চেয়ারম্যান বাড়ির বাদুড়

অ+ অ-

 

অবশেষে আবদুল মুন্নাফের সাথে আমাদের দেখা হবে জেলখানায়, একটা লোহার জালের বিপরীত দিকে। দর্শনার্থী হিসাবে আমরা হাজির হবো এমন একটা অপরিসর ও স্বল্পালোকিত কক্ষে যেখানে কয়েদি ও তাদের দর্শনার্থীদের ক্রমাগত চিৎকারে যে কারো কানের পর্দা ছিঁড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কানের পর্দা ছিঁড়ে যায় না, বরং কানের ওপর ভয়াবহ চাপ নিয়ে তারা কথা চালিয়ে যায়। কথা চালিয়ে যায় চিৎকার করে করে, কিছু বুঝে, কিছু না বুঝে, একই প্রশ্ন বারবার করে, একই উত্তর বারবার দিয়ে। আবদুল মুন্নাফ কেমন যেন একটু ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলো আর আমরা জালের যতটা কাছে যাওয়া যায়, অর্থাৎ জালে প্রায় নিজেদের মুখ লাগিয়ে তার সাথে কথা চালিয়ে গেলাম। সে চিৎকার করে বললো: আমার কিছু টাকা প্রয়োজন, টাকা ছাড়া এখানে কিছু পাওয়া যায় না। এমনকি আমার জন্য বরাদ্দকৃত বিছানা-বালিশটাও না। তারা বলেছে যদি আমি টাকার ব্যবস্থা না করতে পারি, তাহলে আমাকে টয়লেটের সামনে ফেলে রাখবে। সেখানেই আমাকে ঘুমাতে হবে। কথাগুলো সে বললো অনেকটা সময় নিয়ে, থেমে থেমে চিৎকার করে করে যাতে আমরা এই নরক গুলজার করা হৈ-হট্টগোলের মধ্যেও তার কথা শুনতে পারি। আমাদের সাথে ছিল তার বউ। সে তার গলার শক্তিকে যতটা সম্ভব একত্রিত করে চিৎকার করে জানতে চাইল: তারা কারা? আমাদের মনে হয়েছিল এটা আসলে কোন প্রশ্ন ছিল না, বরং ছিল একটা বিস্ময়সূচক প্রতিক্রিয়া। আবদুল মুন্নাফ চিৎকার করে জবাব দিল: চেয়ারম্যান বাড়ির বাদুড়! এই উত্তর শুনে আবদুল মুন্নাফের বউ আমাদের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালে আমরা তার পরামর্শদাতা হিসাবে তৎপর হয়ে উঠলাম। আমরা তাকে সাহস যোগালাম। বললাম, না, তার স্বামী আবার মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যায়নি, কারণ সে তার প্রয়োজন সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ। বিভিন্ন মানসিক পীড়নে আক্রান্ত আবদুল মুন্নাফের বউ আমাদের কথা মেনে নেয়া ছাড়া আর কীইবা করতে পারতো! তবে আবদুল মুন্নাফের এই জবাব আমাদেরকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল বছরখানেক আগে যখন সত্যি সত্যি সে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিল আর লোকেরা তাকে পাগল ডাকতে শুরু করেছিল। আর আমরা জানতাম যে তার মানসিক সমস্যা শুরু হয়েছিল ঠিক তখন থেকে যখন লোকেরা তাকে পেয়েছিল একেবারে বেহুশ অবস্থায় চেয়ারম্যান বাড়িতে।

কোন এক বর্ষার দিনে কৌতুহলবশত আবদুল মুন্নাফ পোড়োবাড়িটাতে প্রবেশ করেছিল। চারদিক থেকে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা এই বিশাল বাড়িটার সবকটা ঘরই মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল, শুধু মাঝখানের দুতলা ঘরটা ছাড়া। তবে দুতলা ঘরটার উপরতলার ছাদসহ অনেকটাই ধ্বসে গিয়েছিল। মূলফটকের ডানপাশে স্থাপিত সিংহমূর্তিটি বেদী থেকে পড়ে গিয়ে উল্টো হয়ে ঝুলে ছিল, আর বামপাশে স্থাপিত সিংহমূর্তিটি বেদীতে তার জায়গা ধরে রাখলেও মুণ্ডু ভেঙে গিয়েছিল। ভারত উপমহাদেশ ভাগের পর এক হিন্দু পরিবার চেয়ারম্যানের পিতার কাছে বাড়িটি স্বল্পমূল্যে বেচে দিয়ে কলকাতায় চলে যায়। কেনার সময় অবশ্য বাড়িটার সবকিছু মোটামুটি অক্ষত ছিল। চেয়ারম্যানের পিতা শুধু বাড়ির চারপাশের দেয়াল সংস্কার করে আরো মজবুত করে। আবদুল মুন্নাফ দেখলো ফটকসহ বাড়িটির অবস্থা সঙ্গিন হলেও, ফটকের বামপাশে ছাউনি দেয়া চেয়ারম্যানের কবরটা একেবারে পরিস্কার, ঝকঝকে। বিদেশে বসবাসরত চেয়ারম্যানের একমাত্র মেয়ে একজন কেয়ারটেকার রেখেছিল বাড়িটা দেখভাল করার জন্য। কেয়ারটেকার লোকটি মাঝে মাঝে দিনের বেলা আসতো আর চেয়ারম্যানের কবরটা ভালো করে পরিস্কার করে ধুয়ে-মুছে রেখে চলে যেতো। তার কর্মকাণ্ড দেখে যে কারো মনে হতে পারতো যে শুধু কবরটা দেখভাল করার জন্যই তাকে রাখা হয়েছে।

আবদুল মুন্নাফকে পাওয়া গিয়েছিল মাঝখানের দুতলা ঘরটার সামনে একেবারে বেহুশ অবস্থায় বিকালে। তখন আসমান জমিনের ওপর উপুড় হয়ে নেমেছিল। সেই ভারী বর্ষণের ভিতর তাকে কাত হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। সে অবস্থায় লোকেরা তাকে উদ্ধার করে আনে। আবদুল মুন্নাফ বেহুশ হয়ে যাওয়ার পর বৃষ্টি নেমেছিল নাকি আগে তা অবশ্য আমরা জানতে পারিনি। তবে আমরা জেনেছিলাম যে পোড়োবাড়িটিতে প্রবেশ করার সময় আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা ছিল। আবদুল মুন্নাফ এই তল্লাটে একটা বেসরকারি কলেজের ইতিহাসের শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়ে এখানেই থিতু হয়ে বসেছিল। তার বাড়ি ছিল অন্য জেলায়। আবদুল মুন্নাফের বাবা-মা কলেরায় মারা গিয়েছিল, সে বড় হয়েছিল আত্মীয়-স্বজনের কাছে। তাকে নিয়ে এলাকার লোকজনের অবশ্য তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। সে সবসময় একটা কল্পনার জগতে বাস করতো। কলেজের বাইরে তাকে শুধু স্থানীয় মসজিদে মাঝে মাঝে নামাজ পড়তে যেতে দেখা যেত কিংবা বই হাতে বাচ্চাদের খেলার মাঠের পাশে বসে থাকতে দেখা যেত। সে যে কলেজে পড়াতো নূরজাহান সেই কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ত। হঠাৎ নূরজাহান কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিলে কারণটা কী জানতে আবদুল মুন্নাফ তাদের বাড়িতে হাজির হলে তার আর বিয়ে না করে উপায় থাকে না। বিয়ে করার পর থেকে আবদুল মুন্নাফ শিমুলতলীতে তার শ্বশুর বাড়িতে থাকতে থাকে।

আবদুল মুন্নাফ চেয়ারম্যান বাড়িতে প্রবেশ করার পর তখনও পর্যন্ত টিকে থাকা দুতলা ঘরটার নিতলাটার ভেতরে উঁকি দিয়ে কী দেখেছিল তা আমরা ধীরে ধীরে জানতে পারি। আমরা তখন আমাদের কৈশোরের শেষপ্রান্তে ছিলাম, চারপাশের লোকজন সম্পর্কে আমাদের কান তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল, ফলে আমরা আবদুল মুন্নাফের ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়েছিলাম। আমরা শুনেছিলাম আবদুল মুন্নাফ চেয়ারম্যান বাড়িতে একটা বাদুড় দেখতে পেয়েছিল। সে দেখেছিল পুরো ঘরটাই শ্যাওলার আস্তর দিয়ে ঢাকা। এককোন থেকে দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে একটা বটগাছ। নিচে মেঝেতে ছিল লতাগুল্মের ঝোপ। কয়েকটা কড়িবড়গা তখনও টিকে ছিল। সেগুলোর একটায় বাদুড়টা ঝুলছিল। বাদুড় নিশাচর, দিনের বেলা ঘুমায়। অবশ্য বাদুড়টি ডানাদুটো মৃদু মৃদু নাড়ছিল। তখন সে কিচকিচে গলায় কাউকে কথা বলতে শুনলো: আমি চেয়ারম্যান! আবদুল মুন্নাফ হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। এখানে এই পোড়ো বাড়িতে কে কথা বলবে! আর যদি কেউ কথা বলেও তাহলে সেটা চেয়ারম্যান হতে পারে না। চেয়ারম্যান তো বছর চৌদ্দ আগে মরে গেছে। তাই সে ঘরের প্রতিটি কোনায় ভালো করে তাকালো, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না। যখন সে নিশ্চিত হলো যে ঘরে কেউ নেই, তখন সে আবার কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেল। এবার আরো বেশি জোরালো ও স্পষ্ট: আমি চেয়ারম্যান!

আবদুল মুন্নাফ বাদুড়টার দিকে তাকালো, কারণ ততক্ষণে সে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে বাদুড়টাই কথা বলছে। সে দেখলো বাদুড়টাও তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ নিরব থেকে আবারো বলতে শুরু করলো: হ্যাঁ, আমিই চেয়ারম্যান! মৃত্যুর পর আমি বাদুড়ের উপর ভর করেছি। আমার দেহরক্ষী আমাকে গুলি করে মেরেছিল। অথচ ওকে আমি কাঁদা থেকে তুলে এনে বড় করেছিলাম।

চেয়ারম্যান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

তার মা গুলজান ছিল এই এলাকার একনম্বরের সুন্দরী। আমি গুলজানকে তুলে আনি। তার স্বামী আমার বিরুদ্ধে সালিশ ডাকার চেষ্টা করে। কতো বড়ো বাঞ্চোত! ফলে লোকেরা তার লাশ পায় বিলের ধারে। স্বামী মারা যাবার তিনদিন পর গুলজানকে আমার লোকেরা আমার গোপন ডেরা থেকে ছেড়ে দেয়। পরদিন তার লাশও পাওয়া যায় বিলের ধারে। ইঁদুর মারার বিষ খেয়েছিল। আমি লাশ দেখতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি পোলাটা বিলের কাঁদায় মায়ের লাশের পাশে বসে আছে। আমি তাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। আমাদের অনেক চাকর-বাকর ছিল, তাদের কাছে সে বড় হতে থাকে।

একাত্তরের শেষ দিকে আমি পালাই। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিশোধের কাছ থেকে বাঁচতে। আমার শ্বশুরকূলের লোকজন আমাকে লুকিয়ে রাখে। যুদ্ধ শেষ হবার তিনবছর পর ফিরে আসি। তখনই কাণ্ডটা ঘটে।

কী কাণ্ড? হতভম্ব আবদুল মুন্নাফের মুখ ফসকে প্রশ্নটা বের হয়ে আসে।

আমার হত্যাকাণ্ড!

গুলজানের ঘটনার কয়েক বছর পর এসেছিল আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসি। আমি তখন ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। তখন কোন বাঞ্চোত আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস পেতো না। আইয়ুব খানের মতো আমিও সব কাজী আবদুল বারীকে শায়েস্তা করে ফেলেছিলাম। আমার নির্যাতনের পদ্ধতি ছিল অভিনব!

