বিলেতে কোহিনুরের খোঁজে

অ+ অ-

 

বিলেতে এসে কাজে-অকাজে যে দফতরে যাই, সেখানেই দেখি রাজমুকুটের খোদাইকৃত চিত্র। আমাদের কুইনমেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামেও দেখি ঝলমলে রাজমুকুট। চিঠি পোস্ট করতে যাই, রাস্তার মোড়ের টকটকে লাল পোস্টবক্সেও সোনালি মুকুটের ছাপ। টেলিফোন বদ্ধ বুথেও বর্ণিল রয়্যাল ক্রাউন। বাজার-সদাই করতে গিয়ে চামড়ার ওয়ালেট থেকে পাউন্ড-পেনি বের করি। ব্রিটিশ মুদ্রায়ও দেখি রানি এলিজাবেথের মুকুট পরা ছবি। বুঝতে অসুবিধে হয় না, এদেশে সব কাজকর্ম সম্পাদিত হয় রানির নামে। এখানে চলছে মুকুটশোভিত রাজতন্ত্রের শাসন। হাজার বছরের ঐতিহ্যে চলমান রাজশাসনের বিচিত্র সব প্রথা আর আড়ম্বর। জেনে অবাকই হলাম, রয়্যালটির মূল মুকুটের ওজন প্রায় দুই কেজি। ২৮৬৮ টি হীরে, ১৭ টি নীলকান্তমণি, ১১ টি পান্না ও ২৬৯ টি মুক্তাখচিত এই ভারী মুকুট পরা বুড়ো রানি এলিজাবেথের পক্ষে আক্ষরিক অর্থে কষ্টকরই ছিল বৈকি! শুনেছি, সেজন্য বৃদ্ধা রানিকে অবকাশ দিতে রাজকর্মচারীরা একটা আলাদা পাত্রে ভারী মুকুটটি সাজিয়ে রাখত।

মনে পড়ে, মুকুটময় লন্ডনে শুরুর দিনগুলো কাটত হেলাফেলায়। বিলেতের এদিক সেদিক ঘুরতাম। তবে আবহাওয়ার কোনও ঠিকঠিকানা নেই, এই মেঘ এই বৃষ্টি, এই রোদ এই ছায়া। আচমকাই বিনা নোটিশে হাজির হয় ঠাণ্ডা বাতাসের দমকা। বিলেতের পেস্ট্রি-চকলেট বেশ উপাদেয়। তবে  প্রপার ব্রিটিশ মিল কিন্তু বেশ বিস্বাদ। সুপার শপ থেকে আলু-তেল-মুরগি কিনে আনি। অনভ্যস্ততার কারণে রান্নাবান্না করতে বেশ হিমশিম খাই। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, নিঃসঙ্গ সাঁঝে পাচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়াটা ছিল ইচ্ছে-বিরুদ্ধ। রাইস কুকারে বাসমতি চাল ফুটালে বেশ মৌতাত ছড়ায়। এর তুলনায় মাছ-মাংস কুটা-বাছা-ধোয়া বেশ বিরক্তিকর বৈকি। তখনও ইউটিউবের সর্বগ্রাসি আগ্রাসন ছিল না, তাই দূরালাপনিতে কারো কাছ থেকে রেসিপি জেনে নিতাম। কিন্তু রাঁধতে গিয়ে সব গোলমাল হয়ে যায়অনুপান এদিক-সেদিক হয়ে যায়। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের মতো স্বপাক আহার গোগ্রাসে খাইএকাকী, বিষণ্ণ। কাঁচা হাতে পাকানো কারি মুখে দিয়ে মা-বাবার কথা মনে পড়ত খুব। হেঁসেলবাসি মা এসব শুনে কেঁদে কেটে অস্থির। বাবা ফোনে নিদান দেন এভাবে, বিলেতে তো ধানচাষ হয় না, মিঠে পানির মাছও নেই। এক লোকমা খাবার আগে প্রভুর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি যারা ফসল ফলায়, বাজারজাত করে এদের কথাও মনে রেখো। মাঠে ফসল বোনা পর্ব থেকে পাতে উঠার আগ পর্যন্ত অন্তত দেড় ডজন মানুষ শ্রম- ভালোবাসা দেয় এই খাবার জোগানে।  এরপর আর কখনও খাবার নিয়ে অনুযোগ করিনি।

