নাড়াই
রহিমার মা দেখতে যেমন কুৎসিত থাকে তেমনই নোংরা হয়ে। নোংরা থাকতে থাকতেই বোধ হয় তার চেহারা এমন কুৎসিত হয়ে উঠেছে। আবার এমনও হতে পারে যে তার চেহারা আগে থেকেই কুৎসিত এবং এই কুৎসিত চেহারা কখনও সুশ্রী হয়ে উঠবে না ভেবে নিজের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পেছনে কোন ধরনের শ্রম দিতে সে দিতে রাজী নয়। রহিমার মার গায়ের রঙ কালো—ফ্যাকাশে কালো, উজ্জ্বল কালো নয়, কলার পঁচা খোসার মত কালো। আর রহিমার মার মাথার চুল পাটের ফেউশার মত। গ্রামের লোকজন রহিমার মার দাঁতগুলোকে বলে কোদালে দাঁত।
সকালে ঘুম থেকে উঠে পাশের বাড়ির কোন মহিলার সাথে নাড়াই আরম্ভ করে হেসেল থেকে পোড়া মাটি ভেঙ্গে নিয়ে মুখে পুরে। তারপর তার হলদে হয়ে উঠা দাঁতে পিষে পোড়া মাটি গুড়ো করে জিহ্বার ডগায় আনে। এরপর ভেতরে ময়লা জমা নখওয়ালা তর্জনীর ডগায় পোড়া মাটির গুড়া নিয়ে দুই পাশে খুব দ্রুত তিন-চারটি ঘষা দিয়ে কুলকুচি করে ফেলে।
রহিমার মা যতই নোংরা হয়ে থাকুক না কেন শীতের সময়টা বাদে প্রায় প্রতিদিনই গোসল করে সে। উন্মুক্ত ছোট্ট উঠোনে দাঁড়িয়ে পাশের ধনী বাড়ির চাপ কল চেপে নিয়ে আসা এক কলসী জল মাথার উপর ঢেলে দেয়। এরপর পরনের শতচ্ছিন্ন ময়লা শাড়িটা আরেকটা শতচ্ছিন্ন ময়লা শাড়ির দ্বারা পরিবর্তন করে।
হ্যাঁ, রহিমার মার কাপড়-চোপড় খুবই ময়লা। তার মানে এই নয় যে সে তার কাপড়-চোপড় কখনও পরিষ্কার করে না। কাপড়-চোপড় সে পরিষ্কার করে, গোসলের মত হালকা ভাবে নয়, খুব কঠিন ভাবেই করে। তবে অনেক দিন পরপর, বিশেষ করে দুই ঈদের আগে। মাঝখানে ডিমের কুসুমের মত সামান্য পানি জমে থাকা বাড়ির পাশের ডোবার ঢালু জায়গায় প্রথমে সে একটা কাঠের তক্তা পাতে। তারপর পরনের শাড়ি হাঁটু পর্যন্ত কুচিয়ে তক্তার দুই পাশে দুই পা কাঁদার ভেতরে গেঁথে মরদের মত দাঁড়িয়ে সোডার পানিতে দুই দিন ধরে ভিজিয়ে রাখা কাঁপড়-চোপড় তক্তার উপর আছড়ায়। ময়লা কাপড়-চোপড় থেকে নিঃসৃত কুচকুচে কালো পানি তক্তা গড়িয়ে ডোবার ঘোলা জলে গিয়ে মেশে।
রহিমার মার নাকটি প্রচন্ড এক ঘুষিতে বসিয়ে দেওয়ার মতই থ্যাবড়ানো। চোখ দুটি বাড়ির পাশের ডোবার জলের মতই ঘোলা এবং চোখের কোণায় সবসময় ঘিয়ে রংয়ের কেতর জমে থাকে। আর রহিমার মার গায়ের রঙ পরিপক্কতা পেয়েছে তার ঠোঁট দুটিতে এসে।
শরীরের উর্ধ্বাংশ ঢেকে রাখার সচেতন প্রয়াস রহিমার মার মধ্যে সাধারণত দেখা যায় না। ফলে তার শরীরের উপরিভাগের প্রায় অনেকটাই থাকে উন্মুক্ত হয়ে। তার স্তন দুটি যেন দুই চিলতে চামড়া- বুকের উপরিভাগ থেকে বের হয়ে নাভি পর্যন্ত ঝুলে থাকে। মাঝে মাঝে গ্রামের বাইরে যাওয়ার সময় ব্লাউজ পরলে ব্লাউজের নীচ দিয়ে বরাবরেই মতই ঝুলে থাকে তার স্তনদ্বয়। স্তনবৃন্ত আকারে আঙ্গুলের ডগার মত আর রঙে তার ঠোঁট দুটির মত। রহিমার মার স্তনে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গর্ত, অনেকটা বসন্তের দাগের মত। তবে ওগুলো বোধ হয় বসন্তের দাগ নয়, কারণ রহিমার মার মুখে বা শরীরের অন্য কোথাও এমন সুস্পষ্ট গর্ত নেই। গুটি বসন্ত তার সমস্ত শরীর বাদ দিয়ে শুধু স্তনের মধ্যে জেগে উঠবে—স্তনের প্রতি এমন শত্রুতা তো বসন্তের থাকার কথা নয়।
রহিমার মা তার ঘুমের সময়টা বাদে প্রায় সবসময়ই কারো না কারো সাথে নাড়াই করে। সে সাধারণত নাড়াই করে তার প্রতিবেশী নারীদের সাথে। নাড়াই জমে উঠলে বেশ কিছু দর্শকও জুটে যায়। সাধারণত বিকেলের শ্রান্ত রোদ নাড়াইয়ে তার পারদর্শিতা বাড়িয়ে তোলে। সে তখন তার ছোট ভিটার কিনারে দাঁড়িয়ে উর্ধ্বাংশে প্রায় আব্রুহীন হয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে পাশের বাড়ির নারীটির উদ্দেশ্যে গালিগালাজ করতে থাকে। ঝগড়ার সময় রহিমার মার ডান হাতের তর্জনীটা বর্শার ফলার মত বের হয়ে থাকে যাতে করে সে যে কোন সময় এটা উচিয়ে তুলতে পারে।
ঝগড়া বাঁধানোর জন্য সুনির্দিষ্ট কোন কারনের তার দরকার পড়ে না। ঝগড়ার খাতিরেই সে ঝগড়া করে। ঝগড়া বাঁধানোয় একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে তার—যে কোন সময় যে কোন কারোর সাথেই ঝগড়া বাঁধাতে পারে সে। আগেই বলে রাখছি—ঝগড়ায় তাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মত দক্ষতা এই তল্লাটে কারো নেই। মাঝে মাঝে কেউ যদি তাকে নাড়াইয়ে পরাজিত করার মত অবস্থায় চলে আসে তখন সে এমন এক অস্ত্রের মোক্ষম ব্যবহার করে যে প্রতিপক্ষ পালানোর পথ পায় না।
রহিমার মার সাথে নাড়াই করলে নাড়াইয়ের অনেক কলা-কৌশল শেখা যায়। ঝগড়ার ঠিক কোন মুহূর্তে ঠিক কোন গালিটি দিতে হয়। সুনির্দিষ্ট কোন একটা গালি দেওয়ার সময় ঠিক কেমন মুখভঙ্গি ফুটিয়ে তুলতে হয়। ঝগড়ার কোন সময় কেমন অঙ্গভঙ্গি করতে হয়।
রহিমার মার সাথে নাড়াই করতে করতে তার প্রতিপক্ষরা নাড়াইয়ে বেশ দক্ষ হয়ে উঠে। ফলে অন্য পাড়ার নারীদেরকে খুব সহজেই কুপোকাত করতে ফেলতে পারে। এরা শুধু রহিমার মার প্রতিপক্ষই নয়, এরা রহিমার মার শিষ্যও কারণ রহিমার মার কাছ থেকে নাড়াইয়ের অনেক কলা-কৌশলও এরা শিখে। এবং রহিমার মার শিষ্য হিসেবে এদের একটা বিশেষ গর্ববোধও আছে। এই নারীরা যখন বউ হয়ে প্রথমবারের মত এই গ্রামে আসে তখন তারা মুখ তুলে পর্যন্ত তাকাতে পারত না। অথচ রহিমার মার প্রশিক্ষণ পেয়ে মাস ছয়েকের মধ্যেই প্রত্যেকেই বড় বড় কল্লায় পরিণত হয়।
রহিমার মা ও তার প্রতিপক্ষ মুখোমুখি হয়ে যে গালিগালাজ আদান-প্রদান করে তার প্রায় সবই যৌনগন্ধী। শুধু তাই নয়, মাঝে মাঝেই রহিমার মা কামুক পুরুষের মুখভাব ও অঙ্গভঙ্গি নিজের মধ্যে ফুটিয়ে তুলে তার তর্জনীটাকে শক্ত হয়ে উঠা পুরুষাঙ্গের বিকল্প হিসেবে নিয়ে প্রতিপক্ষের দিকে দৌড়ে যায়। তারপর প্রতিপক্ষের একদম সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কণ্ঠ খানিকটা নামিয়ে তবে তীব্রতা আরো বাড়িয়ে একটি অশ্লীল বাক্য এক নাগাড়ে অনেকক্ষণ ধরে বলতে থাকে।
মাঝে মাঝেই রহিমার মা তার প্রতিপক্ষকে নিয়ে যৌনতায় ভরপুর গল্প তৈরি করে রসিয়ে রসিয়ে বলে যেতে থাকে। এসব গল্পে নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয় গ্রামের ক্ষমতাবান, ধনী এবং মাতাব্বর শ্রেণীর লোকেরা। এই সব পুরুষ দেখতে বেটে, লম্বা, চিকন, মোটা এবং তরুণ, যুবা, প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ যেটাই হোক না কেন রহিমার মার বর্ণনায় তাদের পুরুষাঙ্গ সবসময় বেশ লম্বা এবং মোটা তাজা হয়ে থাকে। এসব গল্পে প্রতিপক্ষ নারীর ক্ষতবিক্ষত যৌনাঙ্গ দিয়ে রক্ত পড়ার বর্ণনাও বাদ যায় না।
ঝগড়া চলাকালীন সময়ে রহিমার মা যদি কোন ফেরিওয়ালা দেখে তাহলে সে ঝগড়া থামিয়ে নরম স্বরে ফেরিওয়ালাকে ডাকে। ফেরিওয়ালা কাছাকাছি আসতেই, রহিমার মা তার প্রতিপক্ষ নারীটির দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বলে উঠে: ভাই—ওই মাগীর খুব শখ উঠছে, অরে একটু চুইদা থুইয়্যা যান। আচম্বিতে এধরনের কথা শুনে ফেরিওয়ালার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠে। লোকটি এমনভাবে স্থান ত্যাগ করে যেন লোকটিকে বাঘে তাড়া করেছে। ওদিকে প্রতিপক্ষ নারীটিকেও পলায়নরত ফেরিওয়ালাক উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায়: আমার না ভাই—ওই মাগীরই শখ উঠছে, অরেই চুইদা থুইয়্যা যান। অতঃপর রহিমার মা ও তার প্রতিপক্ষ—দুজনেই পলায়নমান লোকটাকে ডেকে ডেকে একই কথা বলতে থাকে।
রহিমার মার গালি থেকে অবশ্য ঈশ্বরও রেহাই পায় না। ঝগড়ার মধ্যেই আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য খিস্তি খেউড় করতে শুরু করে। এসময় সে মাঝে মাঝেই একটি কথা বলে: অন্ধ জবেদ আলী তবুও অল্প অল্প দেখতে পায়, অন্ধ খোদায় কিচ্ছু দেখতে পায় না। যাহোক, ঈশ্বরকে গালিগালাজ করতে করতে একসময় তার কণ্ঠস্বর নাটকীয় ভঙ্গীতে কোমল হয়ে উঠে। শুরু হয় ঈশ্বরের উদ্দেশ্য তার নালিশ জানানো। কেন তার এত দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, যন্ত্রণা, নিপীড়ন, বঞ্চনা, অসুখ-বিসুখ, সংসারে এত টানাটানি—এগুলো নিয়েই খোদার কাছে তার নালিশ।
এরপর হঠাৎ করেই সে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে মাটিতে ন্যাটা দিয়ে বসে পড়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তারপর বুক থেকে আঁচল সরিয়ে সেই আঁচল দুই হাত দিয়ে আকাশের দিকে তুলে মোনাজাত ধরে। মোনাজাতে সে কান্না জড়িত কণ্ঠে করুণ স্বরে খোদার কাছে তার যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তির মিনতি জানাতে থাকে।
তবে একসময় সে বুঝতে পারে যতই প্রার্থনা করুক না কেন এসব থেকে তার মুক্তি নেই। তখন সে আঁচল মাটিতে ফেলে দিয়ে হাতের তর্জনী আকাশের দিকে উচিঁয়ে ধরে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে গর্জে উঠে। এবং আগের মতই খিস্তি খেউড় করতে শুরু করে।
মাগীর ঢং দেখে আর বাঁচি না—প্রতিপক্ষের ছুড়ে দেয়া এই কথাটি কানে প্রবেশ করা মাত্রই সে তার চোখ উপরের খোদার থেকে নামিয়ে মাটির নারীটির দিকে ফেলে।
আরো কিছুক্ষণ হয়ত গালিগালাজ চলে বা সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় প্রতিপক্ষকে অভিশাপ দেওয়ার পালা। বুকের আঁচল তার সম্মুখের মাটিতে বিছিয়ে অভিশাপ দিতে শুরু করে। প্রতিপক্ষ নারীটির স্বামীর সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হওয়ার খবর নাকি এখনই এসে পড়বে। তার যে বাচ্চা ছেলেটা চরায় খেলতে গিয়েছে সে নাকি ইতিমধ্যেই পানিতে ডুবে মারা গিয়েছে। এই কিছুদিনের মধ্যই নাকি প্রতিপক্ষ নারীটির সারা শরীর কুষ্ঠ রোগে ভরে যাবে—বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়বে। আর কোন দিনই সে সুস্থ সন্তান প্রসব করতে পারবে না—আতুর-নুলা, বোবা-কালা সন্তান প্রসব করবে। নারীটির বাবা-মা নাকি মৃত্যুর ঢেকুর তুলতে শুরু করেছে। রহিমার মার মুখ থেকে এরকম আরো কত ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর ধরনের যে অভিশাপ বাণী উচ্চারিত হয় তার ইয়ত্তা নেই।
মাঝে মাঝে অভিশাপ দিতে দিতে রহিমার মা মসজিদের দিকে রওনা হয়। খোদার ঘরে গিয়ে কান্না ভেজা সকরুণ কণ্ঠে এমন অভিশাপ দিবে যে খোদার সেগুলোকে দ্রুত কার্যকর করা ছাড়া আর কোন পথ থাকবে না। যাহোক, কি মনে করে যেন কিছু দূর গিয়ে ফিরে আসে। তবে বেশ কয়েক বার ভয়ঙ্কর উত্তেজিত অবস্থায় সত্যি সত্যি সে মসজিদ প্রাঙ্গনে চলে গিয়েছে। মসজিদের আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলকে মোনাজাতের ভঙ্গীতে ধরে উর্দ্ধে তাকিয়ে প্রতিপক্ষ নারীটিকে অভিশাপ দিয়েছে, তার যাবতীয় দুঃখ-কষ্টের ব্যাপারে খোদার কাছে নালিশ জানিয়েছে। এমনকি খিস্তি-খেউড় করতেও ছাড়েনি। এই হচ্ছে রহিমার মা। ঝগড়ায় তার সাথে সবাইকেই হার মানতে হয়। যাহোক, রহিমার মার অভিশাপ পর্ব শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে নাড়াইয়ের এক ধরনের সমাপ্তি ঘটলেও রেশ থেকে যায়।
ইতিমধ্যে আধাঁর নেমে আসে। রান্নাবান্না বা সংসারের টুকিটাকি কাজকর্ম করার মধ্যেও একে অপরকে উদ্দেশ্য করে মাঝে মাঝে মিইয়ে যাওয়া সুরে গালিগালাজ করতে থাকে। তারপর রেডিওতে বাজতে গান শেষ পর্যায়ে এসে যেমন ভলিউম কমতে কমতে থেমে যায় তেমনি ভাবে তাদের গালিগালাজ কমতে কমতে একবারে থেমে যায়।
রাতে প্রতিপক্ষ নারীটির স্বামী রহিমার মার অভিশাপকে ব্যর্থ প্রমাণ করে সুস্থ-সবল ভাবেই গাওয়াল থেকে ফিরে এলে সে তার স্বামী রহিমার মার সাথে ঝগড়ার কথা খুলে বলে। স্বামীটি খাওয়া-দাওয়া সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে হঠাৎ বাঘের মত ক্ষেপে উঠে উঠানে এসে মর্দভাষায় রহিমার মাকে গালিগালাজ করতে শুরু করে।
রহিমার মাও সাথে সাথেই পাল্টা গালিগালাজ করতে শুরু করে। তবে রহিমার মার অভিধানে এমন কোন গালি নেই যা সে প্রত্যক্ষভাবে ঐ পুরুষটিকে দিতে পারে। তাই সে পুরুষটির মা-বউ-বোনকে গালি পাড়তে থাকে। আর ওদিকে প্রতিপক্ষ নারীর স্বামী রহিমার মাকে গালি দেয় প্রকট ও প্রতক্ষ্যভাবে—আর এতেই রহিমার মা ক্ষত-বিক্ষত হয়। ফলে রহিমার মা তার সাথে ঝগড়ায় পেরে উঠে না।
