বাদল সরকারের কবিতার তুলনা ও প্রতি তুলনা

অ+ অ-

 

বাদল সরকারকে আমরা জানি একজন সফল নাট্যকার হিসেবে। তিনি নিজে অভিনয় করেছেন, নাটক পরিচালনা করেছেন। তৃতীয় থিয়েটারের মুখ্য প্রবক্তা হিসেবে নাট্য আন্দোলনে প্রবলভাবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। টাউন প্লানার হিসেবে জীবিকা শুরু করলেও তাঁর পরিচয় নাট্যব্যক্তিত্ব হিসেবে। ভারতে তো বটেই, বহির্ভারতেও তাঁর খ্যাতি সুবিদিত। সেই মানুষটা একসময় কবিতা লিখেছেন। পাতার পর পাতা কবিতা লিখে নিজের অনুভবকে তুলে ধরেছেন। স্বতন্ত্রভাবে কোনও কবিতার বই প্রকাশিত না হলেও তাঁর কবিস্বভাব বিকশিত হয়েছে তাঁর লেখা নাটকের মধ্যে। সংলাপে সংলাপে তার বহিঃপ্রকাশ আমরা লক্ষ্য করেছি। এমনকি সরাসরি কবিতা দিয়ে তিনি পাত্র পাত্রীর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। নাটক লেখার সময়কালে তাঁর ডায়েরির পাতা ভরে উঠেছে কবিতায় কবিতায়। ব্যক্তিগত চিঠিতেও তিনি নানাসময়ে মনের ভাব ব্যক্ত করার জন্যে নিজের লেখা কবিতার আশ্রয় নিয়েছেন।

প্রবাসের হিজিবিজি নামে তাঁর একটি বই আছে। বইটি মূলত গত শতাব্দীর শেষ দিকে লেখা তাঁর বেশ কয়েকটি চিঠি ও ডায়েরির অংশ নিয়ে নির্মিত হয়েছে। নাট্যকার হিসেবে তাঁর হয়ে ওঠার এক অনবদ্য আভাষ এই গ্রন্থে রয়েছে। তিনি নিজেও এ নিয়ে লিখেছেন, পুরনো কাসুন্দি পড়ে যাঁদের ভাল লেগেছে এবং দ্বিতীয় খণ্ডের প্রতীক্ষায় আছেন বলে জানিয়েছেন, তাঁদের অনুরোধ করব এই বইটিও পড়তে, নইলে পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটার কাজটা সম্পূর্ণ হবে না। এ ছাড়া কিছু অল্পসংখক মানুষ যাঁরা আমার নাটক অল্পবিস্তর পড়েছেন তাঁরাও এই গ্রন্থে কিছু খোরাক পাবেন। ছাপা নাটক যদি তৈরি খাদ্য হয়, তবে রান্নাঘরের বেশ কিছু খবর এখানে মিলবে। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার পুরনো কাসুন্দি হল চার খণ্ডে লেখা বাদল সরকারের আত্মজীবনী। প্রথম জীবনে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্যে জন্যে লণ্ডনে গিয়েছিলেন (১৯৫৭-৫৯) তারপর ১৯৬৩-৬৪-তে নমাস ফ্রান্সে আর ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ এই দুবছর নাইজেরিয়ায় ছিলেন। চাকরি পড়াশুনোর ফাঁকে ফাঁকে নাটক লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন। তখনও তিনি ভাবেননি, দেশে ফিরে সর্বক্ষণের একজন ব্যতিক্রমী নাট্যব্যক্তিত্ব হয়ে উঠবেন তিনি। দেশে ফিরেছেন, চাকরি করেছেন, সংসার পেতেছেন, পুত্রকন্যার জনক হয়েছেন কিন্তু নাটক তাঁকে তাড়া করে ফিরেছে। তাই চাকরির ফাঁকে ফাঁকে নাটকের জন্যে সময় ব্যয় করেছেন। ষাট দশকের শেষদিকেই তিনি একজন প্রখ্যাত নাট্যকার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান এবং খ্যাতি প্রশংসা ও পুরস্কারের শিরোপা নিয়ে তিনি খুঁজতে থাকেন নাট্যভুবনে তাঁর নিজস্ব গন্তব্য। অবশ্য অচিরেই খুঁজে পান তিনি এবং তৃতীয় থিয়েটারের একজন প্রবক্তা হিসেবে নিজেকে নিজেই চিহ্নিত করেন। প্রসেনিয়াম থেকে মুখ ঘুরিয়ে খ্যাতি বিত্ত সম্মানের তোয়াক্কা না করে সেই যে তিনি এই আন্দোলনে মেতে উঠলেন দীর্ঘ চার দশকেরও অধিক সময় ধরে আমৃত্যু তাকেই আঁকড়ে রইলেন। এমন আদর্শবাদী, ত্যাগী, আত্মনিবেদিত মানুষ আজকের দিনে সত্যিই বিরল। এত কথা লিখতে হল নাট্যকার হিসেবে তাঁর হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপট তুলে ধরার জন্যে। আর তাঁর নাট্যসত্তার সঙ্গে যে তাঁর কবিস্বভাব যুক্ত হয়ে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে তা তাঁর যুগান্তকারী নাটক এবং ইন্দ্রজিৎ পড়লেই বোঝা যাবে স্পষ্টভাবে। এই নাটকের মুখবন্ধে তিনি জানান আমাদের, নাটকটির রচনাকাল ১৯৬৩, কিন্তু আসলে এটি রচিত হয়ে গিয়েছিল লণ্ডনে ১৯৫৭ থেকে ১৯৫৯ সালে। বস্তুত একটা ছাড়া সবকটি কবিতাই ঐ সময়ে লেখা। তখনকার ডায়েরিতে লেখা কিছু অংশ হুবহু তুলে ধরা হয়েছে এই নাটকে।

বাদল সরকারের প্রবাসের হিজিবিজি (লেখনী) প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৬ সালে। যদিও এই গ্রন্থের খসড়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল ১৯৮৯ সালেই। এই বইয়ের ভূমিকায় লেখক জানিয়েছেন, কাউকে চিঠি লিখলে চিঠিটা প্রাপকের সম্পত্তি হয়ে যায়, প্রেরক আর সেটা দেখবার সুযোগ পায় না। তবু বিদেশ থেকে লেখা কিছু চিঠি পড়তে পারার সুযোগ আমার ঘটেছিল অনেক দিন পরে, ১৯৮৯ সালে। তখনই এই রচনার পরিকল্পনা মাথায় এসেছিলচিঠি আর ডায়রীর বাছাই করা অংশ কালক্রমে অনুসারে সাজানো। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে কিছু কবিতা, যেগুলো ডায়রীর নামান্তর, কারণ তখনকার চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছিল তাতে। এই বইতে বাদলবাবুর অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু দম্পতি কানু ও মনুকে লেখা অনেকগুলো চিঠি সংকলিত। কানুর পোশাকি নাম অজিতনারায়ণ বসু আর মনুর নাম অঞ্জলি বসু (দত্ত)। এঁদের সঙ্গে বাদলবাবুর সম্পর্ক কতখানি নিবিড় ছিল তা ওই চিঠিগুলো আর ডায়রিতেই উল্লেখিত। পরবর্তীকালে অঞ্জলি বসু বাদলবাবুর অনেক গ্রন্থের প্রকাশক হয়েছিলেন। দীর্ঘকালের এমন মধুর সম্পর্ক আজকাল খুব কম দেখা যায়।

বাদল সরকারের কাব্যপ্রতিভা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই তাঁর অবিস্মরণীয় নাটক এবং ইন্দ্রজিৎকে আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। এই নাটকটি বহু আলোচিত। বলা যায়, এই নাটকটিই তাঁকে এক সর্বভারতীয় পরিচয় এনে দেয়। অস্তিত্ববাদের এক উজ্বল উদাহরণ হিসেবেই শুধু নয়, মানুষের জীবনের ক্লান্তিকর একঘেয়েমির এক অপূর্ব নিদর্শন এই নাটক। নাটকটির পরতে পরতে কেবল কবিতা। বাদলবাবুর প্রবাস জীবনের সময় লেখা তাঁর ডায়রি ও চিঠিপত্র পড়লে বোঝা যাবে ওই অল্প বয়সেই তিনি কীভাবে আয়ত্ত করেছেন অস্তিত্ববাদের সারাৎসার। প্রসঙ্গক্রমে নাটকে ব্যবহৃত একটি কবিতার উল্লেখ সম্ভবত অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

এক—দুই—তিন
এক—দুই—তিন—দুই—এক—দুই—তিন
এক—দুই—তিন—দুই—এক—দুই—তিন
চার—পাঁচ—ছয়
চার—পাঁচ—ছয়—পাঁচ—চার—পাঁচ—ছয়
 চার—পাঁচ—ছয়—পাঁচ—চার—পাঁচ—ছয়
সাত—আট—নয়
সাত—আট—নয়—আট—সাত—আট—নয়
সাত—আট—নয়—আট—সাত—আট—নয়
নয়—আট—সাত ছয়—পাঁচ—চার—তিন—দুই—এক

এটিকে নতুন ধরনের কবিতা হিসেবে গণ্য করতে চান সমালোচকবৃন্দ, আবার কেউ কেউ একে শুধুমাত্র চমক ছাড়া আর কিছু বলতে নারাজ। যে যাই বলুক, এই চক্রবৎ ঘুর্ণমান জীবন যে এক ধরনের একঘেয়েমী ছাড়া কিছু নয়, এটাই তিনি বলতে চেয়েছেন। মধ্যবিত্ত জীবনের ছকে বাঁধা ক্ষুদ্র অতি ক্ষুদ্র সমাবৃত্ত তথা তা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে ফেরার এ এক অসামান্য নাটক। আরো খানিকটা এগিয়ে গেলে এই নাটকের মর্মবাণী আরো স্পষ্ট হয়। কবিতার ব্যবহার আমাদের কাছে আরেকটু স্পষ্ট হয়ে আসে।

একদুই তিন। অমলবিমলকমল।এবং ইন্দ্রজিৎ। এবং মানসী। ঘর থেকে স্কুল। স্কুল থেকে কলেজ। কলেজ থেকে দুনিয়া। বড়ো হচ্ছে। আর ঘুরছে। ঘুরছে আর ঘুরছে আর ঘুরছে। একদুইতিন- দুইএক। অমলবিমলকমল। এবং ইন্দ্রজিৎ।

এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কবিতা আর কী হতে পারে? এই নাটকের পরতে পরতে কবিতা। এর পরে আরেকটি কবিতার উল্লেখ করতেই হবে,

দিকে দিকে থাক ঐতিহাসিক পাথুরে নয়ন মেলা,
ছন্দবাঁধনে আবর্তনের চলুক অনাদি খেলা।
আলো আঁধারির চক্রধাঁধায় কালের শোণিতধ্বনি
দিবারাত্রের খণ্ডচয়নে গেঁথে যাক বন্ধনী,
অজানা দিশায় আগামী অতীত ভুলে যাক সন্ধান,
আমি তো বর্তমান।
কী হবে মিথ্যা সূক্ষ্ম হিসাবে পুরনো সংখ্যা গুণে?
কী হবে স্বপ্নে ভবিষ্যতের তন্তু—আঁচল বুনে?
রাত্রিদিনের ছন্দে কখনো যাবে না তো কেটে তাল,
বৃথা কেন তবে মনের দেউলে ভরে তোলে জঞ্জাল?
হৃৎস্পন্দনের সময়ের তালে বেঁধে যদি পারো
পরোয়া থাকে কারো।

এটি একটি দীর্ঘ কবিতা। পরের অংশটি তাই এখানে উল্লেখ না করলেই নয়।

নির্বোধ মনে অবুঝ অঙ্কে তবু উত্তর খোঁজা,
তবু সংখ্যার চক্ররাশিতে ভারি করে তোলা বোঝা।
অনেক দিনের হিসাবে শূন্য—সে কথা যায় না মানা,
অল্পদিনের ক্ষুদ্র গণনে তাই তো গণ্ডী টানা।
প্রকৃতিপত্রে শিশু অক্ষরে জীবনের ভাষা তাই
এখনো তো লিখে যাই।

এর পরে আসছে আরেকটি দীর্ঘ কবিতা। এ শুধু কবিতা নয়, এই নাটকের মর্মবাণী। লেখক চরিত্রটা যে নাট্যকার নিজেই।

নাগরদোলার আবর্ত—ছাদে গড়া
আমি এলোমেলো আকাশে এনেছি নেশা
অজ্ঞ বাতাস চেতনার বিষে মেশা,
না জানা ছন্দে ভাঙ্গাচোরা বোঝাপড়া।
এদের কথা আমাকে বলতে হবে। এদের নাটক আমাকে ভাষায় গাঁথতে হবে।
ভাষা তো প্রাচীন, ক্ষতবিক্ষত কথা,
আলো দিশাহারা শিথিল অপ্রকাশে,
সমাধি মৌন জড়তার জাগপাশে, চিতাবহ্নিতে প্রদীপ্ত বাচালতা।

কবিতা এখানে শেষ নয়। নাটক চলছে। তারমধ্যে কাব্যভাষায় ঢূকে পড়ছে আরেকটি কবিতার অনুষঙ্গ

ঘন্টা বাজছে। একটি পরমাণু খসে পড়ছে। আর একটি পরমাণুকে ডাকছে। তিনটি পরমাণু ডাকছে। আরো রাশি রাশি পরমাণু মিলে মিশে তালগোল পাকিয়ে বিরাট এক পৃথিবী ঘুরছে আর ঘুরছে। আর একের পর এক সেকেন্ড মিনিট ঘন্টা ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। (আবার ঘন্টা। অমল কমল বিমল অধৈর্য।) ঘন্টা বাজছে। আবার বাজবে। তবু পৃথিবী আছে। তবু শতাব্দী আছে। আমার পৃথিবী। আমার শতাব্দী। নাগরদোলা চুলোয় যাক। আমরা আছি। অমল বিমল কমল। এবং ইন্দ্রজিৎ। এবং আমি। আমরা আছি। পৃথিবীতে আছি।

এরপর কবিতার বাকি অংশ। সবটা মিলিয়ে একটা পূর্ণ কবিতা।

আমি বিভক্ত, আমি অণুখণ্ডিত,
গুঁড়ো দিয়ে গাঁথা জটিল ঐক্যতান। 
বুড়ো শতাব্দী আজো পেতে আছে কান,  
চূর্ণ পৃথিবী এখনো অপরাজিত।  
বুড়ো শতাব্দী আজো পেতে আছে কান।।    
চূর্ণ পৃথিবী এখনো অপরাজিত।   
বুড়ো শতাব্দী আজো পেতে আছে কান,
চূর্ণ পৃথিবী এখনো অপরাজিত।  

এবং ইন্দ্রজীৎ নাটকে লেখক নিজেও তো একটা চরিত্র। তাঁর মুখে নানাসময়ে নানা সংলাপ এবং কবিতা। একসময় লেখক বলছেন

অমল চলে গেছে। বিমল চলে গেছে। কমল চলে গেছে। ইন্দ্রজিৎ বসে ভাবছে। ইন্দ্রজিৎ চলে গেছে। আমি বসে ভাবছি।

আমি—আমি। বসে ভাবি। শুধু ভাবি।
শুধু ভাবি বসে আমি খণ্ডিত উপকথা 
অসম্ভাব্য বায়বীয় পূর্ণতা। 
সমাপ্তি যদি মেশে বিলোপের গানে,
অর্ধচেতনা তবু কেন আনে ঝংকৃত মুখরতা?
পৃথিবীর গুঁড়ো বাতাসে ছড়ানো ধুলো
সময়ের কুলো বাছে।  
জীবনের বীজ ধুলোতে কি মিশে আছে?    
কী হবে কুড়িয়ে ছাঁকা ভবিষ্যকণা?
এ মাটি পুরনো। রিক্ত আকাশ। 
বৃথা পরিকল্পনা।      
আমি। বসে ভাবি আজো ভাবি।    
আজো কেন তবু ভাবি পুরো মানুষের কথা? 
অংশ-চেতনা আজো কেন খোঁ লিখনের অন্যথা?

এইভাবে কবিতার পথ ধরে ধরে নাটকটা এগোতে থাকে। কবিতার উচ্চারণে নাটক হয়ে ওঠে বাঙময়। নাটকের অন্তস্থিত ভাবকে বিস্তার করে। অসাধারণ সব সংলাপিকার মধ্যে মধ্যে ঘটে যায় কবিতার উন্মেষ। আলাদাভাবে নয়, নাটকের প্রয়োজনেই কবিতা আসে। এর পরের কবিতাটি উল্লেখ করছি তার আগের কয়েকটি সংলাপ দিয়ে। কবিতাটি একসময় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। এই নাটকটির প্রসঙ্গ উঠলেই কবিতাটির কথা এসে যেত।

মাসীমা—কে তোর লজিকের ধার ধারে? যতো সব অলক্ষুণে কথা। বিয়ে না করলেই ঐসব উদ্ভুটে কথা মাথায় আসে।           
লেখক—বিয়ের কথা এলো কোত্থেকে?    
মাসীমা—না, বিয়ের কথা আসবে কেন? আসবে যতো সমস্ত কে কী কেন কবে কোথায়। বিয়ে করবি নে কেন—সে কথাটার জবাব দিতে পারিস? 
লেখক—করবো কেন—সেইটার জবাব বার করতেই হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি। 
মাসীমা—শোনো কথা—করবো কেন! সবাই করছে, তুই করবি না কেন?
লেখক—এই পেয়ে গেছি! সব্বাই করছে। 
“কেন তুমি হাঁচবে? কেন তুমি কাশবে?
দাঁত ক’টি মেলে ধরে কেন মধু হাসবে?  
কেন তুমি দেবে তুড়ি, ওরা যদি তোলে হাই?
সব্বাই করে বলে, সব্বাই করে তাই।
মাসীমা—এই কাব্যি শুরু হোলো। আমি চললাম। 
(লেখক পথ আটকে দাঁড়ালো)
লেখক—কাব্যির নাম শুনে কেন তুমি পালাবে? 
কেন রোজ রেডিওটা অতো জোরে চালাবে? 
কেন তুমি ডালে দেবে আটখানা লঙ্কাই? 
সব্বাই করে বলে সব্বাই সব্বাই করে তাই! 
মাসীমা—ডালে আবার আটখানা লঙ্কা কবে দিলাম?  
লেখক—কেন তুমি ঘড়ি ধরে অফিসেতে ছুটবে?   
কেন তুমি তরকারি বটি দিয়ে কুটবে?    
তেল দিতে কেন বাছো অন্যের চরকাই?   
সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই !” 
মাসীমা—কী যে পাগলামি করিস—আমি বুঝে উঠতে পারি না। বিয়ে-থা করলে এসব ক্ষ্যাপামি ঘুচে যেতো দু’দিনে। (মাসীমার প্রস্থান)’ 

এর পরেই আছে একটি দীর্ঘ সংলাপ। সংলাপ না বলে তাকে স্বগতোক্তিই বলা যায়। সেই স্বগতোক্তিই কবিতা হয়ে যায়।

লেখকবিবাহ-জন্ম বিবাহ মৃত্যু। জন্মের পর বিবাহ। তারপর মৃত্যু। অনেকদিন আগে একটা সুন্দর গল্প পড়েছিলাম। আপনারা পড়েছেন কিনা জানি না। গল্পটার বেশির ভাগ ভুলে গেছি। একজন রাজপুত্র ছিল মনে আছে। আর একটা রাজকন্যা। অনেক ব্যাপারের পর তাদের বিয়ে হোলো। তারপরতারপরই আসল কথাটাতারা সুখে রাজত্ব করতে লাগলো। রাজত্বকিংবা সংসারঅথবা ঘরকন্নাকথাটা কী ছিল মনে পড়ছে না। কিন্তু সুখে। এতো সুখে যে তা নিয়ে আর গল্পই হয় না। ( নেপথ্যে শঙ্খধ্বনি। মানসীর মাথায় কাপড়। সলজ্জা নববধূ। মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে।) বিবাহ। একটি পুরুষ এবং একটি নারী। দম্পতি-জম্পতি-জায়াপতি। সহজ ভাষায়বর-কনে।

এভাবেই চলতে থাকে নাটক। নাটকের অর্থবহ সংলাপের পাশাপাশি কবিতার অনুষঙ্গ আসে এক অমোঘ অনিবার্যতা নিয়ে। নীচের কবিতাটি প্রায়ান্ধকার মঞ্চে শোনা গেছে লেখক নামক চরিত্রের কণ্ঠস্বরে। কবিতাটি এসেছে নাটকের চরিত্রগুলোর অন্তরের মর্মবাণী হয়ে আলো আঁধারি পরিবেশে। এ যেন ওই নাটকের পাত্র পাত্রীর অন্তরের কথা।

মৃত্তিকা সমুদ্রে শেষ। সমুদ্র দিগন্তে সীমাটানা।
সৌরমণ্ডলের চক্রে পৃথিবীর নগণ্য ঠিকানা 
কোথায় হারিয়ে আছে। 
অবিশ্রান্ত সময়ের কাছে 
দু’ই মুহূর্তের খেলা পৃথিবীর অস্তিত্ববিলাস,
আকস্মিক সমন্বয়ে জীবনের ক্ষণ-ইতিহাস,
সৃজন লুপ্তির মাঝে গোটাকয় মুহূর্তের দান—
ধরণীর অর্থহীন প্রাণ।
সে অনন্ত গণনাতে
আমি আছি সংজ্ঞাহীন সামান্য কণাতে।
বকের আশ্চর্য মৃত্যুর ছন্দে খুঁজে তালের বিচ্যুতি, 
অনির্বাণ জীবনের অলীক আকুতি— 
এর চেয়ে বিস্ময়প্রয়াস 
এখনো লেখেনি মর্তে মানুষের স্বল্প ইতিহাস।  
তবু আমি কীটাণু-অধম    
বেশরম। 
প্রতিবেশী সান্ত্বনায় ভুলে থাকি বিরাট ধারণা 
জটিল গণিত-তত্ত্ব সূক্ষ্ম আলোচনা।  
প্রাণের উদ্ধত অধিকারে 
অনন্ত ঘোশণা রাখি কণিকার মুহূর্তপ্রচারে।

বস্তুত এবং ইন্দ্রজিৎ দাঁড়িয়ে আছে অস্তিত্ববাদী কয়েকটি কবিতার উপর ভর করে। নাটকের সংলাপ আর কবিতার মিশেল দিয়ে বাদল সরকার বাংলা নাটকে নতুন একটি মাইল ফলক নির্মাণ করেছিলেন। নাটকটির পাত্র পাত্রীর অন্তরের বাণী হয়ে দেখা দিয়েছে এইসব কবিতাগুলো। ক্লান্ত দীর্ণ মানুষের অন্তরের কথা এইভাবেই বিধৃত করেছেন নাট্যকার।

আমি ক্লান্ত। বৃথা প্রশ্ন থাক,
এখন ঘুমোতে দাও নিভন্ত নির্বাক
ছায়ার গভীরে। 
কী হবে কথার রাশি দিয়ে?
কী হবে তর্কের বীজ বাতাসে ছড়িয়ে?
আমি ক্লান্তির যুক্তির জ্বালায়,
আমাকে ঘুমোতে দাও একা নিরালায়
ছায়ার গভীরে। 
আমার সন্ধান ক্লান্ত। এখনো গোপন
ধরণীর শেষ বিশ্লেষণ।
আমার প্রচেষ্টা ক্লান্ত। এখনো নিঃসাড়
জগতের জড়তার ভার।
আমার প্রতীক্ষা ক্লান্ত সমাধির পাশে
জীবনের ব্যর্থ আশে
মরণের তীরে। 
প্রশ্ন নিয়ে তুমি যাও,
তর্ক নিয়ে যুক্তি নিয়ে তুমি যাও ফিরে,
আমাকে ঘুমোতে দাও ছায়ার গভীরে।

এইভাবে নাটক এগিয়ে চলে। বাদলবাবু অপরূপ সংলাপের পাশাপাশি অবিস্মরণীয় কিছু কবিতার যোগসূত্র রচনা করে আমাদের উপহার দেন এবং ইন্দ্রজীৎ-এর মতো নাটক। এই নাটকের শেষও হয় কবিতা দিয়ে। সেই কবিতার উল্লেখও তাই খুব জরুরি।

আজো তাই
এ পথের শেষ নাহি পাই।
ফুরালে এ পথ 
পূর্ণ হবে সর্ব মনোরথ
দেবতার সোপানশ্রেণীতে—
এ আশ্বাস নাই আর পথশ্রম দূর করে দিতে।
এ যাত্রায় তাই
উদ্দেশ হারালো আজ, অর্থ কিছু নাই।
তবে তাই হোক।
বৃথা প্রশ্ন চাপা থাক, ভুলে যাই শোক।
জীবনের প্রথম প্রভাতে
বিনা দ্বন্দ্বে বিনা প্রশ্নে উন্মুক্ত দু’হাতে 
তীর্থপথ মহাদীক্ষা করেছি গ্রহণ। 
দিবসান্তে আজ যেন মন 
নাহি ভোলে সেই দীক্ষা। তীর্থ নয়, 
তীর্থপথ আমাদের—মনে যেন রয়।

এ যেন রবীন্দ্রনাথের শিশুতীর্থ। বিপদসংকুল পথ ধরে শুধু এগিয়ে যাওয়া। উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেয়েও যেন বড় যাত্রাপথ।

বাদল সরকারের কবিতার জগৎকে সেইভাবে বুঝতে গেলে এই এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকটাই যথেষ্ট। অবশ্য নাটকটা অস্তিত্ববাদের ওপর ভিত্তি করে রচিত বলে এতে কবিতার প্রয়োগ প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। কেননা বিষয়বস্তুটাই ছিল আপাত দুর্বোধ্য এক আত্মকথনে ভরা। তাই মাঝে মাঝেই নাট্যকারকে কবিতার আশ্রয় নিতে হয়েছে। তার কবিতা নিয়ে কেউ কখনও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ করেননি। বরং নাট্যকার নিজে আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যতা ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছেন তাঁর কবিকাহিনী নাটকে। আধুনিক কবিতা যেন কবি হওয়ার এক শর্টকাট পদ্ধতি। বর্তমানকালে পত্রপত্রিকার পাতায় পাতায় এত যে কবিতার ছড়াছড়ি তার আগামবার্তা যেন দিয়ে গেছেন বাদলবাবু। পরবর্তীকালে বাদলবাবু কিন্তু কবিতার জগৎ থেকে সেইভাবে সরে না এলেও, নাটকে কবিতার ব্যবহার তেমন করেননি। যদিও তাঁর নানা নাটকে কবিয়াত্র মতো ছন্দে গেঁথে গেঁথে সংলাপের বিস্তার ঘটিয়েছেন। এই লেখা শেষ করব তাঁর সারারাত্তির নাটকে ব্যবহৃত একটি সংলাপের সঙ্গে লাগোয়া একোটি কবিতা দিয়ে। একজন বৃদ্ধের মুখ দিয়ে তিনি যে একাকীত্বের মর্মবাণী শুনিয়েছেন তা আমাদের অন্তরকে স্পর্শ করে। কবি হিসেবে বাদলবাবুল উচ্চতাকেও তেমন করেই বুঝিয়ে দেয়।

বৃদ্ধএই ঘরে বহু কথা জমা হয়ে আছে। বহু বহু কথা। অনেক কথা। ওরা যায় না। ওরা ভাসতে থাকে। ভারি বিষাক্ত বাষ্প হয়ে জমে থাকেএই ঘরে, ওইখানে, ওই কোণে, ওই দেয়ালে, ওই সব জিনিসের কোণে খাঁজে আনাচে-কানাচে। রাত্রে ওরা বেরোয়, ওরা ঘোরে, ছড়ায়, জড়ায়, কুণ্ডলী পাকায়। শত শত বিষাক্ত কিলবিলে সাপের মতো ওরা কুণ্ডলী পাকায়। আর চেনায়। আর জানায়। আর সারারাত্তির ধরে আমি ওদের মধ্যে বসে থাকি, ঘুরে বেড়াই, পায়চারি করি। ওরা আমাকে চেনায়। আর জানায়। আর বোঝায়। আর চেতনার বিষে বিষে আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সব বিষ গিয়ে জমা হয় আমার এই দুটো চোখে। এই দুটো চোখে। এই দুটো জেগে থাকা, খুলে রাখা, মেলে ধরা চোখে এই দুটো চোখ।

সারারাত্তির! সারা রাত্তির!
সারারাত্তির খোলা দুই চোখে
জমে থাকা বিষ ছোবলে ছোবলে
বিষাক্ত যতো কথার ছোবলে
কতো হলাহল চেতনার বিষ
সারারাত্তির এই দু’টো চোখে নিয়েছি।
পুষে রাখা জমে থাকা কথা
চেতনার বিষে বিষাক্ত কথা
এই ঘরে এই বিষের আধারে
সারারাত্তির ছড়িয়ে ছড়িয়ে গিয়েছি।
তবু এ আমার—এ আমার কথা,
এ ঘর আমার, এ আমার বিষ,
যতো কথা আছে আনাচে কানাচে
ছায়াতে ছায়াতে কোণে খাঁজে মিশে
যতো কথা আছে সবই একা আমি
একে একে এনে পুষে পুষে রেখে দিয়েছি।  
সারারাত্তির আমি তো একাই
যতো কথা সবই আমি তো একাই
একে একে এনে পুষে—পুষে রেখে দিয়েছি।

এর চেয়ে উঁচুমানের কবিতা আর কী হতে পারে। কবি হবার জন্যে নয়, নিজের নাটককে আরো জোরদার করতে বাদল সরকার তাঁর নিজের লেখা কিছু কবিতা নাটকে ব্যবহার করেছিলেন। সেখানেই তাঁর সিদ্ধি, সেখানেই তাঁর কবিতা রচনার পরম প্রাপ্তি। অথচ কাব্যনাট্য রচনায় তিনি কখনও উৎসাহ বোধ করেননি।

এ পর্যন্ত বাদল সরকারের যে সমস্ত কবিতা নিয়ে আলোচনা করলাম, তার সবই তাঁর নাটকের প্রয়োজনে লেখা। এগুলো তাঁর প্রবাসের হিজিবিজি গ্রন্থে রয়েছে। তবে এসব কবিতা ছাড়াও আরো বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন তিনি। এগুলো সবই ১৯৮৮র নভেম্বরে প্রকাশিত নানামুখ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছিল। এতে তাঁর মৌলিক কিছু কবিতা ছাড়া আছে কয়েকটি ইংরেজিতে লিখিত কবিতা, বেশ কিছু বিদেশি কবিতার অনুবাদ, এমনকি তাঁর লেখা একটি গানও এখানে রয়েছে এখানে। এই কবিতাগুলো তাঁর নিজস্ব চিন্তা-চেতনার এক অন্যতম ফসল। মনের খেয়ালে লিখেছিলেন। মনের মধ্যে এই কবিসত্তাকে তিনি আজীবন বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তবু শেষ পর্যন্ত কবি না হয়ে হয়েছেন নাট্যকার। নাটকে প্রয়োগ করেছেন তাঁর কবিতা। নাটকের জগতে নিয়ে এসেছেন নতুনতর চিন্তা-ভাবনার ঢেউ। সারা ভারতে শুধু নয়, তাঁর এই ভাবনার কথা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন বিদেশেও। তাই নাট্যব্যক্তিত্ব হিসেবে বাদল সরকারের আলাদা একটি জায়গা আছে। সেই জায়গাটা কেবল ইতিহাসের পাতায় নয়, মানুষের অন্তরে।

৩৬ টা মৌলিক কবিতা, ৬ টা ইংরেজিতে লেখা, ৫ টা অনুবাদ কবিতা, তিনটে ছড়া ছাড়া একটা গানও আছে এখানে। এগুলো মূলত লেখা তাঁর প্রবাসজীবনে লেখা। শুরু হয়েছে ১৯৫৮-৫৯ সালে। তবে ইংরেজি কবিতাগুলোর একটি লেখা ১৯৪৭ সালে। যা হোক ৬১ ছাড়া, ৬৩, ৬৮, ৭০, ৭৬, ৮৬, ৮৭-তেও লিখেছেন। এগুলো সবই মুদ্রিত আকারে এখানে আছে। তবে এর বাইরেও তিনি হয়তো আরো লিখেছেন, কিন্তু সেগুলো আর প্রকাশের মুখ দেখেনি। তাই আমাদের আলোচ্য মুদ্রিত আকারে প্রাপ্ত কবিতাগুলো নিয়েই। ১৯৫৮ সালের ১৯ মার্চে লেখা নেশা কবিতাটা দিয়েই শুরু করা যাক। কবিতাটাতে ভারি ভারি শব্দের প্রয়োগ আছে। যেমন

নগ্নলাস্য বিলাসের উচ্ছ্বলিত আবর্তলীলায়
ফেনিল কামনাপুঞ্জ বুভুক্ষার তরঙ্গে মিলায়
আত্মনিমজ্জনে।  দীপান্বীতা নিশিমূর্ছনায়
সূর্যভীরু সৌন্দর্যের ক্ষণদীপ্ত স্ফুলিঙ্গকণায়
কশাক্ষিপ্ত চিত্ত’পরে সুপ্তি-ছোটা নেশা ধরে
মুহূর্তের তরে।
(নেশা, নানামুখ, পৃষ্ঠা-১৩৭)

কবিতাটা পড়লে বোঝা যায়, আলঙ্কারিক শব্দের দিকে তখনো তাঁর ঝোঁক রয়ে গেছে। অথচ তিন দিন পরে লেখা কবিতাটা কিন্তু একেবারেই অন্যরকম। মুক্তছন্দে লেখা। শব্দের কচকচি নেই। একেবারে নিরাভরণ সেইসব অভিব্যক্তি।

শুধু তারার আলো
আর রাতের কালো
পাতায় পাতায় বাতাসের শনশনানি,
সাবধানী ত্রাসের কানাকানি,
রাতজাগা পাখীর শিকারী চোখ মেলা,
অন্ধকারে লুকোচুরি খেলা,
লোভাতুর হাওয়ায় স্বার্থগন্ধ,
ঝিল্লির ক্রন্দনে নিশিরাগিনীর ছন্দ
অন্ধ যন্ত্রণাভরা,
কালো বনানীর পাগল-করা গোঙ্গানি।
আর আছে আকাশে তারার আলো
আর গাছে গাছে রাতের কালো।
(তারার আলো,নানামুখ, পৃষ্ঠা-১৩৮)
  

কবিতার পাশাপাশি চলছে নাটক লেখা। নাটক মানেই তো সংলাপ। তাই কবিতাও যেন হয়ে উঠছে সংলাপের মতো চোখা, সুনির্দিষ্ট ভাবনা সংবাহী। প্রসঙ্গত ৪।২।১৯৮৬-তে লেখা একটা ছোট কবিতার উল্লেখ করব। এ যেন ক্লান্তপ্রাণের হতাশ্বাস।

মাটিতে
“একরাশ আকাশ আমায় শান্ত করেছিল,
একঝড় বাতাস আমায় ক্লান্ত করে দিলো,
একদেশ দুঃখ আমার বৃন্ত ছিঁড়ে নিলো,
আমি মাটিতে, শুকিয়ে, 
আমি মাটিতে, লুকিয়ে,
যেটুকু বাঁচাতে পারি হতাশ্বাস পরাজয় দিয়ে।” 
(নানামুখ, পৃষ্ঠা-১৬৩)

এই কবিতাটির মধ্য দিয়ে বাদল সরকারের কবিত্ব শক্তির যে পরিচয় আমরা পাই তা সত্যি অভূতপূর্ব। আক্ষেপ হয়, তিনি কেন কবিতার জগতে সেইভাবে এলেন না! তবে এটা ঠিকই যে তাঁর এই ক্ষমতা তাঁকে একজন অন্যরকম নাট্যকার তৈরি করেছে। বাংলায় মোহিত চট্টোপাধ্যায় ছাড়া আর কারো ভিতর এমনটা সেইভাবে দেখা যায়নি। ১৯৮৭-তে লেখা তাঁর তাতে কার কি নামাঙ্কিত একটি কবিতার কথা এখানে বলতেই হবে। এই অসামান্য কবিতাটিতে সুরারোপ করে সংগীতে রূপান্তর করেছিলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়।এদিকে এলতলা বেলতলা’–এই গানটি শুনলে বোঝা যাবে কবিতা হিসেবে কী উচ্চতা এর! গানের প্রিলিউডে মাটির বেহালার সুরের মূর্ছনা এনে আমাদের অবাক করে দিয়েছিলেন প্রতুলবাবু।

প্রাপ্ত পাঁচটি ইংরেজি কবিতা নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলার নেই। এগুলো সম্ভবত তাঁর হাত মকসো করার খেলা। তাই হয়ত বেশি লেখেননি। তবে বিদেশি কবিতার যে অনুবাদ্গুলো তিনি করেছেন, তা সত্যিই অনন্য। বিশেষ করে জাঁক প্রেভের-এর কবিতা। বঁধু তোমার জন্যেপারিবারিক’–এই কবিতা দুটিতেও প্রতুলবাবু সুরারোপ করে গেয়েছেন। খুব ভাল ওই গান দুটিও। এই কবিতা দুটি অন্য অনেকে অনুবাদ করেছেন। কিন্তু বাদলবাবু সত্যিই অসামান্য। কবিতাতে এনে দিয়েছেন দেশিয় মেজাজ, আবার দেশিয় হয়েও আন্তর্জাতিক।

ছড়া দুটি নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। অত্যন্ত সাদামাঠা তার প্রকাশভঙ্গিমা। আর এখানে সংকলিত একমাত্র গানটিকে কবিতা হিসেবেই পড়তে হচ্ছে। কেমন ছিল এর সুর? বাদলবাবুর গলায় কেমন লাগত? এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে না আর। তবু যদি এর স্বরলিপি থাকত এখানে, তাহলেও কিছুটা পরিমাপ করা যেত। কিন্তু এখন আর আক্ষেপ করে লাভ নেই। যা নেই, তা তো নেইই, শুধু যা আছে তা নিয়েই আমদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

এই হল কবি বাদল সরকার। সারাজীবন কবিতা নিয়ে ভেবেছেন, অথচ কবি হিসেবে আলাদা কোনও দাবি তাঁর ছিল না। সেই অর্থে কবি হতেই হয়ত চান নি। কবিতা এসেছে তাঁর মনের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া ভাবনাগুলোকে রূপ দেবার জন্যে। তাই তাঁর নাটকগুলোর সংলাপে সংলাপে কবিতার অনুভব। এমনকি আলাদাভাবে কবিতার ব্যবহার করেছেন নাট্কের মুহূর্তগুলোকে প্রাণবন্ত করে তোলার জন্যে। তাই তো তাঁর নাটক অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা।

ব্যক্তিগত জীবনে খুব কাঠখোট্টা মনে করেছেন অনেকে। কেমন যেন রসকসহীন একটা মানুষ। আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু একেবারেই অন্যরকম। সেই সত্তর দশকের গোড়া থেকে যাঁকে দেখে এসেছি, তাঁর সঙ্গেই একান্তভাবে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলাম নব্বইয়ের গোড়া থেকেই। কারণে অকারণে কতবার যে গেছি তাঁর কাছে! অনেকসময় ফোন না করেই ওঁর কাছে গেছি। সবসময় আমাকে তিনি সমাদরই করেছেন। অনেক কাজ ও অকাজের কথা হয়েছে। কবিতা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কোনওদিন কথা হয়নি, তবে যখন বিদায় নেবার সময় তিনি বলেছেন, আবার এস, অবশ্য জানি তুমি এমনিতেই আসবে। তখন অজানিতেই তিনি আমার মধ্যে এনে দিয়েছেন অসামান্য কবিতার অনুভব। আমি বাড়ি ফিরতে ফিরতে পুনর্বার আসার প্রস্তুতি নিয়েছি মনে মনে। এমন কবিতাময় মানুষের আকর্ষণ কী কম?