চট্টগ্রামের কিংবদন্তি এক ভাবসংগীত শিল্পী!

অ+ অ-

 

সাধক আবদুল গফুর হালীকে নতুন করে চেনানোর কিছু নেই। বাংলার ভাবজগতের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও নাট্যকার তিনি। শুধু চাটগাঁয় নয়, দেশের অপরাপর প্রান্তেও তার নামে নানা কিংবদন্তি চালু। হালীর ভাবসংগীতে আসা নিছক ঘটনা নয়, ভাবের সুর তাকে সে পথে ধাবিত করেছে। সেটা কীভাবে? তার বিয়ের পরের ঘটনা। ১৯৫৫ কি ১৯৫৬ সাল হবে। সংসার গোছাতে বাবার ব্যবসায় মনোযোগ দিলেন। সে সময় লাল পোশাক পরা মাইজভাণ্ডারির লোকেরা তার মনোজগতে নাড়া দেয়। ছোটবেলা থেকে সূফিসাধক আসকর আলী পণ্ডিতের গান শুনে বড় হয়েছেন তিনি। সবচেয়ে বেশি আলোড়িত হয়েছিলেন রমেশ শীল, বজলুল করিম মন্দকিনি আর মৌলভী হাদীর ভাবসংগীতে। সে সময় একবার তিনি হাজির হন মাইজভাণ্ডার শরিফে। মাইজভাণ্ডারের ঢোলের বাদ্য আর গান তাকে অস্থির করে তোলে। মন কাড়ে ভক্তদের বিনয় ভাববিনয় ভাব মানে ভক্তির আনত ভাব। যে ভাব ভক্তির রসে সিক্ত। ভক্তির প্রেমে হারিয়ে যাওয়া। সংগীতের ভেতর নিজেকে সমর্পণ করা। পরমের সঙ্গে মিশে থাকা।

সেবার সঙ্গীরা তাকে বললেন গান গাইতে। গাওয়ার পর যখন চোখ খুললেন, দেখেন হারমোনিয়ামের ডালা টাকায় ঢেকে গেছে। তারপর বাড়ি ফিরে হালী অনুভব করলেন, কে যেন বলছে, লেখ, লেখ! লিখলেন আরেক কিংবদন্তি গান আর কতকাল খেলবি খেলা/ মরণ কি তোর হবে না/ আইল কত গেল কত/ কোথায় তাদের ঠিকানা। সেও এক জ্ঞানজগতে নিজেকে হারিয়ে ফেলার দুনিয়া। ভাবের প্রেমসাগরে নিজেকে হারিয়ে সুরের ভেতর নিজেকে ধরার জগৎ। প্রশ্ন হলো, ভাবজগতের ঠিকানা কি? নানা স্থানে এর ব্যাখ্যাও হাজির করেছেন তিনি। হালী শব্দটাকে বলেছেন, এলহাম। আরবি এলহাম শব্দের বাংলাও করেছেন প্রেরিত। কথাটা ইংরাজি ইন্সপ্রিরেশান শব্দের মতো শোনায়। ভাববিদ্যার কথা মানলে এলহাম আদতে অধরাকে ধরা। ভক্তি দিয়ে ধরা; ভাব দিয়ে ধরা। প্রেম দিয়ে ধরা। অধরা যেভাবে ধরাভাবে কথা বা সুর হয়ে ফোটে। কি ফোটে হালীর গানে?

কোনো বিদ্যায়তনে লেখাপড়া আর সংগীতের হাতেখড়ি নেই তার। কবি সোমেশ্বর অলির নেয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, যারা গান লেখেন, যারা কবিতা লেখেন, তাদের কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এটা ভাবের জিনিস। প্রশ্ন হচ্ছে, ভাব আসে কোথা হতে? হালীর কথা, ভাব আসে প্রকৃতি হতে। ফলে প্রকৃতি তার গুরু। হালীর তর্ক সেখানেই শেষ নয়। তার মত, সংগীত গুরুমুখী বিদ্যা। ভাব দিয়ে ভাবকে ধরার কর্ম। মানে অধরাকে ধরবার ভাব ধর্ম। হালীর দার্শনিক মত, আত্মা না চিনলে আত্মার উদ্ধার হবে না। আত্মাকে চেনা মানে নিজেকে চেনা। হালীর এসব কথা দার্শনিক সক্রেটিসের কথার তুল্য। আদতে হালীর এমন ভাববাচ্য বাংলার চিন্তাজগতের মূলধারারই কথা। কেন মূলধারা?

আমরা যে আধুনিক ভোগদর্শনের জগতে বাস করি, সেখানে বস্তুত প্রেম নেই। ‘ভাব’ নেই। ‘মায়া’ নেই। অধরা জগৎ নেই। আছে বস্তুগত অবক্ষয়ের অন্য রূপ। আমাদের তর্ক সেটা নয়। আমাদের তর্ক বাংলার ভাবসম্পদের কথা নিয়ে। যে সম্পদ আত্মানুসন্ধানের ভেতর সমাজে জীব আর প্রকৃতিতে প্রেমভাব জারি রাখে। প্রেম দুভাবে একদিকে জীব ও জীবে আর অন্যদিকে জীব ও প্রকৃতিতে। যেখানে পরম আর সুন্দরের মিলন হয়। সেটা কেমন?

সাধক আবদুল গফুর হালী তিন ধরনের গান রচনা করেছেন। আধ্যাত্মিক গান, বিচ্ছেদী গান আর মিলনাত্মক গান। ভাবগত তিন ধরনের গানের কেন্দ্রে আছে প্রেম। ভাবের সাগর থেকে প্রেম ছেঁকে তোলার মতন। তার আধ্যাত্মিক গান মূলত আত্মানুসন্ধানের সাধন। পরমের সঙ্গে আমি ভাবের মিলন। তার মত, আমি এখানে নাই মানে আমি অন্য কোথাও আছি। ফলে মানুষ মরণশীল নয়। এ অমরণশীল আত্মসন্ধানই পরমের সঙ্গে আমির সাক্ষাৎ মিলন। আমি এখানে মানুষেরই পরম রূপ। মানে মানবাত্মার নূরের মেলায় বসতি। জাতপাত ভুলে যেখানে মানুষ পরমের সাধনা করে। কেননা মানুষ নিছক ব্যক্তি নয়, ব্যক্তির ধারণা মাত্র। ব্যক্তি নূর ওর্ফে আলো পেতে হলে পরমের কাছে যেতে হবে। পরম মানে অপরের ধ্বনি বা রব। অপর রবের সাক্ষাৎ পেলে ব্যক্তি মানুষ হয়ে ওঠে। হালীর সেই বিখ্যাত গান—‘দেখে যারে মাইজভাণ্ডারে বইসাছে নূরের মেলা এ তর্কের সাক্ষী। আরো শত শত উদাহরণ আছে তার গানে। বস্তুত নূর এখানে মানুষের জ্ঞানের নামান্তর মাত্র। ব্যক্তিজ্ঞানের সঙ্গে নূরভাব উদয় হলে মানুষ জন্ম নেয়। আধ্যাত্মিক গানের বাইরেও ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির কিংবা ব্যক্তির সঙ্গে প্রকৃতির সম্বন্ধ তার গানে বারে বারে এসেছে। তাতে আছে ভক্তি আর বিভক্তি রস। ভক্তি মূলত প্রেম উৎপাদনের মিলনাত্মক সম্পর্ক। আর বিভক্তি মূলত বিচ্ছেদের কুঠুরি। তবে দুই রসেরই গোড়া প্রেম। যেখানে প্রেম নেই, সেখানে ভক্তিও নেই। আর বিভক্তির মিলনই প্রেম।

জীবদ্দশায় হালীর অসংখ্য গান এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। আশির দশকের শেষদিকে বাংলাদেশে আসেন জার্মান হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক হান্স হার্ডার। হার্ডার ২০০৪ সালে ডার ফেরুকটে গফুর মানে পাগলা গফুর বলে এক গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তাতে হালীর জনপ্রিয় ৭৮টি গান স্থান পায়। বইয়ে হালীর গানকে তিনি পূর্ব বাংলার মরমি গান বলে আখ্যা দেন। মূলত আবদুল গফুর হালী দুই ভাষায় গান ও নাটক লিখেছেন। চাটগাঁইয়া বাংলায় আর প্রমিত বাংলায়। গানের মতো তার নাটকও জনপ্রিয় হয়েছিল, নানা মিথ তৈরি করেছিল। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ রেডিওর অনুরোধে তিনি চাটগাঁইয়া ভাষায় গুলবাহার নাটক লেখেন। সম্ভবত এটিই চাটগাঁইয়া ভাষার প্রথম মঞ্চ নাটক। তবে অদৃশ্য কারণে বাংলাদেশ রেডিও নাটকটি প্রচার করেনি। পরে এটি প্রদর্শিত হয় কক্সবাজারের যাত্রামঞ্চে। প্রথম শোতেই নাটকটি দর্শক জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে। নাটকের একটি দৃশ্যে অঞ্জু ঘোষ একটি কলাগাছ ধরে কান্নাকাটি করেছিলেন। প্রদর্শনী শেষে নাটকের সেই কলাগাছ নিলামে ওঠে। কলাগাছটির দাম নিলাম হয় ১০০ টাকায়। এ কিংবদন্তি গবেষক নাসিরউদ্দিন হায়দারের লেখায়ও উল্লেখ আছে। তার নাটকের মধ্যে নীলমণি, চাটগাঁইয়া সুন্দরী, কুশল্যাপাহাড়, সতী মায়মুনাআশেক বন্ধু উল্লেখযোগ্য। ভাবচিন্তার দুটি বই তত্ত্বনিধি আর জ্ঞানজ্যোতি তার অনন্য কীর্তি। গান লিখেছেন হাজার দুয়েক। স্বরলিপি করেছেন। গানের বই আছে বেশ কয়টি। শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, শেফালি ঘোষ, কল্যাণী ঘোষের মতো কিংবদন্তি শিল্পীরা তার গানে সুরারোপ করেছেন। 

বাংলার জাতীয় সাধক আবদুল গফুর হালীর জন্ম ১৯২৯ সালে, চট্টগ্রামের পটিয়ার রশিদাবাদে। তিনি গত হন ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর। পরিণত বয়সেই হালী চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গেছেন অসীম ভাবসম্পদ। তার রেখে যাওয়া ভাবসম্পদ আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিরই মূলধারা। জাতীয় সংস্কৃতি এই জন্য যে, তিনি বাংলার জনসমাজের ভেতর থেকে উঠে এসেছেন। জনসমাজের ভাষা, অন্তর্গত চেতনাপ্রবাহ, জীবনাচরণের চিহ্ন তার কথা আর সুরে গেঁথে আছে। যেখানে বর্ণ নেই, জাতপাত নেই, ভেদাভেদ নেই। আছে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে আত্মিক মিলন, আছে মানবপ্রেম, আছে দিব্যজ্ঞানের তত্ত্বকথা, আছে সমাজের বিভেদহীন সংস্কৃতির সন্ধান। যে সংস্কৃতির ভেতর জেগে আছে পরমের সঙ্গে মানুষের মর্ম; লীলা, রস আর অপার সৌন্দর্য। ভোগবস্তুর বাইরে মানুষ যেখানে বেঁচে থাকে, তেমনি হালীও বেঁচে থাকবেন সাধারণ মানুষের অন্তরে। তিনি অমর ভাবসাধক। আমরণ গেয়েছেন মুক্তির সংগীত। তাই কোনো পুরস্কার কিংবা লোভ-লালসা তাকে কলুষিত করতে পারেনি। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি একজন জাতশিল্পী ও ভাবতত্ত্বজ্ঞানী। যে মানুষের মননের মুক্তি দেয়। সাংস্কৃতিক বন্ধনে আবদ্ধ করে।