সহপাঠী-বন্ধুরাও উষ্ণ বুকে এগিয়ে এলো। ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হলাম বিলেতি সৌরভে। উকিল-পুলিশের হট্টগোল নেই, টাকাপয়সার চিন্তা নেইমানানসই বৃত্তি পাই। কারণে-অকারণে লন্ডনের অলিগলিতে ঘুরি। চোরা চাহনিতে মানুষজনের দিকে তাকাই। চারদিকে নারীদের আধিক্য। মেয়েদের অবয়বে থই থই করছে যৌবন। গ্রীবা উঁচিয়ে ঠক ঠক করে বুট মাড়িয়ে সুঠাম মেয়েরা পথ চলে। পরিপাটি গৌরীদের নিঃশঙ্ক ও স্বাধীন চলার ভঙ্গী বেশ নজরে পড়ত। এর তুলনায় ছেলেরা যেন খানিকটা আড়ষ্ট। সপ্তাহান্তে পার্টিতে গেলামকী অপরূপ আলোর ঝলকানি। কৃষ্ণাঙ্গী কেউ তীরের মতো কণ্ঠে যৌবনের জয়গান গায়। হঠাৎ করেই কেউ একজন হোঁচট খেলোতার হাতের মদিরাপাত্র ছিটকে পড়ল। কাঁচের টুকরো আর ভূপতিত লোহিত মদে ফ্লোর নোংরা হয়ে পড়ল। বারের লোকজন কেউ বিরক্ত না হয়ে শশব্যস্ত হয়ে জানতে চাইলআর ইউ ওকে? পাথুরে চোখের নারী ম্যানেজার এগিয়ে পিছলে পড়া এক অর্বাচীন যুবাকে হাগ করে ফ্রি পানীয় অফার করলে তাজ্জব বনে গেলাম। আবার এই অপগাণ্ডের এই অযাচিত সৌভাগ্যে খানিকটা আক্ষেপও হলোইস, আমিই যদি উষ্ঠা খেয়ে পড়তামকী যে মজা হতো। লেবানিজ এই ছেলেটিও বলল, একবার গির্জায় ভুলক্রমে সে মোবাইল সাইলেন্ট না করলে সার্ভিসের সময় ফোনের রিংটোন বেজে উঠলে ধার্মিক লোকজন তাকে বেশ বকাঝকা করেছিল। সেই তুলনায় পানশালার আধমাতাল মানুষজন বেশ দরাজ দিল!

যা হোক, ধীরে ধীরে আমার জড়তা কাটতে শুরু করল। লন্ডনের পথে পথে ইতিহাস-ঐতিহ্যের মণি-মাণিক্য তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেই। সহপাঠীদের সাথে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গিয়ে ব্রিটিশ লুটপাটের চিহ্ন দেখি। অবশ্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকগণ তত্ত্ব দিয়েছেন, এটি ছিল বর্বর সমাজের সভ্যকরণের ব্রিটিশ মিশন। উদাহরণস্বরূপ, কবি রুডইয়ার্ড কিপলিং এর বিতর্কিত দ্য হোয়াইটম্যানস বার্ডেন কবিতায় উপনিবেশবাদের নৈতিক জয়গান গাওয়া হয়েছে। অবশ্য উত্তর-ঔপনিবেশিক পণ্ডিতগণ বরাবরই এর বিপক্ষে অজস্র যুক্তি দেখিয়েছেন। স্মর্তব্য, ১৯৭৪ সালে উগান্ডার ইদি আমিন বৃহৎ আসনে বসে চারজন শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীকে বাধ্য করেণ তাঁকে কাঁধে নিয়ে রাজধানি কাম্পালার রাস্তায় পদক্ষিণ করতে। বিগম্যান আমিনের ছিলেন শরীর-স্বাস্থ্যে ভারী মানুষ। কায়িক শ্রমে অনভ্যস্ত শ্বেতকায় বাহকগণ গোঙাতে শুরু করলে উৎসুক সাংবাদিকদেরকে ইদি আমিন হেসে বললেন, এটাই হোয়াইটম্যানস বার্ডেন। বেশ বিদঘুটে উদাহরন বৈকি। 

লাইব্রেরিতে বসে বইয়ের পাতা উল্টাই, জ্ঞানের যে কত নদী-সরোবর। কতো সব বই-পুস্তকের সারি। রয়েছে অনলাইনে বিশ্বের বিখ্যাত সব পাঠাগারের সাথে সংযুক্তি। সবুজ লনে বসে বন্ধুদের সাথে রাজা-উজির মারি। কখনও আমাদের আড্ডা জমে যায় কুইন মেরি ইউনির সবুজ চত্বরে। আমি রাজকীয় বৃত্তিপ্রাপ্ত শুনে এক সহপাঠিনী একদিন বলল, সম্ভবত সাবেক কালের ঔপনিবেশিক শোষণের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত এ মেধাবৃত্তি। এই স্কলারশিপ কি গরু মেরে জুতাদানের উদাহরন নয়? মেধাবী তন্বীর কথায় দ্বিমত পোষণ করাটা বোকামির পর্যায়ে পড়ে। ভারতীয় ছেলে সিদ্ধার্থ উপমা দিলো এভাবে, এটা অনেকটা লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশিরের মতন।  

আমিও হোয়াইটম্যানদের কীর্তিকলাপ দেখতে প্রায়শই ঘুরতে বেরুই। কখনও একাকী হাঁটতে যাই টেমসের পাড়ে হাওয়া খেতে। ওয়েস্টমিনস্টার এবিতে গিয়ে কলোনিয়াল প্রভুদের হাজার বছরের রাজা-রাজন্য, কবি-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী-সমরবিদ, দার্শনিক-যাজকদের পরিপাটি সমাধী দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই। কখনও বা মখমলের মতো সবুজ পার্কে বসে আড্ডা মারি- কাঠবিড়ালিকে চিনাবাদাম ভেঙে খাওয়াই। ব্রিটিশদের দেখাদেখি জোরসে কদমে হাঁটি। যদিও বৈকালিক ভ্রামণিকদের সঙ্গী বিশাল বিশাল কুকুর দেখে ডর-ভয় আলগোছে লুকিয়ে রেখে ব্রিটিশ ভব্যতা অনুযায়ী হাসিহাসি মুখ সাজিয়ে রাখি। ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে বসে অন্যদের দেখাদেখি এস্প্রেসো কফিতে চুমুক দিইনিম তিতা এর কাছে নস্যি, নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসার উপক্রম। আশপাশে সোনালি বা কোঁকড়ানো চুলের উচ্ছল ললনারা বসে আছে। বাঙালি এই যুবক বেশ হাবভাব নিয়েই তিতা কফি গিলে ফেলি।

লাইব্রেরিতে বসে বইয়ের পাতা উল্টাই, জ্ঞানের যে কত নদী-সরোবর। কতো সব বই-পুস্তকের সারি। রয়েছে অনলাইনে বিশ্বের বিখ্যাত সব পাঠাগারের সাথে সংযুক্তি। সবুজ লনে বসে বন্ধুদের সাথে রাজা-উজির মারি। কখনও আমাদের আড্ডা জমে যায় কুইন মেরি ইউনির সবুজ চত্বরে। আমি রাজকীয় বৃত্তিপ্রাপ্ত শুনে এক সহপাঠিনী একদিন বলল, সম্ভবত সাবেক কালের ঔপনিবেশিক শোষণের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত এ মেধাবৃত্তি। এই স্কলারশিপ কি গরু মেরে জুতাদানের উদাহরন নয়? মেধাবী তন্বীর কথায় দ্বিমত পোষণ করাটা বোকামির পর্যায়ে পড়ে। ভারতীয় ছেলে সিদ্ধার্থ উপমা দিলো এভাবে, এটা অনেকটা লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশিরের মতন। এবার সে যা বলল তা শুনে আমরা লা-জওয়াব। ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে এক সময় এদেশীয় লুট শব্দটা নাকি এক সময় এতই পছন্দ হয়ে যায়, কালক্রমে অক্সফোর্ড অভিধানে এটি ইংরেজি শব্দ হিসেবে ভুক্ত হয়। পাকিস্তানি তরুণ খুররাম বলল, টাওয়ার অব লন্ডনে প্রদর্শিত বিখ্যাত কোহিনুরও নাকি লুণ্ঠিত সম্পত্তি! কথাটার সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করতে আমরা দলবেঁধে এই জগৎবিখ্যাত হীরকশোভিত রাজমুকুট দেখতে এসেছি। এর ঠিকুজি-মালিকানা এসব নিয়ে সহপাঠীদের মাঝে রীতিমত কপট-ঝগড়া বেঁধে যায়। দিল্লিবাসি শাগুন জৈনের হাসি ভুবনবিখ্যাত না হোক, অন্তত আমাদের ক্যাম্পাস-বিখ্যাত। সে তার মশহুর হাসি হেসে বলল, ইরান, আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান এই হিরে দাবি করে বসেছে।  কে যেনো ব্যঙ্গস্বরে মন্তব্য করল, এটা নিয়ে ইংল্যান্ডের আদালতে একটা বাটোয়ারা মামলা জুড়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়! আমি বেকুবের মতো একটা প্রশ্ন ছুড়লাম, এই কোহিনুর হিরে নিয়ে যে এতো ঝগড়া- ফ্যাসাদ, এর মূল্য কত? দিল্লিওয়ালি তরুণী বলল, এই সাওয়াল কিন্তু যুবরাজ হুমায়ুন করেছিলেন এর মালিক বাদশাহ বাবরকে। বলা দরকার, মালওয়ার রাজার কাছ থেকে এই হিরে  মোঘলদের অধিকারে আসে। আমি টিপ্পনী কাটলাম, ফুলস থিঙ্ক এলাইক, দেখো, যুবরাজ হুমায়ুন আর আমার চিন্তায় কোনো ফারাক নেই। শাগুন নাটকীয়ভাবে কুর্নিশ করে চোস্ত হিন্দিতে জানিয়ে দেয়, সম্রাট বাবর শ্মশ্রুতে আঙুল চালিয়ে জবাব দিয়েছিলেন, এই হীরের মূল্য দিয়ে সারা দুনিয়ার সকল মানুষকে দুইবেলা আহার করানো যাবে। উপমহাদেশীয়রা সমস্বরে বলে উঠল, মারহাবা, মারহাবা। এই শোরগোলের এক আফগানি হায়দরি হাঁক দিলো, অপূর্ব, এই বুঝি কোহিনুরআলোর পাহাড়!

ব্রিটিশ সহপাঠী এমি মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিল। অবশ্য নিশ্চুপ আদবকেতায় অতি পরিশীলিত বলে এদের মনের গহন আটলান্টিকের মতই গভীর ও অগম্য। এরা উচ্ছল হয় কারণে- অকারণে। ব্রিটিশদের অন্তরে কিসের ঘূর্ণন চলছে তা সহসায় টের পাওয়া যায় না। হঠাৎ করেই এমি স্পষ্টস্বরে বলল, কোহিনুরের মূল মালিক ছিল ভারতের স্থানীয় রাজা যা পরে মুঘলরা অধিগ্রহণ করেন, এতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে বিজয়ী নাদির শাহ এক সময় যুদ্ধলব্দ মাল হিসেবেই এটি দিল্লি থেকে পারস্যে নিয়ে যান। এটি যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের পরিক্রমায় এক সময় আফগানিস্তান হয়ে খালসা রাজা রণজিৎ সিংহের দখলে আসে। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফৌজ পাঞ্জাব অধিগ্রহণ করলে লাহোর চুক্তির বরাতেই কোহিনুর কোম্পানির কব্জায় আসে।পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আড়াই শ বছর পূর্তি উপলক্ষে মহারানি ভিক্টোরিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ কোহিনুর উপহার প্রদান করা হয়। সে গুগল করে দেখিয়ে দিল চুক্তির প্রাসঙ্গিক ধারা: শাহ সুজা উল মূলকের কাছ থেকে লাহোরের মহারাজা রণজিৎ সিং-এর হস্তগত কোহিনুর মুকুটটি অত্র চুক্তির মর্মমতে ইংল্যান্ডের মহারানির কাছে সমর্পণ করা হবে।

উপমহাদেশীয়রা অনেকে ঢোঁক গিলল। নির্ভীক শাগুন রীতিমত কোমর বেঁধে এগিয়ে এলো। শ্রেষ্ঠীকন্যা শাগুন আন্তর্জাল হাতড়ে আঙুল গুনে গুনে মনে করিয়ে দেয় কলোনিয়াল শোষণের খতিয়ানইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ সালে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। এর মাত্র চার বছরের মাথায় কোম্পানির দ্বৈতশাসনে বাংলায় ১ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায়। ১৯৪৩ সালে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বাংলার সব শস্য ইংরেজরা বিভিন্ন দেশে যুদ্ধরত সৈনিকদের জন্য ও ব্রিটেনে পাঠিয়ে দিলে ভয়ানক দুর্ভিক্ষে এদেশের অন্তত ৩০ লাখ মানুষ মারা যায়। গবেষক উৎস পাটনায়েক দেখিয়েছেন যে, বিরাট ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়া ছাড়াও ১৯০ বছরের ব্রিটিশরা লুট করেছে মাত্র ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার! 

রাজকীয় পার্ক, লন্ডন

টাওয়ার অব লন্ডন ছেড়ে আমরা গড্ডালিকা প্রবাহের মতো ব্রিটিশ মিউজিয়ামে হাজির হলাম। ভারতীয় মেয়ে সাগুন আগে আগে চলে। বিনে টিকেটে জাদুঘরে প্রবেশ করে হচকচিয়ে গেলাম। এই অপূর্ব সংগ্রহশালায় কতসব স্মৃতিচিহ্ন থরে থরে সাজানো। এক ফাঁকে পাথুরে থামে হেলান দিয়ে অনলাইন আসক্ত স্মার্ট সাগুন গোমড়ামুখি হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েই বসলব্রিটিশ মিউজিয়ামের সিংহভাগ নিদর্শন চোরাই মাল, যা ব্রিটিশ প্রণীত পিনাল কোড ১৮৬০ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধরিসিভার অব স্টোলেন প্রপার্টিসাজা তিন বছরের জেল! আইনের ছাত্র হলেও আমি অতোটা তলিয়ে দেখিনি। তবু মাথায়  যুক্তি এলো, আমার মাথায় যদি আপনি বন্দুক ধরে থাকেন, আমি আমার মানিব্যাগটি উপহার দিয়ে দিতেই পারি! কিন্তু তার মানে কী বন্দুকটা সরিয়ে নেওয়ার পরও আমি আর সেটা ফেরত চাইব না! ব্রিটিশ তরুণী এমি রয়ে সয়ে শুধরিয়ে দেয়, এই জাদুঘরের এসব জিনিসপত্র লুণ্ঠিত নয়, বরং সংগৃহীত করে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

সফেদ তরুণী এমি চোখের তারা স্থির করে শাগুনের দেয়া ৪৫ ট্রিলিয়ন লুটের তথ্য ও এখনকার তির্যক মন্তব্য নিঃশব্দে গলাধকরণ করছিল। ঝড়ের পূর্বাভাস। ভারতীয় নাছোড়বান্দা আর গোরা তরুণীর মাঝে কি চুলোচুলির উপক্রম? অবশ্য ব্রিটিশ তরুণীর ববকাট ছোট চুল। চুলোচুলি হবার সুযোগ নেই দেখে আশ্বস্ত হলাম। অন্যরাও গলা চড়াল বলে। ক্লাস প্রতিনিধি হিসেবে আমি সবাইকে নিরস্ত করে বললাম, আজকের দিনটা আমার জন্য বেশ আনন্দের। আমি বড় হয়েছি গাঁও-গেরামে। সোনা-চান্দির গয়নাগাটি দেখলেও আজ প্রথম এতো কাছ থেকে নিজ-চোখে ডায়মন্ড দেখলাম। তাও আবার রাজমুকুটে আঁটা ঝলমলে কোহিনুর! আমি ধন্য। সবাই হই হই করে ছেঁকে ধরল, চলো, সবাই মিলে সেলিব্রেট করি। আইসক্রিম বারে যাবার পথে আমি শোনালাম হীরে নিয়ে রঙ্গ

ভ্যালেন্টাইন দিবসের সকালে ঘুম ভেঙে আহ্লাদী স্ত্রী স্বামীকে বললেন, ওগো, শুনেছ, রাতে আমি না একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমার গলায় ইয়া বড় ডায়মন্ডের নেকলেস। বলো তো এই স্বপ্নের মানের কী? স্বামী মুচকি হেসে বললেন, বাহ, খুব সুন্দর স্বপ্ন। স্বামী তড়িঘড়ি করে অফিসে চলে গেলেন। বিকেলে ফিরে স্বামী অপেক্ষমাণ স্ত্রীর হাতে একটা ফুলের তোড়া, এক বক্স চকলেট আর ছোট্ট একটা মোড়ক উপহার দিলেন। স্ত্রী আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভাবলেন, স্বামী আমাকে এতো ভালোবাসে? কী যে বোকা আমি! এতোদিন একটুও বুঝিনি। স্বামী ফ্রেশ হওয়ার সময় স্ত্রী ওই মোড়ক খুলে দেখেন, ভিতরে স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার পুস্তিকাসহি সোলেমানি খাবনামা। বলা বাহুল্য, বেচারা স্বামীকে ওই রাত শয়নকক্ষের বাইরে সোফায় কাটাতে হয়েছিল। 

ভ্যালেন্টাইন দিবসের সকালে ঘুম ভেঙে আহ্লাদী স্ত্রী স্বামীকে বললেন, ওগো, শুনেছ, রাতে আমি না একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমার গলায় ইয়া বড় ডায়মন্ডের নেকলেস। বলো তো এই স্বপ্নের মানের কী? স্বামী মুচকি হেসে বললেন, বাহ, খুব সুন্দর স্বপ্ন। স্বামী তড়িঘড়ি করে অফিসে চলে গেলেন। বিকেলে ফিরে স্বামী অপেক্ষমাণ স্ত্রীর হাতে একটা ফুলের তোড়া, এক বক্স চকলেট আর ছোট্ট একটা মোড়ক উপহার দিলেন। স্ত্রী আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভাবলেন, স্বামী আমাকে এতো ভালোবাসে? কী যে বোকা আমি! এতোদিন একটুও বুঝিনি।

তবে গোপনে বলে রাখি, ঔপনিবেশিকতা নিয়ে অল্প-বিস্তর পড়েছি। ব্রিটিশ সহপাঠীর দাবির বিপরীতে অপ্রতুল পাল্টাযুক্তি রয়েছে। লাহোর চুক্তি কী স্বাধীন সম্মতিতে হয়েছিল, না কি কোহিনুর প্রদানে স্থানীয়দের বাধ্য করা হয়েছিল তা আইন আর পারিপার্শ্বিক ঘটনার প্রশ্ন। তামাদির প্রশ্নও আসবে অনিবার্যভাবেই। রাজবৃত্তিপ্রাপ্ত বলে এসব বিষয়ে বেশি তর্ক করলে নিমকহারামির মতো শোনায় কী না, তাই আর কথা না বাড়িয়ে নিশ্চুপই রইলাম। এছাড়া আরও একটি গুঢ় হেতু আছেএই গোরা যুবতীর সাথে চিনাবাদাম খেতে খেতে মাঝে মাঝে লন্ডনের এদিক সেদিক ঘুরি। তার মহার্ঘ্য-সঙ্গ আমি এখনই হারাতে চাই না।

আইসক্রিম খেয়ে অন্যরা যে যার মতো চলে গেলে উদ্যানে বসে ব্রিটিশ সহপাঠী ককনি উচ্চারণে জানিয়ে দেয় কোহিনুরে ঠিকুজি। এই কোহিনুর হিরে তো চির-অভিশপ্ত। ভারতের কৃষ্ণা নদের অববাহিকায় প্রাপ্ত এই অনিন্দ্যসুন্দর রত্নের সাথে শুধু মাধুর্য নয়, জড়িয়ে আছে লোভ, লুণ্ঠন, হানাহানির ইতিহাসও। যেমন, মালওয়ার রাজা এই রত্নের প্রভাবে যুদ্ধে গোহারা হারলেন। কোহিনুরে নতুন মালিক হলেন মোঘলসম্রাট  বাবর।  এর ছোঁয়ায় বাবরও রাজ্যহারা হয়ে অনেক বছর পথে পথে ঘুরলেন। একসময় এই হিরে শোভিত হলো সম্রাট শাহজাহানের বিখ্যাত ময়ূরসিংহাসনে। আমি প্রশ্ন করলাম, এই কুহকী পাথরের কারণেই কি শাহজাহান শেষ জীবনটা বন্দীদশায় কাটালেন? সহপাঠী হেসে বলে, শুদ্ধাচারী আলমগীর হীরে-জহরতের সংস্রব এড়িয়ে দীর্ঘদিন নির্বিঘ্নে বাদশাহি করলেন। বাদশাহ আলমগীরের পরের প্রজন্ম এই হিরের প্রভাবেই কী না ছন্নছাড়া হলো, এমনকি তলওয়ার চালাতেও ভুলে গেল। আফগান শাসক নাদির শাহও কোহিনুর লুণ্ঠন করে এক সময় ঘোরবিপদে পড়েন, এমনকি খুন পর্যন্ত হন। এরপর আহাম্মদ শাহ আবদালির বরাতে এই রত্ন লাহোরের রাজা রণজিৎ সিংহের হাতে  আসে। আমি প্রশ্ন করলাম, ব্রিটিশ সিংহের থাবায় তার মসনদও তো তছনছ হলো। কিন্তু রানী ভিক্টোরিয়া তো এই মুকুট পরেই জগতজুড়ে রাজত্ব করলেন, তাই নয় কি? এই রক্তহীরার তুকতাক কি বিলেতে অচল? এমি চোখের পাপড়ি দুলিয়ে বলল, এসব পাতকী ইতিহাস জেনে রানী ভিক্টোরিয়া [১৮৩৭-১৯০১] জ্যোতিষীর পরামর্শে হীরাটিকে নতুন ধাঁচে কেটেকুটে মুকুটে এঁটেছিলেন। বৃদ্ধ জ্যোতিষী এই হিতোপদেশও নাকি দিয়েছিলেন, কোহিনুর শুধু নারীর কাছেই শুভ, কোন পুরুষ একে ছুঁলেই তার সর্বনাশ হয়ে যাবে। রানি ভিক্টোরিয়ার পর এই হীরে পরেন কুইন কনসর্ট ম্যারি এবং আলেকজান্দ্রা। আর সর্বশেষ এই হীরে শোভা পেয়েছে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শিরে- ১৯৫৩ সালে। সত্যিই তো, এই কোহিনুর কুসংস্কারাচ্ছন্ন পুরুষ রাজারা কখনই পরিধান করেননি। আমি বললাম, দেখা যাবে, রাজা হলে চার্লস সাহেব এই ভোজবাজির হীরে ছুঁয়ে দেখেন কী না। বলা বাহুল্য, শুধু চার্লস নন, স্বয়ং কুইন কনসর্ট ক্যামিলাও রাজার অভিষেকে কোহিনুর পরা থেকে বিরত থাকেন। মনে পড়ল কোহিনুর নিয়ে রচিত জীবনানন্দের স্তবক

তোমারে ঘেরিয়া জাগে কত স্বপ্ন–স্মৃতির শ্মশান,
ভুলুণ্ঠিত লুব্ধ অভিযান;
সাম্রাজ্যের অশ্রু, রক্ত, সমাধি, পতন
হে হীরক, একে একে করেছ চুম্বন!
স্পর্শে তব অনাদি অতীত যেন নিরন্তর মর্মে ওঠে ধ্বনি!
মাধবের বক্ষে তুমি ছিলে কি গো স্যমন্তক মণি!

রাতের বেলায় ঝলমলে বাকিংহাম প্যালেস

এই পংক্তিমালা অনুবাদের চেষ্টায় যেন রীতিমত ঘামিয়ে উঠি। সামনের বনস্পতির আগায় আগায় সোনালি ঝিলিকের মতো কিছু দেখি- বিদায়ী সূর্য লজ্জাতুর ঘোমটা টেনে বুঝি নিজ ঘরে ফিরছে! বিস্তৃত ডানায় হলদে রোদ মেখে পাখিরা উড়ে যায় এদিক-সেদিক। ঘড়ির কাটায় এখনও দিনের অনেকটাই নাকি, তবু দিনমণি একদম  নিস্তেজ হয়ে ঝাউবনের লোমশ গায়ে বিদায়ী পরশ দেয়। উদ্যান-জুড়ে ফিনফিনে হাওয়া বয়। ঘন পত্র-পল্লবের শামিয়ানায় চারপাশ বেশ ছায়াচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। সুনিবিড় নিসর্গ থেকে বনজ গন্ধ ভেসে আসে। বাতাসে উড়ে এসে কয়েকটা মুকুটরূপি মেপল পাতা বাকিংহাম প্যালেসের দ্বারে থামল। বলে রাখি, এটি ব্রিটিশ রাজার আবাসস্থল ও অফিস। অস্তায়মান সূর্যের ম্রিয়মান তীর ঠিকরে ঠিকরে পড়ে রাজবাড়ির থামে- দেয়ালে, ঘাসের গালিচায় কিংবা ধূসর পাতায়। সোনালি আলো মরে গেলে চারপাশে হিমহিম ধূসরতা নেমে আসে। বুঝতে পারছি, পারদের হিমাংক নিচে নেমে যাচ্ছে। দিনের শেষ আভা কী রাজপ্রাসাদের দেয়ালে-থামে-খিলানে মায়াবী অরুণ ছড়িয়ে দিল? সন্ধ্যার নিঝুম বিষন্নতা ছাপিয়ে অদূরে কোথাও পাখি ডেকে উঠল বিশ্রীস্বরে। রাজকীয় প্রাসাদের খোপে খোপে জ্বলে উঠেছে সেকেলে প্রদীপ। প্রাসাদের বহির্ভাগে সর্বগ্রাসি দীপশিখা কাঁপতে শুরু করেছে দপদপিয়ে। উজ্জ্বল আলোয় চারপাশ ছেয়ে যাচ্ছে। ঘোরলাগা চোখে দেখছি কী কোনো মায়াময়-জতুগৃহ? সোনার কেল্লার পাশে দণ্ডায়মান গোরা সহপাঠিনীও যেনো হয়ে গেছে সোনার মূর্তি!  মোলায়েম শিশির বা বৃষ্টির গুড়ো এসে নাকে মুখে লাগে। হিমেল বাতাসের ঝাপটায় কলিজা বুঝি ঠাণ্ডা হবার উপক্রম! দুষ্টমতি বন্ধু কনুই দিয়ে আলতো গুঁতো দিলে সম্বিত ফিরে পাই। এই ঝলমলে ঘরের বাসিন্দাদের আদেশে নিদারুণ শাসন-শোষণ চলছিল তল্লাটে তল্লাটে। গলায় বিরক্তিকর বুকজ্বলা ঢেঁকুরের মতো উগড়ে আসেনিউরনে ধ্বনিত হয় ভারতীয় সহপাঠীর দেয়া তথ্য৪৫ ট্রিলিয়ন! লুটপাট! এমি মরাল হাতে পানির বোতল বাড়িয়ে দিয়ে ব্রিটিশ ভব্যতা নিয়ে কোমলস্বরে বলল, আর ইউ ওকে?  দূরে কোথাও গির্জার ঘণ্টা বেজে উঠল- টং, টং, টং।