নেলসন ম্যান্ডেলার চশমা

অ+ অ-

 

কেপটাউনে একখানা সিরিয়াস বইয়ের দোকানের হদিস দিলেন আমার শিক্ষক, ওসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিস্টিন স্ক্যার অরগারেট। তিনি ফেসবুকে দেখেছেন আমি কেপটাউনের বিভিন্ন বইয়ের দোকানে ঘুরছি। তখনই তিনি জানালেন ক্লার্কস বুকশপ বলে একটা বইয়ের মোকাম আছে খুব ভালো। গুগলেশ্বরী জানাল মোকামটি আমাদের অনিক্স হোটেল থেকে গাড়িতে চড়লে মাত্র ৫ মিনিটের পথ। কাজেই আমি সকাল থেকেই প্রস্তুত দোকানটিতে যাব। রোববার, ২ অক্টোবর, আমাদের শেষ দিন কেপটাউনে। পরের দিন উড়োজাহাজ ধরব বাড়ি ফেরার জন্য। তো শেষ পাতে মানুষ যেমন মিষ্টান্ন নেয় বেশ আয়েশ করে, আমিও মনে মনে জপতে থাকলাম ক্লার্কস বুকশপের নাম। মানচিত্রে দেখেছি আশপাশে অন্যকিছু কেনাকাটার দোকানও আছে, কাজেই আমার সাথে গেলে খুব একটা বিরক্তি লাগবে না, এমন আশ্বাস পেয়ে দুপুরের খাবার সেরে ভাবি, মনি ও মনে আমার সঙ্গী হলো।     

উবার ঠিকঠাক দোকানের সামনেই থামল। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে দোকানে ঢুকতে গিয়ে দেখি সেটি বন্ধ। কাঁচের ভেতর দিয়ে সকল বইপত্র দেখা যাচ্ছে, জানালায় বেশকিছু চিত্তাকর্ষক শিরোনামের বইও চোখে পড়ল। কিন্তু দোকান তো বন্ধ। পাশেই দেখি এক বাংলাদেশী দোকান। জিজ্ঞেস করতে জানাল, রোববার, তাই বন্ধ। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ভাগ্য ভালো পাশে অলঙ্কার, জামাকাপড় ইত্যাদির দোকান ছিল। আমি আর মনে পুরো বেকার হয়ে গেলাম। ভাবি আর মনি কেনাকাটা করল খুশি মনে। এখান থেকে আমাদের গন্তব্য সি পয়েন্ট। জায়গাটি অতিক্রম করে আগের দিন আমরা উত্তমাশা অন্তরীপ গিয়েছিলাম। আজ আমরা সৈকতে সময় কাটাব, তাছাড়া ওখানকার একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁতেও খাওয়ার কথা রয়েছে। সেজন্য এক উবার ডেকে রওনা দিলাম সি পয়েন্টের দিকে।

সমুদ্র প্রান্ত বা সি পয়েন্ট নামটা দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন কুকের একজন কমান্ডার স্যামুয়েল ওয়ালিস, ১৭৭৬ সালে, কেপটাউনে তখন গুটিবসন্ত মহামারী রূপ নিয়েছে, তার হাত থেকে বাঁচতে সাগরের এক প্রান্তে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা। আমরাও একটি মহামারী প্রত্যক্ষ করলাম। বছর দুয়েক আগেও ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল আদৌ স্বাভাবিক হবে কি না বিদেশ ভ্রমণ। বলা বাহুল্য নয়, নয়া স্বাভাবিক পরিস্থিতি পেরিয়েই দক্ষিণ আফ্রিকা এসেছি আমরা। এখন সি পয়েন্টের সামনে যত্ন করে বানানো বিচ রোড ধরে হাঁটছি, আর একপাশের সারি সারি ভিক্টোরিয়ান দালানকোঠা দেখছি। লোকজন এখানে করোনা নিয়ে অতোটা চিন্তিত নয়, কারণ অধিকাংশের মুখেই মুখোশ নেই।

কিছুদূর গিয়ে দেখলাম একটি পার্কে গণ্ডারের ভাস্কর্য। আরেকটু সামনে থ্রি এঙ্কর বে। ওখানে বসিয়ে রাখা বিশাল এক চশমা। সি পয়েন্টে এই চশমাটি বসান হয় ২০১৪ সালে। তখনই এটা নিয়ে হৈচৈ হয়। বিতর্কের কারণরে-ব্যান কোম্পানির দাবি এটা পাবলিক আর্ট ওয়ার্ক। চশমাটা আসলে ম্যান্ডেলার চশমা, আর সেটি দিয়ে রবেন আইল্যান্ড তথা গণতন্ত্রকে দেখা। মানে চশমার পেছনে দাঁড়ালে আপনার নজরে আসবে দূরে জেগে থাকা রবেন দ্বীপ।

আমরা উবার থেকে নেমেছিলাম সি পয়েন্টের সুইমিং পুল এলাকায়। সেখানে নেমেই দেখি দারুণ ব্যাপার! আলাদা এক মঞ্চে জোড়ায় জোড়ায় নারীপুরুষ ছন্দময় সঙ্গীতের সাথে সালসা নাচছে। উঠান সকলের জন্যই উন্মুক্ত, নাচতে জানুন, আর না-ই জানুন। দেখলাম অনেকেই কৌতুহলের বশেও জোড় বেঁধে নাচতে নেমে যাচ্ছে। আমরা আফ্রিকার মাটিতে কিছুক্ষণ উপভোগ করলাম লাতিন আমেরিকার নৃত্য। এরপর ঠিক করলাম, রাতের খাবার খেতে বহু দেরি, তো একটু হেঁটে সামনে এগুনো যাক।

কিছুদূর গিয়ে দেখলাম একটি পার্কে গণ্ডারের ভাস্কর্য। আরেকটু সামনে থ্রি এঙ্কর বে। ওখানে বসিয়ে রাখা বিশাল এক চশমা। সি পয়েন্টে এই চশমাটি বসান হয় ২০১৪ সালে। তখনই এটা নিয়ে হৈচৈ হয়। বিতর্কের কারণরে-ব্যান কোম্পানির দাবি এটা পাবলিক আর্ট ওয়ার্ক। চশমাটা আসলে ম্যান্ডেলার চশমা, আর সেটি দিয়ে রবেন আইল্যান্ড তথা গণতন্ত্রকে দেখা। মানে চশমার পেছনে দাঁড়ালে আপনার নজরে আসবে দূরে জেগে থাকা রবেন দ্বীপ। তবে চশমা নিয়ে এই শিল্পকর্ম সম্পর্কে সমালোচকরা বলছেন এটা নিছক পণ্যের বিজ্ঞাপন। ম্যান্ডেলার নাম ভাঙানো মাত্র। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় অন্যরা কি বিরত আছে ম্যান্ডেলাকে বেচাবিক্রি থেকে? ফ্রিজ ম্যাগনেট, মগ, টিশার্ট, কোথায় নেই ম্যান্ডেলা?

রবেন দ্বীপ ও ম্যান্ডেলা সম্পর্কে একটু না বললেই নয়। ম্যান্ডেলা ১৯৬২ সালে রাজনৈতিক অভিযানে সরকারের অনুমতির তোয়াক্কা না করে আফ্রিকার বারোটি দেশ ঘুরে, লন্ডন হয়ে যখন দেশে ফেরেন, তখন বিপদের গন্ধ পেয়ে অ্যাপারথেইড সরকার তাকে গ্রেফতার করে। এরইমধ্যে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সশস্ত্র শাখার নেতা হিসেবে ম্যান্ডেলা বেশ পরিচিতি পেয়ে গেছেন। বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে ১৯৬৩ সালে তাঁকে প্রিটোরিয়া সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়। পরের বছর ম্যান্ডেলা, ওয়াল্টার সিসুলু, আহমেদ কাথরাদা, গোভান এমবেকি, রেমন্ড ম্লাবা, ডেনিস গোল্ডবার্গ প্রমুখ নেতাকে রবেন দ্বীপের কারাগারে প্রেরণ করা হয়। অপরাধতাঁরা রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। রাষ্ট্রের পরিচালক যদি বর্ণবাদী হয় তবে রাষ্ট্রবিরোধী হয়ে তারা কোনো ভুল কাজ করেননি। এই দ্বীপ কারাগারে তাঁদের মতো শুধু রাজনৈতিক বন্দী নয়, সাধারণ অপরাধীদেরও রাখা হতো। এমনকি ১৯৩১ সালের আগ পর্যন্ত কুষ্ঠরোগীদেরও রাখা হতো বিশেষ ব্যবস্থাপনায়। তারাই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদে, ১৮৯৫ সালে, এই দ্বীপে গুড শেপার্ড নামে একটি গীর্জা নির্মাণ করেন, নিজেদের প্রার্থনার জন্য। সেটা এখনো দেখভাল করে রাখা হয়েছে, পর্যটকদের খাতিরে। দ্বীপে আরো একটি ছোট গির্জা রয়েছে, গথিক শৈলিতে নির্মিত সুদৃশ্য উপাসনালয়টি গ্যারিসন গির্জা নামে পরিচিত। ১৮৪১ সালে বানানো। রাজনৈতিক বন্দীদের অনেকে ধর্মবিশ্বাসী না হয়েও প্রতি রোববার এই গির্জায় আসতেন শুধুমাত্র দিনের হিসাব ঠিক রাখার জন্য। নয় তো দিন-তারিখ গুলিয়ে যেত। দিন-তারিখের হিসাব গুলিয়ে যাওয়া মানে বিচ্চিন্নতাবোধ জন্ম নেওয়া এবং মানসিক স্বাস্থের উপর চাপ তৈরি হওয়া। তাই রাজনৈতিক বন্দীরা সাত দিনের হিসেব ঠিক রাখতে এবং নিজেদের ভেতর চিন্তার আদানপ্রদানের জন্য গির্জার চৌকাঠে পা রাখতেন নিয়ম করে।

১৯৬১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার দ্বীপটিকে মূলত রাজনৈতিক বন্দীদের কারাগার হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৬৪ সালে ম্যান্ডেলাকে নিয়ে আসা হয়, আর নম্বর দেওয়া হয় ৪৬৬/৬৪, অর্থাৎ ৬৪ সালে আনা চারশ ছেষট্টি নম্বর কয়েদি। ঐতিহাসিক ৪৬৬/৬৪ নম্বর কয়েদির তালা মারা কক্ষটি আট ফুট বাই সাত ফুট মাপের, তাতে রয়েছে মোটা শিকের ছোট্ট জানালা। তিনটি পাতলা কম্বল, একটি থালা আর চামচ, পাশে রাখা টিনের বিন। এই ক্ষুদ্র ঘরটিতেই আঠার বছর বন্দী ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা।

১৯৬১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার দ্বীপটিকে মূলত রাজনৈতিক বন্দীদের কারাগার হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৬৪ সালে ম্যান্ডেলাকে নিয়ে আসা হয়, আর নম্বর দেওয়া হয় ৪৬৬/৬৪, অর্থাৎ ৬৪ সালে আনা চারশ ছেষট্টি নম্বর কয়েদি। ঐতিহাসিক ৪৬৬/৬৪ নম্বর কয়েদির তালা মারা কক্ষটি আট ফুট বাই সাত ফুট মাপের, তাতে রয়েছে মোটা শিকের ছোট্ট জানালা। তিনটি পাতলা কম্বল, একটি থালা আর চামচ, পাশে রাখা টিনের বিন। এই ক্ষুদ্র ঘরটিতেই আঠার বছর বন্দী ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। নিজের আত্মজীবনী লং ওয়াক টু ফ্রিডমে তিনি লিখেছেন, বন্দীশালা শুধুমাত্র আপনার স্বাধীনতাকেই ছিনিয়ে নেয় না, এটি আপনার পরিচয়কে ছিনিয়ে নিতেও উদ্যত হয়।

কিন্তু মাদিবার পরিচয় দুই কম দুই দশকেও ছিনিয়ে নিতে পারেনি বর্ণবাদী সরকার। বরং বন্দী অবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে আসা নেতাকর্মীদের ভেতর বাহাস করে নিজেদের পরিচয়কে আরো স্পষ্ট ও পরিণত করে নিতে পেরেছেন তিনি। ম্যান্ডেলার মতোই আরেক লড়াকু নেতা রবার্ট সোবুকুয়েকেও রাখা হয়েছিল রবেন দ্বীপে। তবে তাঁকে রাখা হয়েছিল সম্পূর্ণ একা করে। ম্যান্ডেলা বা এএনসির অন্য নেতাদের সাথে তার দেখা দূরে থাক, কেউ জানতেই পারেননি এই দ্বীপে বন্দী আছেন রবার্ট সোবুকুয়ে। সোবুকুয়েকে নিয়ে ভিন্ন লেখায় বিস্তারিত লিখেছি। 

রবেন দ্বীপ থেকে আবার ফেরা যাক মূল ভূখণ্ডে, ম্যান্ডেলার চশমার কাছে। এই গণশিল্পকর্মটি আমার মন্দ লাগেনি। চশমার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালে দৃষ্টি চলে যাবে সুনীল সাগরে রবেন দ্বীপের দিকে। সেখানে সূর্য ডুবিডুবি করছে। আকাশের সাদা মেঘ কমলা রং ধারণ করতে শুরু করেছে। সেই সাথে ঠাণ্ডা হাওয়ার প্রকোপও বাড়ছে। সাথে মনে আছে, তাই অদূরে এক ফিলিং স্টেশন লাগোয়া দোকানে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। আমরা যে রেস্তোরাঁ যাব সেটি রিজেন্ট স্ট্রিটে, সুইমিং পুলের কাছে। কিন্তু আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি এক কিলোমিটারের বেশি। এই ঠাণ্ডা বাতাসের ভেতর অতদূর হেঁটে ফেরা সম্ভব নয়। উবার ডেকে চড়ে বসলাম তাতে।

ভারতীয় রেস্তোরাঁর নাম সানডু সি পয়েন্ট। মালিক সানডুর সাথে আগের দিন এমিলের বাসায় পরিচয় হয়েছিল। উনিই সকল রান্নাবান্না করেছিলেন এবং এখানে খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিলেন। আমরা অবশ্য গিয়ে উনাকে পাইনি। ম্যানেজার ছিল। বিরিয়ানি, পরোটা, চিকেন কারি, পনির কারি ইত্যাদি খাওয়াদাওয়া শেষ করে আবার উবার ডাকলাম।

হোটেলে ফিরে ক্লান্তি ভর করল। হাঁটাহাঁটি তো আর কম হয়নি। ঘুমিয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি। পরদিন কেপটাউনকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ফেরার পালা। তবে বুকশপের কাঁচে আমার যে ছায়া রেখে এসেছি, সে নিশ্চয় এখনো আটকে আছে ওখানেই, ভেতরের বইগুলো দেখার চেষ্টা করছে।

ছবি: লেখক