সিন্দবাদ ও অন্যান্য কবিতা

অ+ অ-

 

ফররুখ আহমদ

ফররুখ আহমদ কবি ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরা জেলার মাঝআইল গ্রামে। গ্রামের পাঠশালাতেই তার শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে তিনি কলকাতার বালিগঞ্জ সরকারি হাই স্কুলে ভর্তি হন। ঐ সময় কবি গোলাম মোস্তফা ছিলেন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। প্রাথমিক জীবনে কবিত্ব বিকাশে কবি গোলাম মোস্তফা তাকে উৎসাহ দেন। ১৯৩৭ সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৯ সালে কলকাতার রিপন কলেজ হতে আইএ পাস করেন। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ ও সিটি কলেজে, প্রথমে দর্শন ও পরে ইংরেজিতে অনার্সে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু পড়াশুনা আর শেষ করতে পারেননি। ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক মোহাম্মদীপত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। ঢাকা বেতারে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন তিনি। ঢাকা বেতারে তিনি ছোটদের খেলাঘর অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ফররুখ আহমদের ভূমিকা অনন্য। ওই সময় তার মধুর চেয়েও মধুর যে ভাই আমার দেশের ভাষা গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থসাত সাগরের মাঝি [১৯৪৪], সিরাজাম মুনিরা [১৯৫২], নৌফেল ও হাতেম [১৯৬১], মুহূর্তের কবিতা [১৯৬৩], ধোলাই কাব্য [১৯৬৩], হাতেম তায়ী [১৯৬৬], নতুন লেখা [১৯৬৯], কাফেলা [১৯৮০], হাবিদা মরুর কাহিনী [১৯৮১], সিন্দবাদ [১৯৮৩], দিলরুবা [১৯৮৪]। শিশুতোষগ্রন্থপাখির বাসা [১৯৬৫], হরফের ছড়া [১৯৭০], চাঁদের আসর [১৯৭০], ছড়ার আসর [১৯৭০] ও ফুলের জলসা [১৯৮৫]। তিনি বাংলা একাডেমি [১৯৬০], প্রেসিডেন্ট পদক প্রাইড অব পারফরমেন্স [১৯৬৫], আদমজী পুরস্কার [১৯৬৬], ইউনেস্কো পুরস্কার [১৯৬৬], একুশে পদক [১৯৭৭-মরনোত্তর], স্বাধীনতা পদক [১৯৮০-মরনোত্তর] লাভ করেন। ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর তার মৃত্যু হয়। নানা রাজনৈতিক কারণে বাংলাভাষার শক্তিমান কবি ফররুখ আহমদের তেমন মূল্যায়ন হয়নি। এটা বাংলাভাষা ও সাহিত্যের জন্য খুব সুখকর হয়নি। আমরা প্রতিধ্বনির পাঠকদের জন্য আমরা ফররুখ আহমদের একগুচ্ছ বাছাই কবিতা প্রকাশ করেছি। পাঠক নিশ্চয়ই তাঁর কবিতার রস আস্বাদন করবেন।

 

ফররুখ আহমদের কবিতা

সিন্দবাদ

কেটেছে রঙিন মখমল দিন নতুন সফর আজ,
শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক,
ভাসে জোরওয়ার মউজের শিরে সফেদ চাঁদির তাজ,
পাহাড়-বুলন্দ ঢেউ বয়ে আনে নোনা দরিয়ার ডাক;
নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি সিন্দবাদ!
আহা, সে নিকষ আকীক বিছানো কতদিন পরে ফিরে
ডেকেছে আমাকে নীল আকাশের তীরে,
ডেকেছে আমাকে জিন্দিগী আর মওতের মাঝখানে
এবার সফর টানবে আমাকে কোন স্রোত কেবা জানে!
ঘন সন্দল কাফুরের বনে ঘোরে এ দিল বেঁহুশ,
হাতীর দাঁতের সাঁজোয়া পরেছে শিলাদৃঢ় আবলুস,
পিপুল বনের ঝাঁজালো হাওয়ায় চোখে যেন ঘুম নামে;
নামে নির্ভীক সিন্ধু ঈগল দরিয়ার হাম্মামে।
কেটেছে রঙিন মখমল দিন ওজুদে চিকনা সরে,
তবু দূরচারী সফরের ঢেউ ভেসে এল বন্দরে,
হাতীর হাওদা ওঠাও মাহুত কিংখাব কর শেষ;
আজ নিতে হবে জংগী সাঁজোয়া মাল্লার নীল বেশ।
রোষে ফুলে ওঠে কালাপানি যেন সুবিশাল আজদাহা,
মউজের মুখে ভাসছে কিশতী শ্বেত,
জানি না এবার কোন স্রোতে মোরা হব ফিরে গুমরাহা
কোথায় খুলবে নওল ঊষার রশ্মিধারা সফেদ;
কোথায় জাহাজ হবে ফের বানচাল,
তক্তায় ভেসে কাটবে আবার দরিয়ায় কতকাল;
সে কথা জানি না, মানি না সে কথা দরিয়া ডেকেছে নীল!
খুলি জাহাজের হালে উদ্দাম দিগন্ত ঝিলমিল,
জংগী জোয়ান দাঁড় ফেলে করি দরিয়ার পানি চাষ,
আফতাব ঘোরে মাথার উপরে মাহতাব ফেলে দাগ;
তুফান ঝড়িতে তোলপাড় করে কিশতীর পাটাতন;
মোরা নির্ভীক সমুদ্রস্রোতে দাঁড় ফেলি বারো মাস।

সুরাত জামাল জওয়ানির ঠোঁটে বেকার নওজোয়ান
ভাবে জীবনের সব মধু লোটে কমজোর ভীরু প্রাণ,
এ আশ্চর্য আমাদের কাছে! কিশতী ভাসায়ে স্রোতে
আমরা পেয়েছি নিত্য নতুন জীবনের তাজা ঘ্রাণ।
পাকে পাকে ঘুরে তীরবেগে ছুটে আবর্তে দিশাহারা,
ক্ষুধার ধমকে ঘাস ছিঁড়ে খেয়ে আকাশে জাগায়ে সাড়া,
জালিমের চোখ আগুনে পোড়ায়ে গুঁড়ায়ে পাপের মাথা;
দেখেছি সবুজ দরিয়া জাজিমে স্বপ্ন রয়েছে পাতা।
হাজার দ্বীপের বদ রুসমের উপর লানত হানি,
কিশতীর মুখ ফিরায়েছি মোরা টানি,-
বুরাঈর সাথে পেয়েছি ভালাই অফুরান জিন্দিগী,
আবলুস-ঘন আঁধারে পেখম খুলেছে রাতের শিখী।
আর থেকে থেকে দমকা বাতাসে নারিকেল শাখে হাওয়া
ভোলায়েছে সব পেরেসানী শুরু হয়েছে গজল গাওয়া,
সুরাত জামাল জওয়ানির ঠোঁটে কেটেছে স্বপ্ন রাত
শুনেছি নেশার ঘোর কেটে যেতে এসেছে নয়া প্রভাত।
জড়ো করি লাল পোখরাজ আর ইয়াকুত ভরা দিন
দরিয়ার বুকে নামায়েছি ফের বে-দেরেগ সংগিন,
সমুদ্র-সিনা ফেড়ে ছিটে চলে কিশতী, স্বপ্ন সাধ;
নতুন পানিতে সফর এবার হে মাঝি সিন্দবাদ।
আজ নির্ভীক মাল্লার দল ছোটে দরিয়ার টানে,
পান করি সিয়া সুতীব্র জালা কলুষিত বিয়াবানে;
হারামি মওত ঢাকে সারা মন, দেহ,
গলিজ শহরতলীতে আবার জেগে ওঠে সন্দেহ;
বিষ নিশ্বাসে জিন্দিগী ফের কেঁদে ওঠে বিস্বাদ,
নতুন পানিতে সফর এবার হে মাঝি সিন্দবাদ।
কালো আকীকের মত এ নিকষ দরিয়ার বুক ছিঁড়ে
চলো সন্দল বন-সন্ধানে অজানা দ্বীপের তীরে,
হালের আঘাতে নোনা পানি ছুঁড়ে রাহা খোঁজে গুমরাহা,
পার হয়ে যাও আয়েশী রাতের ফাঁদ;
পাথর জমানো দরিয়ার তীরে মওতের বুকে আহা,
কাফুরের মত নতুন জীবন ডাকছে সিন্দবাদ।
জড়তার রাত শেষ হয়ে এল আজ,
কেটেছে পল্কা নরম আয়েশ আশরতে বহুদিন,
মর্চে ধরেছে কবজায়; ম্লান তাজ।
আজ ফুঁড়ে চলো দরিয়ার সংগিন,
ভাঙো এ নরম মখমলে ছায়া দিন;
মাতমি-লেবাস ফেলে আজ পরো মাল্লার নীল সাজ।
আমরা মরি না, সুখা মাটি শুধু তাকায় শংকাকুল,
দরিয়ার ডাকে এক লহমায় ভাঙে আমাদের ভুল,
প্রকাশিত নীল দিন;
দেখে সফরের প্রসারিত পথ দিগন্ত-স্রোতলীন।
আনি আলমাস গওহর লুটে আনি জামরুদ লাল,
নিথর পাথার বালাখানা থেকে ওঠাই রাঙা প্রবাল,
এরা জিঞ্জিরে আটক চিড়িয়া হীন কামনায় বুড়া
শিরাজী মত্ত! পাথর হানিয়া করি সব মাথা গুঁড়া।
রাতে জেগে শুনি, খোদার আলমে বিচিত্র কল্লোল
তারা ছিটে পড়ে মধ্য সাগরে জাহাজে জাগায় দোল,
আমরা নাবিক জংগী জোয়ান ইশারা পেয়েছি কত
মউজের মুখে তাই ভেসে যাই টুকরা খড়ের মত।
বজ্র আওয়াজ থামায়ে গভীর দরিয়ায় ওঠে চাঁদ
দিলের দুয়ারে মাথা ঠুকে মরে নাবিক সিন্দবাদ!
ভেঙে ফেলে আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ,
দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাঁধ,
ছিঁড়ে ফেলে আজ আয়েশী রাতের মখমল-অবসাদ,
নতুল পানিতে হাল খুলে দাও, হে মাঝি সিন্দবাদ!

 

সাত সাগরের মাঝি

কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হল জানি না তা।
নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।

দুয়ারে তোমার সাত-সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা।
তবু জাগলে না? তবু, তুমি জাগলে না?
সাত-সাগরের মাঝি চেয়ে দেখ দুয়ারে ডাকো জাহাজ,
অচল ছবি সে, তসবির যেন দাঁড়ায়ে রয়েছে আজ।
হালে পানি নাই, পাল তার ওড়ে নাকো,
হে নাবিক! তুমি মিনতি আমার রাখো:
তুমি উঠে এসো, তুমি উঠে এসো মাঝিমাল্লার দলে
দেখবে তোমার কিশতি আবার ভেসেছে সাগরজলে,
নীল দরিয়ায় যেন সে পূর্ণ চাঁদ,
মেঘ-তরঙ্গ কেটে কেটে চলে ভেঙে চলে সব বাঁধ।
তবু তুমি জাগো, কখন সকাল ঝরেছে হাসনাহেনা
এখনো তোমার ঘুম ভাঙলো না? তবু, তুমি জাগলে না?

দুয়ারে সাপের গর্জন শোনো নাকি?
কত অসংখ্য ক্ষুধিতের সেথা ভীড়,
হে মাঝি! তোমার বেসাতি ছড়াও, শোনো,
নইলে যে সব ভেঙে হবে চৌচির।
তুমি দেখছ না, এরা চলে কোন আলেয়ার পিছে পিছে?
চলে ক্রমাগত পথ ছেড়ে আরও নীচে।
হে মাঝি! তোমার সেতারা নেভেনি একথা জানো তো তুমি,
তোমার চাঁদনী রাতের স্বপ্ন দেখেছে এ মরুভূমি,
দেখো জমা হল লালা, রায়হান তোমার দিগন্তরে;
তবু কেন তুমি ভয় পাও, কেন কাঁপো অজ্ঞাত ডরে।

তোমার জাহাজ হয়েছে কি বানচাল,
মেঘ কি তোমার সেতারা করে আড়াল?
তাই কি অচল জাহাজ ভাঙা হাল
তাই কি কাঁপছে সমুদ্রে ক্ষুধাতুর
বাতাস কাঁপানো তোমার ও ফাঁকা পাল?

জানি না, তবু ডাকছি তোমাকে সাত দরিয়ার মাঝি,
প্রবাল দ্বীপের নারিকেল শাখা বাতাসে উঠেছে বাজি?
এ ঘুমে তোমার মাঝিমাল্লার ধৈর্য নাইকো আর,
সাত সমুদ্র নীল আক্রোশে তোলে বিষ ফেনভার,
এদিকে অচেনা যাত্রী চলেছে আকাশের পথ ধরে
নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।
বেসাতি তোমার পূর্ণ করে কে মারজানে মর্মরে?
ঘুম ঘোরে তুমি শুনছ কেবল দুঃস্বপ্নের গাথা।
উচ্ছৃঙ্খল রাত্রির আজো মেটেনি কি সব দেনা?
সকাল হয়েছে। তবু জাগলে না? 
তবু তুমি জাগলে না?
তুমি কি ভুলেছ লবঙ্গ ফুল, এলাচের মৌসুমী,
যেখানে ধূলিতে কাঁকরে দিনের জাফরান খোলে কলি
যেখানে মুগ্ধ ইয়াসমিনের শুভ্র ললাট চুমি
পরীর দেশের স্বপ্ন সেহেলি জাগে গুলে বকাওলী!

ভুলেছ কি সেই প্রথম সফর জাহাজ চলেছে ভেসে
                                  অজানা ফুলের দেশে,
ভুলেছ কি সেই জমরুদ-তোলা স্বপ্ন সবার চোখে
                                     ঝলসে চন্দ্রলোকে,
পাল তুলে কোথা জাহাজ চলেছে কেটে কেটে নোনা পানি,
                                                    অ-শ্রান্ত সন্ধানী 
দিগন্ত নীল-পর্দা ফেলে সে ছিঁড়ে
সাত সাগরের নোনা পানি চিরে চিরে।

কোন্ অজ্ঞাত বন্দরে এসে লাগলো সেই জাহাজ
মনে পড়ে নাকো আজ,
তবুও সেখানে ভরেছে জাহাজ মারজানে মর্মরে
এইটুকু মনে পড়ে।

কবে যে তোমার পাল ফেটে গেছে উচ্ছৃঙ্খল ঝড়ে,
তোমার স্বপ্নে আজ অজগর দুঃস্বপ্নেরা ফেরে।
তারা ফণা তোলে জীর্ণ তোমার মৃত্যুর বন্দরে
তারা বিষাক্ত করেছে তোমার নুয়ে পড়া আকাশেরে।
তবু শুনবে কি, তবু শুনবে কি সাত-সাগরের মাঝি
শুকনো বাতাসে তোমার রুদ্ধ কপাট উঠেছে বাজি;
এ নয় জোছনা—নারিকেল শাখে স্বপ্নের মর্মর,
এ নয় পরীর দেশের ঝরোকা নারঙ্গী বন্দর
এবার তোমার রুদ্ধ কপাটে মানুষের হাহাকার,
ক্ষুধিত শিশুর কান্নায় শেষ সেতারের ঝংকার।

আজকে তোমার পাল ওঠাতেই হবে,
ছেঁড়া পালে আজ জুড়তেই হবে তালি,
ভাঙা মাস্তুল দেখে দিক করতালি,
তবুও জাহাজ আজ ছোটাতেই হবে।

কে জানে কখন কেটেছে তোমার স্বপ্নমুগ্ধ রাত,
আজকে কঠিন ঝড়ের আঘাতে দ্বারে করে কশাঘাত,
সর্প-চিকন জিহ্বায় তার মৃত্যুর ইঙ্গিত,
প্রবল পুচ্ছ আঘাতে তোমার রঙীন মিনার ভাঙে।
হে মাঝি! তবুও থেমো না দেখে এ মৃত্যুর ইঙ্গিত,
তবুও জাহাজ ভাসাতে হবে এ শতাব্দী মরা গাঙে।

এখানে এখন রাত্রি এসেছে নেমে,
তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরণ,
এখানে এখন প্রবল ক্ষুধায় মানুষ উঠেছে কেঁপে
এখানে এখন অজস্র ধারা উঠছে দুচোখ ছেপে
তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরণ

কাঁকর বিছানো পথ,
কত বাধা, কত সমুদ্র, পর্বত,
মধ্যদিনের পিশাচের হামাগুড়ি,
শকুনি ফেলেছে ছায়া আমাদের মাথার উপরে উড়ি—
ফেলেছি হারায়ে তৃণঘন বন, যত পুষ্পিত বন,
তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরন—
শাহী দরজার সকল কপাট অনেক আগেই খোলা,
অনেক আগেই সেখানে দ্বাদশী জোছনা দিয়েছে দোলা। 

হে মাঝি! তোমার নোঙ্গর তুলবে না?
এখনো কি আছে দেরি?
হে মাঝি! তোমার পাল আজ খুলবে না?
এখনো কি তার দেরি?

বাতাসে কাঁপছে তোমার সকল পাল
এবার কোরো না দেরি,
নোনা পানি যদি ছুঁয়েছে তোমার হাল
তাহলে কোরো না দেরি,
এবার তাহলে বাজাও তোমার যাত্রার জয়ভেরী,
আসুক যাত্রী পথিক, হে মাঝি এবার কোরো না দেরি।
দেরি হয়ে গেছে অনেক জানো তা তুমি,
ফিরে গেছে কত জাহাজ-ভাসানো দরিয়ার মৌসুমী;
কত এলাচের দানা উড়ে গেছে ঝড়ে
দারচিনি-শাখা ভেঙেছে বনান্তরে,
মেশকের বাস বাতাস নিয়েছে লুটি
মৃত্যু এখন ধরেছে তোমার টুটী,
দুয়ারে জোয়ার ফেনা;
আগে বহু আগে ঝরেছে তোমার সকল হাসনাহেনা।

সকল খোশবু ঝরে গেছে বুস্তানে,
নারঙ্গী বনে যদিও সবুজ পাতা—
তবু তার দিন শেষ হয়ে আসে ক্রমে—
অজানা মাটির অতল গভীর টানে
সবুজ স্বপ্ন ধূসরতা বয়ে আনে
এ কথা সে জানে 
এ কথা সে জানে।

তবু সে জাগাবে সব সঞ্চয়ে নারঙ্গী রক্তিম,
যদিও বাতাসে ঝরছে ধূসর পাতা;
যদিও বাতাসে ঝরছে মৃত্যু হিম,
এখনো যে তার জ্বলে অফুরান আশা;
এখনো যে তার স্বপ্ন অপরিসীম।

হে মাঝি! এবার তুমি পেয়ো না ভয়,
তুমিও কুড়াও হেরার পথিক-তারকার বিস্ময়,
ঝরুক এ ঝড়ে নারঙ্গী পাতা, তবু পাতা অগণন
ভিড় করে—যেথা জাগছে আকাশে হেরার রাজ-তোরণ।
সে পথে যদিও পার হতে হবে মরু
সে পথে যদিও দরিয়ার নোনা পানি,
তবুও সেপথে আছে মঞ্জিল, জানি আছে ছায়াতরু
পথে আছে মিঠে পানি।
তবে পাল খোল, তবে নোঙ্গর তোলো;
এবার অনেক পথশেষে সন্ধানী!
হেরার তোরণ মিলবে সমুখে জানি।
তবে নোঙ্গর তোলো;
তবে তুমি পাল খোলো,
তবে তুমি পাল খোলো।।

 

পুরানো মাজারে

পুরানো মাজারে শুয়ে মানুষের কয়খানা হাড়
শোনে একরাত জাগা পাখীর আওয়াজ। নামে তার
ঘনীভূত রাত্রি আরো ঘন হ’য়ে স্মৃতির পাহাড়।
এই সব রাত্রি শুধু এক মনে কথা কহিবার
নিজেদের সাথে। জানি; –মুসাফির–ধূলির অতিথি
প্রচুর বিভ্রমে, লাস্যে দেখেছিল যে তন্বী পৃথিবী 
পুঞ্জীভূত স্মৃতি তার জীবনের ব্যর্থ শোক-গীতি:
রাতজাগা পাখীর আওয়াজ: জমা আঁধারের ঢিবি–
যেন এক বালুচর, দুই পাশে তরঙ্গ-সঙ্কুল
জীবনের খরস্রোত, নিষ্প্রাণ বিশুভ্র বালুচরে
কাফনের পাশ দিয়ে বেজে চলে দৃঢ় পাখোয়াজ।
পুরানো ইটের কোলে শোনে কারা সংখ্যাহীন ভুল
ঝরেছে অপরাজেয় অগণিত মৃত্যুর গহ্বরে।
মাজারে কাঁপায়ে তোলে রাতজাগা পাখীর আওয়াজ।।

 

বর্ষার বিষণ্ণ চাঁদ

বর্ষার বিষণ্ণ চাঁদ এ রাতেও উঠেছে তেমনি
যেমন সে উঠেছিল হাজার বছর আগেকার
বৃষ্টি-ধোয়া আসমানে। সে রাত্রির অস্ফুটে ব্যথার
মৃদু স্বর আছে এ আকাশে। সেই ক্ষীণ কণ্ঠধ্বনি
আমার মনের তারে বেজে ওঠে আপনা আপনি,
শ্রাবণ মেঘের মাঝে ডুবে যায় চাঁদ যতবার;
যতবার ভেসে ওঠে। দূরে এক অস্পষ্ট মাজার
শতাব্দীর স্মৃতি নিয়ে জাগায় ব্যথার আবেষ্টনী।
হাজার বছর পরে এই চাঁদ বিষন্ন বর্ষার
ব’য়ে নিয়ে যাবে স্মৃতি জনপদে বেদনা-মন্থর;
অস্পষ্ট ছায়ার মত, যেখানে এ রাত্রির দুয়ারে,
খুলে দেবে অন্ধকারে জীবনের বিস্মৃত প্রহর;
বৃষ্টি ধোয়া আসমানে জাগাবে সে এই ক্লান্ত স্বর;
হাজার বছর পরে একবার শুধু একবার।।

 

শীতরাত্রির আলাপ

দুনিয়া: সেই উজ্জ্বল আসমানি শামিয়ানা
লুকালো কোথায়, হয়নি আমার জানা।
আসমান: ছিলাম যেখানে, আছি আমি সেখানেই।
পাই না তোমাকে; তোমারি তো দেখা নেই।
দুনিয়: দু’চোখে আমার মৃত্যুর কালো আঁধি।
আসমান: হিম কুয়াশায় বন্দিনী শাহজাদী।।