কোন উপায়ন্তর না দেখে রহিমার মা সারাদিনের গাওয়ালে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়া নিতান্ত নিরীহ, গোবেচারা, অস্থিচর্মসার, হাড়গিলে স্বামীটাকে লাত্থি-উষ্ঠা দিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। ঘর থেকে বাইরে এসে উঠানে দাঁড়িয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে তোতলাতে তোতলাতে রহিমার বাপ যে গালিগুলো দেয় সেগুলো তার কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা ঝাঁকড়া জটা চুলের মতই নিজেদের মধ্যে জট পাকিয়ে যায়। তারপর সে ঐ জটপাকানো গালিগুলোর মাঝখান থাকে একটা সহজ-সরল গালি, যেমন: শালীর পোলা, বেছে নিয়ে সেটাই বার বার জপ করতে থাকে। এছাড়া রহিমার বাপের আর কীইবা করার আছে। গুটি কয়েক শব্দ বার বার জপ করার মধ্যেই তো রহিমার বাপের পুরো জীবনটা আটকে গেছে। দুই পাশে ঝাঁকা ঝোলানো বাইগ কাঁধে নিয়ে ন্যুজ দেহে বাড়ি বাড়ি ফেরি করার সময় সে সুর করে বলতে থাকে—ভাঙ্গা গেলাশ, জুতার ফিতা, পুরান ব্যাটারি। জীবিকা নির্বাহের জন্য এই শব্দগুলোর বাইরে অন্য কোন শব্দ বলার তেমন একটা প্রয়োজন পড়ে না। কয়েকটা শব্দ পুনরাবৃত্তির মাধ্যমেই সে যেহেতু জীবনযুদ্ধে টিকে আছে সুতরাং সে হয়ত মনে করে একটা মাত্র গালি পুনরাবৃত্তি করেই সে নাড়াইয়েও পার পেয়ে যাবে।
রহিমার বাপ একবার এক মাছওয়ালার কাছ থেকে একভাগা গুরা মাছ কেনার পর তার ভাগাতে আরো কিছু মাছ চায়। মাছওয়ালা তার পাতিল থেকে কিছু মাছ রহিমার বাপের ভাগাতে রাখে তবে এতে রহিমার বাপের মন ভরে না, সে আরো মাছ চায় এবং মাছওয়ালা তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন রহিমার বাপ বলে ‘মাছ দে’ লোকটি মাছ দেয় না, রহিমার বাপ আবার বলে ‘মাছ দে’, লোকটি তখনও মাছ দেয় না। এতেই রহিমার বাপ উত্তেজিত হয়ে ‘মাছ দে’ শব্দটা বার বার করে জপতে শুরু করে।
এক পর্যায়ে বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে রহিমার বাপ আসলে মাছওয়ালার কাছ থেকে আর মাছ চায় না শুধু ‘মাছ দে’ এই শব্দটা বার বার করে পুনরাবৃত্ত করতে চায়। নারী-পুরুষের যৌন মিলনের সময় যেমন পুরুষ সঙ্গীটি একটি কাজ বার বার করতে থাকে ঠিক তেমনি ভাবে রহিমার বাপও একটি শব্দ বার বার বলতে থাকে।
যাহোক, ‘মাছ দে’ শব্দটা জপ করতে করতে সে এক সময় আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ধীরে ধীরে ব্যাপারটাকে সে সঙ্গীতের পর্যায়ে নিয়ে যায়। ‘মাছ দে’ শব্দটা পুনরাবৃত্তির মধ্যে সে তাল-লয় ও সুর ঢুকিয়ে ফেলে। মাছওয়ালা ওখান থেকে উঠে চলে যাবার পরও সে ‘মাছ দে’ শব্দটার পুনরাবৃত্তি চালিয়ে যায়। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে রহিমার বাপের চারপাশে লোকজন জড়ো হয়।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন