‘সুয়োরানী-দুয়োরানী’র আদলে ‘ককটেল’
২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ককটেল’ সিনেমাটি কিছুদিন আগে দেখার বেশকিছু কারণ ছিল। সেই সময়ের ব্যবসাসফল ছবি নির্মাণে ও গল্পে আর দশটা সাধারণ বলিউডি ধাচের সিনেমা থেকে আলাদা, এমনটাই শুনেছিলাম। শ্রুতিমধুর গান, স্টার কাস্টিং, সিনেমাটোগ্রাফি সবদিকে সিনেমাটিকে 'ভালো' বলা যায়। বলিউডের ধুমধাড়াক্কা মারামারি, কাটাকাটি, আইটেম সং ককটেল সিনেমায় ছিল না, এ কারণে হয়তো ২০১২ সালের প্রেক্ষাপটে সিনেমাটি আলাদা হতে পারে।
তবে ছবির গল্প একেবারেই সাধারণ যা চিরায়ত দুয়োরানী-সুয়োরানীর গল্প বলে যেখানে এক রাজার দুই রানী-ভালো রানীকে রাজা ভালবাসেন আর খারাপ রানীকে ভালবাসেন না। তারপর সেই খারাপ রানী রাজাকে বগলদাবা করতে বিভিন্ন চক্রান্ত করেন কিন্তু প্রেমিক রাজা দিনশেষে ভাল রানীর কাছেই ফিরে যান। সিনেমার সুয়োরানী চরিত্রের মধ্য দিয়ে বলিউডে প্রথম অভিষেক হয়েছিল ডায়না পেন্টির, দুয়োরানীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন এবং ‘অসহায়’ রাজার চরিত্রে ছিলেন সাইফ আলী খান। দেড় ঘন্টার সিনেমা কারণে অকারণে ৮টি গান ব্যবহারের কারণে আড়াই ঘন্টা দৈর্ঘ্যের সিনেমায় পরিণত হয়েছে। সিনেমার পরিচালক হোমা আন্দাজানিয়া।
চলচ্চিত্রের শুরুতেই মূল তিন চরিত্রের সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। নায়ক গৌতম [সাইফ আলি খান] বলিউডের চিরাচরিত প্লে বয়ের চরিত্রে আবির্ভূত, যার কাজ মেয়ে দেখলেই পটানোর চেষ্টা করা যিনি সিনেমার শুরুতে আবেদনময়ী বিমানবালার সাথে প্রেমলীলায় মত্ত হয়ে চরিত্রের সদ্ব্যবহার করেছেন। সিনেমার আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মীরা [ডায়না পেন্টি] আদর্শ ভারতীয় নারী যিনি কিনা স্বামীর খোঁজে সুদূর ভারত থেকে লন্ডনে এসেছেন, সিনেমার তৃতীয় চরিত্র ভেরোনিকা [দীপিকা পাডুকোন] স্বাধীনচেতা, ফূর্তি করা ‘মেয়েমানুষ’ যে কিনা সিনেমার শুরু থেকেই লন্ডনে থাকছেন। ঘটনাক্রমে স্বামীর কাছ থেকে প্রতারিত ক্রন্দনরত মীরাকে দেখতে পেয়ে ভেরোনিকা তার বাড়ি নিয়ে আসে এবং একসময় তাদের বন্ধুত্ব তৈরি হয়। ভেরোনিকা নারী হিসেবে একেবারেই ছন্নছাড়া স্বভাবের। ভেরোনিকার সেই বাড়িতে মীরা যেন একেবারে আলো হয়ে আসে। সে রান্না করে, ঘরদোর গুছিয়ে রাখে, পূজা-অর্চনা করে ইট-পাথরের বাড়িটাকে ঘর বানিয়ে দেয় ভেরোনিকার জন্য। প্রচণ্ড সংসারী মীরা আপাতদৃষ্টিতে আদর্শ নারী হওয়ার পরেও কেন তার সংসার টিকলো না তা এক রহস্যই বটে কেননা তার স্বামী চরিত্রে অভিনয় করা রণদীপ হুডার চরিত্র নিয়ে পরিচালক একপ্রকার উদাসীনই ছিলেন।
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও পুরুষের দৃষ্টিতে আদর্শ নারী কেমন হওয়া উচিৎ অর্থাৎ ‘Male Gaze’ প্রতিষ্ঠিত করাই যেন চলচ্চিত্রের কাজ। ১৯৯৮ সালে নির্মিত করণ জোহরের ‘কুছ কুছ হোতা হে’ সিনেমাতে যেমন নায়ক রাহুল অঞ্জলিকে পরিপূর্ণ ‘নারী’ হিসেবে দেখতে পায়নি বলে ভালবাসেনি বা বিয়ে করেনি।
উদার মনের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ভেরোনিকার সাথে মীরার স্বভাবগত ভিন্নতা যে কতবেশি তা স্পষ্ট হয়ে উঠে ভেরোনিকার সাথে গৌতমের সম্পর্ক হওয়ার পর। মেয়ে দেখলেই কাত হয়ে যাওয়া পুরুষের প্রতি একধরনের দূর্বলতা আছে এই উপমহাদেশের মানুষদের। ফ্রি মিক্সিং পুরুষের ক্ষেত্রে গুণ হিসেবে ধরা হয় যে কারণে বেশিরভাগ বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে নায়ককে অগণিত স্বল্পবসনা নারীদের পাশে নিয়ে নেচে বেড়াতে দেখা যায়, কিন্তু নারীর বেলায় তা হয় চারিত্রিক অসঙ্গতি। এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের আদর্শ উদাহারণ ‘ককটেল’ সিনেমাটি।
গৌতম ভেরোনিকার শারীরিক সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে সম্পর্কে জড়ায় কিন্তু বিয়ের বেলায় তার পছন্দ মীরার মত ঘরোয়া সংসারী মেয়ে। যে নিজের ভালো থাকার চেয়ে অন্যের ভালো থাকাকে প্রাধান্য দেবে, যে সংসারের সবার খেয়াল রাখবে, অন্যের ছুড়ে ফেলা জুতা-জামাটা নিজ হাতে পরিষ্কার করে দেবে। অথচ ভেরোনিকার মত ‘উড়নচণ্ডী’ মেয়ে থেকে শুরু করে মীরার মত ‘আদর্শ নারী’র প্রথম পছন্দ, মেয়ে দেখলেই লোলুপ ঝরানো গৌতমের মত পুরুষ। গৌতমের পরিবারের মতে, তার এই খামখেয়ালি স্বভাব পরিত্রাণের একমাত্র নিয়ামক- মীরার মত মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়া আর ভেরোনিকার এই উচ্ছৃঙ্খল স্বভাব থেকে মুক্তির রাস্তা হলো সংসারী হওয়া নতুবা সে যতই স্বাবলম্বী বা উদারমনা হোক না কেন, লাভ নেই।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভেরোনিকার মত স্বাবলম্বী নারীও গৌতমের মত নড়বড়ে চরিত্রের অধিকারী মানুষের ভালবাসা পাওয়ার আশায় নিজেকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলে মীরার মত হতে চায়। ভেরোনিকা তার 'উচ্ছন্নে' যাওয়া স্বভাব পালটে ফেলে মীরার মত পূজা-অর্চনা করে, গৌতম অফিস থেকে ফিরলে তার প্রিয় রান্না করে খাওয়ায়, ঘরবাড়ি গোছগাছ করে রাখে।
সিনেমার শুরুতে ভেরোনিকা চরিত্রটিকে উদারমনা সহানুভূতিশীল হিসেবে দেখালেও পরবর্তীতে তা প্রচণ্ড হিংস্রতায় রূপ নেয়। গৌতমের ভালবাসা পাওয়ার আশায় তার প্রিয় বন্ধু মীরাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। কিন্তু যা হয়, দুয়োরাণী কখনোই রাজার ভালবাসা পেতে সক্ষম হয় না। এদিকে রাজা সুয়োরানীকে খুঁজে বের করে বারবার নতুন করে সব শুরু করার কথা বললেও স্বার্থহীন সুয়োরানী তাকে ফিরিয়ে দেয় বন্ধুর প্রতি অবিচার করবে না বলে।
ভেরোনিকার মত স্বাবলম্বী নারীও গৌতমের মত নড়বড়ে চরিত্রের অধিকারী মানুষের ভালবাসা পাওয়ার আশায় নিজেকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলে মীরার মত হতে চায়। ভেরোনিকা তার 'উচ্ছন্নে' যাওয়া স্বভাব পালটে ফেলে মীরার মত পূজা-অর্চনা করে, গৌতম অফিস থেকে ফিরলে তার প্রিয় রান্না করে খাওয়ায়, ঘরবাড়ি গোছগাছ করে রাখে।
এই সিনেমার সবচেয়ে স্বার্থপর চরিত্র গৌতমের প্রতি পরিচালক একেবারেই সুবিচার করেননি, বরং স্বার্থপরতার সিল মেরে দিয়েছেন ভেরোনিকার চরিত্রে। দুই নারীর জীবন বিষিয়ে দেওয়ার পরও গৌতমকে রাখা হয়েছে পরিস্থিতির স্বীকার নির্দোষ অবস্থানে। একজন প্রেমিকা থাকার পরও তার বান্ধবীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়া গৌতমকে কখনোই অনুতপ্ত হতে দেখা যায়নি। ভেরোনিকার প্রেমিকের প্রতি গোপন ভালবাসার জন্য মীরাকে বারবার অনুশোচনায় পুড়তে দেখা গেলেও এই জায়গায় গৌতম ছিলেন একেবারেই নির্বিকার যেন ভেরোনিকার মত মেয়ের সাথে এমনটা করাই যায়। এদিকে ভেরোনিকা তার প্রেমিক হারানোর যন্ত্রণায় মীরার সাথে তার বন্ধুত্ব ছিন্ন করেছে, মীরাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে কিন্তু প্রেমিক গৌতমের ক্ষেত্রে কঠোর হওয়া দূরে থাক, তার ভালবাসা পাওয়ার চেষ্টায় ব্যাকুল হয়ে উলটো মীরাকেই সবকিছুর জন্য দায়ী করেছে।
ভেরোনিকার মীরার মত হতে চাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা রীতিমতো হাস্যকর লেগেছে এবং এটিই সিনেমার সম্ভব দুর্বল দিক কারণ ভেরোনিকা ছিল এই সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্র। এই সিনেমা দর্শককে প্রচ্ছন্ন বার্তা দেয় যে, সংসার করতে চাইলে মীরার মত হও; সংসারী, স্বার্থহীন। কারণ ভেরোনিকার মত উড়নচণ্ডী মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ানো যায়, বিয়ে করা যায় না।
যাই হোক, অনেক অঘটনের পর দুয়োরানী নিজের ভুল বুঝতে পারে এবং সুয়োরানীর সাথে রাজাকে মিলিয়ে দেয়। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও পুরুষের দৃষ্টিতে আদর্শ নারী কেমন হওয়া উচিৎ অর্থাৎ ‘Male Gaze’ প্রতিষ্ঠিত করাই যেন চলচ্চিত্রের কাজ। ১৯৯৮ সালে নির্মিত করণ জোহরের ‘কুছ কুছ হোতা হে’ সিনেমাতে যেমন নায়ক রাহুল অঞ্জলিকে পরিপূর্ণ ‘নারী’ হিসেবে দেখতে পায়নি বলে ভালবাসেনি বা বিয়ে করেনি। কারণ তখন তার সামনে ছিল আকর্ষণীয় নারী চরিত্র টিনা কিন্তু শেষে যখন অঞ্জলি পালটে গিয়ে নারী(?) হয়েছে, অঞ্জলির দেহাবয়ব দেখে মুগ্ধ হয়েছে, রাহুল তাকে বিয়ে করেছে। এক্ষেত্রে নারীর অবস্থান নিষ্ক্রিয় কারণ অঞ্জলির বিয়ে অন্যত্র ঠিক হয়ে যাওয়ার পরেও সে রাহুলের কাছেই ফিরে যায়। রাহুলের স্ত্রী ও রাহুলের বান্ধবী দুজনই রাহুলকে ভালবেসেছে, তার বেলায় কারো কোনো বাছবিচার ছিল না।
মিডিয়া খুব সূক্ষ্মভাবে বুঝিয়ে দেয় নারীর কেমন হওয়া উচিৎ, কোন ঘরানার নারী সব পুরুষের পছন্দ, পুরুষের চরিত্র বলে কিছু হয় না এটি শুধু নারীর কনসার্ন। যুগ যুগ ধরে যে বস্তাপচা মেল গেজের নির্মাণ দেখে আসছি, তার সাথে ‘ককটেল’ মুভির কোনো পার্থক্য না দেখে হতাশ হয়েছি। তবে বর্তমানে অনেক ভিন্নধারার চলচ্চিত্রের নির্মাণ হচ্ছে যার মাধ্যমে এই মেল গেজের সুড়সুড়ি কমতে থাকবে বলে আশা করাই যায়।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন