ভাষার বি-উপনিবেশায়ন: বাঙালির ভয়টা কোথায়?

অ+ অ-

 

বাংলাদেশ’-এর রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত ইতিহাস। ভাষার নামকে ভিত্তি করে গঠিত জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। আর জাতিরাষ্ট্রের আত্মপরিচয়ে প্রয়োজন তার নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্য। কিন্তু এ জনপদ আজ অতীতচ্যূত শেকড়হীন বিচ্ছিন্ন এক জনপদ। যা ইউরোপীয় সংস্কৃতি, শিক্ষা ও ধর্মীয় বাস্তবতা নির্ভর। বাংলাদেশের বর্তমান এ বাস্তবরূপের পিছনে কারণ কী? এককথায় উত্তর ইউরোপীয় উপনিবেশ শক্তি। কারণ উপনিবেশি শক্তিই শোষণ-শাসন, শিক্ষা-সংস্কৃতি আধিপত্য দিয়ে বাঙালিকে ঐতিহ্যহীন করেছে। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সারা বিশ্বের উপনিবেশমুক্ত বা পরিত্যক্ত দেশগুলোতে প্রায় একই ধরনের অবস্থা দেখা গেছে। তাহলে করণীয় কী? উপনিবেশের জারিত প্রকল্পগুলো পরিত্যাগ করে হাজার বছরের বহমান ঐতিহ্যবাহী ধারার বিকাশ না হলে জাতীয় আত্মপরিচয় সৃষ্টি সম্ভব নয়।  

বাংলাদেশ থেকে উপনিবেশ শাসন বিলুপ্ত হয়েছে দীর্ঘদিন। কিন্তু উপনিবেশের করণকৌশল, পরম্পরা বা কার্যবৃত্তি এখনো সমভাবেই জারিত বা কার্যকর। সেজন্য উপনিবেশ ধারণাটি একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। বসতি স্থাপন অর্থে উপনিবেশ শব্দটি শাব্দিক অর্থ নির্দেশ করলেও এ প্রত্যয়টি শাসন-শোষণ, আধিপত্য, মানস-সংস্কৃতি কিংবা অনুকৃতিমূলক বিষয়াদির সঙ্গে জড়িত। যা স্থায়ী বসতিদের পরিপন্থি। উপনিবেশ বা সাম্রাজ্য এক নয়। উপনিবেশ শাসন-শোষণের সঙ্গে আধিপত্যবাদ, ভিন্ন সংস্কৃতিকরণ, মানস পরিবর্তন, লুণ্ঠন, পাচার প্রভৃতি ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। উপনিবেশকে সাধারণত দুভাগে দেখা যেতে পারে। প্রথমত-বস্তুগত বা দৃশ্যত উপনিবেশ এবং অন্যটি অবস্তুগত বা দৃশ্যগ্রাহ্যহীন উপনিবেশ। বস্তুগত উপনিবেশের সঙ্গে শাসন শোষণ শব্দটির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ থাকলেও অবস্তুগত উপনিবেশের সঙ্গে অনুকৃতি মানস সংস্কৃতিপরনির্ভরশীলতার সম্পর্ক। সেজন্য অবস্তুগত উপনিবেশ অত্যন্ত ভয়ংকর ও সুদূর প্রসারী ক্ষতিকর। কেননা অবস্তুগত উপনিবেশের সঙ্গে জ্ঞানতাত্ত্বিক, আধ্যাত্মিক, মানস পরিবর্তন, মানস সংস্কৃতি ও অনুকৃতি ইত্যাদি জড়িত। সাম্প্রতিক বিশ্বে উপনিবেশ-উত্তর জ্ঞানকাণ্ড বা ভাবনা বলতে উপনিবেশ বিরোধী জাতীয় সংস্কৃতির জাগরণমূলক কার্যক্রমকে নির্দেশ করেন। বিশ্বে উত্তর-উপনিবেশবাদকে counter discourse হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।

চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে ইউরোপীয়দের সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতার মূল কারণ ছিল দুটোএক, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অন্যটি ধর্মান্তরকরণ। যারা ইউরোপ-বর্হিগামী হতো তাদের বেশির ভাগই ছিল ইউরোপের দাগি আসামী এবং সাথে থাকতো মিশনারি পাদরি বা ধর্মযাজকগণ। এরা ব্যবসা বাণিজ্যের নামে লুণ্ঠন করতো। এদের অত্যাচারে  ১৬৬৬ সালের দিকে সম্রাট শাহজাহান যখন অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তখন খ্রিষ্টান ধর্মযাজক জে কাবরাল সম্রাটের প্রতি তাচ্ছিল্যের স্বরে মন্তব্য করেছিলেনসম্রাট নিশ্চয় ভয় পাচ্ছেন ভারতবর্ষ না জানি বেদখলেই চলে যায়। শুরুর দিকে উপনিবেশের বসবাসের ঘাঁটি ছিল গোয়া, হুগলী, পরে কৃষ্ণনগর, শ্রীরামপুর, কলকাতা, ঢাকা ও চট্টগ্রাম। ১৬১৫ খ্রিষ্টাব্দে মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরকে যাজক টমাস রো নানা কৌশলে সন্তুষ্ট করিয়ে প্রথম স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছিল। যা হোক, প্রাচীন কাল থেকেই এদেশ ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ।  পর্যটক হিউয়েন সাঙের মন্তব্যে ভারতবর্ষ ছিল প্রচুর সমৃদ্ধশালী, লোকজন বিদ্যানুরাগী, স্বভাব ভদ্র, উন্নত রুচিশীল। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের বাংলাকে মিশরের চেয়েও সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী বলে উল্লেখ করেছেন। ১৬২৮ বা ১৬২৯ সালে খ্রিষ্টান ধর্মযাজক সেবাস্টিন মানরিকের বক্তব্যের মধ্যে ভারতবর্ষ স্বনির্ভর, স্বাস্থ্যকর, প্রচুর ফলনশীল ও পোশাক শিল্পসহ নানাদিকে সমৃদ্ধের তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু এদেশ ইউরোপীয়দের হস্তগত হবার পর পরবর্তী উপস্থাপনা ছিল পুরোপুরি ভিন্ন; ইতিহাস-ঐতিহ্যহীন, দরিদ্র, অসভ্য ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের। 

১৭৫৭ সালে মীর জাফর আলী খানকে পুতুল নবাব বানালেও ১৭৬৫ সালে বক্সারের যুদ্ধের মধ্যদিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে হস্তগত করে। বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন গর্ভনর হোন ওয়ারেন হেস্টিং (১৭৭২১৭৮৫ কালপর্ব)। এর আমলেই শুরু হয় নতুন ইতিহাস, নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা, ইউরোপীয়করণ। মুসলমানদের ধর্মশিক্ষা দেবার জন্য খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের নেতৃত্বে চালু হয় কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা। এসময় সৃষ্ট কৃত্রিম দুর্ভিক্ষে বাংলা অঞ্চলের এক তৃতীয়াংশ লোক না খেয়ে মারা যায়। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এসময় জ্ঞানচর্চার জন্য উইলিয়াম জোন্সের নেতৃত্বের এশিয়াটিক সোসাইটি গঠিত হয়। ১৭৮৬১৭৯৩ লর্ড কর্নওয়ালিসের সময় নানাভাবে মুসলমানদের অবদমন করা হয়। খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে চিরস্থায়ী ভূমি বন্দোবস্ত করা হয়। ১৭৯৮১৮০৫ পর্বে লর্ড ওয়েলেসসি ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণের রাখতে এবং ব্রিটিশদের সর্বোচ্চ শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার পদ্ধতি গড়ে তুলে। এসময় চালু হয় ফোর্ড উইলিয়াম কলেজ।  এসবই এদেশীয় মানুষের ঐতিহ্যবাহী বোধ-বিশ্বাস-ইতিহাসকে অবদমন করে সৃষ্টি হতে থাকে ইউরোপীয়দের আধিপত্য নির্ভর ইতিহাস, তাদের মতো সংস্কৃতি ও তাদের গোলাম বানানোর শিক্ষাপদ্ধতি। ধীরে ধীরে সুসমৃদ্ধ শিল্পোন্নত বাঙালি জাতি পরিণত হয় ইতিহাস-ঐতিহ্যহীন হীনম্মন্য ভুখা নাঙ্গা অসভ্য বর্বর জাতি হিসেবে। সে সময়ের মুর্শিদাবাদ কেমন সমৃদ্ধ ছিল? ক্লাইভ কেমন দেখেছিল? তা নানা বইতে উল্লেখ আছে। আমরা সে প্রসঙ্গে না যাই।

বাংলা ব্রিটিশদের হস্তগত হবার পর তৎকালে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসবিদ আলবিরুনি, সদরউদ্দীন হাসান নিজামী, মিনহাজ--সিরাজ, জিয়াউদ্দিন বারানী, খাজা নিজামুদ্দিন, মুহাম্মদ কাসিমের তথ্যগুলোকে পরিত্যাজ্য মনে করেন। কিন্ত ইতিহাসকারদের কারো তথ্য না নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়ার কোম্পানির গর্ভনর ওয়ারেন হেস্টিং সিরাজউদ্দৌলার কর্মচারী গোলাম হোসনে নিয়ে প্রথম ইতিহাস তৈরি করান। এই ইতিহাসেই প্রথম সিরাজউদ্দৌলাকে কলঙ্কিত করা হয়। এরপর ইতিহাস তৈরিতে এগিয়ে আসেন ইংরেজ লেখক। কিন্তু এসব তথ্যে মুসমানরা ঐতিহ্যহীন। ১৮১৭ সালে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ দ্য ব্রিফ হিস্টি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া নামে যে ইতিহাসগ্রন্থ রচনা করেন তা সম্পূর্ণ ইউরোপীয় ফরমেটে যুগবিভাজন ও কন্টেন্ট বিশ্লেষণ। বাংলাদেশের সামাজিক পরবর্তনকে তথ্যবদ্ধ করেন ইউরোপীয় সময় ও টুলস দিয়ে। ফলে অন্ধকারযুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক খ্যাত অধ্যায় কল্পনার সৌধ ছাড়া কিছুই ভাবা যায় না। ব্রিটিশরা কখনো পর্যালোচনা করে নাই ঠিক ঐ সময়টাকে আমাদের এখানে অন্ধকারযুগ বা আধুনিক যুগ বলা যায় কী না? আর সদরউদ্দীন হাসান নিজামী থেকে শুরু করে প্রায় শতাধিক আরবি-ফারসি-বাংলায় লেখা ইতিহাস তথ্যকে উপেক্ষা করা হয়েছে সে গ্রন্থে। এ প্রসঙ্গে মাসুদ ইমরান তার গবেষণায় দেখান যে, উপনিবেশরা কৌশলে এ উপনিবেশিত বাঙালি জাতিকে বর্বর, ইতিহাসহীন বা সংস্কৃতিহীন পরিচয়ের হীনমানসিকতা তৈরি করে। উপনিবেশিত বাঙালি জাতিকে নিশ্চিত করে যে, যদিও কিছুটা ইতিহাস আছে তবুও সেটা পশ্চাৎপদ, অনুপযোগী, অর্থহীন কিংবা বর্বর। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আফসোস করতেন—‘এ দেশের ইতিহাস নাই, ইতিহাস লিখিতে হইবে সে কারণটা ছিল কী। আর লিখিত ইতিহাসটাই কী। তা মূলত হিন্দু ঐতিহ্যের জাগরণবাদী ইতিহাস। সেসময় ধূয়া উঠতো মুসলমানের লেখা ইতিহাস যে মানিবে সে বাঙালি না। তাহলে বাঙালির আত্মপরিচয়ে কী লিখিত ছিল? বাঙালি মানে হিন্দু ঐতিহ্যবাদী কল্পিতসত্তা। নিখিলচন্দ্র নাথ তার বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন মুসলমানদের পরাজয়ের কথা লিখিতে পারিতেছি বলিয়া গৌরববোধ করিতেছি। একজন ইতিহাসকারের কী ভয়ংকর কথা। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, রজনীকান্ত চক্রবত্তী, নিখিলনাথ রায়, নগেন্দ্রনাথ বসু এমনকি অধুনা আরসি মজুমদার প্রমুখ ইতিহাসকার পূর্বোক্ত মুসলিম শাসনকালীন ইতিহাসকারদের গ্রন্থ থেকে কোনো তথ্য-উপাত্ত না নিয়েই নিজেরা তৈরি করেছেন পুরাণের কল্পিত তথ্য নির্ভর সাম্প্রদায়িক ইতিহাস। যা আমাদের পড়ানো হয়।

ধীরে ধীরে অতীতের সুসমৃদ্ধ বাংলাকে বিশ্বে পরিচিত করে তুলে দুর্ভিক্ষপীড়িত, ভূখা-নাঙ্গা ভিক্ষুকের দেশ হিসেবে। ইংরেজরা বাংলার লাভজন ঐতিহ্যবাহী শিল্পসমূহকে ধ্বংস করে দিয়ে পাশ্চাত্যের কাঁচামালের আড়তে পরিণত করে। এখান থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে বিলাতে পাঠাতো আর বিলাতে থেকে সেসব পণ্য প্রস্তুত করে এদেশে এনে এদেশীয়দের কাছেই চড়া দামে বিক্রি করতো। এভাবে শিল্পসমৃদ্ধ বাংলা হয়ে উঠে কৃষিনির্ভির।  ঔপনিবেশিক শোষণের সুবিধার্থে ইংরেজরা গড়ে তুলেছিল নগর এবং নগর কেন্দ্রিক এক নতুন ভারতীয় সমাজ। সেই সমাজের অঙ্গ ছিলো ব্যবসাদার, ঠিকাদার, দালাল, মহাজন, কেরানী প্রভৃতি পরজীবী শ্রেণী। সে সময় শহরের সম্পন্ন মধ্যবিত্ত গৃহে নিজেদের বিলাস ব্যসনের জন্য গড়ে তুলছিল বাবু কালচার। উপনিবেশের শিক্ষাবিদ মেকলে ভারতের সমস্ত মানুষকে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করার স্বপ্ন দেখতেন। হাজার বছরের ভারতীয় শিক্ষাচিন্তাকে অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য করে যাজক এডাম স্মিথের শিক্ষা জরিপকে কেন্দ্র করে ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ আদলে ভারতের নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন। ম্যাকাওল বা মেকলের শিক্ষা তত্ত্বের মূল সুরটি ছিলভারতীয়রা দেহে হবে ভারতীয় কিন্তু আত্মায় হবে ইউরোপীয়। ওই সময় উপনিবেশ অনুকৃত বুদ্ধিজীবীরা পূবার্পর চিন্তা না করেই এটাকে উচ্চতর আদর্শ হিসেবে যৌক্তিকতা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আধিপত্য ও ক্ষমতার সুযোগে বাংলার অসংখ্য জ্ঞান ও চিন্তাধারাকে ইউরোপীয়রা আত্মস্থ করে সেগুলো এদেশেই ইউরোপীয় তত্ত্ব হিসাবে প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠিত করেন। বাংলায় রাজনীতি ও ধর্মীয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের পিছনে ব্রিটিশদের অবদানই বেশি। সম্ভবত ইতিহাস লুকানোর পরিপ্রেক্ষিতেই ওই সময়ের খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের যাজক উপাধি অনেক ক্ষেত্রেই অনুল্লিখিত।

নাটকের প্রচলিত ইতিহাসে বলা হয়১৭৯৫ সালে কলকাতায় ডোমতলায় লেবেদেফের ডিসগাইস নাটক অনুবাদ ও মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে বাংলা নাটকের শুরু। সেলিম আল দীনসহ অনেকেই তা উপনিবেশের মিথ্যাচার বলে প্রমাণ করেন। তিনি বিশ্বাস করেন নাটকের মতো একটি জননন্দিত শিল্পমাধ্যমের এমন আকস্মিক উদ্ভাবনা হতে পারে না। বাংলা নাটক হাজার বছর ধরেই ছিল। তা এ জনপদে নানা নামে, নানা রূপে ও নানা রীতিতে প্রচলিত ছিল। ভরতমুণির নাট্যশাস্ত্রে ওড্রমাগধী নামে যে আঞ্চলিক নাট্যরীতির উল্লেখ পাওয়া যায় তা বাংলা অঞ্চলের নাট্যরীতি। এমনকি বৌদ্ধসাধন সংগীত চর্যাপদ এর মধ্যেও নাট্য প্রয়োগের উল্লেখ আছে নাচন্তি বাজিল গান্তী দেবী, বৌদ্ধ নাটকও বিষমা হই। মধ্যযুগ খ্যাত সময়ে বাংলা অঞ্চলের প্রধানতম শিল্পমাধ্যমই প্রচলিত নাটক। যা তখন নাটক শব্দে পরিচিত ছিল না। পালা, জারি, যাত্রা, কীর্তন, পাঁচালি, কথকতা এগুলোই বাংলা অঞ্চলের নাটক। এগুলো একটি স্থানিক আয়তনে দর্শকের সামনে উপস্থাপিত হতো। কিন্তু উপনিবেশ শাসন ইতিহাস করণে আমাদেরকে ঐতিহ্যহীন হিসেবে চিহ্নিত করে ইউরোপীয়দের দাসে পরিণত করেছে।

ইতিহাস নাই ইতিহাস লিখিতে হইবেপ্রেক্ষিতে রামগতি ন্যায়রত্ন প্রথম প্রস্তাবনামূলক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থ লেখেন। এ গ্রন্থটি সম্পূর্ণ সনাতন ধর্মীয় বাংলা ভাষায় লেখা গ্রন্থের বর্ণনা। যাকে অনুকরণ করে ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে দীনেশচন্দ্র সেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস তৈরি করেন। দীনেশচন্দ্র সেন তার ইতিহাসের গ্রন্থের জন্য যে তথ্য-উপাত্ত নিয়েছেন তা ঐ সময়ের খ্রিষ্টান ধর্মযাজক জে লঙ-এর বই থেকে। সে দুধরনের বইয়ের লিস্ট ছিলএকটি ছিল মোহামেডান বুকস বা মুসলমানদের বাংলা বইয়ের তালিকা। অন্যটি ছিল সনাতন ধর্মীয় বা হিন্দুদের বাংলা বইয়ের তালিকা। ড. দীনেশচন্দ্র সেন ইতিহাস তৈরিতে তথ্য-উপাত্ত গ্রহণ করেছিলেন সনাতনী ধর্মের বাংলা বইয়ের তালিকা থেকে। ফলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মুসলমানদের গ্রন্থ পুরো বাদ পড়ে। এমনও শোনা যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থ সংগ্রহের নামে মুসলমানদের গ্রন্থ নিয়ে ধ্বংস করেও দিতো। দীনেশচন্দ্র সেন J. Long-এর যে বইয়ের তালিকা থেকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস তৈরি করেছেন তার ভূমিকায় লেখা আছে—The Object of this works is to be a guide to those who wish to procure Bengali books, either for educational purpose or for gaining an acquaintances with the Hindu manners, customs of modes of thought, popular literature is an index to the state of the popular mind.

সাহিত্যতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে অনেকেই দীনেশচন্দ্র সেনকে সম্মতি দিয়েছেন। কিন্তু বিতর্ক ছিল তুঙ্গে। দীনেশচন্দ্র সেন পরবর্তী এডিশনে আলাওলের পদ্মাবতী নামটি যোগ করেছিলেন। যদিও পরে মুসলমানী সাহিত্য নামে আলাদা একটি গ্রন্থও রচনা করে মুসলমানদের সন্তুষ্ট করেছিলেন। কিন্তু মূল ইতিহাসের স্রোত সনাতনী ১৪০০ বইয়ের তালিকার ঘরানায়ই রয়ে গেছে। ইতিহাস তত্ত্ব-বিশ্লেষণে মুসলমানদের সাহিত্য ইতিহাসের মূল প্রবাহের সাহিত্যের চেয়ে সাহিত্যগুণে কোনো অংশে কম নয়। আরাকান রাজ্যের রোমান্টিক প্রণয়নির্ভর ধারাভিত্তিক রিপ্রেজেন্টেশন তুচ্ছ বা অবজ্ঞার চিহ্ন বহন করে। সোনারগাঁয়ের সাহিত্যধারার নাম আজ প্রায় বিলুপ্ত। শাহ মুহম্মদ সগীরের বিখ্যাত রচনা ইউসুফ জুলেখা গৌড়াধিপতি সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের (১৩৮৯১৪১০) তত্ত্বাবধিত। গিয়াসউদ্দীনের সভাকবি হিসেবে খুব সম্ভবত শাহ মুহম্মদ সগীর আরাকানে বসবাস করতেন না। অথচ ইতিহাসে তাকে আরাকানে পুরো ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আরো বিস্মিত হতে হয় ইসলামি শাসনের স্বর্ণযুগে ইসলামী শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে রামায়ণ, মহাভারত অনুবাদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণবধারার চর্চা হয়েছে সেখানে মুসলিম সাহিত্যচর্চার কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। অথচ হাজার মাইল ব্যবধানের সেরূপ সাহিত্যচর্চা হওয়া কেমন বিভ্রান্তিকর।

আধুনিকতা শব্দের ধূঁয়া তুলেই ইউরোপীয়রা বাঙালিকে করেছে বিভ্রান্ত। আধুনিকতা আঠারো শতকে ইউরোপে গড়ে ওঠা একটি প্রপঞ্চ/ফেনোমেনা। এ দর্শনের মূলে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য-যুক্তি-বিজ্ঞান-ধর্মীয় গোঁড়ামীহীন ইত্যাদি নানা চিন্তা নির্ভর থাকলেও বাংলাদেশে অধিকাংশ চিন্তাশীল মানুষ মনে করে ইউরোপীয়দের মতো করা। অর্থাৎ ইউরোপীয় শিল্প-সাহিত্য-নাটকের রীতি-আঙ্গিকের অনুকরণ করাই আধুনিকতা। এ ভুল চেতনায় বাংলাদেশি যুগ যুগ ধরে তার ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়েছে। পশ্চিমা কাঠামোর নীতিকে অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে দেখা হয় নাই আমাদের নিজস্ব রূপ-রীতি। বিদেশি চোখ দিয়ে খুঁজতে গিয়ে হারিয়েছি নিজেকে। আঠারো শতক ছিল এদেশে ইউরোপীয় শাসন, শোষণ, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্যে উপনিবেশের মানদণ্ড ও আধিপত্যকে চিরস্থায়ী করা। ইউরোপীয় আধিপত্যবাদী ডকুমেন্ট পাকাপোক্ত করা এবং এদেশীয় প্রতিনিধি তৈরি করা। পূর্বেই বলা হয়েছে১৭৮০ সালে ওরায়েন হেস্টিং-এ সময় কলকাতা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হতেন খ্রিষ্টান ধর্মযাজকগণ। যাজকগণ মুসলিম ধর্মবেত্তাগণকে শিক্ষা দিতেন। বিষয় কত হাস্যকর। ইতিহাসে পাওয়া যায় হ্যালহ্যাড প্রথম বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেছেন। অথচ হ্যালহেড বাংলা ভাষা জানতো না বলেই নানা তথ্যে উল্লেখ আছে। সামগ্রিক পর্যালোচনায় স্পষ্ট যে, ইউরোপীয় শাসন-আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।

১৮০১ সালে ফোর্ড উইলিয়াম দুর্গের ভেতরে ফোর্ড উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগ চালু হয়। এতে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেয় এক সময়ের ব্রিটেনের বিখ্যাত মুচি উইলিয়াম কেরি। খ্রিষ্টান ধর্মযাজক হয়ে বাংলায় ধর্মান্তরণের জন্য এসেছিলেন। এ কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পাশ্চত্যের অল্প বয়সী যুবকদের এনে শাসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণ ও ধর্মান্তরকরণের ভিত পাকাপোক্ত করে নেয়। সাথে সৃষ্টি করতে থাকেন এদেশীয় বুদ্ধিজীবী মহলে ইউরোপীয়দের সহযোগী শ্রেণি। ধীরে ধীরে এদেশীয় বুদ্ধিজীবীরা উপনিবেশের আত্মিক দাসে পরিণত হয়। শুরুর দিকে খ্রিষ্টান মিশনারিগণ এদেশের মানুষকে ধর্মান্তরিতকরণের গুরুত্বপূর্ণ পন্থা হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপদ্ধতি ও পাঠক্রম সৃষ্টি করেছিল। বই-পত্রও মিশনারিরাই ছাপিয়ে বিতরণ করেন। জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্য বিস্তারের আরেক কেন্দ্র ছিল শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশন। যা হোক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলতেন—‘যাজক উইলিয়াম কেরি ছিলেন বাংলা ভাষার দর্জি। কেরি দর্জির মতো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে কেটে-ছেঁটে তাদের ইউরোপীয় আধিপত্য নির্ভর নানা বিভাজনে বিভক্ত করতে থাকেন। সেলিম আল দীন উপনিবেশ সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ধারার গদ্য, পদ্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক প্রভৃতি উপনিবেশের প্রথাগত বিভাজন মানতেন না। মঙ্গলকাব্য ধারার গ্রন্থসমূহকে তিনি মহাকাব্য বলায় বেশি আগ্রহী ছিলেন। কারণ বাংলার এক-একটি সাহিত্যের মধ্যেই ছিল সমস্ত গুণ। উপনিবেশ সৃষ্টি বিভাজনীয় জ্ঞানতাত্ত্বিক সমস্ত বৈশিষ্ট্যই বাংলার এক-একটি সাহিত্য নির্দশনের মধ্যে লভ্য। কেরি প্রজেক্টের শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে ইসলাম ধর্মাশ্রিত ভাষাগত শব্দকে পুরোপুরি বর্জন করেন। ধর্মান্তরকরণের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া হিসেবে পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। উইলিয়াম কেরি কথোপকথন’-এর মধ্য দিয়ে বাংলার প্রান্তিক সমাজজীবনের ভাষা তুলে ধরেন নব্য শাসকদের সামনে যা অত্যন্ত ভয়ংকর। এ ভাষার নমুনায় বাঙালিকে ইতর বা অসভ্য ভাবতে কুণ্ঠিত হবার কোনো কারণ নেই। অথচ ওই সময়ে রচিত পুঁথিগুলোতে বাংলার চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এমনকি যাজকদেরই ফুলমণি ও করুণার বিবরণ-এ বিধৃত চিত্রে বাঙালির উঁচুতর রুচিরোধ ও মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। বলতে অত্যুক্তি হবে না কেরি ঢাকা অঞ্চলের সে সময়ের সমৃদ্ধ বাংলা চোখেই দেখেন নাই। ষোড়শ শতকেই বাংলা ভারতের রাজকীয় ভাষার মর্যাদা পেয়েছিল। প্রচলিত ইতিহাসে অনেকেই কেরিকে বাংলা গদ্যের জনক বলে থাকেন। বাংলা গদ্য তৈরির ক্রেডিট দেন আঠারো শতকের উপনিবেশ-মিশনারীদের। অথচ পঞ্চদশ শতকের রসুল বিজয় গ্রন্থে বাংলা গদ্য পাওয়া যায়। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে বৈষ্ণবীয় বাংলা গ্রন্থ কারিকা অষ্টসখীর গণনির্ণয়সহ নানা গ্রন্থেই বাংলা গদ্য আছে। এমনকি এ অঞ্চলের চম্পুকাব্য নামে সাহিত্য ধারাটিও ছিল গদ্য-পদ্যে লিখিত। 

উইলিয়াম কেরির ইতিহাসমালা রচনায় বাঙালির ঐতিহ্যচিন্তা ও আচার প্রথা বুঝাতে যেভাবে বাঁদরতত্ত্বর আরোপ করেছেন তা বাঙালি ও সিভিলিয়নের মধ্যে সাংঘর্ষিক। বাঁদরকে মাথায় উঠতে দেওয়া যাবে না পাছায় ঘা লাগাতে হবে। রূপাশ্রিত বাঁদরটিই ছিল বাঙালি। ইতিহাসমালায় প্রায় দেড়শটি গল্প রয়েছে। তারমধ্যে পঞ্চতন্ত্র থেকে ১৪টি, বেতাল পঞ্চবিংশতি থেকে ২টি, দ্বাত্রিয়শৎপুত্তিলিকা থেকে ১টি, কথাকোষ, পুরুষ পরীক্ষা, বসুদবহিন্দি থেকে ২৯টি, ঈশপ থেকে ৪টি, প্রচলিত ফারসি গল্প থেকে ৮টি, ইউরোপীয় ৮টি, নীতিকথা ও রূপক গল্প হচ্ছে ২৫টি। এগুলো উপস্থাপনের মনস্তত্ত্বে সূক্ষাতিসূক্ষভাবে ইউরোপীয় আধিপত্যবাদই লক্ষ্য করা যায়। রামরাম বসুর কাছ থেকে সবকিছু শিখে নিয়ে খ্রিষ্টান যাজকগণ তারপর তাকেই নৈতিকস্খলন জনিত কারণ দেখিয়ে চাকুরিচ্যুত করে। এর ভেতরে কত না রহস্য আছে।

ব্রিটিশ উপনিবেশ সরকার এদেশের শাসন ক্ষমতা দখলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছিল মুসলমানদের। উপনিবেশরা মুসলমানদের অবদমিত করে ক্ষমতায়ন করেছিল হিন্দুদের। চিরস্থায়ী ভূমি বন্দোবস্ত নামে কৌশলে অনেকাংশে নিঃস্ব করেছিল মুসলমানদের। সেসময় মুসলমানদের লিখিত গ্রন্থকে চরমভাবে অবহেলা করা হয়। আরবি-ফারসি-বাংলা ভাষায় লিখিত মুসলমানদের গ্রন্থের কোনো তথ্যই ইতিহাসকরণে স্থান পায়নি। যেসময় দেড়শ মুসলিম সাহিত্যিকের নাম পাওয়া যায় অথচ সে সময়কে বলে সাহিত্যহীন বন্ধ্যাযুগ। উপনিবেশসময় মুসলমানদের গ্রন্থকে তুচ্ছার্থে বলা হতো পুঁথি (প্রকৃত শব্দে পুস্তক)। ব্রিটিশদের ছাপাখানা ছিল বিধায় পরবর্তী প্রায় ১০০ বছর মুসলমানদের কোনো গ্রন্থ ছাপা হয়নি। এমনকি যেসময় হিন্দুদের বই ছাপা হতো সে সময়ও মুসলমানদের বই ছাপা হতো না। ১৮০০১৯০০ পর্যন্ত ছাপা বইয়ের লিস্ট দেখলেই তা দেখতে পাবেন। অনেক মুসলিম তার বই প্রকাশের জন্য নামের শ্রী লিখতেন। মুসলমানদের বইয়ের আরেকটি তকমা লাগিয়েছিল তা হচ্ছে বটতলার পুঁথি।

ম্যাক্স মুলার ব্যঙ্গ করে বলতেন, ভারতের সাহিত্য ব্রিটিশ লাইব্রেরির একটি তাকের সমান। অথচ ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে বাঙালি জাতি ছিল বিশ্বের ষষ্ঠ সমৃদ্ধ জাতি। জ্ঞান-সাহিত্যচর্চায় অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। নানাভাবে তুচ্ছ ও তাচ্ছিল্য ও উপনিবেশ  কৌশলে পিছিয়ে পড়তে থাকে মুসলমানরা। সতেরো শতকে সৃষ্ট কলকাতা নগরীর আঠারো শতকে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছিল উপনিবেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্য নির্মাণ করে দেবার প্রচ্ছন্ন ফ্যাক্টরি। তা হিন্দুদের প্রাধান্যে কিন্তু মুসলমানরা ঐতিহ্যশূন্য। সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও উনবিংশ শতকের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ সংগৃহীত ও সম্পাদিত এদেশীয় কোনো গ্রন্থই আজ অকৃত্রিম রূপে নেই। মঙ্গলসাহিত্য ধারাগুলো মূলত নাট্যপালা, সেগুলো হয়ে উঠেছে কাব্য। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মূলত নাটগীত, হয়ে উঠেছে কাব্যমালা। মুকন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীদেবীর পালা হয়ে উঠেছে চণ্ডীমঙ্গলকাব্য। মহুয়া, মলুয়া, কাজলরেখা মুসলমানদের এ পালানাট্যগুলো হয়ে উঠেছে ছন্দে ছন্দে গীত ব্যালেট। অর্থাৎ মূল পরিচয় থেকে কতটা সরিয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ উপনিবেশের সঙ্গে তুলনা করে ঐতিহ্যপ্রীতির তকমা লাগাতে গিয়েও এমন কাজ করেছেন অনেকে। প্রকৃত অর্থে তা ছিলো এদেশীয়দের জন্য প্রকৃত ক্ষতি।

মুসলমানদের কাছ থেকে সংগৃহীত কোনো গ্রন্থের তথ্যই ইতিহাসকরণে দেয় নাই। এটা নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তারমধ্যে একটি গল্প হলো একবার বিশিষ্ট মনীষী আহমেদ শরীফের কাকা আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদের কাছে মুসলমানীয় গ্রন্থ (পুঁথি) সংগ্রহের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা গিয়েছিলো। কিন্তু প্রতিনিধিদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কারণ এসব বুদ্ধিজীবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করে মুসলমানদের পুঁথিগুলো নিয়ে তা নষ্ট করে ফেলে। পরে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েছিলেন নিজের ভাতিজাকে পুঁথির দায়িত্ব বা পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়ার শর্তে। এ গল্প থেকেই অনুমান করা যায় কীভাবে মুসলমানদের চর্চিত সাহিত্যগুলো বাদ পড়েছিল বা বাদ দেওয়া হয়েছিল সেসময়। যেসময় বাংলার প্রত্যেকটা মুসলমানের ঘরে ঘরে ছিল ইউসুফ-জুলেখা, সয়ফুলমূলক বদি্উজ্জামাল কিংবা হানিফার জঙ্গনামা সেখানে ইতিহাসে এগুলো নাকি চট্টগ্রামের ছোট্ট রোমান্টিক কাহিনির চর্চা। অথচ হিন্দু বাড়ির গোয়ালঘরে কিছু পেলেও তা ইতিহাসের মূল উপাত্ত। যার দ্বিতীয় কোনো কপি নাই। একটি ডকুমেন্ট দিয়েই ইতিহাসের যুগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম নির্দশন চর্যাপদ বলার মধ্যে উপনিবেশ রাজনীতি জড়িত আছে।

ইউরোপীয় উপনিবেশ বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা পদ্ধতিকে সমূলে ধ্বংস করে উপনিবেশ তাদের মতো খণ্ডখণ্ড বিচ্ছিন্নমুখী শিক্ষা কাযক্রম চালু করেছিল। বিচ্ছিন্ন বা খণ্ডিত জ্ঞান দিয়ে ইতিহাস, সমাজের কোনো ঘটনা বা বিষয়ের প্রকৃত সত্য উপলব্ধি সম্ভব নয়। বাংলা অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষায় উপনয়ন হতো। প্রতিদিনের পাঠ হতো প্রকৃতির সান্নিধ্যে ও একজন গুরুর কাছে। বাংলায় একজন গুরুর অধীনে গুরুকূল, মক্তব, মাদ্রাসা, টোল, চতুস্পাঠীতে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা লাভ করতেন। এক গুরুর কাছে পড়া শেষ হলে অন্য গুরুর কাছে যেতেন। এতে শিক্ষার্থী যেমন প্রায়োগিক বস্তুবিদ্যায় দক্ষ হতেন তেমনি আত্মিক-তাত্ত্বিক-বৌদ্ধিক জ্ঞানেও পরিপূর্ণ হতেন। প্রাচীন বাংলার শিক্ষাকার্যক্রমের উদ্দেশ্যে ছিল জীবিকার্জনের জন্য শিক্ষা, সমাজের প্রতি কর্তব্য, মানবমুক্তি, ধর্মনিষ্ঠার শিক্ষা ও চরিত্র নির্মাণের শিক্ষা। পরিব্রাজক স্ট্যাবো মন্তব্য করেছিলেন এরা (বাংলা-ভারতীয়) এতটাই সৎ ছিলেন যে তারা নিজেদের ঘরবাড়ি তালাবদ্ধ করতেন না বা লিখিত কোন চুক্তিপত্রের প্রয়োজনও বোধ করতেন না। অথচ বাঙালি আজ নৈতিকতার চরম অবক্ষয়ে।

সেলিম আল দীন বলতেনব্রিটিশরা এসে ক্লাসরুম বানিয়েছেগির্জার ডায়াস ও প্রার্থনাকারীর মঞ্চের আদলে। বিভিন্ন স্পেসালিস্টরা এতে যাজকদের মতো উপদেশ বা বক্তব্য দেয়। বর্তমানের উপনিবেশের খণ্ডিত জ্ঞানপদ্ধতি দ্বারা প্রকৃত সত্য বুঝা সম্ভব নয়। বর্তমানে যদি কোনো ঘটনার বাস্তবসত্য বুঝতে চায় তবে তার কমপক্ষে ৬-৭টি সাবজেক্টের বা বিষয়ের জ্ঞান থাকতে হয়। সেলিম আল দীন বলতেনছয়শত খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে সমস্ত পৃথিবীতে মোট ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাদের ৯টিই ছিল ভারত-বাংলায়। বাকি ২টি গ্রিসে। অথচ আজ আমরা ভিখারীর জাতি। এ সময়ের বাংলার গুরুত্বপূর্ণ সাধক শহীদ আল বোখারী মহাজাতক তার একক পাঠদান পদ্ধতিতে মানব জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি জীবনভিত্তিমূলক জ্ঞান শিক্ষা দেন। এতে উপনিবেশ জ্ঞান ও আবহ বাংলার শিক্ষার পার্থক্য আমাদের কাছে কিছু হলে কিছুটা স্পষ্ট হয়। ব্রিটিশরা দোসর ও তাদের কেরানী বানাতে চেয়েছেন। তাই এদেশীয় প্রযুক্তির যেন বিকাশ না ঘটে তার ব্যবস্থা করেছেন। তাঁতীদের আঙ্গুল পর্যন্ত কেটে দিয়েছেন। অথচ এ প্রাচীন বাংলা ছিল অত্যন্ত শিল্পসমৃদ্ধ। প্রাচীনকাল থেকেই আরবরা ইউরোপে নানা শিল্প রপ্তানি করতো। মসলিন, রেশমের নামতো আমরা জানিই। প্রযুক্তি বিদ্যা এমনকি জাহাজ তৈরি বিদ্যায় বিশ্বের মধ্যে অন্যতম ছিল প্রাচীন বাংলা আরো অনেক কিছু। অথচ আজ বাঙালি হীনম্মন্য, দাস কিংবা ভিখারীর জাতিতে পরিণত হয়েছে। উদ্ভট এক মনোবিকৃতিতে ভরে গেছে দেশ। বর্তমানে কেউ সত্য বললে তা যদি মুসলমানদের পক্ষে যায় তবে আরবীয় মরুভূমির মানুষ ট্যাগ পেতে হয়। আর হিন্দুদের পক্ষে গেলে ভারতীয় ট্যাগ। কিন্তু যারা বলছে তারা কারা? তারা নিজেরা যে ইউরোপীয়, খ্রিষ্টীয় সংস্কৃতির তাই তারা জানে না। তারা নিজেরা বাংলাদেশি হয়নি এখনো। নিজেরা কী নিজেরাই বুঝে না। কী হাস্যকার। ফ্রান্স ফানোর ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক গ্রন্থটি যখন পড়েছিলাম তখন আশ্চর্য হয়েছিলাম আফ্রিকান কালো নিগ্রোদের অদ্ভুত মনোজগত দেখে। কালোরা মনে মনে বিশ্বাস করে তারা সাদা। কী অদ্ভুত মনোবৈকল্য। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তেমন মনোবৈকল্যই তৈরি করে যাচ্ছে।

পরিবেশে বলা যায় বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক গঠিত দেশ একটি বাংলাদেশ। এ জাতিভিত্ত্বিক দেশের আত্মপরিচয়ে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও সাহিত্যের জাগরণ প্রয়োজন। এ জাতীয় জাগরণের জন্য প্রথমে প্রয়োজন উপনিবেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্য কাঠামো বর্জন। কিন্তু একধরনের কাল্পনিক ভয় আমাদেরকে আড়ষ্ট করে রাখে। উপনিবেশ শাসন চলে গেছে দীর্ঘদিন কিন্তু আজও এ ভয় কেন? এই ভয়টা কিসের? উপনিবেশ চলে যাবার পরও মনোজগতে কীভাবে টিকে থাকে উপনিবেশ! কারা প্রতিনিধিত্ব করে উপনিবেশ শক্তির। আমরা জাতীয় মুক্তি চাই কিন্তু অদৃশ্য আতঙ্কে আমরা কথা বলতে পারি না; সত্য উচ্চারণ করতে পারি না। কী এক অজানা কাল্পনিক ভয় আমাদেরকে তাড়া করে ফেরে। সে ভয় দূর করা প্রয়োজন। ঐতিহ্যের জাগরণ ছাড়া আত্মমর্যাদাশীল সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়।  

 

তথ্যসূত্র

১. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদিপর্ব, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, অষ্টম সংস্করণ, বৈশাখ-১৪২০,
২. দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যপুস্তক পর্যদ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ১৯৯১
৩. শহীদুল ইসলাম, বৃটিশ উপনিবেশবাদ: মিথ ও বাস্তবতা, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ, ঢাকা, ২০০৯
৪. সেলিম আল দীন, মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা
৫. ফয়েজ আলম, বাঙালির ইতিহাস চর্চার পথের কাঁটা, ঘাঘফুল, ঢাকা, ২০২৪
৬. বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি খণ্ড, সম্পাদনা— এমাজউদ্দীন আহমদ, হারুন অর রশীদ, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৭
৭. মাসউদ ইমরান ‘সেলিম আল দীনের নাটকে বি-উপনিবেশিকরণ এবং এথনিক থিয়েটার হেজিমনি’ প্রবন্ধ, বনপাংশুল, দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, ঢাকা, ২০০৯
৮. ফয়জুল আজিম, বাংলাদেশের শিল্পকলার আদিপর্ব ও ঔপনিবেশিক প্রভাব, বাংলা একাডেমী, ২০০০
৯. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা নাটকের ইতিহাস: প্রথম খণ্ড, এ মুখার্জী এ্যান্ড কোং, কলকাতা, পৃষ্ঠা—৯৭
১০. বাংলা পিড়িয়া, সম্পাদনা—এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ‘শিক্ষা’ অন্তভূর্ক্তি, ২০০৮, ডিজিটাল ভারসন