একা রাতের কাছে

অ+ অ-

 

মানুষটার সাথে সংসার শুরুর পর থেকেই বুকের ভেতর হু হু করা কান্না জমতে আছে। বুকের তলায় থোকা থোকা মেঘ যেন, বদ্ধ ডোবার মতো ঘোলা জল হয়ে আছে এইসব গুমোট কান্নারা। মাঝেমাঝে মনে হয় এই কান্নাসমূহই তার যত পূঁজি, তার জমানো সঞ্চয়, অর্জন। কমতো সময় গেল না। এরমধ্যে দুতিনটে ছানাপোনা পেটে এসেছে। তাও মানুষটা সেই যা ছিলতাই থেকে গেছে। শুধু বুকের ঝাঁপিটিতে স্তুপ হওয়া কান্নার মতো বিষাদ, বিষণ্নতা তিলতিল করে আরও বেড়েছে।

মানুষটা তার কাছে ভিড়লে আস্ত একটা ভিজা বিড়াল ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। তার বুক থেকে, কোল থেকে, শরীর থেকে ওম নিতে কেমন কাঙাল হয়ে ওঠে, লুটোপুটি করে। অমন একটা জোয়ানমরদ নিজেকে কাদাদলা করে তার কাছে উবুর করলে জয়নব বেগমতো মেয়ে মানুষ, তাও তার কবুল পড়া স্ত্রীসে আর কতটুকু বাঁধ আগলে পাথর হয়ে দাঁড়ায়। উপচানো কাতর-আদরে তার সকল জেদ, কাঁটাতারের বেড়া সবকিছু তছনছ হয়ে যায়। তারপর কিছুদিন গেলেই সে বুঝতে পারে, সে আর শরীরে একা নেই। আরও একবার মা হতে চলেছে। লোকটা ততদিনে আবার কোথাও উধাও হয়ে গেছে।

তার মাথার উপরে থাকা আকাশটা তখন ছন্নছাড়া হাওয়া হয়ে যায়। হাওয়া আছে, তা টের মিলে ঠিকই। কিন্তু হাওয়াকেতো আর ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। সে উদাম আকাশের নিচে একলা বইতে থাকে। এরমধ্যে কোথাও হাসিম উদ্দিনের গন্ধটুকুও নেই। বিয়ের পর এ নিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি জয়নব বেগমকে। তার দেবর-ভাশুর, ভাশুরের বউ, পাড়া-পড়শি কথা কি কেউ কম শুনিয়েছে। সবার কথার তির সেতো তার দিকেই ছুটে এসেছে।

—‘তুইতো অতদিনে জানসই, ও সংসার করছে। কিন্তু তার কোনো দায় নাই, দায়িত্ব নাই। পয়লা-পয়লা বুঝলি না, ঠিক আছে। কিন্তু অতটা বছর গেছে। দুই-তিনটা বাইচ্চা নিলি। তারপরও বুঝবি না। ও রাত-বিরাতে আইল, আর তুই তার বাইচ্চা নিতেই থাকলি, নিতেই থাকলি। তর কোনো বোঝ নাই, বাইচ্চা-কাইচ্চা অইলেই অইল। তারারে বাচাইতে অইব না, পালতে অইব না। কেমনে হুঁশ অইব তর।

জয়নব বেগম বাড়ির পশ্চিম দিকের পুরোনো পুকুরের পাড়ে বাঁশঝাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে কখনও দক্ষিণের, কখনও উত্তুরের হাওয়াকেই কথা শোনায়।—‘কেমনে এত মানুষরে বোঝাই কও, মানুষটাতো আমার কাছেই আয়। যতবার মনরে বোঝাই লাত্থি মারি এই সংসারের পাছাত। যা হওয়ার হইছে, আর দরকার নাই অমন সংসার, অমন মরদমানুষের।...কিন্তু, মানুষটা যেই কাছে আয়, আদরের জন্য দুধের বাইচ্চা অই যায়। আমিতো তারে আর দূরে ঠেলতে পারি না। আমি তো তার সাত গ্রাম জানিয়ে ঘোমটা পরা বউ, আমার কাছেইতো আইছে। আমার মনে আর কিছুই থাকে না। আমি গলে পানির মতো হয়ে যাইরে।...

এরকম মুহূর্তে বুকটা এক মাঠ শূন্যতায় হাহাকার করে ওঠে তার। কোনদিকে পথ, দিশাসে কিছুই খোঁজে পায় না। মজা পুকুরের পানি থেকে পচা, বহু প্রাচীন একটা গন্ধ ভেসে আসে। তার নাকেমুখে সেই থকথক করা গন্ধ ঠোকর মারে। পেটের ভেতর হাত-পা নেওয়া ছাওয়ালটা দুনিয়ার আলো দেখবে বলে কেমন অস্থির করে তুলে তাকে। তখন কে হাসিম উদ্দিন, আর কে জয়নব বেগম এসব তার আর মনেই থাকে না। ছাওয়ালটাকে পেটের জলে আগলে রাখতেই এখন তার যত আয়োজন, যত প্রস্তুতি।

বিয়ের রাতে হাসিম উদ্দিনকে তার ভুল মানুষ মনে হয়নি। বিয়ে হয়েছে দুই পরিবারের দেখাশোনা, সম্মতি ও আয়োজনেই। হাসিম উদ্দিনকে আগে থেকে জানা, তার সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়ার তেমন সুযোগ ছিল না তার। মানুষটা কাছে এসেই নতুন এক মায়া তৈরি করেছিল। গা-গতর থেকে পুরুষ মানুষের ভুরভুর করা গন্ধ তার নাকে এসে লাগছিল (যদিও পুরুষ মানুষের আলাদা কোনো গন্ধ আছে কিনা, থাকলে কেমনএসবতো তার জানা নেই। এর আগে এত ঘনিষ্ট হয়ে সে কোনো পুরুষ মানুষের পাশে বসেনি। দু-একবার দমকা হওয়ার মতো কারো গন্ধ এসে নাকে লাগতে পারে, এটুকুই)। জয়নব বেগমের কাছে এই মানুষ, এই ঘর, এই মুহূর্ত সবকিছুই ছিল নতুন। তবু মানুষটাকে সে আপনই ভেবেছে, নিজেরই মনে করেছে, নির্ভর করেছে। গাঙের নতুন পানির মতো গড়িয়ে গড়িয়ে গেছে তার দিকে, দুজনেই একই পানিতে ভিজেছে।

একটা ঘোরের ভেতর সময়টা ছিল। তখন এই মরদ মানুষটা ছাড়া আর কোনো ভাবনাই তার মাথায় খেলেনি। যেদিকে তাকাতো এই মানুষটার ছায়াই তার চোখে পড়েছে। মানুষটা যখন তার দোকানের দিকে গেছে, সে পেছনে দাঁড়িয়ে যতদূর দেখা যায় তাকিয়ে থেকেছে। যখন ফিরে এসেছে, চেনা গায়ের গন্ধে ভরে গেছে পুরা ঘর (এই গন্ধ আর কেউ পেত কিনা, সে জানে না)। কিন্তু এই ঘোর বেশিদিন থাকেনি। একদিন তার কানের দোল হারিয়ে গেলে সে ঘর তোলপাড় করে। তার তন্নতন্ন করা খোঁজাখুঁজিতে হাসিম উদ্দিনও যোগ দেয়। সোনার দোলজোড়া আর পাওয়া যায়নি। জয়নব বেগম বাড়ির অনেকের দিকেই আড়চোখে তাকিয়েছে, যদিও নিশ্চিত নয় বলে মুখে কাউকে কিছু বলতে পারেনি। তবে সন্দেহের এই তিরটা অন্যদের দিকে সে বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যেই তার গলার হারটাও খোয়া যায়।

তখনই সে জানতে পারে বিয়ের পর হাসিম উদ্দিনের কাছে জয়নব বেগম যেরকম একটা নেশার নাম। রাত-বিরেতে একবার ছুঁতে না পারলে বড় অস্থির লাগে, খালি লাগে। তার এরকম আরও একটি নেশা আছে, যেটা অনেক পুরোনো। মাঝেমধ্যে সেই নেশার কাছে যেতে সে অস্থির হয়ে ওঠে, ছটফট করে। জয়নব বেগমকে যখন কেউ বলে, তোমার মরদরে তুমি সব রাইতে পাও।

