ভারতীয় কথাশিল্পী গীতাঞ্জলি শ্রীর গল্প বেলপাতা
গীতাঞ্জলি শ্রী
ছয়টি উপন্যাস এবং অসংখ্য ছোটগল্পের রচয়িতা গীতাঞ্জলি শ্রীর জন্ম ভারতে। প্রথম গল্প ‘বেলপাতা’ প্রকাশিত হয় ১৯৮০-তে, জনপ্রিয় হিন্দি পত্রিকা ‘হংস’-এ। হিন্দি সাহিত্যের জগতে গীতাঞ্জলির পদার্পণ ঘটল ১৯৯১ সালে। বেরোলো তাঁর প্রথম ছোটগল্পের বই অনুগুঞ্জ। প্রথম উপন্যাস মাই। তারপর হামারা শহর উস বরস, খালি জগাহ, গল্পগ্রন্থ ইঁহা হাতি রহতে থে। ভারতীয় হিন্দি সাহিত্য গীতাঞ্জলি শ্রীর হাত ধরেই প্রথম আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার পায় ২০১৮ সালে, ‘রেত সমাধি’ উপন্যাসের জন্য।
রামায়ণ, মহাভারত, পঞ্চতন্ত্র, কথাসরিৎসাগরের আখ্যান আর চন্দ্রকান্তার অ্যাডভেঞ্চার পড়েই তৈরি হয়েছিল তাঁর জগৎ। তিনি যখন দিল্লির লেডি শ্রীরাম কলেজে ভর্তি হচ্ছেন, তত দিনে হিন্দি সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগটা হয়ে গিয়েছিলো নিবিড়। প্রেমচন্দের পৌত্রী ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তবে হিন্দিতে যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ছিলো না, তাই হিন্দি নিয়ে আর পড়তে পারেননি। বেছে নিলেন আধুনিক ভারতের ইতিহাস। স্নাতকোত্তর পাঠ নিলেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। গবেষণা করেছেন বরোদার মহারাজা সওয়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেমচন্দকে নিয়ে।
শ্রী কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছিলেন, তারপর পুরোপুরি লেখায় মনোনিবেশ করেন। পেশাগত জায়গা থেকে একজন লেখক হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করার বিষয়টি কতটা ঝুঁকির সে প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমাদের কাছে হয়তো খুব অর্থ-সম্পদ নেই, লিখে হয়তো সেটা অর্জন করতে পারিনি কিন্তু আমরা কখনো না খেয়ে থাকিনি কারো দ্বারস্থ হইনি। একটা প্রশান্তির জীবনযাপন করেছি সবসময়। আমার স্বামী বরাবরই আমাকে সহযোগীতা করেছেন।’
‘বেলপাতা’ গীতাঞ্জলি শ্রীর প্রথম প্রকাশিত গল্প যা ১৯৮৭ সালে সুপরিচিত হিন্দি সাহিত্য পত্রিকা হংস-তে ছাপা হয়েছিল। গল্পটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ অনুগুঞ্জ-এ প্রকাশিত হয়, ১৯৯১ সালে। প্রতিধ্বনির জন্য অনূদিত গল্পটি ২০১০ সালে রাজকমল প্রকাশনী থেকে বের হওয়া গীতাঞ্জলি শ্রীর প্রতিনিধি কাহানিয়াঁ থেকে নেওয়া হয়েছে।
গীতাঞ্জলি শ্রী: ছবি © জয়তী পান্ডে
বেলপাতা
সবজি বাজারে ফাতিমার পা ধপ করে কাদার মতো থকথকে একটা জিনিসের ওপর গিয়ে পড়ে।
‘ওফ...’ বিরক্তির সঙ্গে, সে তার পা সরিয়ে নেয়।
‘আরে তেমন কিছু না, রিল্যাক্স,’ ওম পায়ের নিচের দিকে ঝুঁকে সান্ত্বনা দেয়, ‘ওহ সামান্য গোবর।’
কেন জানি ফাতিমার মধ্যে প্রবল রাগ দেখা দেয়, ‘দেখ, তোমার জন্য গোবর পবিত্র হতে পারে। আমার কাছে এটা ঘোড়ার লাদির মতোই ঘৃণ্য।’
ওমের ভিতরটা কেমন কেঁপে উঠে, ‘ফাতিমা পাগল হয়ে যাবে। এমন করে ভাবলে, প্রতিটি জিনিসের কেবল দুটো অর্থই দাঁড়াবে একটা হিন্দু অর্থ, আরেকটা মুসলমান।
‘এখনো সময় আছে শুধরে যাও’ ওম অনেকটা কর্কশ গলায় বললো, ‘তুমি যে জিনিসে ফেঁসে যাচ্ছ সেটা এখনো নরম, এখনও চাইলে সেখান থেকে বের হতে পারবে। কিন্তু ফাতিমা, যদি বুঝতে না পার, তাহলে শেষ হয়ে যাবে, আর পরে সেই নরম জিনিস যখন শক্ত হয়ে যাবে… তুমি সেখানে আটকে যাবে, নড়তেও পারবে না, শক্ত হয়ে আটকে থাকবে…।’
দুজনেই স্কুটারে করে বাড়ি ফিরে।
শন্নো চাচি বাড়িতে এসেছেন, ‘এই নাও বাবা, শিরডি গিয়েছিলাম, সাঁই বাবার প্রসাদ।’ বৌমা, এই তাগা বেঁধে নাও।’
ফাতিমা চুপচাপ তাগা বেঁধে নিল।
তার চোখে এক অদ্ভুত চমক ছিল।
সেদিন সন্ধ্যায় ফাতিমা তার স্যুটকেস খোলে। আম্মা গোলাপি আর সবুজ বুটিদার সাটিন কাপড়ের কুশন আর জায়নামাজ মুড়িয়ে দিয়েছিল। ফাতিমা জানালার নীচে, ঘরের এক কোণে কুশন রেখে জায়নামাজ বিছিয়ে দিল। নামাজ পড়া শেষে আসন ঘরের কোণার দিকে খানিকটা সরিয়ে দেয়।
রাতে ওম ধীরে ফাতিমার কাঁধে হাত রাখে। ফাতিমা মুখ ফিরিয়ে নেয়। ওম খানিকটা কাছে ঘেষে বলে, ‘ফাতিমা, তুমি এসব কী করছ?’
ফাতিমা আহত প্রাণীর মতো ছিটকে দূরে সরে যায়, ‘আমি কিছুই করছি না। উল্টো চোর কোতোয়ালকে…’ সে চিৎকারের স্বরে বলল।
ফাতিমা কেমন যেনো অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে, যেন সূক্ষ্ম পরতের নিচে ‘হিস্টোরিয়া’ আর ‘হিস্টোরিয়া’ই চাপা পড়ে আছে। যতক্ষণ নীরব ছিলো ততক্ষণ ঠিকঠাক, কিন্তু যেই সামান্য আওয়াজ হলো পরত ফেটে যেনো চিৎকার বেড়িয়ে এলো।
ওম তার হাতটা হালকা চেপে ধরে, ‘সোনা আমার, আমি কি করেছি? তুমিতো প্রতিটি কথার মানে খুঁজতে থাকো। খুব তাড়াতাড়ি মন খারাপ করে ফেল। আগে আমরা সবরকমের কথাতেই হাসতাম।’
ফাতিমার চোখে তখন জল এসে যায়, ‘অতীতের কথা বলবে না। আমরা আগে অন্য কিছুই ছিলাম।’ সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বালিশে মুখ গুজে দেয়।
ওম তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
‘ছাড়, ছাড় আমাকে। ছেড়ে দাও!’ সে কাঁদতে কাঁদতে ওমের আলিঙ্গন থেকে ছুটে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
‘না,’ ওম আরও শক্ত করে জাবড়ে ধরে বলে, ‘না ফাতিমা, আমি কিভাবে তোমাকে ছেড়ে যাব। প্লিজ...! তুমি বুঝতেই পারছ না...।’
সে-ও তো বুঝতে পারছিল না। তার মতিভ্রম হয়েছে। মুখ ফুটে যেনো একটা ঢেউ বেরিয়ে এসে তাকে মাঝ সমুদ্রে অজানা এক অন্ধকারের গর্তে ফেলে দিয়েছে। কেন এসব ঘটছে? এসব কি হচ্ছে? সে কিছুই বুঝতে পারল না। ঢুকরে ঢুকরে কাঁদা ফাতিমাকে বুকে টেনে নিয়ে মধ্যরাতের জ্যোৎস্নায় ওম চুপচাপ শুয়ে পড়ে। খাটের পাশে রাখা কেবিনেটের দিকে ইশারা করছে চাঁদ। ফাতিমার কলেজে পড়াকালীন সময়ের ছবিটা দেওয়ালে অস্পষ্ট ঝলক দিচ্ছিল। পাতলা শরীর, জিন্সের সঙ্গে কুর্তা, কুর্তার ওপর লম্বা চুলের বেণী দোলানো হাসিখুশি মুখ, চঞ্চল চোখ। তখন ফাতিমার কত সুন্দর সাজগোজ ছিল আর সাহসী। বিদ্রোহী। হোস্টেল লাউঞ্জেই তার আব্বার সাথে ঝগড়া করেছিল—‘কীসের সমাজ... ধর্ম… ধমকাবে না আমাকে... সারা দুনিয়া যদি জঘন্য কোনো নিয়ম চালু করে তাহলে সেটা সঠিক হয়ে যায় না।’
দুজনে মিলে সবাইকে মোকাবেলা করেছিল। জীবনের হুমকি দেওয়া বেনামী চিঠিগুলো ঘৃণার সঙ্গে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। ওমের চাকরি চলে যায়। অভিযোগ ওঠে সে বদরাগী আর ব্যক্তিগত কাজে অফিসের জিনিসপত্র ব্যবহার করে। বন্ধুদের সঙ্গে দুজনেই ছিলো হাস্যোজ্জ্বল। সত্যি, ওম যখন তখন নিজের লেখার জন্য অফিসের কাগজ ব্যবহার করতো। একের পর এক ঝামেলা হয়েছে। শহরেও হাঙ্গামা হয়েছে।
ফাতিমাকে তার আব্বু তালা মেরে ঘরে বন্ধি করে দেয়। কিন্তু সে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে যায় আর দুজনে বিয়ে করে ফেলে।
ওম দীর্ঘ শ্বাস নিলো। এমন মনে হচ্ছিলো যেনো একটা ভয়ার্ত সময়ের সমাপ্তি ঘটেছে, একটা বিপজ্জনক গল্পের শেষ থেকে না জানি কেমন করে আরেকটা নতুন গল্পের শুরু হয়ে গেছে।
সকালে যখন তার ঘুম ভাঙ্গলো দেখে ফাতিমা নামাজ পড়ছে।
‘এটা কি?’ ওমের সারা শরীরে যেনো আগুন জ্বলে ওঠে। সে এক লাফে বিছানা থেকে উঠে জায়নামাজ ছিনিয়ে নেয় আর ফাতিমাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দেয়, ‘এটা কি করছ?’ সে দাঁত খিঁচিয়ে বলে, ‘এখন এইটুকু করার বাকি ছিল?’
‘ছেড়ে দাও আমাকে!’ ফাতিমার গলা কাঁপছে। তার চোখে দৃঢ় সংকল্প দেখে ওমের মাথা চড়া দিয়ে ওঠে। ফাতিমা ছুটে গিয়ে পুনরায় নামাজে গিয়ে বসে।
নাশতার সময় দুজনে চুপ ছিল। ওম চেহারার সামনে ধরে থাকা পত্রিকা সরিয়ে নেয় কেবল নাশতা মুখে দেওয়ার জন্য। ফাতিমা যখন খালি প্লেট তুলতে শুরু করে তখন সে আর চুপ করে থাকতে পারলো না।
‘দাঁড়াও।’
ওমের দিকে না তাকিয়ে, ফাতিমা মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
‘যাও,’ ওম গলা চেঁচিয়ে বলে, ‘যখন শোনার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ আর শুনবে না তখন আর বলে কি লাভ?’
ফাতিমা দ্রুত শাড়ি ফরফরিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে যায়। সে সত্যি সত্যি কিছুই শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তার মনে হচ্ছিলো কেউ এখন আর তাকে চেনে না, মানে না। নিজের পরিচয়ের জন্য সে তার সমস্ত বেদনা, সমস্ত হতাশা একটি বিন্দুতে নিয়ে এসে আত্মত্যাগ করার শপথ নিয়েছে। হয় শুধু সহ্য কর, নাহয় অপমানিত হও। সে তার নিজের পরিচয় খুঁজতে থাকে। দেখা যাক, সে নিজেও দেখিয়ে ছাড়বে।
ওমের এক হাত তার কাধের ওপর। ‘ফাতিমা!’ তার আওয়াজ অনেকটা রুদ্ধ-রুদ্ধ।
ফাতিমা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ওমের এই কোমলতা তার একদম সহ্য হচ্ছিল না। সে হাত সরিয়ে দেয়। সে একটা ভরসা আর বিশ্বাসে আটকে যাচ্ছে যেনো তাকে রাজি করানোর চেষ্টা হচ্ছে। ‘প্রয়োজন নেই এমন কোমল ব্যবহারের। চিৎকার কর। মেরে ফেলো। কিন্তু…।’
‘ফাতিমা, একটু ভাব। তুমি কেন বুঝতে পার না যে তুমি কি করছ? সারা দুনিয়া টিটকারি মারবে, জল আর তেলের মিল কবেই বা হয়েছিল… তুমি কেন নিজেকে সামলাতে পারছ না…? আমরা একে অপরকে ভালবেসেছি। ধর্মের বাইরে গিয়ে… তুমি কেন ধরে নিয়েছ যে দুনিয়ার তৈরি এই মিথ্যে ভ্রমের জালে আমরা আটকে যাব?... তুলনা নিয়ে বসে আছ নিজেদের হিন্দু-মুসলমান হিসেবে দেখাতে। তুমি বিষকে মলম ভাবছ। প্লিজ ফাতিমা, প্লিজ…। যে খাঁদ থেকে লড়াই করে বেরিয়েছিলে সেই খাঁদেই আবার পড়ে যেতে চাইছ?... আমরা তো অবিচারের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করা লোকগুলোর জন্য শক্তি হয়ে গিয়েছি, ‘সিম্বল,’ ‘সিম্বল’ অব ভিক্টোরি…’
ফাতিমা প্রতিবাদী হয়ে উঠলো, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ সিম্বল। শুধু সিম্বল হয়েই থাকলাম। মুর্দা সিম্বল। আর কিছুই না। যেমন পতাকায় আঁকা চক্র।… ওম, আমি মানুষ, কোনো ফেরেশতা না। শুনতেছ? বুঝতে পার?... শোন ওম, আমারও একটা পৃথিবী চাই, মানুষের।… ডু ইউ আন্ডার্স্ট্যান্ড…। যেখানে নানা বৈচিত্র্যের সম্পর্ক থাকবে, দূরের, কাছের। আমি চারটা ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সহায়তায় জীবন পাড়ি দিতে চাই না। ওম… ওম, তুমি একটা বোকা… জীবন কেবলমাত্র একটা ইন্টিমেট বৃত্তের ভেতরে থেকেই কাটানো যায় না। প্রতিমুহূর্তের এই ইন্টিমেসি… সবাই কতটা কাছের… সবাই সবার সম্পর্কে সবকিছু জানে…। ওম, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য কিছুটা দূরে থাকাও প্রয়োজন। আমার সেটাই চাই… সেইসব চাই।’
ওম উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘সব’ কিছু মানে কী বলতে চাইছ? এইভাবে তুমি ‘সব’ পেয়ে যাবে? ফাতিমা, তুমি নিজেকেও হারিয়ে ফেলবে। যেটাকে ‘সব’ ভাবছ সেটা মূলত একটা প্রাণহীন সিম্বলস… তুমি ভয় পেয়ে গেছ…।
ফাতিমা এক ঝটকায় সেখান থেকে চলে গেল।
সে সত্যি খুব ভয় পেতে শুরু করেছে। খামাখা ভয়ের একটা ছাপ তার সারা শরীর দুলিয়ে দেয়। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে সেই চেনা জানা শব্দ, নিচে টপ টপ করে পরা পানির শব্দ, হাওয়ায় একটু একটু করে জানালার কপাট ধাক্কা খাওয়ার শব্দ, দূরে রাস্তায় ট্রাকের শব্দে অন্ধকারে ভয়ে কাঁপতে থাকে… কে ওখানে? কী…?
কখনো স্বপ্নে দেখে আম্মুর ঘরে ঢুকেছে। আম্মু চুপচাপ কাজ করছে। কোথাও হয়তো যাবে। চেহারায় কোমল নিষ্প্রভ ছাপ; আর ফাতিমা কী যেন তাকে বলার জন্য মরিয়া হয়ে আছে, তাকে শোনার জন্য মরিয়া হয়ে আছে। কিন্তু আম্মু কিছুতেই কথা বলছে না, পাথরের মতো ভারী হয়ে আছে। ভেঙে পড়েছে, চিৎকার করছে, অজানা একটা দমবন্ধকরা অবস্থা তাকে ধাক্কা দিতে থাকে। মুখের প্রতিটি ভঙ্গি যেনো সেই চিৎকারে মিইয়ে যাচ্ছে।
আচমকা সে জেগে ওঠে। সেই চিৎকার করা, বিকৃত মুখের উপরে পড়া এমন শান্ত, স্থির, অবিমিশ্রিত ঘুমিয়ে উঠা চেহারা…। সে আরও বেশি ভয় পেয়ে যায়।
ফাতিমা চেয়ারে বসে পড়ে। উদাস। তার সব সাহস ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। নিজের করা ভুলের মাশুল কি হতে পারে তা জানার আগ্রহ ছিল না। আদর্শের লড়াই এখন অনেক হয়েছে। তার মনে হচ্ছিলো মাথা তুলে দাঁড়ানোর বিন্দু পরিমাণ শক্তি তার এখন নেই। প্রতিটি চারা বড় করতে মাটি দরকার, হাওয়া আর পানি দরকার। সে শুকিয়ে যেতে লাগলো। ওম বলতো, তার কোনো অধিকারই নেই এতটা দুর্বল হয়ে পড়া যেনো প্রতিটি ঝড়ো বাতাসে আরো বেশি করে নুইয়ে পড়তে না হয়। সমাজের মোকাবেলা যেহেতু করেছ বন্ধ্যা জমিতে ফসল ফলাতে হবে। নইলে লতার মতো কোনো গাছ কিংবা দেওয়ালে পেঁচিয়ে যায়নি কেন?
অনেক হয়েছে বকবকানি। ফাতিমার মাথা ভনভন করছে। ফাতিমার মনে হচ্ছে অন্য আরেক জন্মে সে তার এই দুর্বলতাকে গালি দিবে। এই মুহূর্তে সে নিজের জন্য একটু জায়গা চাইছে, নিজের পরিচয় চাইছে, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে আছে।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল। ফাতিমা তাকিয়ে দেখে। শন্নো চাচি। সোমবার। চাচি প্রতি সোমবার চলে আসেন। মায়ের নামে পূজা করে যান। দুই বছর মা রাগ করে ছিলেন। কিন্তু নিজের সন্তান থেকে কোন মা দূরে থাকতে পারে! দেখতে দেখতে সব অভিমান দূর হয়ে যায় আর মা তার ছেলের ঘরে আসা যাওয়া শুরু করে। তখন থেকে শন্নো চাচিও আসতে লাগলো।
মা ফাতিমাকে মনেপ্রাণে ভালবাসতে শুরু করে দিল।
একবার শন্নো চাচি চোখ রাঙ্গিয়ে বলেছিলেন, ‘আরে, তোমার বউয়ের কণ্ঠতো খুব সুরেলা। নইলে আমি আওয়াজ শুনেই বলে দিতে পারতাম কে হিন্দু আর কে মুসলমান।’
মা ফাতিমার গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘আমার ছেলের বউকে কোনোদিক থেকে দেখতে মুসলমান মনে হয় না।’
ফাতিমা জিজ্ঞেস করে ফেলে, ‘আমিও শুনতে চাই আওয়াজের মধ্যে কি রহস্য আছে?’
চাচী হাত নাচান, ‘ভাই, মুসলমান মেয়েরা বরাবরই কর্কশ আওয়াজ পায়। অনেকটা পুরুষের মতো! ভারী!... কণ্ঠে কোমলতা নেই বললেই চলে।’
ফাতিমা মুখ ফুটে বলে ফেলে, ‘গলার আওয়াজ তো আওয়াজই, হিন্দুদের তো পুরুষদের গলাও নারীদের মতো, চিকন…!’
শেষে ওম আর ফাতিমা এই ঘটনা নিয়ে বন্ধুমহলে বেশ হাসাহাসি করে। ওমের পাঁচফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতার পুরুষত্ব নিয়ে টানা হেঁচড়া চলে। ফাতিমা নিজেকে শিল্পী ফাতেহ খাঁ বলে দারুন একটা গান শুনিয়ে দেয়।
সামনের দিনগুলোতে এমনই গল্প হতো যেগুলো নিয়ে বন্ধু মহলে একে অপরকে খেপানো হতো। সবকিছু মিলিয়ে সামাজিক রীতি-নীতি নিয়ে হাসি ঠাট্টা হতো। ওমের বাবা বলতো চলার পথে যদি কখনো কোনো সাপ অথবা মুসলমান সামনে পড়ে তাহলে আগে মুসলমানকে খতম করো পরে সাপকে! ওম তখন বেনে আর পাঠানের গল্প শোনায়, এক বেনে পাঠানের বুকে ঘুষি চালাচ্ছিল তো চালাচ্ছিল আর হাউমাউ করে কাঁদছিল এই ভেবে যে, সে কেমন করে থামবে। থামলেই তো পাঠান উঠে তাকে এমন মার মারবে…!
কখনো ওম ফাতিমাকে খ্যাপায়, ‘এদিকে আয় মুসলমানি, দেখ তোর শরীর থেকে কেমন গন্ধ আসছে, পানির সঙ্গে বৈরী করা মেয়েলোক।’
ফাতিমা দুষ্টামির ভঙ্গিতে ওমের কাছ থেকে সরে এসে, ‘যা যা কাফির, দুই ফোঁটা ছিটিয়ে দিয়ে পবিত্র হওয়ার ঢং কর। আসছে আমার ধর্মাত্মা কোথাকার!’
তখন আরও বন্ধুরাও চলে আসতো, ‘না না ভাবি, গোসলের কথা ছাড়। সৌভাগ্য যে এতই গরম, সঙ্গে তোমাকেও যেতে হবে। কিন্তু তার কি হবে যার গা থেকে মাংস খাওয়া সব প্রাণীর গন্ধ আসে?’
‘কী? যত্তসব আজেবাজে কথা?’
সবাই হাসে, ‘কেন আমাদের গাই গন্ধ ছড়ায়? কখনো না। তাহলে সিংহ? আর মুসলমান?
‘তাহলে ঘোড়া?’ ফাতিমা তালি বাজিয়ে হাসে।
সবাই আড্ডার আসরে মজে যায়। কখনো ধর্ম নিয়ে সাধারণ মানুষের গালগপ্প নিয়ে হাসে তো কখনো অবাক হয়ে। কি কি উদ্ভট নিয়ম চালু করে ফেলে মানুষ, মানতে থাকে।
শন্নো চাচী যেনো মুখে মধু ঢেলে ব্যঙ্গ করতেন। তিনি তো ‘ফিট’ করবেনই। কিন্তু কখনো যা-তা কথা বলতেন না। তিনি একবার যখন পুত্রবধু হিসেবে গ্রহণ করলেন সেখানে আর স্নেহের কোনো কমতি ছিল না।
তারপর হঠাৎ করে একদিন মায়ের মৃত্যু হয়ে যায়। ওম একেবারে ভেঙে পড়ে। মাকে মনে করে ছোট্ট শিশুর মতো কাঁদতে থাকে। ফাতিমাও কান্না করতো। মায়ের কথা মনে হতো। তখন তার নিজের আম্মু আর আব্বুর কথাও খুব কর মনে পড়তো। না জানি তারা কী অবস্থায় আছে। এদিক ওদিক থেকে উড়ো খবরও চলে আসতো। খালুজান আর বেঁচে নেই… নাদিমের বিয়ে হয়ে গেছে… মোতিয়ার অপারেশন হয়েছে… এইসব। সবার থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিলো ফাতিমা। কখনো… কিছু হয়ে যায় যদি…?
ওম মায়ের ছবি ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেওয়ালে লাগিয়ে দিল। শন্নো চাচী সেই ছবির পাশেই তার প্রিয় ভগবান শিবশঙ্কর-এর ছবি লাগিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে আসলে হাত জোড় করে প্রণাম করেন। দেখতে দেখতে সেই জায়গাটা একটা পূজার আসন হয়ে গেল। পার্বতী আর গণেশও যুক্ত হয়েছে। সামনে পিতলের থালায় একটা শিবলিঙ্গ, গঙ্গাজল, আগরবাতি আর প্রদীপও সাজানো হলো।
মায়ের কথা মনে করতে গিয়ে পূজার এমন বন্দোবস্ত হয়ে গেল যে ওমও কিছু বলেনি। ফাতিমা আর সে আরতী করে আর শন্নো চাচীর কথামতো ঘরের সেদিকটায় জুতা পড়েও যায় না।
অনেকদিন ধরে চাচী না এলে ওমকে অনেকটা গম্ভীর দেখায়, ফাতিমা বিষয়টা লক্ষ্য করে। এমনই একদিন ফাতিমা জিজ্ঞেস করে, ‘আমি কি ফুল পরিবর্তন করে দেব?’
ওম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললো, ‘আচ্ছা, মায়ের ভাল লাগতো।’
ফাতিমা স্নান সেরে চাচীর মতো মাথার ঘোমটা টেনে নেয়। কলাপাতায় জবা, গোলাপ আর বেলী ফুল ধুয়ে নেয় আর শিব ঠাকুরের জন্য বেলপাতা। দুধ দিয়ে শিবলিঙ্গকে স্নান করিয়ে, ফুল, পাতা দিয়ে প্রদীপ জ্বালায়। তার মনে থেকে হাহাকার জাগে, ‘আম্মা… আম্মি…আব্বা…!’
পরের বার চাচী এসে জানতে চান, ‘পূজা কে দিয়েছে?’
‘আমি।’ ফাতিমা বলে।
চাচী কোনো উত্তর দিল না কিন্তু প্রতি সোমবার করে আসতে শুরু করেন।
‘কেন বৌ, ওম কি অফিসে গেছে?’
‘হ্যাঁ, চাচী।’
‘আর তুই সেই দাগাটা খুলিসনি তো? খুলিস না, তোর কোল পূর্ণ হবে।’
‘তাগা দিয়ে নয়, আমাদের ইচ্ছেতে কোল পূর্ণ হবে।’
‘আরে ইচ্ছে তো আছেই।’ চাচী পূজার সামগ্রী রাখার শেলফ থেকে ঘি নামিয়ে ভোগের জন্য সামান্য হালুয়া বানায়। পূজা করে।
কোনো এক জন্মাষ্টমীতে নিচের দিকের শেলফ পরিষ্কার করে কৃষ্ণের জন্য আসন বানানো হয়েছিল। তখন ফাতিমা, ঠিক যেমন করে মা বানাতো, তেমন করে শিংড়ার আটা দিয়ে হালুয়া বানিয়েছিল। সন্ধ্যার দিকে যখন ওমকে খেতে দিল তখন সে জিজ্ঞেস করে, ‘শন্নো চাচী বানিয়ে দিয়ে গেছে? তুমি?... এতটা সহজ নাকি। একদিনে এসব হয় না।’
শন্নো চাচী পূজা করে চলে গিয়েছেন। ফাতিমাও ব্যাংকের কাজে বেরিয়ে পড়েছে। ফুটপাতে লোকজনের ভীড়। ফাতিমার মনে হলো, সে সবার চলার পথের সামনে পড়ে যাচ্ছে আর সবাই তাঁকে দেখে বিরক্ত হয়ে কি যেনো বলছে। অপরাধবোধ থেকে সে কখনো বাম দিকে তো কখনো ডান দিকে ঝুঁকে হাঁটে আর কিছুক্ষণ পর হঠাৎ থেমে যায়…ভীড় কেটে যাক…।
সে ভীড় দেখে খুব ভয় পেতে শুরু করে। লোকজনকে ভয় পেতে শুরু করে। কখনো পরিচিত কাউকে দেখে ফেললে প্রথমে সে হয়তো তাকে চেনে না আর যদি চিনে ফেলেও তাহলে দ্বিধাভরা এক গাল হেসে পাশ কাটিয়ে এমনভাবে চলে যায় এই ভেবে যে পাশ কাটানো লোকটি তাকে চিনতে পেরেছে তো… চিনতে চায় তো?
ওম চটে যায়, ‘কোথাও গেলে বলে যাওয়ার চেষ্টাও করো না। লোকে ভাববে, তুমি খিলজি বংশের বলে অহংকার বেশি, বাদশাহি দেমাগ বয়ে বেড়াচ্ছ।’
‘তাহলে আমাকে নিয়ে যেও না কোথাও।’ ফাতিমা আলাপ সেখানেই শেষ করে দেয়।
ওম প্রায় একাই যেতো। ফাতিমাকে বলে বলে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া লোকগুলো প্রতিটি কথার কুটিল অর্থ অবশ্যই বের করতে থাকে এবং করে-ও। সেদিনই, মনচন্দা বলছিল, বালা বলেছিল নাকি, ‘নতুন আসছে শাহজাদী। ভাবতেছে ছেলের জন্মদিন তো একটা বাহানা, মূলত দূর্গাপূজার উৎসব জমায়েত হবে আসলে। এটা মানো আর না মানো, মুসলমান যেনো একটু বেশিই মুসলমান। আমি সিদ্দিকীর ঘরে প্রতি ঈদে যেতাম। যখন আমার এটাও জানা ছিলো সে লুকিয়ে গরু জবাই করে।’
লোকজন কি আবোল-তাবোল বলে মজলিস জমজমাট করে তোলে, এটা ওম এবং ফাতিমার আগেই থেকেই ভাল করে জানা ছিল। সে তো বিয়ের খবর উড়ে বেড়াতেই জগৎ জুড়ে যার-যার পরমেশ্বরের দূত হয়ে বসলো আর ওম এবং ফাতিমার রক্ষকও।
‘আরে ভাই চুপ করে কিভাবে বসে আছ, একটা ভদ্র ছেলে বরবাদ হয়ে যাচ্ছে… সে চণ্ডাল বিয়ে না করা পর্যন্ত কিছুতেই ক্ষান্ত হচ্ছিলো না…!’
‘ওমা কেমন সাহস দেখ? আমাদের মেয়েকে তুলে নিবে? দেখে নেব…।’
শুধু তাই নয়, বেচারা মায়ের মৃত্যুর পরও গুজবের বাজার গরম ছিল, ‘দেখনি, বিয়ে করেছে, ছেলের ধর্ম খেয়েছে, মা কান্না করতে করতে নিজের প্রাণ দিয়ে দিল…।’
মনচন্দা আরও বলছিল, একাত্তর সালে নাকি এমন খ্যাতিও ছিলো যে ফাতিমার বাবা পাকিস্তানের এজেন্ট ছিলো। বিয়ের বিরোধ তো ছিলো একটা নাটক মাত্র, মেয়েকে শত্রুদের সহযোগিতার জন্য কাফিরের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে। ওমের কোম্পানি, সম্ভবত ডানলপের তোশক আর বালিশে এফ বি আইয়ের ফাইল সেলাই করা হতো।
ফাতিমা চেক ভাঙ্গিয়ে ফিরে আসে।
বিকেলে ওম দ্রুত ফিরেছে। ‘চলো ডমরুপার্ক যাই।’
সেখানে পৌঁছে দুজনে একটা বড় গাছের নিচে সেটার চওড়া গুড়িতে হেলান দিয়ে বসে। ফাতিমা মাটিতে পড়ে থাকা একটা গাছের ডাল নিয়ে খেলতে থাকে। আচমকা রাস্তার এক কুকুর সেই গাছের ডালে এক পা তুলে ক্রিয়া করার ছবি তার মনে ভেসে উঠতেই সে চিৎকার দিয়ে ডাল হাত থেকে ফেলে দেয়।
‘কি হয়েছে…কি হয়েছে?’ ওম-ও ভড়কে গিয়েছে।
‘ঐ যে…’ ফাতিমা বড় বড় চোখ বের করে তাকালো। আর খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো। নদীর মতো কলকল করে উন্মুক্ত হাসতে লাগলো।
‘ফাতিমা!’ ওম তাকে জড়িয়ে ধরলো।
হাঁসতে হাঁসতে ফাতিমা কান্না করে দিল।
‘ওম আমার ভাল লাগছে না। আমার একদম ভাল লাগছে না।’
‘কি হয়েছে, ফাতিমা! আমার জান, এবার তো খুশি হয়ে যাও। সবকিছু ঠিকঠাকইতো চলছে। তুমি তো আম্মির কাছেও যাবে।’
আব্বার খবর এসেছিল। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। খুব অসুস্থ ছিল। ফাতিমা হন্তদন্ত হয়ে নিজের বাড়িতে পৌঁছেছিল। বিয়ের পর এই প্রথম। অনেক কান্নাকাটি হলো। আব্বাজান ভাল হয়ে গেছে। কিন্তু মহর্রম শুরু হয়ে গেছে। ফাতিমা ওমকে লিখেছে, ‘আব্বা বাসায় এসেছে। এখন কোনো শংকা নেই। কিন্তু মহর্রম শুরু হয়েছে। মহর্রমের পরেই আসতে পারবো। এই মুহূর্তে তাকে ফেলে আসা ঠিক হবে না।’
দেখা হতেই দুজনের ঝগড়া হয়ে গেল। ওম হামলে পড়লো, ‘আমাদের সমঝোতা হয়েছিল যে ধর্মের সঙ্গে আমাদের কারো কোনো সম্পর্ক থাকবে না। এর পাল্লায় কোনোভাবে আর পড়বো না।’
ফাতিমা আশ্চর্য হয়ে বলে, ‘তুমি তো গজবই কর ওম। আমার এখনো ধর্মের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। আব্বা অসুস্থ ছিল। আম্মির মনটাও হালকা হলো। আমাকে কাছে পেয়ে তার দুঃখ অনেকটা হালকা হয়েছে। এইটুকুই। আমি কোথাও সমঝোতা ভঙ্গ করিনি।’
‘বাহ! বাহ!’ ওম রাগান্বিত চেহারায় ব্যঙ্গ করে বললো, ‘তুমি রোজা রাখবে, মহর্রম করবে, আবার নিষ্পাপ ভঙ্গিতে বলবে কি এমন ভুল করেছি? এরপর দেখা যাবে আম্মির মনের শান্তির জন্য বিয়েও করে ফেলতে হয়ত?’
‘তাহলে সেটাও কোনো ভুল হতো না?’
ফাতিমা গভীর দৃষ্টি নিয়ে ওমের দিকে তাকাল। দুই মিনিট পর শান্ত স্বরে বললো, ‘হ্যাঁ, হয়তো ভুল হতো না। আমার কিছু যায় আসতো না কিন্তু আম্মু আর আব্বুর তো সম্মান মিলতো, আমার সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার উপায় থাকত। আমাকে এইভাবে জোড় করে আলাদা হওয়ার দরকার পড়তো না।… ভাইয়ের বিয়েতে পর্যন্ত আমি যেতে পারিনি… তোমার… হিন্দুত্বের কারণে।’
ওম নিস্তব্ধ হয়ে গেল, ‘আরে! দুই দিন সেখানে থেকে ফিরে এসেছ আর তাতেই দেমাগ খুলে গেল? আমি কি নিকাহ করতে না করেছি? অথবা কোনোরকম ধর্মীয় অনুষ্ঠানে? বলো। মন্দির, মসজিদ, গির্জা…’
‘খুব বয়ে গেছে’, ফাতিমা কথার মাঝে বলে উঠলো, ‘এখন মন্দির আর সেখানে সাত পাকের কথা হবে। মন্দিরে কিসের কলঙ্ক লেগেছিল? তুমি জান, ভালো করেই জান, এটাও জান যে, আমাদের সমাজে কিছু যদি যায় তাহলে সে নারীরই যায়। ছেলেরা শুধু নিয়ে থাকে…। তোমার হিন্দু ধর্মের মতো… বহু দূর পর্যন্ত নিজের ছায়া বিছায়… নিজের ছত্রছায়ায় অন্যকে পালতে থাকে অথবা দংশন করে… এ তো খুব ভাল খবর যে নিজের ধর্মের বিস্তারে কোনো খবর নেই অন্য কেউ সামান্য আশ্রয় চাইলে, অধিকার চাইলে, সামান্য জায়গা চাইলে এমনভাবে জ্বলে ওঠো, যদি এমন হয় তাহলে আমারও সেরকম চাই! উল্লু বানিও না। তোমার কি ক্ষতি হয়েছে বা বিগড়েছে?’
ওম গায়ে হাত তুলে ফেলে, ‘তাহলে এখন এইসব দলিল দেখাবে? আর এটা বোঝানোর চেষ্টা করবে আমি তোমাকে তুলে এনেছি? নিজের সম্মতির দায়িত্ব নিতেও এখন ভয় পাচ্ছ?’
ফাতিমা কাঁদতে লাগলো। কিন্তু বলতে থাকলো, সম্মতি? তুমি কি কোনো উপায় রেখেছিলে? হয় এইদিকে আস না হয় চলে যাও, ভাগ, মর। ছেড়ে দেওয়া কি এতই সহজ?’
‘ফাতিমা’, ওম চিৎকার করতে লাগলো, ‘এভাবে আমাদের অতীত নিয়ে টানাহেঁচড়া করো না, আমাদের ভালবাসাকে দূষিত করো না।’
ডমরুপার্কে দুজনে নিজেদের অতীতকে আসল আর নকলের গিটে বেঁধে বসে থাকে।
ওম ফাতিমাকে কোলের উপর শুইয়ে দেয়, ‘এখন আবার কি? এখন প্রতি বছর তুমি শোক পালন করতে নিজের বাড়িতে যাও।’
ফাতিমা কর্কশ স্বরে বলে, ‘যাই আর কি। কি সম্পর্কই বা রাখতে পেরেছি কারো সঙ্গে? কি দিতে পেরেছি তাদের?... ওম আমি সমাজের সঙ্গে লড়াই করেছিলাম, সমাজ আমার বদনাম করবে, পরিত্যাজ্য করবে, আমি সেসব সহ্য করেছি। কিন্তু বাবা-মা থেকে আলাদা হওয়া…’
ওম চিন্তামগ্ন হয়ে যায়। সন্তান থেকে বাবা-মাকে আলাদা করে এমন সমাজ আছে নাকি?
সে দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ‘না ফাতিমা, আমরা অভিযোগ করতে পারি না। জগদীশ কাকার কথা মনে কর।’
জগদীশ কাকা ফাতিমাকে ইংরেজি পড়াতো। তিনিই একমাত্র মুরুব্বি ছিলেন যিনি সেই সময়ে বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের আগে তিনি হুশিয়ারও করে দিয়েছিলেন, ‘দ্যাখো, এই সমাজের শক্তিকে এত হালকা ভেবো না। সমাজের প্রতি নিজেদের নিয়ত ঠিক করে ফেল। খুব থুথু দিবে এটাই ধরে নাও। যদি তাতে ভয় পাও তাহলে আরেকবার ভাবতে হবে। দুনিয়ার সামনে উপর দিয়ে হেসে হেসে থাকবে কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। মেনে নিতে পারবে এইসব, সাহস আছে, যদি থাকে তাহলে আগাও। আমরা সবাই তোমাদের সাথে আছি। এই নকল ভেদাভেদ তোমরা বাচ্চারা চাইলেই দূর হবে।
তবে ঠিকঠাক ভেবে নাও, এতে করে যা হারাবে তা হারাতে দাও… নাম, বংশ… কোনো কিছুর দুঃখ করো না।’
‘ফাতিমা’, ওম তার দুই হাতের তালুর মাঝে ফাতিমার মাথাটা নিল, ‘সমাজকে তোয়াক্কা করিনি, হারিয়ে দিয়েছি আর এখন নিজেরা ঝগড়া করছি!’
‘তোমার কি,’ ফাতিমা ওমের হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, ‘তোমার মা, তোমাদের আত্মীয় সবাই ঠিকঠাক আছে। তুমি তাদেরই থেকেছ।’
ওম কিছুটা রাগত স্বরে বলে, ‘তোমার আম্মির ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যদি তোমাকে মেনে নিতে না পারে তাহলে সেটা তার দুর্বলতা, আমার মাকে কেন দোষ দিচ্ছ?’
ফাতিমার খারাপ লাগতে থাকে। সে উঠে বসে পড়ে, ‘তুমি বুঝতে পারবে না। তুমি ছেলে মানুষ… হিন্দু… তোমার কিসের ভয়?’
‘উফ!’ ওম মাথা জড়িয়ে ধরে, ‘তাহলে এখন এইসব কথা কাটাকাটি চলবে। যখন সমাজের নিকৃষ্ট আইনের তোয়াক্কাই করলে না তখন সেটার কাঠগড়ায় আমাকে কেন তুলবে? ছেলে, মেয়ে, হিন্দু-মুসলমান!’
‘বলা সহজ,’ ফাতিমার রাগ বাড়তে লাগলো, ‘সে উঠে আলাদা হয়ে বসে। তুমি শুরু থেকেই ঝামেলাহীন ছিলে। কিন্তু আমাকে প্রতিটি পদক্ষেপে সমাজের বাণ সইতে হয়। এমনকি মেথরানী পর্যন্ত আমাকে জিজ্ঞেস করে অথচ তোমার সামনে একটা কথাও বলে না। তোমার সেই পড়াশোনা জানা ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছোট্ট বাচ্চাটা পর্যন্ত, তোমার সঙ্গে সেই পুরানো ঢঙ্গে কথা বলে আর আমাকে হ্যালো পর্যন্ত বলে না।
কেউ কি তাকে জিজ্ঞেস করবে, যে এমন অপছন্দের আসল কারণটা কি, আমার সঙ্গেই কেন? যেনো এই সবকিছুর দায়ভার কেবল আমার আর তুমি দুধে ধোয়া তুলসীপাতা, মাসুমবাচ্চা…। ধোপাও দেখি ইচ্ছে করে আমার কাজটা দেরি করে… ফাতিমার কান্না পায়।’
‘বাদ দাও ফাতিমা,’ ওম কথা বলতে শুরু করে, ‘আমরা কখনো কি কারো কাছে দ্বিতীয় কোনো আশা-ভরসা রেখেছিলাম? তাদের নির্দয়তা, সংকীর্ণতা প্রতিনিয়ত দেখছি। বাদ দাও তাদের কথা। কেন এত ছোট ছোট ঝগড়ায় মাথা ঘামাও?’
‘এটাই তো আমি বুঝে গেছি,’ ফাতিমার চিৎকার দিয়ে উঠে, এখন আমি আর নেই, ‘এই ছোট ছোট লড়াইগুলোই আসল। বড় লড়াই লড়তে থাকা সহজ। সেটা আমরা গর্ব করে লড়াই করি। অভিমানে মরে যাই সে লড়াইয়ের জন্য। কিন্তু ছোট লড়াইগুলো… কৃমির মতো জঘন্য, ভেতর কুড়ে কুড়ে ফাঁপা করে দেয়… তারা এতই ছোট যে তাদের বড় এবং আত্মমর্যাদাপূর্ণ অদম্য যুদ্ধের সাথে যুক্ত করা কঠিন হয়ে যায়।… তোমার লড়াই বড়। লড়াই কর আর চেটে খাও বড়-বড় লড়াইয়ের জয়। পরাজয়ের মধ্যেও তার অহংকার আছে। কিন্তু আমি... আমি... এই ছোট ছোট লড়াইগুলোকে বড় লড়াইয়ের জন্য ছেড়ে দেইনি… আমি!’
‘এটা আমাদের পরাজয় ফাতিমা! আমাদের হেরে যাওয়ার কোনো কারণ নেই…তুমি…ত…ত…তুমি…’ ওম নিরাশায় তোতলাতে থাকে।
‘আমি এখন আর কিছুই জানি না। চুপ কর।’ ফাতিমা ত্রস্ত হয়ে পড়ে।
ওমের বুক ভারী হয়ে উঠে, ‘ফাতিমা ডুবে যাবে। আমরা দুজন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। নিজের দুর্বলতা দিয়ে অবিচারকে প্রশ্রয় দিচ্ছ। অন্যায়কারীরা সুযোগ পাবে, তারা খিস্তি-খেউড় করে দুনিয়ার সামনে এগুলোকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করবে।
যে করেই হোক সামলাও… সামলাতে হবে। জগদীশ কাকা…। কী করি? কোথায় যাই?
শহর ছেড়ে দেব? কিছুদিনের জন্য অন্য কোথাও গিয়ে থাকি? উটি? দ্বিতীয় হানিমুন?
উটিই-তো যাচ্ছিলাম তখন সেই মোটা মহিলাটার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো যে কিনা একজন মোল্লাকে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। লেডিজ কেবিনকে রেলওয়ের লোকেরা সাধারণ কামরা করে দিয়েছিল। সেখানেই ওম আর ফাতিমার জায়গা হয়েছিল। ওম তখন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল আর ফাতিমা মালপত্র নিয়ে বগির ভেতর বসেছিল। সামনে বসা গহনার ভারে হাঁপিয়ে উঠা এক মোটা মহিলা ‘লেডিজ, লেডিজ’ বলে চিৎকার করে উঠে, তখনই একজন মোল্লা তার লোকজন নিয়ে কামরায় ঢুকেছিল। ফাতিমা যখন ঘটনা খোলাসা করেছিল তখন তার চেহারায় ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। মালপত্র ভেতরে রেখে মোল্লার দলবল যখন বগি থেকে নিচে নামলো তখনই সেই মোটা মহিলা ফুসুর ফুসুর করতে থাকে, ‘বেটি, এটা তো ভয়ানক ব্যাপার।’
ফাতিমা সান্ত্বনা দেয়, ভয় পাওয়ার কি আছে আমরা অনেকেইতো আছে? কিন্তু সেই মোটা মহিলার যেনো হুঁশ উড়ে যাচ্ছে। না বেটি, তারা ‘এম’। সে চারদিকে নজর ঘুরিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে তাদের বদমায়েশি নিয়ে ফিরিস্তি করছিল, কিছুই বাদ রাখেনি। ফাতিমা তর্ক করেছিল মহিলাটির সঙ্গে, আমারও খুব করে জানা আছে, আমি নিজেও ‘এম’। সেই মোটা মহিলার দিন-রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। ভোরবেলা ফাতিমা পুটলির মতো কুঞ্চিত হয়ে ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিলো তখন উপরের বার্থ থেকে সেই মোল্লার পনের বছরের ছেলে নেমে বলেছিল, ‘দিদি একটা চাদর নিতে পার, আমার কাছে দুইটা আছে।’ মোটা মহিলাটি ভয় ভয় চোখে বার বার তাকাচ্ছিল।
‘ফাতিমা, চলো কোথাও ঘুরে আসি। আমি অফিস থেকে ছুটি নেব। উটি যাবো। ফাতিমা আমি তোমাকে সুখি দেখতে চাই পুনরায়। প্রাণোচ্ছল…’
ওমের ভাইঝির বিয়েতে ফাতিমা সবুজ রঙের শাড়ি পরেছিল। অনায়াসে ওমের মুখ ফসকে যেন সেদিন বেরিয়ে পড়ে, ‘এ কী, মুসলমানি সাজ দিয়েছ?’
ফাতিমা কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে ধমক দিয়েছিল, ‘চুপ কর ওম, একদম চুপ কর।’
ওম আসলে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তেমন কিছু বলতে চায়নি। কেন যেন কোথাও না কোথাও শোনা, কোথাকার কী সব প্রতিক্রিয়াগুলো অবচেতনভাবে মুখ ফসকে বের হয়ে যায়। ওম ফাতিমার পোড় খাওয়া মনকে পুনরায় ‘মুসলমানি সবুজ’ করে দিতে চায়।
‘হাসো না আমার জান।’
ফাতিমার চোখ যেনো গিঁটে গিঁটে ভরে গিয়েছে। কিভাবে যে সান্ত্বনা পাবে, এতটাই লণ্ডভণ্ড হয়েছিল। ওমের মনে হয়, এবার চাইলে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য চিৎকার করুক কিংবা ছেড়ে দিক অথবা শক্ত করে জাবড়ে ধরুক ফলাফল একটাই হবে, ছিঁড়ে যাবে।
নামাজের সময় হয়ে গেছে। ফাতিমা ভেতরে চলে যায়।
ওম আর চুপ থাকতে পারল না। ওম লাফ দিয়ে গিয়ে তাকে টান মেরে ধরে, ‘তাহলে এটাই বল, এখন পর্দার আড়ালে যাবে আর আমি যেনো দখল না দেই?’
ফাতিমার যেনো নাকের ডগায় রাগ পোষা ছিল, ‘আর তুমি যে প্রদীপ জ্বালাও?
‘আমি… আমি জ্বালাই? সত্য-মিথ্যে কিছুতেই তোমার যায় আসে না দেখছি? তাইলে ঘরে আসা লোকজনকে বলে দেব যে আমাদের ঘরে আসলে ভগবানের নাম নেয়া যাবে না?’
‘না বলার দরকার নাই। কাউকে বলার দরকার নাই। আমাকেও না।’ ওম স্তব্ধ হয়ে ফাতিমাকে দেখতে লাগলো।
জায়নামাজের এক কোনা মুড়িয়ে ফাতিমা ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল। দ্রুত গতিতে হাঁটার ভঙ্গিতে যাচ্ছে। কিন্তু এমনভাবে নয় যেন অফিসের জন্য দেরি হচ্ছে কিংবা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে বরং এমনভাবে যেন কারো কাছ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। ভয় পেয়ে। উদভ্রান্ত। চেহারার প্রতিটি কোনায় লুকানো ব্যাকুলতায় যেনো শক্ত করে বেঁধে নিয়েছে, যেনো কোনো উড়ন্ত ভাব দেখা না যায়, কেউ কিছু টের না পেয়ে যায়, আর খুব টান-টান করে বাঁধা জিনিসের মতো তাঁর চেহারা যেনো টান খেতে খেতে কুঁচকে গেছে…
ভূমিকা ও অনুবাদ: অজিত দাশ
গল্পটা চমৎকার।
ইসরাত জাহান
অক্টোবর ০১, ২০২৩ ২০:৩৭