এই টোল পড়া মালিহা, তোমাকে একটি কথা বলি

অ+ অ-

 

কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা
মনে মনে।    
মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা
মনে মনে।
তেপান্তরের পাথার পেরোই রুপকথার,
পথ ভুলে যাই দূর পায়ে সেই চুপকথার-
পারুলবনের চম্পারে মোর হয় জানা
মনে মনে।।

নাসিম ইমতিয়াজকে এক কথায় বলা যায় গানের সমঝদার লোক। সেই শৈশব থেকেই গান নিয়েই আছেন তিনি। গানকে তিনি খুব ভালোবাসেন। এই যাপিত জীবনে কত কিছু ছাড়লেন, কত কিছুতে ছাড় দিলেন, কিন্তু গানে তিনি একবিন্দুও ছাড় দেননি! সময় ও সুযোগ পেলেই এখনও অনবরত গান শোনেন তিনি। গুনগুন করে গানও গান। এই যেমন এখন তিনি গুনগুন করে গান গাইছেন। কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে।

তবে সেটি বাথরুমে। বাথরুম সিঙ্গার তিনি। সেই শৈশবকাল থেকেই বাথরুম আর গানকে তিনি সমার্থক করে ফেলেছেন, অর্থাৎ বাথরুমে গোসল করলেই স্থান-কাল-পাত্র ভেদে তিনি গুনগুন করে গান গাইবেনই। গান ছাড়া তাঁর গোসল হয় না। তবে, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভয়েসে তাঁর তারতম্য হয়। এই যেমন, নিজ শ্বশুরবাড়িতে গেলে তো আর গুনগুন করে গান গাওয়া যায় না, আর গাইলে পেয়ারের বেগম মালিহা চৌধুরী কিছু বলুক আর নাইবা বলুক, একমাত্র শ্যালিকা শাকিলা চৌধুরীর হাসাহাসির পাত্র হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকে, তাই সেখানে তিনি একরকম মিনমিনে ভয়েসে গান করেন, আর নিজ ফ্ল্যাটবাড়িতে তো ভয়েস বাড়িয়ে হেড়ে গলায় মাঝেমধ্যে ব্যাপক তোলপাড় করেন।

আজ বলা যায় এই ব্যাপক তোলপাড়ই করছেন। আর করবেন না কেন! পাক্কা আটবছর একই পদে থেকে অপেক্ষা করতে করতে আজ প্রমোশনের অর্ডার হাতে নিয়ে উপশহরের মুখের ওই মিষ্টিঘর থেকে নলেন গুড়ের দুই কেজি সন্দেশ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। এ তো কেবল বাড়ির জন্যে। আর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সকলের জন্যে মনে হয় পার্টিরও আয়োজন করতে হবে। করবেন তিনি। কোনো সমস্যা নেই। কত আর খরচ হবে! একদম সকলকে খাইয়ে খুশি করে দেবেন তিনি।

রোজগার তো আর কম করছেন না। বলা যায় দুহাতেই রোজগার করছেন। দুহাতেই সম্মান আসছে! এই লাইন পেতে এই একটু সময় লেগেছে এই আরকি! আর না হলে বড়ো ভায়রা তাসনিম সিদ্দিকি তো তাসনিম সিদ্দিকিই; ওর বড়োভাইও তাঁর সঙ্গে পেরে ওঠার কথা না।

আর বয়সই বা কত হল সার্টিফিকেটে তাঁর! ম্যালা জীবন তো এখনও পড়ে আছে। চব্বিশে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে পাশ করে বেরিয়ে ছাব্বিশে চাকরি নিয়েছেন প্রথম শ্রেণির, আর গুছিয়ে উঠতে উঠতে আঠাশে মালিহা চৌধুরীকে নিজ বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধ করেই ঘরে তুলেছেন।

আর তাঁর এই মালিহা চৌধুরী তো কারো চেয়ে কোনদিক দিয়েই কম না। না শিক্ষাতে কম, না সুন্দরের দিক দিয়ে কম, না বংশে কম! বোটানিতে অনার্স-মাস্টার্স করা মেয়েকে ঘরে তুলতে বাবা-মায়ের সে-কী আপত্তি! না, তারা আত্মীয়তে বিয়ে করাবেন! আত্মীয়র সঙ্গে আত্মীয়তা করে আত্মীয়তা আরও বাড়াবেন! কৃত ওয়াদার বরখেলাপ করবেন না। আরে বাবা, বিয়ে তো করব আমি, সংসারও করব আমি। কাজেই বিয়ে আমার, সিদ্ধান্তও আমার।

শেষমেষ, নাফিজ ইমতিয়াজের সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়েছিল। প্রাপ্ত বয়স্ক, ভাবনা কী, এই ভেবে একরকম বাধ্য হয়েই দুজনেই কাজির অফিসে গিয়ে বিয়ে সেরে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র ভাড়া বাড়িতে উঠেছিলেন। আর এখন তো বছরখানেক হয় নিজ ফ্ল্যাটবাড়িতে বসবাস করছেন। নিজের এই ফ্ল্যাটবাড়ির জন্যে তাকে একটু কায়দা করতে হয়েছে আরকি! এরজন্যে শ্বশুরবাবাকে অনবরত হিসেব রেখে টাকা দিয়েছেন এই তিনি। আর সেই টাকায় শ্বশুরবাবা ফ্ল্যাট কিনে একটু উনিশবিশ করে কেবল জামাইকে উপহার না দিয়ে জামাই এবং মেয়েকে উপহার হিসেবে দান করেছেন। যাক, একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। দুদক তো দুদক, দুদকের মতো এখন আর কারুরই কোনোদিক দিয়ে কোনো প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ নেই।

আশ্বিনের এই মাঝামাঝি সময়ে গরমও পড়েছে ব্যাপক। গরমের এইদিনে সকালে অফিসে যাওয়ার আগে একবার, আবার বাড়ি ফিরে এসে আরেকবার গোসল করবেনই তিনি। কোনো কোনো দিন তিনবারও করেন। এই তো গত পরশু তিনবার করেছেন। অবশ্য এটি আনন্দ-ফূর্তির কালে। আনন্দ-ফুর্তি তো সবসময় হয় না, ইচ্ছে থাকলেও পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে বিপরীত পক্ষ থেকে সাড়াও পাওয়া যায় না। আর পেলে গোসল না করলে শরীর-মনে পবিত্রতাও আসে না।

আনন্দের এই আজকের দিনে একটু আগে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। সত্যি কথা বলতে কী, কেবল প্রমোশনের খবর জানানোর জন্যেই আজ বলা যায় তাড়াতাড়িই বাড়ি ফেরা হয়েছে তাঁর। আনন্দের এই সংবাদটি মোবাইলে তিনি স্ত্রীকে শেয়ার করেননি। আর সব খবর- সব সংবাদ মোবাইলে পেয়ারের স্ত্রীকে জানানো একদম ঠিক না, যখন দূরত্ব কোনো ব্যাপারই না।

আজ এখন এই মুহূর্তে বাড়ি না এলে রবি আর বুধের সিডিউল অনুযায়ী প্রাক্তন সহকর্মী তানিয়া রশিদের সঙ্গে রিক্সায় হুড উঠিয়ে ব্যস্ত রাজপথে ঘণ্টা খানিক আনন্দ ভ্রমণ করতেন তিনি। মাস দুয়েক হয় তানিয়া রশিদের সঙ্গে অতি সঙ্গোপনে তাঁর এই সন্ধ্যাকালীন আনন্দভ্রমণ চলছে তো চলছেই। এই সময়ে এমন বয়সে আর কাহাতক আনন্দ ভ্রমণ করা যায়! তিনি ভদ্রলোক, তাই তক্কে তক্কে আছেন কখন তানিয়া রশিদ বডি ল্যাঙ্গুয়েজে অভিসারের আমন্ত্রণ জানায়। আমন্ত্রণ না পেলে তিনি সাড়া দেবেন না। তাঁর এত ঠেকা নেই! এত লালসাও নেই!

যেভাবেই হোক, অতি সঙ্গোপনে মাসে-দুমাসে একবার শাকিলাকে আপন করে পাচ্ছেন এই-ই যথেষ্ট। বেশি লোভ করতে নেই। অতি লোভে তাঁতী নষ্ট। শাকিলার বেলায়ও তিনি নিজ থেকে এগিয়ে আসেননি, এমনকি কল্পনায়ও বিষয়টি আনেননি। তারপরও কী থেকে কী যেন হয়ে গেল! আজ তো ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২০ তারিখ, ২০১৮ সালের জুলাই মাসের ২০ তারিখ সন্ধ্যারাতে লোডশেডিং হতেই গল্পগুজব করতে থাকা সদ্য এসএসসিতে ৪.৮৫ পাওয়া শাকিলা ইচ্ছে করেই তাঁর কোলে বসে পড়েছিল। সেদিন তিনি শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করছিলেন। কমবেশি প্রতিদিন ডায়েরি লেখার চেষ্টা করেন, তাই সেদিনের ঘটনা লালকালি দিয়ে স্টার চিহ্ন এঁকে সাংকেতিকভাবে লিখে রেখেছিলেন। তারপর থেকে শাকিলার সঙ্গে এই হরদম তাঁর খেলা চলছে তো চলছেই।

আজ যে কী হয়েছে, গোসলই শেষ হচ্ছে না তাঁর। তিনি গোসলে কখনো শাওয়ার ব্যবহার করেন না। বালতিতে পানি ঢেলে তারপর মগ ব্যবহার করে গোসল করেন। এখন এই মুহূর্তে অবিরাম মাথায় পানি ঢেলে যাচ্ছেন, আর গাইছেনও একের পর এক তারুণ্যের গান; যৌবনের গান। আমার যৌবনের মৌবনে লেগেছে দোলা। রে ভ্রমরা বেরসিক তুই...।

এই, এই ! কী শুরু করেছ তুমি! গিন্নির আওয়াজ ধেয়ে এল।

তিনি শরীরে পানি ঢালা বন্ধ করে আওয়াজে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করলেন। নিজ স্ত্রী বলে কথা। তাও আবার যেই সেই স্ত্রী নয়, হাসলে গালে টোল পড়া স্ত্রী!

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁর একবছর লস আছে। শুধু এই টোল পড়া মালিহার জন্যেই তাঁর জীবন থেকে একটি বছর চলে গেছে। তখন মনে হয়েছিল টোল পড়া মালিহার জন্যে একটি বছর কেন, আজীবন চলে গেলেও কোনো দুঃখ বোধ থাকবে না তাঁর।

তখন তিনি ফিজিক্সের স্টুডেন্ট। কেবল ফিজিক্সের স্টুডেন্ট বললে ভুল হবে। বলতে হবে তুখোড় স্টুডেন্ট। এসএসসি, এইচএসসিতে এ প্লাস নিয়ে মেডিক্যাল, বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ না করে নিজ পছন্দের সাবজেক্ট ফিজিক্সে বেশ উচ্চাশা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন। গবেষণা করবেন। সেই হিসেবে ফার্স্ট ইয়ার এবং সেকেন্ড ইয়ার ফাইনালে চমকও দেখিয়েছিলেন। কিন্তু থার্ড ইয়ারে উঠে লাগোয়া বোটানি ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট ইয়ারের টোল পড়া মালিহাকে দেখে তাঁর উচ্চাশার গতিপথ কাঙ্ক্ষিত দিকে না গিয়ে মালিহামুখী হয়ে গিয়েছিল। তারুণ্যের সেই সময়ে তিনি কেন, তাঁর অনেক বন্ধুবান্ধব তাঁদের সায়েন্স ফ্যাকাল্টির দুই মালিহা অর্থাৎ কৃষ্ণকলি মালিহা আর টোল পড়া মালিহার প্রেমে অহর্নিশ হাবুডুবু খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকত! তিনিও বুঁদ হয়েছিলেন। তবে বেশিদিন তাঁকে বুঁদ হয়ে ঘোরাঘুরি করতে হয়নি। নিজের ওই বড়ো বড়ো চোখ দুটির জন্যে তাড়াতাড়ি তাঁর দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গিয়েছিল! অনেকদিন পর মালিহাই কথা প্রসঙ্গে একদিন তাঁকে এই কথাটি বলেছিল।

তিনি জবাব দিলেন।
বললেন, ‘গোসল করছি, ডার্লিং।’
‘দেরি কর না, বেরিয়ে এসো। ঠান্ডা লেগে যাবে।’

তিনি দেরি না করে বেরিয়ে এসে ফ্রেশ-ট্রেশ হয়ে ফ্যান ছেড়ে ডাইনিং টেবিলে সন্ধ্যাকালীন নাস্তা সারতে লাগলেন।

এবং নাস্তা সারতে সারতেই অলোকের কথা জিজ্ঞেস করলেন। অলোকের এখন ঘুমানোর সময়। অলোক ঘুমাচ্ছে। মাস খানিক আগে তাঁদের দুবছরের এই শিশুসন্তান অলোক ইমতিয়াজের ওপর দিয়ে কী ঝড়টাই না গেছে! গরমের এই সময়ে নিউমোনিয়ার কারণে অলোক মরতে মরতে বেঁচে উঠেছে।

বিপদের ওই সময়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও হয়ে গেছে। বাবা-মা খবর পেয়ে মান-অভিমান সব ভুলে তাঁর এই ফ্ল্যাটবাড়িতে ছুটে এসেছেন। দিন দুয়েক থেকে বাবা জরুরি কাজে বাড়িতে গেলেও আবার এসেছেন, থেকেছেন, তারপর গেছেন। আর মা গেছেন এই তো গতকাল। আর আজ তাঁর প্রমোশন হয়েছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাবা-মাকে খুশির এই সংবাদ মোবাইলে অবহিত করেছেন।

এখনও তিনি আছেন গানের মুডে। খাচ্ছেন আর মাঝেমধ্যে গুনগুন করে গান গাইছেন!

এই টোল পড়া মালিহা, তোমাকে একটা কথা বলি।

আবেগের আতিশয্যে টোল পড়া মালিহা হু-হা ছাড়া আর একটিও কথা বলতে পারেননি, এমনকি স্বামীর গোসলের সময় পরপর দুবার টি রশিদ নামে মিসড কল হয়ে যাওয়া ফোনকল সম্পর্কেও তাঁর আর কোনো কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি।

শেষকথা, নাসিম ইমতিয়াজ আবার গোসলের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শরীর আর মনের পবিত্রতার জন্যে তাঁর আবার গোসলের দরকার হয়ে পড়েছে।