দোকলা
সিঙ্গারার সঙ্গে পেঁয়াজ দরকার ছিল। পাশের টেবিলে দেয়া হয়েছে। চারুকে দেয়া হলো না। টিস্যু বক্সটাও ওই টেবিলে। কফি রেখে যাওয়ার সময় টেবিলে ছলাৎ করে পড়লো কিছুটা। পাশের টেবিলে কফি দেওয়া হলো ট্রেতে। সঙ্গে পোড়া রঙের কুকিজ দেখা যাচ্ছে। ক্যাফের পুরনো খদ্দের চারু। দৈনিক আসা হতো একসময়। এখন সপ্তাহে একদিন। কালো কফি। কোন কোন দিন আলু ভাজা। ক্যাফের লোকেরা জানে, কোনদিন এই ফর্দের সঙ্গে কিছু যোগ হবে না। এমনকি টেবিলটাও। তেরো বছর কেটে গেল একই টেবিলে। সব সময় খালি পাওয়া যায় এমন নয়। তবে চারু অপেক্ষা করে। বাইরে দাঁড়িয়ে, ফুটপাতে সময় কাটিয়ে দেয়। টেবিল খালি হলে এসে বসে। ততোক্ষণে কফি-আলু ভাজা তৈরি। দুই সপ্তাহ হলো ক্যাফেতে সিঙ্গারা ভাজা হচ্ছে। চারুর দাবি—ব-দ্বীপের মাটির নিচে যতো গ্যাস। তার চেয়েও বেশি অম্বল ওর পাকস্থলিতে জমা। এবং সিঙ্গারা খাবো বলেই তো মর্ত্যে আসা। তাই আলু ভাজা বিদায়। স্বাগত সিঙ্গারা। চারুর কাছে সিঙ্গারাকে সামাজিক ও সহিষ্ণু মনে হয়। আলু, বাদাম, কলিজা, পেঁয়াজ, মরিচ কেমন মিলেমিশে থাকে ময়দার মোড়কে। উষ্ণ তেলে ডুব সাঁতার দিয়ে ওরা যেন আরো দীপ্ত ও জোটবদ্ধ। সিঙ্গারার কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। এই ক্যাফেতে যেদিন সিঙ্গারা ভাজা হলো, সেদিনই চারু ওদের জানিয়ে দিয়েছিল—ওদের এবার নির্বাণ লাভ হলো। ভোক্তার মনের চৌকাঠ পেরোতে পেরেছে ওরা। পাশের টেবিলে সিঙ্গারা নিয়ে যেন অ্যানাটমি পড়া হচ্ছে। পাঁজর উন্মুক্ত করে রাখা হয়েছে। কিন্তু কোন কিছুই মুখে তোলা হচ্ছে না। চারু ভাবছে, তাহলে কি তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের মানুষ। ব্যাঙ ও মানুষের শরীর ভয় পেয়ে সিঙ্গারার হৃৎপিণ্ড থেকে পাঠ নিচ্ছেন?
চারুর ঘর থেকে পাশের বাড়ির বারান্দা চোখে পড়ে। ওদের রান্নাঘর থেকে দেখা যায় চারুর বারান্দা। পাশের বাড়ির বারান্দাকে ওই বাড়ির পৌর আবর্জনার ভাগাড় মনে হয়। বাড়ির সকল ফেলনা জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলা হয় বারান্দাতে। রোদে পুড়ছে, শীত-বর্ষা গায়ে মাখছে, কিন্তু ফেলনাগুলো অপসারণের কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে শুধু একজনকে। কতো বয়স হবে? সত্তর পেরিয়ে এসেছেন বোঝা যায়। তিনি প্রায়ই এসে দাঁড়ান। কখনও কখনও নিজ জামা দিয়ে ঐ সব ফেলনা জিনিসপত্র মুছতে থাকেন। কোনটি হয়তো তার নিজের ব্যবহার করা। কোনটি হয়তো কারো আবদার মেটাতে বা ভালোবেসে তিনিই কিনে দিয়ে ছিলেন। চারু কখনও কখনও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে, কখন যেন আবার এই মানুষটাকেই এখানে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। মানুষটার মাঝেও কি ওই একই ভাবনা ভাসছে? তাই ফেলনাগুলোর প্রতি এতো আদর। রান্নাঘরে যিনি আসেন, তিনি আপন মনে গান গেয়ে যান। গানের কোন কলি চারুর কানে আসে না। কিন্তু কিছু একটা গাইছে, তাঁর ঠোঁট, চোখ—এমনকি শাড়ির আঁচল তাই বলে। তিনি যখন গানে নিজেকে ভাসিয়ে দেন, তখন তাঁর আঁচলও ঢেউ তোলে। চারু কতোদিন চেষ্টা করেছে, চোখে চোখ রাখতে। উহু, তিনি কখনও এদিকে পলক দেননি। খুব বেশি সময় থাকেন, তা নয়। দেখে মন হতে পারে বাঁধা ফর্দ, বাঁধা সময় নিয়েই আসেন। ঠিক ঘড়ির কাঁটা ধরে শেষ করেন রান্না। গ্রীস্মে, ভাদ্রে কপালে বিন্দু বিন্দু মুক্তো জমে কপালে, গালে। পৌষে কালো একটা চাদর। সেখানে হলুদ রঙের নকশী করা ফুল। চারুর মনে পড়ে, ঠিক এমন একটা নকশী রুমাল কেউ তাকে দিয়েছিল। সেই রুমালে গরুর গোস্তের ঘ্রাণ মাখানো। অনেকদিন চারু রুমাল নাকের কাছে নিয়ে গোস্তের ঘ্রাণ পেরিয়ে ওই মানুষটার শরীরের ঘ্রাণের কাছে পৌঁছতে চেয়েছে পারেনি। রান্নাঘর থেকে গোস্তের সুবাস ছড়িয়ে পড়লে, চারুর সামনে ওই মানুষটা ভেসে উঠে।
পাশের টেবিলের তস্তরীতে পোড়া রঙের কুকিজ এখনও পড়ে আছে। ঠোঁট কফির পেয়ালা ছুঁয়েছে নয়বার। পেয়ালা কফি শূন্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট। চারুতো অতিউষ্ণ কফি পাঁচ চুমুকেই ফুরিয়ে দিতে পারে। ধোঁয়া উড়ছে না আর। হয় শেষ, না হয় তলানীতে পড়ে আছে খানিকটা। অন্যের পেয়ালার তলানীতে পড়ে থাকা কফি খেয়ে নেয়ার অভ্যেস চারুর আছে। খেয়ে নিতে পারে তলানীর চা। চারুর ইশতেহার হলো—মানুষের মনের সঙ্গে আর কোন খাবার বা পানীয়ের এতোটা সংযোগ থাকে না। মানুষ জমায়েত বা আড্ডায় বসেও যখন কফি বা চায়ের পেয়ালা হাতে তুলে নেয়, তখন, সে একলা হয়ে যায়। নিজের একাকিত্ব উদযাপন করে। মনের খবর নেয়। তলানীর উষ্ণজল কেড়ে নিয়ে, সেই একাকিত্বে বাধ সাধি। সঙ্গে পাওয়া যায় মনের খবরটাও। চারু উঠে দাঁড়ায়। বাইরে যাওয়ার ছল করে পাশের টেবিল ঘেঁষে হেঁটে যায়। উঁকি দেয়। গভীর কুঁয়োর মতো মনে হয় কফির পেয়ালা। তলানী দেখা গেলো না। পুরোটাই খেয়ে নিলো নাকি? তার মানে হলো, মানুষটা কারো সঙ্গে সহভাগ করে নিতে চান না তাঁর একাকিত্ব। চারু বাইরে দাঁড়িয়ে বিপরীত দিকের বাড়ির ব্যালকনী থেকে নুয়ে পড়া ফুলের কয়েকটা ছবি তুলে নেয় মোবাইল ফোনের ক্যামেরায়।সঙ্গে সঙ্গে ফেইসবুকে তুলেও দেয়—আজ অপরিচিতার দিন। তাইতো ফুলটি যেমন প্রথম দেখা। প্রথম পরিচয়। পাশের টেবিলের মানুষটিকেও তো আগে দেখা হয়নি। তিনি হয়তো এই ক্যাফেতেও প্রথম। টেবিলের সামনে মোবাইল। তাকে একবারও মোবাইল তুলতে দেখা গেলো না। কোন ফোনও আসেনি। তিনি বসে আছেন, কোন দিকে তাকিয়ে আছেন, বলা মুশকিল। হয়তো এই ক্যাফেতে বসেই সফর করছেন অন্য কোথাও। চারু এবার ভেতরে আসে। সামনে দিয়ে নয়। তার পেছন দিক দিয়ে আসে, যেন পেয়ালার পুরোটা দেখা যায়। না, এবারও নজর পেয়ালার তলানীর হদিস পেলো না। এই যে চারু উঠে গেল, আবার ফিরে এলো, সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। চারুর প্রতি কোন আগ্রহ দেখা গেলো না।
খাবার পরিবেশনকারীদের একজন এসে উনার কাছে জানতে চাইলো—কিছু প্রয়োজন আছে কিনা? অতঃপর তার উচ্চারণ শোনা গেল—আরেকটা কফি দেয়া যাবে? তার মানে তিনি কারো জন্য অপেক্ষা করছেন? এটাতো সাদামাটা বিষয়। রেস্তোরাঁয় কারো জন্য অপেক্ষার অভিজ্ঞতা চারুরও আছে। চারু ধরে নিলো, পেয়ালার এক ফোটা কফিও তিনি অবশিষ্ট রাখেননি। এর মানে হলো—কোন এক সংকটে ডুবে আছেন তিনি। পথ খুঁজছেন বা প্রতীক্ষায় আছেন মুক্তির। তাই সব দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার মতোই কফি দ্রুত ফুরোক সেটাই চান তিনি। নতুন কফি এলো। এবার সঙ্গের কুকিজের রঙ বদলে গেছে। আগের কুকিজ ফেরত গেছে। এবার ক্রিম রঙের। কুকিজ হাতে তুলে নিলেন। পরখ করে দেখলেন। বাজার থেকে ফল-তরকারি-মাছ কেনার মতো। তারপর ছেড়ে দিলেন পেয়ালায়। চারুর বলতে ইচ্ছে করছিল—এভাবে কেউ কুকিজ খায়? টোস্ট ভেঙ্গে চায়ে ডুবে গেলেই কতো আফসোস হয়। তিনি কফিতে চুমুক দিচ্ছেন না। ধোঁয়া ধীরে ধীরে কমে আসছে। চারুর টেবিলে টিস্যু ছিলো না। উঠে গিয়ে পাশের টেবিলের মানুষটিকে বললো—টিস্যু নিতে পারি? তিনি চারুর দিকে চোখ ফেরালেন না। চারু দাঁড়িয়ে থাকলো কয়েক মূহূর্ত। তারপর টিস্যুর সঙ্গে কফির পেয়ালাও নিয়ে এলো নিজের টেবিলে। কোন আপত্তি নেই। আপত্তি থাকবে কি করে, তিনি দেখতে পেয়েছেন কিনা, সংশয় আছে চারুর। এক চুমুকেই পুরো পেয়ালার খেয়ে নেয়। চারু দেথতে পেলো, আজ অনেকটা সময় ক্যাফেতে কেটে গেল। সাধারনত এতো সময় থাকা হয় না। ও উঠে পাশের টেবিলে বসলো। একদম মানুষটার মুখোমুখি। তারপর বলে—একজনে একলা থাকা যায় না। একলা হতে দুজন লাগে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন