কয়েকটি হ্যাঁ ও না-এর গল্প

অ+ অ-

 

|| স্বাধীনতা ||

তূর্যের সাথে ছাড়াছাড়ির প্রায় পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে। বিচ্ছেদের প্রস্তাবটা মিলি নিজেই দিয়েছিল। সম্পর্কটা কেমন যেন একঘেয়ে হয়ে পড়েছিল। তূর্য খুব বেশি ভাল ছেলে। মিলি যা চাইতো তূর্য তাইই করতো। কোনো রকম বিরোধ ছাড়াই মিলির সব কথা মেনে নিতো। কোনো একস্থানে অপেক্ষা করতে বললে, অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে মিলি দেখতো তূর্য ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে বা বসে আছে। একবার মিলি তাকে সিগারেট ছেড়ে দিতে বলেছিল, তূর্য ঠিক ঐ মুহূর্তেই খসখস করে দেয়ালের সাথে ঘষে আগুন নিভিয়ে বলেছিল–‘এই ছেড়ে দিলাম, আর খাবো না। তূর্য আসলেই সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিল। তার প্রতি তূর্যর একাগ্রতা ও নিষ্ঠার কোনো ঘাটতি ছিল না, তবে মিলির মনে প্রচণ্ড রকমের গতানুগতিকতার পাহাড় উপছে পড়ছিল। তূর্য দেখতে যতই নেক্সট-টু-টম-ক্র্যুজ হোক না কেন, মিলি তাকে ডিচ্ না করে পারেনি।

মিলি মনে করেছিল, ছেলেরা প্রত্যাখ্যাত হলে যেমন উদ্ভট কিছু কাণ্ড করে বসে, তূর্যও তাই করবে; মিলির নামে কলংকাবৃত প্রচারণা চালাবে; একসাথে তোলা তাদের ছবিগুলো হয়তো সবার কাছে উন্মোচিত করে দেবে; বেনামে ইমেইল লিখবে। তূর্য এসব কিছুই করেনি। যেদিন বিজনেস ফ্যাকাল্টির ক্যান্টিনে বসে মিলি তার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বলেছিল–‘তোমাকে আমার আর ভালো লাগে না, তূর্য নিজের মাঝে সংকুচিত হয়ে গিয়ে শুধুই বলেছিল আচ্ছা চোখভরা দুঃখ বর্ষীয়ে তূর্য সেদিন চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গিয়েছিল। কোনো রকম অনুনয় সে করেনি।

তারপর প্রায় দুই সপ্তাহ কেউ তাকে ক্যাম্পাসে দেখেনি। তূর্য কতোটা কষ্ট পাচ্ছে তা মিলির কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। নিজেকে সেদিন স্বাধীন মনে হয়েছিল একঘেয়েমিতা থেকে মুক্তি পেয়ে।

ছাড়াছাড়ির দুই সপ্তাহ পর মিলি যেদিন প্রথম তূর্যকে ক্যাম্পাসে দেখলো, তার হাঁটাচলায় কেমন যেন একটা পরিবর্তন এসেছে বলে তার কাছে মনে হলো। পোশাক-পরিচ্ছদও অন্যরকম। একটু ফাঙ্কি-ফাঙ্কি ভাব। মিলি বেশ অবাক হলো। এই তূর্যকে সে চেনে না। তার কাছে একটু খটকা লাগলো। বিষয়টা নিয়ে সে বেশ চিন্তা করে। কয়েকদিন পরই দেখা যায় তূর্য ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের জুনিয়র ক্লাসের এক তরুণীর সাথে। মিলির মনে মধ্যে একটা ঘণ্টা বেজে উঠে। সে কি ঈর্ষান্বিত হচ্ছে? নিজের সাথে রাগ করছে মিলি। আমিইতো ওকে ডিচ্ করেছিনিজেকে বলে মিলি।

আরও একমাস পেরিয়ে যায়। মিলি মনে করেছিল তূর্য তাকে দেখানোর জন্যে এমন করছে। কিন্তু তূর্যর চারপাশে অনেক মানুষের সমাগম দেখে সে বিস্মিত হয়। এমনটা সে আগে কখনও দেখেনি। মিলির কয়েকজন বান্ধবীও মেলামেশা করছে তূর্যের সাথে। ফ্যাকাল্টির করিডোরে, রেজিস্ট্রি ভবনের মাঠে, কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায়, চটপটি চত্তরে। সে তো এমনটা আশা করেনি। মিলি খেয়াল করে দেখলো সে ছাড়া বাকি আর সবাই তূর্যকে নেক্স-টু-টম-ক্রুজই মনে করছে। তবে সেটা বড় কথা নয়। তূর্য এতো নির্লিপ্তভাবে তার প্রত্যাখ্যান গ্রহণ কেন করলো মিলিকে এখন তাইই বেশি ভাবাচ্ছে। তূর্যের শারীরিক ভাষা মিলির ভাল লাগছে না।

আমার ডিচ্ খেয়েছে বলে সে কি এখন সবার সাথে হ্যাংলামি করে বেড়াবে? আগে তো সে আমার সাথে ছাড়া আর কারো সাথে হ্যাং-আউট করতো না; এসব হ্যাংলামি দেখলে পিত্তি জ্বলে যায়’–ভাবে মিলি।

মিলি ঠিক করলো তূর্যের কাছে তার এই পরিবর্তনের কথা একদিন জানতে চাইবে। এই পাঁচ মাসে ছেলেটার বেশ দুর্নামও হয়েছে। তাদের ক্যাম্পাসে সংঘবদ্ধ প্রেম করে এমন কিছু ছেলেমেয়ে আছে। ওরা কাউকে পাত্তা দেয় না। তূর্যকে ওদের সাথেও ঘুরতে দেখা যায়। তার এই আচরণটা জানার জন্যে মিলির ব্যাকুলতা একটা চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। মিলির এখন ভাব হয়েছে তাদের এক বড়ভাই তাহমিদের সাথে। তূর্য যেমনটা ছিল তাহমিদ ঠিক তার উলটো। মিলি আনন্দেই আছে, তবুও তূর্যের পরিবর্তন তাকে ভাবাচ্ছে। চেষ্টা করেও চিন্তাটা দূর করতে পারে না সে।

সুযোগ একদিন সে পায়। তূর্য তখন ক্যান্টিনে মাইশার সাথে বসে ছিল। মাইশা গেছে বিল দিতে। তূর্য টেবিলে একা বসে আছে। মিলিও একাই লাঞ্চ করেছে। তাহমিদ ক্লাসে ছিল। মিলি টুপ করে বসে পড়ে তূর্যের পাশের চেয়ারে। তূর্য তাকায়। বলে–‘আরে, মিউ যে, কেমন আছো, মিলি?

মিউ ডাকটা মিলির মাথার টোপরে ঘৎ করে বসে যায়। কি বলবে বুঝতে পারে না। তূর্য তাকে মিউ বলে ডাকতো।

মিলি বলতে চায়–‘তুরু, তুমি ঠিক আছো?

তূর্য কথা বাড়াতে দেয় না; বলে–‘তুমি এসব জানতে চাইছো কেন, মিলি? আমি ঠিক আছি কি না আছি হোয়াট ডাজ ইট ম্যাটার টু ইউ নাও? আমি এখন স্বাধীন; তোমার নই; তুমি আমায় ডিচ্ করে এক অসাধারণ কাজ করেছো; আমাকে স্বাধীন করেছো

***

 

|| হ্যাঁ ||

চয়নিকা সবার সামনে দাঁড়িয়ে খুব চ্যাঁচাচ্ছে। খুবই। রাগ ঘড়ড়-ঘড়ড় করে ঝাড়ছে। বাংলা, ইংরেজি দুই ভাষাতেই গালি দিচ্ছে। সামাজিকতার ধার আর সে ধারছে না। আমরা বন্ধুরা একটু থমকে গিয়েছি, তবে যখন বুঝতে পারলাম গালিগুলো সে সজলকে দিচ্ছে তখন গল্পটা অনুধাবন করলাম। এমন অপ্সরী-চেহারার মানবীর মুখ থেকে এমন শ্লাঘা বারুদের মতো বেরুতে পারে তা আমাদের জানা না থাকলেও আমি অন্তত মনে-মনে খুশি হলাম। গালি দেয়ার সময় চয়নিকাকে তেমন সুন্দর লাগছিল না।

সজল চয়নিকার সাথে পাঁচ বছর উষ্ণ-থেকে-উত্তপ্ত প্রেম করার পর তা কিছুক্ষণের নোটিশে ভেঙ্গে দিয়েছে। তার শোধই চয়নিকা এখন নিচ্ছে। কিন্তু এই প্রাণান্ত গালিগুলো ঝেড়ে তার কি লাভ হচ্ছে আমরা বন্ধুরা যারা দৃশ্যটা তাদের বুঝতে একটু সময় লাগলো। চয়নিকা শুধু মুখ খারাপ করেই প্রতিশোধ নিচ্ছে। সে জানে তাদের ভালোবাসা এখানেই শেষ। যতটুকু পারে পুষিয়ে নিচ্ছে।

চয়নিকাকে আমার ভালো লাগলেও আমি তাকে কখনও বলতে পারিনি। সজল পেরেছিল; সজল চয়নিকার কাছে নিজেকে নিবেদন করেছিল। আমি পারিনি। চয়নিকা-সজলের প্রেম কাহিনী অনেকদূর গড়িয়েছিল। দুজনের পরিবার তাদের স্বাদরে গ্রহণ করেছিল। তাদের নিয়ে অনেক কল্পনা-জল্পনাও রচিত হয়েছিল।

ইউ ব্লাডি ফাকার; এখন স্বাদ মিটে গেছে? অন্য কাউকে পেয়েছিস, শালা হারামজাদা? চয়নিকার অনেক ডায়ালগের এটা একটা।

সজল তেমন কিছু বলে না। মাথা নীচু করে শুধু বলে–‘আমাকে মাপ করে দিও চয়নিকা। আমি পারলাম না; কেন পারলাম না তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না, তবে পারলাম না।

কথাগুলো বলে সে চলে যেতে চেয়েও একটু থামে। কেন যেন দাঁড়িয়ে পড়ে। সজলের জীবনে কি হয়েছে, আমি কিছুটা বুঝি, বাকিটা বুঝি না। ওর জন্যে মায়া হয়। চয়নিকার জন্যেও মায়া লাগে। চয়নিকার জন্যে বেশি মায়া লাগে।

চয়নিকার চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, সে সজলকে কিছুটা ক্ষমা করেছে তবে নিজেকে করেনি। চয়নিকা বুক চাপড়াচ্ছে–‘এখন আমাকে কে বিয়ে করবে; আমার মা-বাবা জানে ঐ কুত্তাটা আমার স্বামী; আমার সব আত্মীয়রাও তাই জানে; আমার সমাজ জানে; এখন আমাকে কে বিয়ে করবে; কে?

আকাশের দিকে চেয়ে দোয়া চাওয়ার ভঙ্গিতে দুহাত তুলে সে কথাগুলো বলতে থাকে। তাকে তখন পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তি বলে আমার মনে হয়। চয়নিকাকে পছন্দ করা এবং সজলকে তার প্রেমিক হিসেবে বেছে নেয়ার প্রতিবাদে উত্তরে একটা বিক্রিয়া আমার মাঝে তড়িৎ গতিতে কাজ করে। চয়নিকার এমন পতন দেখে আমি কষ্ট পাই। আমি এগিয়ে গিয়ে চয়নিকার হাতদুটো খপ্ করে ধরে ফেলি। থামো, তুমি থামো; আর কথা বলো না; আমি তোমাকে বিয়ে করবো; আমি তোমার স্বামী হবো।

চয়নিকা স্তম্ভিত হয়। তার রাগ ধী-ই-রে, ধী-ই-রে স্তিমিত হয়। আমি তার হাত ধরেই আছি। আমিও ভুলেই গেছি যে তার হাত আমি ধরে আছি। চয়নিকা চোখে পানি আসে। সে আমার দিকে তাকায়। বলে–‘তুমি ঠিক বলছো? চিন্তা করে বলছো?

আমি কোনো কথা বলি না; আমি সজলের চলে যাওয়ার দিকে একবার চেয়ে দেখি। আমি চাই এখান থেকে বেরিয়ে যাক।

সজল বেরিয়ে গেলে আমি বলি হ্যাঁ, তবে লোকটাকে তোমার ভুলে যেতে হবে

***

 

|| না ||

মাইশা ও মৃদুলের দেখা এবং সখ্যতা হয়েছে এখানেই। এই আপিসে কাজ করতে এসে। কেমন করে তাদের প্রেম হয়ে গেলো তার কথা না বলে বরং প্রেম প্রস্ফুটিত হওয়ার পর তাদের জীবনে কি কি ঘটলো সেই গল্পটা বলা যাক।

ওরা এদিক-ওদিক যায়, একসাথে লাঞ্চ করে, একে-অপরকে কাজে সাহায্য করে, প্রয়োজন ছাড়াই দুজনে দুজনের সাথে কথা বলে, দুজনে একসাথে বেশি বেশি সময় কাটায়, আপিস শেষে একজন আরেকজনের জন্যে বাইরে অপেক্ষা করে। তারা মনে করে কেউ দেখছে না, তবে সবাইই দেখে তা তারা বোঝে না। সবচেয়ে বড় কথা, আপিসের এইচ-আর বিভাগ দেখে ফেলে। কিছুটা গুঞ্জন উঠলে, দুজনেই সাবধান হওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু প্রেমচ্ছটা লুকোতে পারেনি। লুকোনো যায় না। এমন সময় মানুষ প্রেম লুকোতে পারে না। তারা বাড়াবাড়ি না করলেও তাদের প্রেমের বিকিরণ আপিসের আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।

এইচ-আর বিভাগের ফয়সাল একদিন তাদের সাথে কথা বলতে চায়। একসাথে নয়; দুজনে সাথে আলাদা-আলাদা। এইচ-আর যখন কাউকে নীরব কক্ষে আসতে বলে, তখন আটঘাট বেধেই আসে। এই সাইলেন্ট রুমগুলোতে প্রকৃতি নেই, বাইরে থেকে আর কারো গলার আওয়াজ শোনা যায় না; শুধুই এয়ার-কন্ডিশনের শঁ-শঁ আছে; আর ফয়সালের শীতল কণ্ঠ।

ফয়সাল প্রথমে কথা বলে মাইশার সাথে। মাইশা, আপনাকে এখানে কেন আসতে অনুরোধ করেছি বুঝতে পারছেন?

জ্বী, ভাইয়া; পারছি।’—মাইশা বলে।

তাহলে?’—ফয়সাল প্রশ্ন করে।

মাইশা নীরব।

ফয়সাল আবারও বলে–‘আপনি কাজে অনেক ভালো করছেন; হাই-পারফর্মার কিন্তু এভাবে চলাফেরা করলে তো আপনার এবারের প্রমোশনটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে; সবাই দেখছে; এইচ-আরও দেখছে; আমাদের আপিসে এসব নিষেধ, আপনি জানেন না?

জ্বী ভাইয়া; জানি।

ফয়সাল মৃদুলের সাথেও একই ধাঁচে কথা বলে। ফয়সাল দুজনকেই ভয় দেখায়। মৃদুল বেশি ভয় পায়। এবার প্রমোশন পেলে সে এক্সটেন্ডেড ম্যানেজমেন্ট কমিটিতে যাবে।

সাইলেন্ট রুমের ফয়সাল দুজনেরই নাড়ি কাঁপিয়ে দিয়েছে। ফয়সাল এমন সব শব্দ ব্যবহার করেছে তাতে মনে হয়েছে সে আদেশ দিয়েছে মাইশা বা মৃদুলকেউ একজন যেন এই আপিস ছেড়ে অন্য কোনো আপিসে চাকরি নিয়ে চলে যায়। যেন এখান থেকে চাকরি ছেড়ে দেয়।

আজ বাড়ি ফেরার সময় কেউ কারো জন্যে অপেক্ষা করে না। পরদিন আপিসে এসে দুজনে কেউ কারো দিকে তাকায় না। মৃদুল কয়েকবার চেষ্টা করেছে মাইশার সাথে যোগাযোগ করার; মাইশা সাড়া দেয়নি। মৃদুল টেক্স করেছে অনেকগুলো, উত্তর আসেনি। বাড়ি ফিরে রাতে মাইশা নিজেই ফোন করে।

কি করা যায় বলোতো, মাইশা? আমরা বিয়ে করে ফেললে ফয়সাইল্ল্যা মেনে নেবে না? মৃদুল বলে।

মাইশা বলে, না, নেবে না; নিয়মটা তো বিয়ে থেকেই শুরু; জামাই-বৌ এক আপিসে কাজ করতে পারবে না; প্রেমিক-প্রেমিকাও পারবে না।

তাহলে!?

আমরা আমাদের ভালো লাগার ইতি টানতে পারি; কিংবা কেউ একজন চাকরিটা ছেড়ে দিতে পারি। তুমি দেখো না; তোমাকে তো গেল ছয়মাসে কয়েকটা কোম্পানি অফার দিয়েছিল’—মাইশা বলে।

কিন্তু আমি এই প্রমোটা পেলেই ভিপি হবো, এক্সটেন্ডেড ম্যানেজমেন্টের একজন হবো, অন্য যায়গায় গেলে তো তা হতে পারবো না; তাদের গ্রোথ্ স্ট্রাকচার এদের মতো না।

মাইশা বলে—‘কিন্তু আমায় তো অন্য কেউ অফার দেয় না; আমি ছাড়লে বেকার হয়ে যাবো; তুমিই ছাড়ো; তা ছাড়া আমারও তো প্রমোশন হবে; মায়না বাড়বে।

না, বেইবী; তুমি ছাড়ো; আমি এই চান্স দূরে ঠেলতে পারবো না; তুমি চাকরি ছাড়ার পরদিনই আমি তোমাকে বিয়ে করবো। দেকি ফয়সাইল্লা তখন কি কয়।

না, মৃদুল; আমি ছাড়বো না।

বেইবী।

মৃদুল; আমি ছাড়বো না।

***

 

|| স্থলাভিষিক্ত ||

মনভরা আশঙ্কা নিয়ে বিয়ের পর প্রথম মিলনের জন্যে অপেক্ষা করছে সুস্মিতা। ঘরে এখন সে একাই। রাত খুব বেশি হয়নি তবে সঞ্জয় এখনও ঘরে আসেনি। সুস্মিতা ধারণা করছে বেশিরভাগ পুরুষের মতো প্রথম রাতেই মিলনেচ্ছু মনোভাব নিয়েই তার কাছে আসবে তার স্বামী। সেটাই স্বাভাবিক। ভীষণ অস্বস্তির মধ্যে মুহূর্তগুলো কাটছে। তার দিক থেকে এটা কোনো রকমের অনিচ্ছা নয়; শুধুই এক অদ্ভুত শঙ্কা-মিশ্রিত অস্বস্তি। এই বিয়েতে রাজি হওয়ার সময় নিজের সাথে অনেক বোঝাপড়া করেছে সে; এই মুহূর্তে শেষ বোঝাপড়াটুকু সে করে ফেলতে চায়।

বিয়ের ভারি ভারি বসন বদলে হালকা পোশাক পরে নেয় সুস্মিতা। চেহারা থেকেও রঙ্গের প্রলেপগুলো দূর করে সে। নিজেকে এখন প্রাকৃতিক মনে হয়। সে এখন সঞ্জয়ের জন্যে তৈরি। নাইতে নেমে কোমর ভেজাবে না তা হয় নাভাবে সুস্মিতা।

ঠিক এই ক্ষণে প্রবীরের স্মৃতি সুস্মিতার মনের আকাশে ভেসে ওঠে। ওর কাছে দুঃখ প্রকাশের সময়টুকুও সে পায়নি। যেই বাসর রাতকে সে স্বাগত জানাতে এখন তৈরি হচ্ছে, তখন কেন প্রবীরের সাথে বাসরগুলোর কথা তার মনে পড়ছে? তার অস্বস্তি কি তাহলে সেই বাসরগুলোকে নিয়েই? সেই বাসরের মতো এই বাসর হবে কিনা ঠিক তাই নিয়েই কি সুস্মিতা চিন্তিত? প্রবীরের সাথে তো তার সামাজিক বাসর হয়নি। প্রবীর মিলিত হতো আকাশ আর পাতালকে এক করে দিয়ে, বাতাস ও মেঘের সম্মেলন ঘটিয়ে এক আশ্চর্য বৃষ্টি ঝরানোর আগে সুস্মিতার হাজার ট্রিলিয়ন অনু-পরমাণুকে থর-থরিয়ে কাঁপিয়ে, তাকে লাউডগা শাপের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকতো হাজার বছর যতক্ষণ না পর্যন্ত এক গোধূলি-গোধূলি আলো দুজনের দেহমনে ছড়িয়ে যেতো।

আমার শঙ্কা কি এখানেই?’—ভাবে সুস্মিতা।

সঞ্জয়ের ঘরে ঢোকার শব্দ হয়। তার দেহভঙ্গিমা বোঝার চেষ্টা করে সুস্মিতা। সেইই কি? সেই প্রবীর? সেই আকাশ-বাতাস? না মনে হয়। আবার দেখে। ভালো করে দেখে। প্রবীরের মতো চেহারা? নাহ, অন্যরকম।

সঞ্জয় অনেক কথা বলে। সুস্মিতা শোনে। সঞ্জয়ের ক্লান্তি নেই। সঞ্জয় সুস্মিতার কথাও শুনতে চায়। সে বলতে চেষ্টা করে। ধী-ই-রে ধী-ই-রে তাদের কথোপকথন হয় এবং ধী-ই-রে ধী-ই-রে, সুস্মিতা আকাশ, পাতাল, বাতাস, মেঘ-বৃষ্টি, কম্পন এবং একটা শাপ আবিষ্কার করে যে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকতে চায়, হাজার গোধূলির আলো চায়।

মিলনের পর সুস্মিতা যখন হাত-পা ছড়িয়ে গোধূলির আলো দেখছে, তখন প্রবীরের কথা মনে হলে, মনে মনে বলে–‘প্রবীর, আজ থেকে তোমায় আমি ছুটি দিলাম।

***