ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার গল্প ‘সমুদ্র’
ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা
জাপানি ছোটগল্পকার এবং উপন্যাসিক ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার ‘সমুদ্র’ গল্পটি অনূদিত হলো দি ডান্সিং গার্ল অব ইজু এন্ড আদার স্টোরিজ বই থেকে। এটি কাওয়াবাতার প্রথম বই। এ বইয়ের গল্পরাজি তিনি লিখেছিলেন এমন এক সময়ে যখন জাপানি সাহিত্যে আধুনিকতাবাদী আন্দোলনের গোড়াপত্তন ঘটছে। যে তরুণেরা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে কাওয়াবাতা নিজেও ছিলেন। সাহিত্যযুগ [বুংগেই জিদাই] নামে যে জার্নালটি আন্দোলনের প্রধান অনুঘটক হয়ে ওঠে তার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কাওয়াবাতা এবং রিইচি ইয়োকোমিৎসু। জাপানি সাহিত্যে নতুন সংবেদন এবং উপলব্ধি সৃষ্টির ঘোষণা দেন তারা, গড়ে তোলেন নতুন এক সাহিত্য শৈলী, যা সংক্ষিপ্ত এবং সরাসরি, প্রাকৃত সত্তার বাহ্যিক দিক এড়িয়ে যা প্রবেশ করে সত্তার গভীরে। দি ডান্সিং গার্ল সংকলনের অন্যান্য গল্পের মতো ‘সমুদ্র’ গল্পেও আমরা পাই সেই প্রখর উপলব্ধি, অন্তর্গত বেদনা এবং গভীর কাব্যময়তা। বইটির ইংরেজি অনুবাদক, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা এবং জে. মার্টিন হোলম্যান। কাউন্টারপয়েন্ট প্রকাশনা সংস্থা থেকে বইটির পুনর্মূদ্রণ হয় ১৯৯৮ সালে। প্রতিধ্বনির জন্য এটি অনুবাদ করেছেন রায়হান রাইন।
ছবি: দ্য জাপান টাইমস © ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা ফাউন্ডেশান
সমুদ্র
কোরীয়দের একটি দল জাপানে একটা সাদা পাহাড়ের রাস্তা ধরে নতুন বসতির দিকে যাচ্ছিল জুলাই মাসে। সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, এমন সময় সমুদ্র দেখা গেল। পাহাড়ের উপর দিয়ে একটা রাস্তা বানাল তারা। এই সত্তরজন লোক তিন বছরের শ্রমে তৈরি করে ফেলল একটা নতুন পথ যাতে ওপারে যাওয়া যায়। অন্য পাশটায় রাস্তা নির্মাণের কাজ পেয়েছিল আলাদা একজন ঠিকাদার। তাই কোরীয়দের আর কাজ ছিল না।
এক নারী ভোরের আগে আগে পাহাড়ের গ্রাম ছেড়েছিলেন। ষোল কি সতের বছরের এক মেয়ে যখন সমুদ্র দেখতে পেল, অবসাদ তাকে পরাস্ত করে ফেলেছে, তার মুখ দেখাচ্ছিল কাগজের মতো সাদা।
‘আমার পেট ব্যথা করছে, আর হাঁটতে পারছি না।’
‘আমরা কী করব? তুমি বিশ্রাম নাও এখানে, পরে লোকজনের সঙ্গে আসো।’
‘তারা কি আসছে?’
‘অবশ্যই আসবে। তারা আসবে নদী স্রোতের মতো।’
অন্য স্ত্রীলোকেরা হাসতে হাসতে সমুদ্রের দিকে নেমে গেল। তাদের পিঠে বোঁচকা এবং বেতের ঝুড়ি।
মেয়েটি তার বোঁচকা নামিয়ে ঘাসের উপর বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে।
দশজন নির্মাণ শ্রমিক গেল তার সামনে দিয়ে।
‘হেই, কী হয়েছে?’ তারা চিৎকার করে বলে মেয়েটিকে।
‘তোমাদের পেছনে কেউ কি আসছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমার পেট ব্যথা করছে। আমি পরে যাব।’
‘নিচে গ্রীষ্ম সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে মেয়েটির মাথা ঘুরল। ঝিঁঝি পোকার তীক্ষ্ণ আওয়াজ বিঁধে যাচ্ছে তার গায়ে। প্রতিবার যখন পাহাড়ী গ্রাম থেকে কিছু শ্রমিক তাদের পথ ধরে এগিয়ে যায়, চারজন বা সাতজন কিংবা দুজন করে, একই ঘটনা ঘটে।
‘কী হয়েছে?’
‘তোমাদের পেছনে কি আসছে কেউ?’
‘হ্যাঁ।’
‘সিডার ঝোপের ভেতর থেকে এক তরুণ শ্রমিক বেরিয়ে আসে। তার পিঠে বড় একটা বেতের বাক্স।
‘তুমি কাঁদছ কেন?’
‘অন্য কেউ কি আসছে?’
‘অন্য কেউ? না। আমার দেরি হয়েছিল, কারণ মহিলাকে আমি ছেড়ে আসতে চাইছিলাম না।’
‘তাই? অন্য কেউই আর আসছে না?’
‘না।’
‘সত্যি বলছ?’
‘কেঁদো না। কী হয়েছে?’
তরুণ শ্রমিক বসে পড়ল মেয়েটির পাশে।
‘আমি হাঁটতে পারছি না। আমার পেট ব্যথা করছে।’
‘ওহ্। আমি তোমাকে কাঁধে করে নিয়ে যাব। তুমি আমাকে বিয়ে করতে পারো।’
‘না। বাবা বলেছে, আমি অবশ্যই এমন দেশে বিয়ে করতে পারি না যেখানে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। আমি এমন কারো কনে হতে পারি না যে এই দেশে এসেছে। সে বলেছে, আমি যেন বিয়ে করি কোরিয়ায় ফিরে গিয়ে।’
‘হুম। আর একারণেই তাকে ওভাবে মরতে হয়েছিল। তোমার জামাটা দেখ।’
‘এটা?’
মেয়েটি তার গ্রীষ্মকালীন কিমনোর দিকে দেখল। ওতে ছিল শরৎকালীন ঘাসের নকশা।
‘এটা উপহার পেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম শুধু ট্রেন ভাড়া আর একটা কোরীয় পোশাক।’
‘তোমার বোঁচকার মধ্যে কী?’
‘হাঁড়ি-পাতিল।’
‘তুমি আমাকে বিয়ে করো।’
‘আর কেউ কি আসছে না?’
‘আমিই শেষজন। তুমি তিন বছর ধরে অপেক্ষা করলেও কোনো কোরীয়কে আর দেখতে পাবে না।’
‘তাই? কেউই আর আসছে না?’
‘আমাকে বিয়ে করো, তুমি হাঁটতে পারছ না। আমি উঠলাম।’
‘আর একজনও কি আসছে না?’
‘একদম তাই, কাজেই আমি যা বলছি শোনো।’
‘ঠিক আছে।’
‘বেশ।’
মেয়েটির কাঁধ জড়িয়ে তরুণ উঠে দাঁড়াল। তারা পিঠের উপর চাপাল তাদের বড় বড় বোঁচকা।
‘তুমি কি নিশ্চিত আর একজনও আসছে না?’
‘চুপ করো।’
‘দয়া করে আমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে চলো যেখানে গিয়ে আমি সমুদ্র দেখতে পাব না।’
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন