‘তাজউদ্দীন আহমদের মন’
১৯৫৫ সাল, তাজউদ্দীন আহমদের বয়স [১৯২৫—১৯৭৫] মাত্র ত্রিশ বছর, যখন তিনি একজন তরুণ সংসদসদস্য, তাঁর ছাত্রত্বও সচল—তখনকার সময়ে তাজউদ্দীন আহমদের একটা চিঠি দৈবক্রমে বহু হাত ঘুরে তাঁর পরিবারের হস্তগত হয়। চিঠিটি তিনি লিখেছেন আবদুল মালেক নামের এক বন্ধুকে, যিনি একসময় গাজীপুর জেলার শ্রীপুরে, স্যানিটারি ইনস্পেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ওই সময়েই শ্রীপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। পরে দুজনের কর্ম এলাকা আলাদা হয়ে যায়। ওই ভদ্রলোক পরে বদলি হয়ে চট্টগ্রামে চলে যান। বন্ধুর সঙ্গে তাঁর আত্মিক হৃদ্যতা ছিল। হয়তো সাংস্কৃতিক মিলনও ঘটেছিল দুজনের মধ্যে। চিঠিটি তাজউদ্দীন আহমদ লিখেছিলেন ইংরেজিতে। পরে তাঁর কন্যা সিমিন হোসেন রিমির উদ্যোগে তা বাংলায় অনূদিত হয় এবং ‘তাজউদ্দীন আহমদের চিঠি’ শিরোনামের বইতে জায়গাও পায়।
চিঠিটি লেখার তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫। লিখেছেন, ১৭, কারকুন বাড়ী লেন, ঢাকা থেকে। বন্ধুকে সম্ভ্রমের সাথে সম্বোধন করেছেন, ‘প্রিয় মালেক সাহেব’ নামে। চিঠির মাঝখানের একটা অংশ আমাদের আলোচ্য বিষয়। যেখানে তাজউদ্দীন আহমদ লিখেছেন, ‘আমার সঙ্গে দীর্ঘদিনের ওঠাবসা থেকে আশা করি আমার সম্পর্কে আপনার অন্তত এটুকু ধারণা হয়েছে যে আমি যে কোন ধরনের তোষামোদকে ঘৃণা করি; একই সঙ্গে আমার শত্রুও যদি প্রশংসা বা কৃতিত্বের দাবিদার হয়,তাকেও তার প্রাপ্য দিতে কার্পণ্য করি না। সাত্তার সাহেবকে প্রশংসা করে আমি যা বলেছি তা কোনো তাৎক্ষণিক তোষামোদ নয়। যদি তাই-ই হতো, তাহলে তিনি যখন এখানে ছিলেন তখন তার কাছ থেকে সুবিধা আদায় করার জন্য তাকে তোষামোদ করতাম।’ [From a quite long association with me you might have at least gathered this much that I hate flattery from any quarter; nevertheless I have never been niggardly in giving credit even to my worst enemy if he deserves that. What I said about Mr. Sattar is not offhand flattery, and had it been so I would have done it while he was here to receive advantages from him.]
এই চিঠি লেখার সাতষট্টি বছর পর, তাঁর মৃত্যুর, জেলখানায় পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে খুন হয়ে যাওয়ার সাতচল্লিশ বছর পর, তাজউদ্দীন আহমদের ওপরে তর্কবাংলায় লেখার অনুরোধ পাবার উপলক্ষে আমার মনে হঠাৎ করেই একটা প্রশ্নের উদয় হলো। প্রশ্নটা হচ্ছে, এই ভূখণ্ডে জন্মে, এই ভূখণ্ডের মাটি-মানুষের রাজনীতির বিচিত্র কুটিল-জটিল জল-কাদায় বেড়ে উঠে, তাজউদ্দীন আহমদ কেমন করে ‘তোষামোদকে ঘৃণা’ করতে শিখলেন? কেমন করে ‘শত্রুকে প্রশংসা করতে’ শিখলেন?
তাঁর রচিত ডায়েরিগুলো আবার হাতড়াতে থাকলাম। অনেকগুলো ডায়েরি হারিয়ে গেছে চিরতরে। বিদ্বজ্জন বদরুদ্দীন উমরের কারণে যেসব ডায়েরি তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারের হাতে ফিরে যায় এবং যা পরে ইংরেজি থেকে বাংলায় তর্জমা করা হয়, সে ডায়েরিগুলোই আপাতত আমার এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার একমাত্র সহায়। তরুণ তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ঘেঁটে খুজতে চললাম পরিণত তাজউদ্দীন আহমদের মনের হদিস!
তরুণ বয়সেই তাজউদ্দীন আহমদ জনগণের মনে জায়গা করে নিয়েছেন কর্ম, সততা, নিষ্ঠা আর নৈতিক গুণে। স্থানীয় মানুষের মনের কথা বুঝতে শিখে গেছেন ততদিনে। একটা ন্যায্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণাও তার পরিপক্ব। সেই ধারণা দিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছেন। গ্রামের আমজনতা সেই কথাও শুনছেন। এটা প্রমাণ করে গ্রামের আমজনতার অন্তরে ততদিনে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন তার ব্যক্তিগত অর্জন দিয়েই। এটা খুব বড় বিষয়।
২
০২ নভেম্বর ১৯৪৭ রোববার, এদিন তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর গ্রামের বাড়ি কাপাসিয়াতে আছেন। তখন তিনি পুরোদস্তুর রাজনৈতিক কর্মী। জনসেবা বিশেষ করে এলাকার মানুষের নানাবিধ সমস্যা সমাধানে কাজ করেন। এলাকার মানুষ নানারকম সমস্যা নিয়ে আসে, তার সমাধান এবং এলাকার উন্নতির জন্য অফিস-আদালতে ছোটাছুটি তখনকার রাজনৈতিক কর্মী-নেতাদের নিত্যদিনের কাজের অংশ, কালচারও বটে। তাজউদ্দীন আহমদ সেই কালচারে অভ্যস্ত, আন্তরিকতার সাথে মন-প্রাণ ঢেলেই সেসব কাজ করেন। ১৯৪৭-১৯৪৮ সালে পাওয়া তাঁর ডায়েরিতে একথা খুব সুস্পষ্ট যে তখন তিনি প্রায়শই ঢাকা-কাপাসিয়া যাতায়াত করেন।
এলাকার স্থানীয় গোসিঙ্গা বাজারে ওদিন তিনি গেছেন। স্থানীয় লোকজন তাঁকে ঘিরে সমবেত হয়েছে। তারা পরের দিন গোসিঙ্গা বাজারে অনুষ্ঠিতব্য ধর্মসভায় উপস্থিত থেকে কথা বলার জন্য তাঁকে অনুরোধ করেন। তিনি ওদিনের ডায়েরি লিখেছেন, ‘গোসিঙ্গার লোকজন আমাকে আগামীকালের সভায় বক্তৃতা দিতে বলল। আমি ঢাকা যাওয়ার কর্মসূচি বাদ দিয়ে বক্তৃতা দিতে সম্মত হলাম।’
পরেরদিন ০৩ নভেম্বর ১৯৪৭, সোমবার। ডায়েরিতে তাজউদ্দীন আহমদ লিখেছেন, ‘বিকেল সাড়ে ৩টায় আবুল কাশেমকে নিয়ে জনসভায় যোগ দিতে গোসিঙ্গা গেলাম। আসর নামাজের পর বিকেল ৫টায় সভা শুরু হলো। প্রায় ৩শত লোক সভায় উপস্থিত হয়েছে। সিলেটের হাজিমউদ্দিন, বড়াদির মৌলভী হাবিবুর রহমান ও কেওয়ার মৌলভী বক্তা হিসেবে উপস্থিত। গোসিঙ্গার নায়েবও অংশগ্রহণ করেছেন। কাচারির সামনে সভা। প্রথমে আমি প্রায় একঘণ্টা ধরে বক্তৃতা দিলাম। তারপর মাগরিব পর্যন্ত সিলেটের হাজিমউদ্দিন এবং মাগরিবের পর বড়াদির মৌলভী হাবিবুর রহমান ভাষণ দিলেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে সবাই সমস্বরে আমাকে আবার বক্তৃতা দেয়ার জন্য ধরল। আমি আবার রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত বক্তৃতা করলাম। তারপর সভা শেষ হল। আমি পর্যায়ক্রমে ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে কথা বললাম। আমাদের একটা জনগণের রাষ্ট্র গঠন করা উচিত। দুর্নীতি ও ঘুষ শক্ত হাতে বন্ধ করতে হবে। মানুষ খোলামনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবকিছু দেখতে ও বুঝতে শিখুক। একটা সুখী রাষ্ট্র গঠনে সহযোগিতা করার জন্য সকলকে আবেদন জানালাম। দেশের কাজে হিন্দুদের এগিয়ে আসতে হবে। এবং তাদের ভাবা উচিত যে, পাকিস্তান তাদের নিজেদেরই দেশ। অফিসার, মাধ্যমিক শিক্ষক, প্রাথমিক শিক্ষকদের ন্যূনতম বেতন ৫০টাকা ও পাট শ্রমিকদের বেতন ৪০টাকা হওয়া উচিত। রাত সাড়ে ১০টায় ফিরলাম।’
মধ্য আগস্ট ১৯৪৭-এ দেশভাগ হয়ে ভারত-পাকিস্তান দুই নতুন রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদ তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাগরিক। ব্রিটিশের হাত থেকে দেশভাগ হবার মাত্র তিনমাস পরে তাজউদ্দীন আহমদ এই বক্তৃতা করছেন। তখন তিনি ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশই তাকে টেনেছে প্রবলভাবে। তার বয়স তখন মাত্র ২২ বছর। তখনো ইন্টারমিডিয়েট পাস করেননি। কেননা, ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন তাঁর। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরী স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে দ্বাদশ স্থান অধিকার করেছেন। যথাসময়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে পারেন নাই। সেটাও রাজনীতির কারণে। ধারাবাহিক লেখাপড়ায় ছেদ পড়েছে। ১৯৪৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে চতুর্থস্থান লাভ করেন। আমাদের আলোচ্য ঘটনাটি তার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগের ঘটনা। সদ্যস্বাধীন পাকিস্তান দেশে ঢাকার অদূরে প্রত্যন্ত কাপাসিয়ার এক গ্রামের ধর্মসভায় যেয়ে ‘ধর্ম ও রাজনীতি’ নিয়ে কথা বলছেন। তার কথা মানুষ মনোযোগ দিয়ে শুনছে। অনুরোধ করছে আরও বলার জন্য। তিনিও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে কথা বলছেন। সেই মনোযোগী শ্রোতাদের বলছেন ‘জনগণের রাষ্ট্র’ গঠনের কথা। আহবান করছেন ‘ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে’র জন্য। সভাটি হচ্ছে স্থানীয় ভূমি অফিসের কাচারি মাঠে। সভায় ভূমি অফিসের কর্মচারী নায়েবও অংশ নিচ্ছেন। পাকিস্তানে বসবাসরত হিন্দুদের সংশয় কাটাতে তাদের অভয় দিচ্ছেন। নতুন রাষ্ট্রে বেতন কাঠামো কেমন হওয়া দরকার তার দাবিও তুলছেন।
এই ঘটনা তাৎপর্যমণ্ডিত। কেননা, তরুণ বয়সেই তাজউদ্দীন আহমদ জনগণের মনে জায়গা করে নিয়েছেন কর্ম, সততা, নিষ্ঠা আর নৈতিক গুণে। স্থানীয় মানুষের মনের কথা বুঝতে শিখে গেছেন ততদিনে। একটা ন্যায্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণাও তার পরিপক্ব। সেই ধারণা দিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছেন। গ্রামের আমজনতা সেই কথাও শুনছেন। এটা প্রমাণ করে গ্রামের আমজনতার অন্তরে ততদিনে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন তার ব্যক্তিগত অর্জন দিয়েই। এটা খুব বড় বিষয়। কেননা ততদিনে তাজউদ্দীন আহমদ যাবতীয় মানবিক গুণ দিয়ে এটা প্রমাণ করেছেন যে জনগণ তার ওপর ভরসা করতে পারে। সেই জনভালোবাসা আর রাজনৈতিক সততা ততদিনে রপ্ত হয়ে গেছে। যে তাজউদ্দীন আহমদকে আমরা ১৯৭১ সালে দিশাহীন বাংলাদেশে বহুলতর প্রতিকূলতার মধ্যেও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদী অর্জনের নিমিত্তে নিবিষ্ট হয়ে জেগে উঠতে দেখি, সেই তাজউদ্দীন আহমদ আসলে তৈরি হচ্ছেন ছাত্রজীবনেই, ডায়েরি সে সাক্ষ্য দিচ্ছে সুনিপুণভাবে।
৩
১৯৪৭ নানা অর্থেই এভূখণ্ডের মানুষের জীবন বদলাচ্ছে। নতুন জীবন তৈরিও করছে। বহুবিধ বিচিত্র, সুখ ও অসুখের ঘটনা ঘটছে। দাঙ্গা, রক্তপাত, স্বাধীনতা, হিন্দু-মুসলমান বৈরিতা, অসাম্প্রদায়িক দেশগঠনের চেষ্টা—এসবের মধ্যে বেড়ে ওঠা নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা জায়গা পাচ্ছে তরুণ তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে। সেসব পাঠে আমরা তাঁর মনের হদিসও পাচ্ছি কিছুটা। কি ‘র’-ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তিনি বেড়ে উঠছেন তারও নমুনা মিলছে। পড়াশোনা, রাজনীতির ফাঁকে তখন তাঁর জীবন গতিময়। ডায়েরি পাঠ করলে বোঝা যায় জীবনের প্রতি মুহূর্তকে ব্যয় করছেন জনভাবনায়। ০৮ নভেম্বর ১৯৪৭, শনিবার। সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠেছেন। ঘণ্টা তিনেক পড়াশোনাও করেছেন। পত্রিকা পড়েছেন সময় ধরে। ঢাকার রেসকোর্স, নীলক্ষেত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের [আজকের বুয়েট] সামনে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে সন্ধ্যায় নিজের ডেরা, মেসে ফিরেছেন। রাত ১২টায় ঘুমুতে যাবার সময় ডায়েরি লিখতে যেয়ে তাঁর মনে পড়ে গেল, ‘কোনো আগন্তুকের প্রশ্নের জবাব দেবার ব্যাপারে সামান্য বেখেয়াল হলে ঐ ব্যক্তির জন্য তা ভোগান্তি হতে পারে। তাই ভবিষ্যতে কোন প্রশ্নের জবাব দেয়ার ব্যাপারে আমার আরো সতর্ক হওয়া উচিত। আজ সন্ধ্যায় নিমতলী রেলক্রসিংয়ের কাছে একজন ভদ্রলোক আমার কাছে পলাশী ব্যারাকে যাওয়ার পথ জানতে চান। আমি কোনো চিন্তাভাবনা না করে তাড়াহুড়োর মধ্যে তাকে নীলক্ষেতের পথ দেখিয়ে দেই। আমার এই বেখেয়ালের জন্য ভদ্রলোককে কী পরিমাণ দুর্ভোগ যে পোহাতে হয়েছে, তা জানি না।’
এই আত্মবিশ্লেষণ বা আত্মজিজ্ঞাসার অভ্যেসই হয়তো পরিণত তাজউদ্দীন আহমদকে এক অনন্য মানুষ হিসেবে রাজনীতি ও সমাজে দাঁড় করাতে সাহায্য করেছে।
৪
বিদ্যাচর্চার সাথে রাজনীতির একটা আন্তঃযোগ ইতিহাসের অংশ। তাজউদ্দীন আহমদ তার বাইরে নন। তরুণ মনে সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে যখনই কোনো উদ্যোগ বা উদ্যমের কথা মনে হয়েছে, তাতে বিদ্যাচর্চাকে অলিঙ্গন করেছেন নিয়তির মতোই। ১৯৪৭ সালে নতুন দেশে মুসলিম লীগের রাজনীতি তাকে খুব একটা স্বস্তি দেয় নাই। সমভাবাপন্নদের নিয়ে নতুন নতুন উদ্যোগের চেষ্টা চলছে সমবেতভাবেই। ২৬ নভেম্বর ১৯৪৭ বুধবার ডায়েরিতে রাজনীতি চর্চার বয়ান আছে বিস্তর। সেখানেই একটা নতুন দলের কথা পরিকল্পনা করছেন। লিখেছেন,‘আমরা আমাদের দলীয় কাজের ব্যাপারে কিছু সিদ্ধান্ত নিলাম। দলের একটা সচিবালয় খুলতে হবে, যাতে এসব বিভাগ থাকবে। (১) অফিস (কামরুদ্দিন আহমদ) (২) পাঠচক্র (তোয়াহা) (৩) পরিসংখ্যান (অলি আহাদ) (৪) প্রচার-প্রচারণা (তাজউদ্দীন)।এই পরিকল্পনাকারী অখ্যাত তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যেই আমরা বটবৃক্ষের পরিণতিতে বিখ্যাত হয়ে ওঠা তাজউদ্দীন আহমদকে খুঁজে পাই ১৯৭১ ও তার পরের সময়গুলোতে। যখন তাঁর পরিকল্পনার সাথে সাথে, কাকে দিয়ে কোন কাজ সবচাইতে ভালোভাবে করা যাবে, তার নকশাটাও থাকছে সুনির্দিষ্টভাবে। রাষ্ট্রনৈতিকগুণসম্পন্ন, স্টেটসম্যানশিপের যে তাজউদ্দীন আহমদকে আমরা চিহ্নিত করি মুক্তিযুদ্ধকালীন ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্ব কালীন, তার গোড়াপত্তন ঘটছে এসময়ে। ডায়েরি তার সাক্ষ্য দিচ্ছে।
এসময়ের একটি ঘটনাও উল্লেখ্য। এটা অবশ্য ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের ঘটনা। ১২মার্চ শুক্রবার। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেছেন। পড়াশোনা হয়নি। বেরিয়ে পড়েছেন ঘর থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে গেছেন। সেখান থেকে ফেরার পথে, ‘দেখলাম কয়েকজন পুলিশ অফিসার খোলাবাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে আসা চাল আটক করেছে। তারা আমাকে সাক্ষী হবার জন্য বলল। কিন্তু জনগণের সাথে তাদের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে আমি সাক্ষী হতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বেরিয়ে এলাম।’—তাজউদ্দীন আহমদের মনের গতিরেখা বুঝতে ডায়েরির এই বয়ানও তাৎপর্যমণ্ডিত।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিম্নরুচি আর অপসংস্কৃতি যত প্রবল হয়েছে, ততই তাজউদ্দীন আহমদের এসব সদ্গুণকে ঠেকানোর শক্তি তীব্র হয়েছে। পাদপ্রদীপ থেকে তাঁকে কিছুটা দূরেও ঠেলা গেছে—কিন্তু তাতেই তাঁর সামষ্টিক দ্যুতি কমানো গেছে এটা মনে হয় না। কেননা তাজউদ্দীন আহমদ যে চিন্তার চাষাবাদ করতেন, রাজনীতিতে তা জনপ্রিয় না হলেও, রাজষিকগুণে তা সবসময়ই আলাদা রকম সম্মানের চোখে দেখা হয়েছে। ভবিষ্যতেও হয়তো হবে।
৫
তাজউদ্দীন আহমদ নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন, তাতে তাঁর দিনপঞ্জি আছে, সারাদিন কী করেছেন তার নির্মেদ সারসংক্ষেপ আছে নির্মোহ বর্ণনায়। আবেগহীন বয়ান সেটা। তবে, প্রতিদিন যত্ন করে দিনভর আবহাওয়ার একটা অনুপুঙ্খ বর্ণণা দিতেন, সংক্ষেপেই। সেসময় পরিবেশ নিয়ে মানুষের ভাবনা এতটা প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা পায় নাই। একাডেমিক জগতেও তখন পরিবেশ নিয়ে আলোচনা অন্তত এই ভূখণ্ডে ছিল বলে প্রমাণ মেলে না। কিন্তু তরুণ তাজউদ্দীন আহমদ পরিবেশ নিয়ে এতটা ভাবতেন কেন? রাজনীতি ও অর্থনীতির ছাত্র, যিনি পণ করেছেন, জনসেবার নিমিত্তে রাজনীতিই করবেন, আর অন্য কিছু নয়—তাঁর পক্ষে পরিবেশে নিমগ্ন হওয়ার একটা সবিশেষ তাৎপর্য আছে বৈকি? তখনোএই ভূখণ্ডের জনমানুষের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। মানুষের জীবনের উজান-ভাটা, কৃষি-অর্থনীতির ওঠা-নামার সাথে ওতপ্রোতভাবেই জড়িত। তাই প্রকৃতির গতিমুখের খবর না জানলে জনমানুষের জীবনযাত্রার অনেক খবর অজানা থাকবে। প্রকৃতির কারণে মাঠের ফসলের কী হচ্ছে বা কী হবে, সেটা জানা একজন জনসেবক রাজনৈতিক কর্মীর জন্য সবিশেষ গুরুত্ববহ। তাজউদ্দীন আহমদ তাই প্রতিদিন চোখ রাখতেন আবহাওয়া আর পরিবেশের ওপর। সেটা নথিভুক্ত করতেন ডায়েরিতে। ১৯৫১ সালের ১৮ এপ্রিল, বুধবার ডায়েরির শেষাংশে আবহাওয়া নিয়ে তাঁর বয়ানটা উল্লেখ করার মতো, দৈর্ঘ্যে এবং গভীরতায়—‘দুপুর ৩টা পর্যন্ত প্রখর রোদ। তারপর থেকে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করল। শেষ বিকেলে মনে হচ্ছিল বৃষ্টি হবেই। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে আসা প্রবল বাতাস বৃষ্টির জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াল। দমকা বাতাসের কারণে ধুলার মেঘে চারদিক ঢেকে গেল। যদিও বৃষ্টির সম্ভাবনা এখনও আছে, কিন্তু বাতাস সেখানে বাধা হয়ে আছে। তাপমাত্রা কমে গেছে।’
৬
তাজউদ্দীন আহমদের জীবনের যে গতি-প্রকৃতি, রাজনীতিতে তার যে অবদান এবং যেভাবে তাঁর জীবনাবসান হয়েছে, সেসব বিবেচনায় নিলে একথা বলা ধৃষ্টতা হবে না যে, তিনি আদর্শবাদী-কেতাবি-নিয়মতান্ত্রিক-রাষ্ট্রনৈতিক রাজনীতির অনুসারী ছিলেন। মানুষের চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন। সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করতেন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আচারে। ‘মনে এক আর মুখে অন্যরকম’—এই দ্বিচারিতা ছিল না তাঁর মধ্যে। গণতান্ত্রিক রাজনীতি আর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মিশেলে একটা টেকসই সহনীয়-বৈষম্যের রাষ্ট্র নির্মাণে সদা কর্মরত ছিলেন। সেটাকেই ধ্যানজ্ঞান করতেন। আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম, সমাজের প্রচলিত সৎ মূল্যবোধগুলোর গুরুত্বও বুঝতেন ভীষণভাবে। চারপাশে সেসব ভাবনার সমাবেশ খুব একটা ছিল না কখনই, তবু হতোদ্যম হন নাই। ভালো ছাত্র ছিলেন, ধীশক্তি ছিল প্রখর, পড়াশোনা করতেন বিস্তর—ইতিহাসের পঠনও ছিল শক্তিমান, তাই কর্মে বিশ্বাস করতেন, ফলাফলে ছিলেন নির্ভার-নিস্পৃহ। সেটাই তাঁকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিম্নরুচি আর অপসংস্কৃতি যত প্রবল হয়েছে, ততই তাজউদ্দীন আহমদের এসব সদ্গুণকে ঠেকানোর শক্তি তীব্র হয়েছে। পাদপ্রদীপ থেকে তাঁকে কিছুটা দূরেও ঠেলা গেছে—কিন্তু তাতেই তাঁর সামষ্টিক দ্যুতি কমানো গেছে এটা মনে হয় না। কেননা তাজউদ্দীন আহমদ যে চিন্তার চাষাবাদ করতেন, রাজনীতিতে তা জনপ্রিয় না হলেও, রাজষিকগুণে তা সবসময়ই আলাদা রকম সম্মানের চোখে দেখা হয়েছে। ভবিষ্যতেও হয়তো হবে।
১৮ এপ্রিল ১৯৫১ তাজউদ্দীন আহমদ ডায়েরিতে লিখেছেন—‘দুপুর ১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অলি আহাদের সঙ্গে দেখা হলো। তার সঙ্গে যুবলীগ সংগঠনের ব্যাপারে আলোচনা হলো। এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কর্মীদের দূরদর্শিতার উপর। তাকে বললাম, কোন কর্মী যেন অন্য কারও অনূভূতিতে আঘাত না করে, বিশেষ করে বয়স্কদের, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে। যে কারও অসংলগ্ন কথাবার্তা এবং অসৌজন্যমূলক ব্যবহার একটি সংগঠনে সবাই একত্রিত থাকার ক্ষেত্রে বিরাট বাধা। কারণ একটি সংগঠনে বিভিন্ন মন মানসিকতার ব্যক্তিরা একত্রিত হন।’
এই উপলব্ধি থেকে বিচ্যুত হন নাই আমৃত্যু। বোঝা যায়, মনের এই গতিই তাঁর রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।
৭
তাজউদ্দীন আহমদের জীবনকে কেউ কেউ গ্রিক ট্র্যাজিক উপাখ্যানের সমার্থক বলেন। কোথাও কোথাও তাঁকে ‘নিঃসঙ্গ সারথী’ বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর নামেই পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান বহুভাবেই নন্দিত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২, স্বাধীন দেশে জাতির পিতা হিসাবে বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ওই অস্থির-ট্রানজিশনাল সময়েও রাষ্ট্রনৈতিক যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটা প্রমাণ করে, ব্যক্তি তাজউদ্দীন আহমদ কোথাও কোথাও সামষ্টিক হয়ে উঠেছেন প্রাজ্ঞতা-দূরদর্শিতায়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবেও তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা স্মরণযোগ্য। তারপরও ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে মন্ত্রিসভা থেকে তাঁকে সরে যেতে হয়। দলের রাজনীতিতেও গুরুত্ব হারান। এরপর ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ জেলখানার অভ্যন্তরে খুন হবার আগ অবধি তাজউদ্দীন আহমদের জীবন নীরবতা ও উৎকণ্ঠার। এই নীরবতা তাঁর দার্শনিক প্রয়াস। উৎকণ্ঠা, রক্তপাতময় রাষ্ট্রপরিণতি দেখতে পাবার নিশ্চিত সম্ভাবনায়। সেসময়ও ব্যক্তি তাজউদ্দীন আহমদের সকল দুর্ভাবনা, রাষ্ট্রনৈতিক-সামষ্টিক দেশভাবনা ঘিরেই। এই অদ্ভুত সুস্থিত, ‘সক্রেটিসীয় মন’ তাজউদ্দীন আহমদ কীভাবে অর্জন করেছিলেন—তার হদিস আছে ডায়েরিতে। যদিও জীবনভর যেসব ডায়েরি লিখেছেন, তার খুব সামান্যই আমাদের হাতে এসেছে—বেশিটাই হারিয়ে গেছে নানাভাবে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন