্কিট হাতে নিয়েই কচ কচিয়ে খেতে লাগল। রোজি ইতস্তত করতে লাগল। শুকনো বিস্কিট ওর কখনও ভালোও লাগে না। তবুও স্যারের বলাতে হাতে তুলে নিলো। বাসায় ফেরার পথে ফরিদা বলল, উনিই হচ্ছেন আমাদের ফিজিক্সের স্যার। তুই চিনিস না?

না।

না কিরে? ফজলু স্যারকে চেনে না এমন স্টুডেন্ট আছে না কি? তুই খুব ভালো মেয়েবলেই ফরিদা মুচকি হাসল।

একটু পরে রোজি জানতে চায়, ঐ বাড়িতে আর কে কে থাকে?

কে থাকবে আর? উনি তো বিয়েই করেননি।

তবে সঙ্গে ঐ ছেলেটি কে?

ও স্যারের ভাইয়ের ছেলে।

ও আচ্ছা।

এরপর কয়েকবারই স্যারের বাসায় যাওয়া হয়েছে। একদিন ফরিদা ছিল না। স্যার বললেন, কী ব্যাপার আজ ফরিদা এল না।

রোজি বলল, হয়তো পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত আছে।

তা তুমি তো আসতে পারো মাঝে মাঝে।

জ্বি স্যার, আপনি খুব ভালো বোঝাতে পারেন। আপনার কাছে আমার প্রায়ই আসা উচিত।

ফিজিক্সের স্যার হলেও তিনি বাংলা পড়াতেন ভালো। ভরাট কণ্ঠে আবৃত্তি করতেন। রোজির ভালোই লাগত। এরপর প্রায় প্রতিটি বন্ধের দিন রোজি স্যারের বাসায় যাওয়া শুরু করল। ফিজিক্সটা ভালো করে বোঝার জন্যই যেত রোজি। এরপর হঠাৎ করে ঘটনাটা ঘটল। যেন ঘুমের মধ্যেই অদ্ভুত শিহরণের সেই স্বপ্ন।

সেদিন ছিল সরকারি ছুটি। ফিজিক্স বইটা হাতে নিয়ে রোজি স্যারের বাসায় গেল। উদ্দেশ্য ছিল ফিজিক্সের প্রথম পর্ব ক্লাসে পড়ানো শেষ হয়েছে কিন্তু অনেকগুলো অঙ্ক তার মাথায় ঢুকছে না। তাই স্যারের স্বরণাপন্ন হতে বাসায় এসে হাজির হলো।

স্যার বিছানায় শুয়ে ছিলেন। মাথায় কাছে একটা বই। দরজা খোলাই ছিল। রোজি দরজা ফাঁক করে সামান্য উঁকি দিলো। স্যার কিভাবে যেন রোজির উপস্থিতি টের পেলেন। হাত ইশারায় কাছে ডাকলেন। মুখটা ভালো দেখা যাচ্ছে না। রোজি কাছে এগিয়ে যেতেই স্যার ইঙ্গিতে বিছানার উপর বসতে বললেন। রোজি কিছু না বুঝেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিছানায় বসল। স্যার আস্তে করে পিঠে হাত রাখলেন। রোজি চমকে উঠল! ওড়না মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। রোজির নিঃশ্বাস গলায় আঁটকে গেল। দৌড়ে পালাতে চাইল, কিন্ত পা দুটো যেন অনড় হয়ে রইল। স্যারের হাত রোজির গলা জড়িয়ে ধরল। ভয়ে রোজির অসম্ভব তৃষ্ণা পেল। এই অভিজ্ঞতা তার জীবনে এই প্রথম। এলোমেলো ভাবনা মনটাকে ওলটপালট করে দিচ্ছিল। এর কোনো অর্থ সে খুঁজে পেল না। হঠাৎ ভীষণ ভয় পেল। আত্মরক্ষার কথা মনে এল। নিঃশ্বাসের তালে তালে উদ্যত বক্ষযুগল ওঠানামা করছে। তার পালিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু সে কিছু না বুঝে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। স্যার তাকিয়ে আছেন তার বুক বরাবর। ধীরে ধীরে চোখের দৃষ্টি নিচে নামতে লাগল। দৃষ্টিটা মাথা কুটে মরছে। রোজির পা দুটো ছড়ানো। সেই পুষ্ট নরম উরুর উপর উষ্ণ হাতের স্পর্শ। এই আয়েশী হাতের স্পর্শ প্রশস্ত নিতম্ব থেকে গভীর জঙ্ঘার উপর সঞ্চলিত হলো। রোজি নিঃশব্দে তার মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করছে।

বুকের ভেতর থেকে সেই চির সাবধানবাণী ধ্বনিত হচ্ছেছিঃ! এ কোথায় চলেছিস রোজি? এ যে মৃত্যুকূপ? অস্পষ্ট অথচ কত জীবন্ত ইচ্ছা প্রস্ফুটিত শরীরে ছুটে বেড়াচ্ছে। রক্তের কোলাহল দামামা বাজিয়ে চলেছে। কী দুরন্ত, কী সাংঘাতিক ইচ্ছা ভেতরটাকে লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। হঠাৎ মায়ের সাবধানবাণী কানে বাজলতুই না মেয়ে মানুষ!

রোজি লাফিয়ে উঠে পিছু হটতে লাগল। চোরের মতো বিব্রত অসহায় কণ্ঠে বলল, আমি যাই স্যার।

স্যার বললেন, যাবে কেন? বসো। আর কিছুক্ষণ থাকো। ওর দিকে এক দৃষ্টি তাকিয়ে রইলেন তিনি।

এখন মানুষটিকে আর ভয় করছে না। ওড়নাটা নিচে পড়ে আছে। বুকের উপরের সাদা অংশটুকু স্পষ্ট হয়ে আছে।

চলে যাবে কেন? পড়া বুঝে নেবে না?

রোজি কিছুতেই সহজ হয়ে কথা বলতে পারল না। মানে ইয়ে... আপনার অসুবিধা হলে...

আমার আর কী অসুবিধা? তবে আজ আর পড়াব না। চল গল্প করি।

রোজি চুপ করে রইল। ফজলু স্যার আপন মনে কথা বলে যাচ্ছেন। জীবনের কথা। ভালোলাগার কথা। নিঃসঙ্গ লোকটির কথা শুনতে শুনতে রোজির নিজেকে বেশ বয়স্কা মনে হচ্ছিল।

বুঝলে রোজি, জীবনটা এরকমই। চাইলেই সব হয় না। জীবনকে বুঝতে না বুঝতেই জীবন শেষ হয়ে যায়। আর বোঝার চেষ্টাও নেই কারো।

দুপুরের রোদ পড়ে এল। জানালার ফাঁক গলে একচিলতে রোদ ওর মুখে এসে পড়ছে। ভীষণ একাকী ও বিষণ্ন মনে হচ্ছে তাকে। স্যার চোখ তুলে চাইলেন। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকা রোজির মুখটা দুহাতে তুলে ধরেই বড় অসহায় কণ্ঠে বললেন, তুমি আর আসবে না?

কৈশোর উত্তীর্ণ মেয়েটির বুকে ঝড় বয়ে গেল। সমস্ত মুখে রক্ত ছলকে উঠল। যেন হৃৎপিণ্ডে গভীর বাজ পড়ল। ওর মনে প্রবল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মাথার ভেতর বার বার উচ্চারিত হচ্ছেতুমি আর আসবে না? রোজি ঘাড় কাত করল। ঠোঁট দুটো বিবশ হয়ে গেছে। প্রচণ্ড জ্বরে যেমন শরীর কাঁপতে থাকে, তেমনি ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল সে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, আর আসবে না এ বাড়িতে। কোনো দিনই না।

রোজি স্বাভাবিক হয়ে ঘরে ফিরে গেল। সেদিন রাতে যখন শুয়েছিল তখন দৃশ্যটা বারবার মনে পড়ছিল। সুডৌল বুকের বৃন্ত কাঁপছিল। নব বসন্তের দ্বার উদঘাটিত হয়েছে। রুখবার সাধ্য তার ছিল না। ঘুমের মধ্যে সে টের পাচ্ছে প্রশস্ত নিতম্বদেশের উপরেই সেই বিপজ্জনক বাঁকটিতে কোন এক সুপুরুষের দৃষ্টি আঁটকা পড়ে আছে। সেই ভরাট কণ্ঠের মানুষটির অদ্ভুত আহ্বান। নিজেরই অজান্তে অসম্ভব ভালোলাগা ওকে অল্প অল্প করে গ্রাস করে নিচ্ছিল। হঠাৎ কিসের শব্দে সেই রঙিন স্বপ্ন টুটে গেল।

রোজি বেশ কিছুদিন পড়াশোনা বন্ধ রাখল। কিন্তু ও-বাড়িতে যাওয়া হতো ঠিকই। জীবনের নতুন একটি দিকের সঙ্গে পরিচিত হলো ও। নতুন কিছু পাওয়া যেমনি আনন্দের, তেমনি কষ্টেরও। বিবেকের দংশনে আগুন জ¦লত বুকের গহিনে। একদিকে অপরাধবোধ, অন্যদিকে ভালোলাগার মাদকতা। কোনোটি থেকেই রেহাই নেই। এমনি একদিন নির্জন দুপুরে রোজি নির্জন বাড়ির গেটে টোকা দিলো।

দরজা খুলে দিলেন স্যার। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। নির্জন স্তব্ধ ঘরে তিনি কথা বলতে শুরু করলেন। জীবনের নানা অভিজ্ঞতার গল্প বর্ণনা করছিলেন। রোজি যতই শুনছিল, ততই অবাক হচ্ছিল। এভাবে কতক্ষণ গড়িয়ে গেল সেদিকে দুজনের কেউই খেয়াল করল না। হঠাৎ সেদিনের সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটল। রোজি নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। প্রচণ্ড শক্তিতে আঁকড়ে ধরা পুরুষের বাহুডোরে যেন স্বেচ্ছায় আবদ্ধ করল নিজেকে। দৃপ্ত পৌরুষের অসংযমী হাত অস্থির ঘুরে বেড়াচ্ছে দেহময়। ওর সমস্ত অস্তিত্বের বিলুপ্তি ঘটেছে। বিবেকের দংশনকে ছুড়ে ফেলে দিলো ডাস্টবিনে। দুই সমান্তরাল অনুভবের এক হয়ে যাওয়া ঝড় বয়ে চলেছে। এক অভিন্ন, অনির্বচনীয় আনন্দের যন্ত্রণায় ভেসে যাচ্ছে দুজন মানব-মানবী। ডুবছে, ভাসছে, বিলীন হয়ে যাচ্ছে কোন অচিনলোকে।

হঠাৎ আর্তচিৎকার। এ কী করছিস রোজি?

বাজ পড়ার শব্দে দুজনেই স্তম্ভিত। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ফরিদা। দুজন দুজনাতে এতই মগ্ন হয়ে পড়েছিল যে, দরজা বন্ধ কি খোলা, কিছুই মনে ছিল না। রোজি কিছু বোঝার আগেই স্যার যেন চোখের পলকে পাশের ঘরে প্রস্থান করলেন। রোজি গুম হয়ে বসে রইল আকাশ থেকে ছিটকে পড়া নক্ষত্রের মতো আর স্তম্ভের মতো স্তম্ভিত ফরিদা অপলক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল। দুজনের অন্তরই বিদীর্ণ হচ্ছিল। রক্তক্ষরণ উভযের মধ্যেই ছিল। একজনের রক্ত শীতল হয়ে পড়েছিল আর একজনের রক্ত ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হচ্ছিল।

সেসব দিন এখন কেবলই অনুভবেই বন্দি। যদিও আবেদনে সাড়া দিয়েই ওদের দুজনা বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। রোজিরও এ বিয়েতে মত ছিল। এসব এখন কেবলই গণ্ডিবদ্ধ বিবাহিতের ঘেরাটোপে বন্দি একটুকরো স্মৃতি।