জয়নব বেগম চমকে ওঠে, নাতো। ওতো মাঝেমধ্যে দোকানে রাত কাটায়। চোর-ছ্যাচর নাকি খুব উৎপাত করছে।

—‘এমন কিছুই না। সে যায় জুয়া খেলতে। দেখিও তোমারেনি কুনুদিন দানে তুলে দেয়।

ততদিনে মনের ভেতর অনেক মেঘ জমে গেছে। পেটেও নতুন জলের পোনা। ওটা বাড়ছে। অপেক্ষায়, কখন সে আলোতে আসবে। জয়নব বেগম যতটা গর্জে ওঠার কথা, ভেঙে পড়ার কথাসেরকম কিছুই হয়নি। সে এখন ভরপোয়াতি গাঙ, তার পাড় ভাঙবার কোনো সুযোগ নেই। সে বুঝতে পারে সোনার কানের দোল, গলার হারএ সবই জুয়ার দানে গেছে।

রাতের গভীরে যখন হাসিম উদ্দিন বউয়ের পেটে হাত রাখে, বেড়ে ওঠা ছানাপোনাটাকে চামড়ার ভেতর দিয়ে ছুঁতে চায়। জয়নব বেগম মানুষটাকে দেখে। ওখানেতো একজন পিতাকেই সে দেখেছে। তার মনটা গলে যায়, যতটা ক্ষোভ নিয়ে সে চড়াও হওয়ার মতো ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়েছিল, সে থির জলের চোখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে,

—‘আমার পেটে যারে দেখছো, এ কার ছানা তুমি কইতে পার।

—‘কেন, ওটাতো আমারই সন্তান। আর কার অইবো।

—‘তাইলে আমারে এই যে দোকানে থাকার কথা কইয়া জুয়ার দানে যাও, আমার অলংকার, দোকানের টাকা-পয়সা সব হারাইয়া আও। এই বাইচ্চাটারে পালবা কেমনে ভাবছো কুনু সময়।

হাসিম উদ্দিন যেন কথা বলার একটা অছিলা খুঁজে পায়। এক ঝাঁপি যুক্তি সে উবুর করে বউয়ের সামনে।—‘কও কি, সবইতো ওই ছাওয়াল, তুমি, তোমরার জন্য। দেখিও একদিন লটারির মতো এই জুয়ার দান থাকি অনেক অনেক টাকা আইব। যা হারাই, এসব তো কিছুই না। কিছু পাইতে গেলে কিছুতো হারাইতে হয়, হয় নাকও।

জয়নব বেগম মানুষটার এই নেশা, এই ঘোরের কথা শুনে অনেকটা অন্ধকারেই পড়ে যায়।—‘কও কি তুমি। জুয়ার দানে তুমি টাকা পাইবা, বড়লোক অইবা। এই কথা তোমারে কইছেটা কে। জুয়ার দান কি তোমারে বড়লোক বানাইতে সাজাইছে। এটা অইল টাকা লুটবার জাল, একটা ফাঁদ।

হাসিম উদ্দিন বউয়ের কথাকে খুব একটা আমলে নিয়েছে বলে মনে হয় না, সে আগের কথারই পুনরাবৃত্তি করে।—‘এ নিয়া তোমার চিন্তা করা লাগতো নায়। দেখিও একদিন অনেক অনেক টাকা আইব। অনেকজোড়া দোল, অনেক গলার হার তোমারে দিমু। কয়ট পরবা তুমি।...

জয়নব বেগম বুঝতে পারে, সে একটা গভীর খাদেই পড়ে গেছে। এই খাদ থেকে ওঠতে সে কতোদিকে তাকায়, কোনো দিক খুঁজে পায় না। এখন ঘর থেকে শুধু জিনিস খোয়াই যায় না, অনেক পাওনাদার আসে তার কাছে। হাসিম উদ্দিনকে সে পাবে কোথায়, হঠাৎ করে রাত-বিরেতে বাড়ি ফিরে। তারপর ভোরের আলো ফোটার আগেই সে কোথায় যে হাওয়া হয়ে যায়। মানুষটাকে সে ভালো করে দেখতেও পারে না। হাসিম উদ্দিনের বাবা-ভাইরা বলেই দিয়েছে, তারা হাসিম উদ্দিনের ধার-দেনার কোনো দায় নিবে না। তারা সংসারটাকেও আলাদা করে দিয়েছে। জয়নব বেগম অথই জলের মধ্যে ডিঙিতে ঘুরপাক খায়, তীরের দিকে আর যেতে পারে না। মাঝেমধ্যে হাসিম উদ্দিন মাছ, শাক-সবজি নিয়ে আসে। চাল-ডাল নিয়ে আসে। তা দিয়েই কিছুদিন হাঁড়ি-পাতিল চুলায় বসাতে পারে জয়নব বেগম। তারপর এর-ওর কাছে ধারদেনা করা, হাত পাতা, এভাবেই চলছে।

জীবনটাকে এভাবে টানতে আর ভালো লাগে না জয়নব বেগমের। হাটে যে দোকানটা ছিল হাসিম উদ্দিনের, সেটা পূঁজি হারিয়ে কবেই বন্ধ হয়ে গেছে। মনটা পুড়ে আঙরা হয়ে আছে তার। মানুষটাকে প্রথম রাতে দেখে যে ভরসা, যে ঘ্রাণের ঘোর তৈরি হয়েছিল, তা কবেই মন থেকে মুছে গেছে। অনেকবার সে মনকে ঠিক করেছে, এই গিট্টুকে কেটেকুটে একা হয়ে যেতে। কিন্তু মানুষটা যখন রাতের বেলা তার কাছে আসে, জয়নব বেগম কী করে যে পুরোনো ঘোরের ভেতর পড়ে যায়। সে ঝগড়া করে, চেঁচামেচি করে। অভাব-অনটন, কষ্টের কথা বলে। তবু সে মানুষটাকে ছেড়ে যেতে পারে না।

মানুষটা ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে সেই একই কথা বলে, কইলামতো, একদিন অনেক টাকা আইব। অনেক টাকা। সব ঋণ দিয়া দিমু। তোমারে অনেক গয়নাগাটি দিমু। অনেক কুঠুরির দালান অইব, দেখিও। তখন জানলা দিয়া লিলুয়া বাতাস ঢুকব, চান্দের আলো ঢুকব।

এরকম কথা শুনে গা জ্বলে জয়নব বেগমের। মনে হয় চুলার দাউ দাউ আগুনের ভেতর সে বসে আছে। তার হাত-পা পুড়ছে, চুল পুড়ছে। মানুষপোড়া গন্ধ তখন তার নাকে এসে ঠোকা মারে। ইচ্ছা হয়, সবকিছু ছাই করে ফেলতে। তার কিছুই সে করতে পারে না। হাসিম উদ্দিনের চোখ তখন অচেনা আলোতে চিকচিক করে। জয়নব বেগম জানেএ এক মিথ্যে খোয়াব, এ এক পথ হারানোর মায়া। চোখের এই আলো অল্প সময়ের। এরকম করে কিছুই হবে না। গভীরতর এক মিথ্যের মায়ায় সে জড়িয়ে আছে, নেশার জালে আটকে আছে। তার সমস্ত আদর, আকুলতা, শরীর কোনো কিছুতেই সেই মায়া ভাঙতে পারে না, জাল ছিঁড়তে পারে না।

এ নিয়েও সে কম কথা শুনে না। অনেকদিন ধরেই সে আরশি-পড়শির গলায় শুনে আসছে, কেমন বউ তুমি কও, মরদটারে নিজের দিকে টানতে পারলা না। নেশাটা ফিরাইতে পারলা না।

এরকম কথা আরও বেশি করে শুনতে হয় তাকে, যখন বছর শেষে একদিন বুঝতে পারে আবারও সে মা হতে চলেছে। তার এই মা হওয়াও কারো কারো কাছে রহস্য তৈরি করে। যে লোকটাকে দিনের আলোয় কেউ দেখতে পায় না, যার কোনো খোঁজখবর নেই। তার বউ কী করে বছর বছর পোয়াতি হয়ে যায়। আশপাশের নারীরা যখন তাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করে, কি গো, কেমনে কি অয়। কও, মানুষটার খোঁজ নাই। আবার মাও অই যাও।

জয়নব বেগম তখন ডাঙার মাছ হয়ে থাকে। মরা মাছের চোখে এই কথা বলা মানুষদের দেখতে থাকে। সে কোনো কথা বলে না। তাদের কথাকে সে উড়িয়ে দেয় কি করে। আবার এই সত্যটাকে সে কেমন করে সবার সামনে মেলে ধরে। মানুষটা যখন রাত-বিরেতে আসে, তার শরীর ঘেঁষে পোষা বিড়ালের মতো ওম খুঁজে। বড় মায়া লাগে তার। কোথায় থাকে, কোথায় কি খায়কিছুই সে জানে না। চোরের মতো হঠাৎ করে রাতের বেলা আসে। সেইতো তার কাছেই আসে। তার নারী মন, বউয়ের মন, ক্লান্ত-বিধ্বস্ত মন বড়ো কাতর হয়ে যায়। তাকে আর ফেরাতে পারে না। এই লোকটাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা, দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়ার কথা সে একদম ভুলে যায়। লোকটা কিছু সময় তার প্রশ্রয়ে শরীরের কাছে থেকে ভোরের আলো ফোটার আগেই আবার কোথাও উধাও হয়ে যায়। যত দিন যায় তার কাছে মনে হয়, জীবন বড়ো এক জটিল মায়া, বড়ো মায়ার ঘোর।  

তার মাতৃত্বকালে পাওনাদারদের জিব সুঁচালো, তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। যা শুনতে সে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে ওঠছে।—‘টাকার কথা কইলে খালি কও, তারে পাই কই। তার সাথে দেখা নাই, সাক্ষাৎ নাই কেমনে ধার শোধ করি। কিন্তু হাসিম উদ্দিন যদি নাই আসে, তাইলে মা অও কেমনে। এর বাপ তাইলে কেটা। নাকি পুরুষ মানুষ ছাড়াই মা অইতে আছো তুমি।

জয়নব বেগম মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। এসব কথার কি জবাব আছে তার কাছে। সে আবারও মা হয়েছে, এটাতো আর গোপন কিছু না। কিন্তু কি করে মা হয়েছে, এটা কি সবার কাছে খুলে বলবার মতো কিছু। মানুষটা যে মাঝেমঝে নিশিকুটুম হয়ে আসে, এটাতো এদের কাছে বলবার সুযোগ নাই। ওরা তখন টাকার জন্য আরও চেপে ধরবে, জাপটে ধরবে। মনটাতে প্রবল ঝড় ওঠে। কালো থমথম করা ঝড়ে সবকিছু ওলটপালট হয়। এই ঝড় কেউ দেখতে পায় না। এসময় নিজেকেও তার খুব অচেনা লাগে, দূরের কেউ লাগে।

এই মানুষটার মধ্যে সে কী এমন পেয়েছে। যার জন্য এত অপমান, এত ঘৃণার তির তাকে বিদ্ধ করছে, জখম করছে। সেই লোকটাকে সে দূরে ঠেলে চলে যেতে চায়, কিন্তু পারে না কেন। লোকটা কাছে আসলেই একপশলা বৃষ্টির মতো সে ভিজে যায়। আবার মাটি নরম হয়ে ওঠে, আবার বীজ ধারণের উপযোগী হয়ে ওঠে।

পুকুরপাড়ে বাঁশঝাড়ের নিচে দাঁড়ালে চোখের সামনে বিস্তীর্ণ একটি খোলা দিগন্ত শরীর খুলে হাসে। সেই মাঠের বুকে, আকাশের নিচে একঝাঁক চিল উড়ছে। এখনতো এত পাখি, সে চিল-শকুন যাই হোক, দেখা যায় না। পাখির উড়ার দিকে, পালকের দিকে অনেক সময় ধরে তাকিয়ে থাকে জয়নব বেগম। মনটাতে জাপটা দিয়ে অনেক হাওয়া ঢুকে। কেমন আনমনা করা হাওয়া। জয়নব বেগম দেখে পুকুরের মধ্যে একদল শিশু-কিশোর সাঁতার কাটছে। এরা তাদের বাড়ির, আশপাশের বাড়ির ছেলেমেয়ে।

এরকম একটা সময়তো তারও ছিল। গরমের দিনে তারা ভাইবোনসহ আরও অনেকে একসাথে পুকুরে সাঁতার কেটেছে, পানিকে তোলপাড় করেছে। ডুব দিয়ে পুকরের এপাড়-ওপাড় হয়েছে। এই সাঁতার কাটতে কাটতে একদিন কী করে যে সে বড় হয়ে যায়। নিজের শরীরটাই তার পর হয়ে গেল। ইচ্ছে করলেই আর দল বেঁধে সাঁতার কাটতে পারে না। মনটাও কোন সুদূরের খোঁজে চঞ্চল হতে থাকে। ঠিক ছায়া নয়, ছায়ার মতো কোনো এক অচেনা-অদেখা পুরুষমানুষ, সেই মরদঘ্রাণ তাকে ঘোরের ভেতর ফেলে। একটা ঘর, এক পুরুষের বুকের কাছে শুয়ে থাকা প্রহরগুলো। বড়ো নেশার মতো তাকে মগ্ন করে, বিভোর করে।

জয়নব বেগম বুঝতে পারে না, তার ঘরতো হল, পুরুষমানুষও হয়েছে। সেই মরদের ঘ্রাণ, তাও সে পেয়েছে। তবু কেন এই পাওয়া, সবকিছুই কচুপাতায় বৃষ্টির ফোঁটার মতো ভিজল না, টিকল না। তার চাওয়া-পাওয়ার মুহূর্তগুলো হাত থেকে গড়িয়ে পিছলে গেছে। শিশু-কিশোররা তখনও সাঁতার কাটছে, হইহই করছে। যদিও এই পুকুরটা এখন আর সবাই ব্যবহার করে না। বাড়িতে বিদ্যুৎ আসায় অনেকেই নলকূপ বসিয়েছে। নলকূপের গলায় মটর লাগিয়ে ঘরের ছাদে রাখা ট্যাংকে পানি তুলে ফেলে। ঘরের ভেতরেই এখন গোসল, ধোয়া-পাকলার কাজটা সেরে নেয় সবাই। পুকুরটা একটু একটু করে পরিত্যক্ত হতে চলেছে। একদিন হয়তো এই পুকুরটা লতাপাতা, ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাবে। এখানে একদিন পুকুর ছিল, এরকম একটা স্মৃতিচারণের চিহ্ন হয়ে থাকবে।

জয়নব বেগম হাসে, তারও হয়তো এরকম দশা হবে একদিন (এরকমতো সবারই হয়। তবে তার বিষয়টি কিছুটা আলাদা মনে হয় তার কাছে। সব জীবন যেমন একরকম না, সব মৃত্যুও একইরকম না)। খুব নিকটেই কোনো একদিন জয়নব বেগম নামে একজন এই পুকুরপাড় থেকে, বাঁশঝাড়ের নিচ থেকে, এই আলো-হাওয়া থেকে নাই হবে যাবে। স্মৃতিটুকু থেকেও পরিত্যক্ত হয়ে যাবে। এই যে বছর বছর পেটে বাচ্চা নিয়েছে, অপমান-লাঞ্ছনা, দুর্গতি সয়েছে। সেই বাচ্চাগুলোকেওতো সে এই আলো-বাতাসে দীর্ঘকাল টিকে থাকার সুযোগ দিতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যে কান্নাকাটি করে একদিন তারা গভীর শূন্যলোকে চলে গেছে। তার মাতৃবুক ভেঙে খানখান হয়েছে। আর রাতের অন্ধকারে আসা মানুষটা তাকে বারবার অলীক আকাঙ্ক্ষার কথা শুনিয়েছে। নতুন করে মাতৃত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

—‘কাইন্দনাতো, আমরা কি বুড়াবুড়ি যে আর ছাওয়াল পাইমু না। তারা থাকতে আইছে না, তারারে ডাকার দরকার নাই। তারা কষ্ট পাইব। দেখ, আবার তুমি মা অইবায়। একদিন অনেক টাকা-পয়সা অইবো। একটা বার, ভালো একটা দান জিততে দেও।

জয়নব বেগম মানুষটার মুখের দিকে চোখ তুলে স্থির মূর্তি হয়ে থাকে। আবছা আলোতে হাসিম উদ্দিনের মুখটা স্পষ্ট দেখায় না, ঝাপশা আয়নায় সেই নারী হয়ে ওঠার প্রথম মুহূর্তের মতো ছায়া ছায়া এক পুরুষমানুষের ছবি ঝুলতে থাকে। অমন সংসার, অমন ঘরকে কি ঘর বলে। তার ইচ্ছা করে নিজের সারা শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরানোর। নিজেকে পুড়িয়ে ছাই করে হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার।

কিন্তু কিছুই সে করতে পারে না। যে অন্ধকারে পাওনাদার, বাড়ির লোকজনের চোখ এড়িয়ে সে ঘরে ঢুকেছিল। সেই পথ ধরে আবারও সেই অন্ধকারে লোকটা মিশে যায়।

জয়নব বেগম যেরকম এই সংসার, এই মরদের ঘোর ভেঙে বেরিয়ে যেতে ভেতরে ভেতরে ভাঙাচুরা, কর্দমাক্ত, তছনছ হয়ে উঠছিল। সেরকম একটা নেশাও ধরেছিল তার। রাত হলেই ঘরের পেছনের দরজার দিকে কান খাড়া করে রেখেছে। কখন ওখানে চেনা হাত, চেনা আঙুলের ঠোকা পড়ে। অনেকটা রাত পর্যন্ত বিছানায় চিৎ হয়ে টিনের চালের দিকে চোখ রেখে শুয়ে থাকে সে। বাঁশঝাড়ে পেঁচা ডাকলে, নিম গাছের ডালে, বেতের ঝোপে দু-একটা পাখি পালক জাপটাতে থাকলে তখন কোনো এক ফাঁকে ঘুমিয়ে গেছে। তখন ধরে নিয়েছে, এ রাতে আর সে আসবে না। মাঝেমাঝে এমনিতেই তার ঘুম লেগে যায়। সারা দিনের নানারকম খাটুনি, মনের ভেতর ঝড়ের ক্লান্তি তাকে বিধ্বস্ত করে, নিথর করে। চাইলেও আর জেগে থাকতে পারে না। পরদিন মনটা বড়ো খচখচ করে, হয়তো মানুষটা এসেছিল। সাড়া পায়নি, ফিরে গেছে। কোথায় কোন আদাড়ে-বাদাড়ে থাকে। কি খায় না খায়। তখন মন খারাপের মেঘ ঘিরে ফেলে তাকে। কিছুটা সময়ের জন্য হলেও বিষণ্নতার কাছে বন্দী হয়ে যায় (যদিও সে এই মেঘকে মনের ভেতর বেশি সময় ধরে জড়ো হতে দেয় না। তার কি করার আছে, সে কি তাকে ঘর থেকে ঠেলে দিয়েছে বাইরে। সে কি দরজা বন্ধ রেখেছে। সেইতো অমন একটা সব হারানোর পথ বেছে নিয়েছে)।

একটা ঝড়ের ভেতর, একলা দিগন্তের ভেতর সে হামাগুড়ি দিতে থাকে। সেতো মানুষটাকে কখনওই সাততলা ঘরের কথা শোনায়নি, সোনা-দানা, গহনা-জহরতের কথা বলেনি। খাস কামরায় দাসি-বাঁদি ঘেরা কেউ হতে চায়নি। সে তো ওই তাকেই, ঘামের গন্ধমাখা শরীরের এই মানুষটাকেই চেয়েছে।

জয়নব বেগম কতোবার বলেছে,—‘কও, তোমার কাছে আমি কুনুদিন কিছু চাইছি। তোমারে কুনুকিছুর লাগি পাগল করে তুলছি। তবু তোমার জুয়ার নেশা যায় না। বোঝ না, যে জুয়ার দান সাজায়। সেকি তোমারে ধনী করতে চায়। তোমার হাতে লাখ লাখ টাকা তুলে দিতে চায়। সে তোমার দানা-কড়ি যা আছে, তাই চায়। শরীরের লও চায়।

—‘জুয়ার দান থেকে অনেক টাকা পাইবা। এই আশায় কতোটা জীবনরে তুমি শেষ করছো, আমারে ফালাফালা করছো, কিছু বোঝ না। নেশা তোমারে দানব করছে, মানুষ রাখে নাই, বোঝ না।

হাসিম উদ্দিন বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু জয়নব বেগম তার চোখ খুঁজে পায় না। তার মনে হয় ওতো এখন ঠুলি পরা মোষ। জুয়ার দানের চরকির বাইরে তার কোনো পথ আর জানা নেই। সবটুকু ধূসর বালুচর হয়ে আছে। জয়নব বেগম মানুষটা তার কাছে ফিরবে, ঘরের কাছে ফিরবে। এরকম আর কোনো আশাই দেখতে পায় না। সে রাতে মানুষটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে সে যেমন বিছানায় বসেছিল, তেমনি বসে থাকে। দরজাটাও তেমনি খোলা থাকে। খোলা দরজা দিয়ে শেষরাতের শীতল বাতাস ঢুকেছে। ঠান্ডা বাতাস কখন তাকে ঘুম পাড়িয়েছে, সে ঘুমেই তলিয়েছে।

এরকমই একটা রাতে তার মনে হয়, দরজায় হয়তো সেই চেনা আঙুলের ঠোকা পড়েছে। সে ঘর থেকে পথে বেরিয়ে এসেছিল। চাঁদ ছিল সাদা টুকরা-টাকরা মেঘের ফাঁকে। মাঠ থেকে হাওয়াও ভেসে আসে। আর মাটির পথ ধরে সে যখন বাড়ির কাছের নদীটির কাছে যায়, মনে হয় তার সাথে মৃত সন্তানেরাও আছে। ছোট ছোট পা ফেলে তার সাথে তারাও হাঁটছে। এরাতো ছোটই। এরা কখনওই বড় হবে না, বড় হওয়ার সময়তো ওরা পায়নি। একটি ক্ষীণ জলের ধারা বইছে নদীতে, তাতে টুকরো-টুকরো ভাঙা কাচ হয়ে ভাসছে চাঁদের শরীর। জয়নব বেগম বুঝতে পারে না, এরকম একটা রাতে, এরকম একটা সময়ে সে কি করবে। কোনদিকে যেতে পারে।

জয়নব বেগম থমকে দাঁড়ায়, হালকা বাতাস তাকে ছুঁয়ে কোথাও ভেসে যাচ্ছে। পাশ দিয়ে একটি শিয়াল থপথপ করে দৌড়ে যায়, একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালে শিয়ালের চোখ-দুটো চাঁদের আলোতে চকচক করে, জ্বলে। অন্য সময় হলে সে ভয় পেত। এই রাতে তার কোনো ভয়ডর নেই।

অনেকদিন মানুষটা আর ঘরে ফিরে না। যে তার সময়টাকে, জীবনটাকে নাজুক করেছে। পুড়িয়ে খাক করেছে। যার কথা মনে হলে তার বুকের ভেতর আঙরা পুড়তে থাকে। সবকিছু তছনছ করে অনেক দূরে কোথাও মিশে যেতে মনের ভেতর উন্মাদনা তৈরি হয়। কিন্তু কোথাও যাওয়া হয় না বলেই কিনা, লোকটা যখন অনেক দিন রাতের বেলা ঘরে আসে না। সেই মানুষটার জন্য মনটা কিরকম চিনচিন করে, নতুন পানিতে ডিম ফোটা শোল মাছের পোনার মতো কিলবিল করতে থাকে অস্থিরতা। জয়নব বেগম আচমকা চিৎকার করে ওঠে, ও মরণ!

তার চাপা ডাক এত ছোট, ঘরের বেড়াতে হুমড়ি খেয়ে মিলিয়ে যায়। এরকম উচাটনই কি তবে তাকে এ রাতে ঘর থেকে বের করেছে। জয়নব বেগম কিছুই নিশ্চিত করতে পারে না, সে কি তবে আবার সেই পুরোনো ঘরের কাছে ফিরে যাবে। নাকি এই খোলা পথ ধরেই হাঁটবে। এই পথ তাকে যতদূর নিয়ে যায়, সেদিকেই যাবে। সে আশপাশে ঘুরে তাকায়, কোথাও কোনো মানুষের ছায়া নেই, শিশু নেই। শুধু মেঘ ভাঙা চাঁদের আলোতে গাছগুলো ডুবে আছে।