তোমার শাশুড়ির প্রথম স্বামীর কথাই ধর! হারামজাদাটা ছিল আমার হাতির মাহুত। তোমার শাশুড়িকে আমি চোখে চোখে রেখেছিলাম। আমার মতলব সে বুঝতে পেরে মাহুতকে তা বলে দিয়েছিল। মাহুত আমার কাজ ছেড়ে বউ নিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে ভেগে যাবার মতলবে ছিল। মাঙ্গির পুত!

একদিন আমার লোকেরা হাতিটাকে খেপিয়ে তুলে আর মাহুতকে হাতিশালে ঢুকিয়ে দেয়। হাতি তাকে একেবারে পিশে ফেলেছিল। মাস্টার, তুমি তো জানো, যখন মর্দা হাতি মাদি হাতি খুঁজতে থাকে তখন সে কেমন হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। আমার মর্দা হাতির তখন ঐ সময় চলছিল।

যখন তোমার শাশুড়িকে আমার এক দরিদ্র আত্মীয়ের কাছে আবার বিয়ে দিই, সে তখন এক-দেড় মাসের গর্ববতী। তবে তাদের অবস্থা আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। প্রচুর টাকা দিয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।

দেখতে পাচ্ছো আমিই তোমার শ্বশুর। ঐ খাটাসটা না, যাকে তুমি শ্বশুর হিসাবে জানো। এই কথা বলে বাদুড় আবদুল মুন্নাফের দিকে বাঁকা চোখে তাকালো।

সেদিন বিকালে লোকেরা আবদুল মুন্নাফকে বেহুশ অবস্থায় উদ্ধার করল তুমুল বৃষ্টির ভেতর। রাতে তার হুশ ফিরে এলো ঠিকই, কিন্তু সে প্রলাপ বকতে থাকলো। ভোরবেলায় সে একেবারে চুপ মেরে গেল। তারপর থেকে সে যেন কেমন হয়ে গেলো। সে কলেজে পড়াতে যাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিলো। তার ঘুম একেবারে উঠে গিয়েছিল। সবসময় সে তার বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। প্রথম কয়েকদিন তার বউ একে অধিক ভালোবাসার প্রকাশ মনে করে পুলকিত হয়েছিল। কিন্তু দ্রুতই তার ভুল ভেঙে গেলো। সে তার স্বামীর চোখে এক অদ্ভুত কৌতুহল দেখতে পেলো। সারারাত সজাগ থেকে আবদুল মুন্নাফ তার ঘুমন্ত বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত। কিছুদিন পর সে বিড় বিড় করতে শুরু করল। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পারলাম যে আবদুল মুন্নাফ পাগল হয়ে গেছে।

উপজেলা সদরে কোন মনোচিকিৎসক ছিল না। আর গ্রামের লোকেরা আবদুল মুন্নাফের ক্ষেত্রে নিশ্চিত ছিল যে এটা সেই প্রেতটার কাজ যে প্রেত এক ভয়াল জ্যোৎস্নার রাতে চেয়ারম্যানের পোয়াতি বউটাকে কুয়ার কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছিল আর টইটম্বুর জলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। চেয়ারম্যানের যে মেয়েটা বিদেশে থাকে, তখন তার বয়স পাঁচ কি ছয়। সে বছর পুরো এলাকা জুড়ে ভয়াবহ মাছির উপদ্রব দেখা গিয়েছিল আর মাছির অত্যাচারে লোকেরা কোথাও শান্তিতে বসতে পারতো না। মাছির শরীর থেকে মৃত মানুষের গন্ধ পাওয়া যেতে থাকলো। তবে আবদুল মুন্নাফ শিক্ষিত হবার কারণে বেঁচে গিয়েছিল। কলেজের সহকর্মীরা আবদুল মুন্নাফের শ্বশুরকে পরার্মশ দিয়েছিল তার মেয়ের জামাইকে ময়মনসিংহ জেলা সদরে মনোচিকিৎসকের কাছে নেওয়ার জন্য। ফলে নাক দিয়ে গরম পানি ঢেলে কিংবা কোন একটা চোখ নষ্ট করে দুষ্ট আত্মা দূর করার পদ্ধতির মুখোমুখি হওয়া থেকে আবদুল মুন্নাফ বেঁচে গিয়েছিল।

আমরা শুনেছিলাম যে জেলা সদরে মনোচিকিৎসকের কাছেই আবদুল মুন্নাফ চেয়ারম্যান বাড়িতে কী ঘটেছিল তা প্রথমবারের মতো খুলে বলেছিল। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আবদুল মুন্নাফের অনুরোধে চেম্বার থেকে অন্য সবাইকে বের করার পর পরই আবদুল মুন্নাফ কথা বলতে শুরু করেছিল।

ডাক্তার সাব, এই চেম্বারেই কাজী আবদুল বারীকে নির্যাতন করে সারা জীবনের জন্য বধির করে দেয়া হয়েছিল।

ডাক্তার অবিচলিত স্বরে জানতে চাইলেন: কাজী আবদুল বারী কে?

যে আইয়ুব খানের মার্শাল ল-এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল।

না, এখানে আমরা আপনার মতো লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলি, চিকিৎসা দিয়ে থাকি। এই জায়গা কখনও কাউকে নির্যাতন করার জন্য ব্যবহার করা হয়নি।

ডাক্তার সাব, পৃথিবীর যে কোন জায়গা যে কোন সময় নির্যাতন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে! এমনকি চেয়ারম্যান বাড়ির হাতিশাল পর্যন্ত!

চেয়ারম্যান বাড়ির হাতিশাল! সেটা কোথায় আর সেখানে কী ঘটেছিল?

আবদুল মুন্নাফ ডাক্তারের প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে ফিসফিস করে বলল: ডাক্তার সাব, আমার স্ত্রীকে বাঁচান। সে বাদুড় হয়ে যাবে!

কে বলেছে যে আপনার বউ বাদুড় হয়ে যাবে?

চেয়ারম্যান বাড়ির বাদুড় বলেছে। সে-ই আমার বউয়ের পিতা। সে ছিল চেয়ারম্যান। মরে গিয়ে সে বাদুড়ে রূপান্তরিত হয়েছে। মেয়ের বাবা যেহেতু বাদুড় হয়ে গেছে, তার মেয়েও বাদুড় হয়ে যাবে। সে হবে আরো তাড়াতাড়ি, মৃত্যুর আগেই। ডাক্তার সাব, আমার স্ত্রীকে বাঁচান!

আমরা শুনেছিলাম ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক ঔষধ সেবন করে কয়েক মাসের মধ্যে আবদুল মুন্নাফ প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছিল। যদিও তার অসুস্থতার শুরু থেকে বুকের মধ্যে শূন্যতার যে অনুভূতিটা তার হতো তখনও তা রয়ে গিয়েছিল। শূন্যতার অনুভূতি হলে আবদুল মুন্নাফের মনে হতো সে কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছে যা কখনো আর ফিরে পাবে না, কিন্তু হারিয়ে ফেলা জিনিষটা যে কী তা সে নিশ্চিত করে জানতো না। তবে ডাক্তার আবদুল মুন্নাফের সমস্যাকে জটিল ধরনের মনোরোগ ফোবিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি তাকে অ্যাসিডিটি দূর করার ঔষধও দিয়েছিলেন। সেই ঔষধ সেবনে আবদুল মুন্নাফের সুস্থতা তার জন্য নতুন বিপদ ডেকে আনলো। সে অবশ্য চেষ্টা করেছিল কাউকে কিছু না বলতে। ডাক্তার তাকে বলেছিল তার আসলে হ্যালোসিনেশন হয়েছিল এবং সে ডাক্তারের কথা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু মানুষের ক্রমাগ্ত চাপের মুখে চেয়ারবাড়ির বাদুড় তাকে যা বলেছিল তা সে একজনমাত্র গ্রামবাসীকে বলেছিল। গ্রামে ঐ লোকটার সাথেই তার মাঝে-সাঝে কথাবার্তা হতো। লোকটাকে সে বিশ্বাস করেছিল। লোকটা তাকে কথা দিয়েছিল পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও কাউকে কথাটা বলবে না, কিন্তু পৃথিবী তার আপন গতিতে চলতে থাকলেও আবদুল মুন্নাফের কথাটা দাবানলের মতো শিমুলতলীতে ছড়িয়ে পড়লো। ফলে আমরাও জেনে গিয়েছিলাম যে আবদুল মুন্নাফ যাকে শ্বশুর হিসেবে জানে সে তার শ্বশুর নয়, বরং মৃত চেয়ারম্যান নূরজাহানের প্রকৃত পিতা। তখন তার শ্বশুর তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। শ্বশুর গ্রামবাসীকে বলে যে আবদুল মুন্নাফ আগে থেকেই একটা পাগল। গ্রামবাসীরা বুঝতে পারলো যে আবদুল মুন্নাফের শ্বশুর বিপদে পড়েছে তাই এই কথা বলছে। কারণ নূরজাহানকে আবদুল মুন্নাফের কাছে বিয়ে দেবার বিষয়ে সেই সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিল। আবদুল মুন্নাফের সামনে তখন একটা পথই খোলা ছিল তা হলো ঢাকায় কোন চাকরি যোগাড় করা। ফলে আমরা তাকে দেখতে পাবো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, একটা লোহার জালের বিপরীত দিকে।

পত্রিকায় চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে সে ঢাকায় হাজির হয়েছিল। অফিস সেক্রেটারি হিসাবে কাজে যোগ দেওয়ার দিনেই তার অফিসে পুলিশ তল্লাশি চালালো আর আবদুল মুন্নাফসহ আরও তিনজনকে ধরে নিয়ে গেলো। বড়কর্তারা সবাই থাকলো ধরা-ছোয়ার বাইরে। আটক হবার সময় আবদুল মুন্নাফ পুলিশকে বলেছিল যে সে কেবল ঐদিন কাজে যোগ দিয়েছে এবং সে জানে না কোম্পানি কী অপরাধ করেছে আর অফিসে তার কাজটা কী হতো। এক পুলিশ বললো: থানায় গেলে তুমি সবই বুঝতে পারবা! জায়গা মতো ডিম দিলে আর রুলের গুতা দিলে সব বাঞ্চোতের মুখ দিয়ে খইয়ের মতো সত্য বের হয়। মাঙ্গির পুতেরা, অবৈধ ব্যবসা করো! পরদিন পুলিশ তাদেরকে জেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

নূরজাহানের মরিয়া চেষ্টায় কিছু দিন পর আবদুল মুন্নাফ জামিন পায়। এই প্রচেষ্টায় নূরজাহান তার বাবার কোন সহায়তা পেলো না। আবদুল মুন্নাফ উপজেলা সদরে একটা ছোট্ট বাসা ভাড়া করে নূরজাহানকে নিয়ে থাকতে শুরু করলো। তবে তার বিরুদ্ধে মামলা চলতে থাকলো, তাকে হাজিরা দিতে ঢাকা যেতে হতো।

এই পরিস্থিতিতে আবদুল মুন্নাফ আবার চেয়ারম্যান বাড়িতে প্রবেশ করলো। সে দেখলো বাড়িটাতে সব আগের মতোই আছে, তবে বাদুড়টা কোথাও নেই। ভালো করে দেখার জন্য সে ঘরটার একটু ভেতরে প্রবেশ করলে লতা-গুল্মের ঝোপের মধ্যে সে বাদুড়টাকে আবিস্কার করলো। মরে কঙ্কাল হয়ে গেছে!

চেয়ারম্যান বাদুড়টাকে পর্যন্ত ছাড়ে নাই! এই ভেবে আবদুল মুন্নাফ পিশাচ বলে জোরে চিৎকার করে উঠলো।

প্রাচীন বাড়ি প্রতিধ্বনি করে তাকে তা ফিরিয়ে দিলো!