অক্টোবরের শেষ বিকেল
দিনটা নিরিবিলি শেষ হয়ে যেতে পারত, অন্য আর দশটা একঘেঁয়ে দিনের মতো। সেটাই তো স্বাভাবিক। আজ, গতকাল, আগামিকাল, পরশু এসব সময় নির্দেশকগুলো জীবনকে কি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? নাকি জীবন পিছনে যাচ্ছে! জন্মকে শুরু আর মৃত্যুকে শেষ বলাটা হিসাবের সরলীকরণ মাত্র। এই সরলীকরণের মধ্যে চিন্তাগুলো একেবারে উল্টো হয়ে আছে জলের ওপর প্রতিবিম্বের মতো। শুধু জীবন নয়, পৃথিবীর সবকিছুকে এই শুরু শেষের ছকে ফেলাটা তাৎক্ষণিক স্বস্তির হলেও এটা সবকিছুকে জটিলতায় ডুবিয়ে দেয়।
আজ নব্বইতম জন্মদিনে, এই নরম রোদের বিকেলে বসে বৃদ্ধ মোবাশ্বের আলী জীবন ও জগতকে দেখছেন ভিন্নমাত্রায়। বৃদ্ধের শরীরের চামড়া ঝুলে পড়েছে, চোখ দুটো ঢুকে গেছে কোটরের ভেতর ভয়ানকভাবে, কথা বলার সময় মাথাটা ঠক ঠক করে কাঁপছে। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতেই আমার এই বিকেলে আগমন। এটা একটা চমৎকার নিরিবিলি ওল্ডহোম।
বৃদ্ধ এখন খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার নব্বইতম জন্মদিনের উপযুক্ত শব্দমালা, যেটা দিয়ে আরম্ভ হবে আজকের এই বিশেষ বিকেল। তিনি হাতটা প্রসারিত করে আঙুলগুলোকে উঁচু করে ধরলেন যেন ওটা একটা পাখির বাসা, আর অপেক্ষা করতে লাগলেন শব্দটার জন্য, যেটা এক্ষুনি উড়ে এসে ওটার ওপর বসে তা দেবে। তিনি বলতে লাগলেন ‘শুরু’ শব্দটির কোনো অস্তিত্ব নেই, এ এক ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। মানুষ শেষকে শুরু ভেবে এর পেছনে ছুটতে থাকে। কোনো কিছুরই শুরু নেই। মানুষ যতদূরই শুরুর দিকে এগিয়ে যাক না কেন, সে শুধু শেষের বিভিন্ন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। জন্মের মাধ্যমে জীবনের শুরু কথাটা ভিত্তিহীন বরং জন্ম হলো শেষের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। অর্থাৎ কোনো কিছুই কখনও শুরুই হয়নি সবসময় শেষ হচ্ছে। মানুষ যখন কোনোকিছুকে শুরু বলছে, তখন ওটা মূলত শেষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই এখন অন্তত মানুষকে এসব উল্টো চিন্তা বা মিথ্যার পিছনে ছোটা বাদ দিতে হবে।
কথাগুলো বলার পর যেন তিনি শব্দটাকে উড়ে যেতে দিলেন। হাতটা গুটিয়ে এনে পাখির বাসাটাকে ঢুকিয়ে ফেললেন পাঞ্জাবির পকেটে। আমার মনে হলো, তিনি বয়সের ভারে একটা ঘোরের মধ্যে বাস করছেন। আর এসব চিন্তার মূলে রয়েছে তার নৈঃসঙ্গ জীবন আর ক্লান্তিবোধ। যেটা তাকে নিয়ে গেছে বিভ্রমের কাছাকাছি। যেখান থেকে তিনি সবকিছুকে উপলদ্ধি করছেন একেবারে উল্টোভাবে। এই বয়সে তার জীবনে আর যাইহোক জন্মদিন আসা ঠিক নয়, কারণ এটা তাকে আরও বেশি হতাশ করে তুলেছে। এ মুহূর্তে জীবনটা তার কাছে হঠাৎ খুবই ছোট হয়ে গেছে, যে জীবনকে বয়ে নিয়ে এসেছেন নব্বইটা বছর, সেটাকে আরও একটা জন্মদিনে পৌঁছানো নিয়ে তিনি সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। সাদামাটা দিনের মধ্যে হঠাৎ বিশেষ দিন তার মস্তিষ্ক আর স্বাস্থ্য দুটোর জন্যেই ক্ষতিকর।
কথাগুলো আমার ভেতর দুধরণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল, তবে আমাকে এর যেকোনো একটি বেছে নিতে হবে নিজেকে নিরপেক্ষ রেখে। কিন্তু সমস্যাটা হলো আমি বয়সে এখনও বেশ তরুণ এবং তার সাথে রয়েছে আমার কয়েক যুগের পার্থক্য। আমি এসেছি হাতে একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে একজন বিশিষ্ট প্রবীণের জন্মদিনে। যার রয়েছে একটি বর্ণাঢ্য সামাজিক অতীত। যিনি স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন জীবনের বাকি দিনগুলো, আর এখানে এসেছেন একান্তে বেঁচে থাকার আশা নিয়ে। তিনি কি সেটাকে অতিক্রম করেছেন? সন্দেহ বেড়ে যায়। আর আমি বুঝতে চেষ্টা করি একটা দীর্ঘ জীবনের ক্লান্তিবোধ কত ভয়াবহ, কীভাবে প্রতিটা জন্মদিন একটা মানুষকে নৈরাশ্যে ডুবিয়ে দেয়? বছরের পর বছর উদ্যমহীন, স্বপ্নহীন একটা জীবন নিছক বস্তুর মতো কীভাবে পৃথিবীতে টিকে থাকে? আর আমাকে ভাবতে বাধ্য করে যদি শুরু বা সৃষ্টি বলে কিছু না থাকে, আর যদি তাই হয়, তবে মানুষ কি সৃষ্টির উৎস খোঁজার পরিবর্তে কখনও শেষের বা ধ্বংসের উৎস খোঁজার মানসিকতায় পৌঁছাতে পারবে? আমার ভেতর থেকে [যেখানে হাতছানি দিচ্ছে অনেকগুলো সম্ভাবনা] নিঃসঙ্কোচে বেরিয়ে আসে, সম্ভবত না। তাহলে শুরু আর শেষের ধারণা যেটাকে তিনি মানুষের ভ্রান্ত সরলীকরণ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন, সেটা কি শুধুই বার্ধক্যের নিরর্থকতার ফল? এই কাঁচা বয়সে আমার পক্ষে চট করে বলা বেশ কঠিন।
এই চমৎকার বিকেলে, ওল্ডহোমের বারান্দায় বসে বৃদ্ধ তাকিয়ে আছেন সামনের বিশাল প্রান্তরের দিকে। দমকা হাওয়া বইছে। সামনে বেশ বড়সড় একটা মাঠ; মাঠের ওপাশে একটা জলাশয় আর জলাশয় পেরিয়ে জমাট বাঁশবন। ঘাসে ঢাকা মাঠ জলের মধ্যে গিয়ে শেষ হয়েছে। দেখলে মনে হবে যেন ক্ষুদ্র ঘাসগুলো দৌড়াতে দৌড়াতে জলের মধ্যে ঝাঁপ দিয়েছে [যেন কোনো অদৃশ্য শক্তির গভীরে]। আর রহস্যজনকভাবে [বিবর্তনের হিসাব-নিকাশ শেষে] ওপাড়ে গিয়ে ওগুলো এক একটা লম্বা লম্বা বাঁশ হয়ে উঠেছে। তিনি তার দৃষ্টিকে জলাশয়ের উপর রাখলেন আর বললেন, এই ঘাস আর বাঁশ এরা একে অন্যের সহোদর। এদের পথও এক; শেষ এবং সর্বশেষ! তারপর গোলাপের দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। ওগুলো রয়েছে একটি মাটির টবে পরস্পরকে জড়িয়ে। বৃদ্ধের সামনে ওগুলোকে মনে হলো সার্কাসের ভাঁড় যারা জোড়াতালি দেওয়া জামা পরে নাকে মুখে বিবিধ রঙ লাগিয়ে নৈঃসঙ্গে মগ্ন এক দর্শককে আনন্দদানের ব্যর্থ চেষ্টা করছে। তিনি এবার সেগুলো ছিঁড়তে লাগলেন। গোলাপের পাপড়িগুলো বাতাসের তোড়ে এদিক ওদিক উড়ে যেতে লাগল।
তিনি একত্রিত করলেন তার অবশিষ্ট সঞ্চিত শক্তিকে। এরপর ভেঙে দিলেন সময়ের চিরস্থায়ী বিভাজনগুলো। অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত থেকে ছেঁটে ফেললেন বর্তমান আর ভবিষ্যতকে। তলোয়ারের মতো হাত দুটোকে কয়েকবার শূন্যে ছুঁড়ে তিনি বাতাসকে টুকরো টুকরো করলেন। আর অস্ত্রের ঝনঝনানি থেমে যাওয়ার পর মনোযোগ দিলেন ব্যবচ্ছেদ করা টুকরোগুলোর দিকে। যেগুলো এইমাত্র অতি গুরুত্বপূর্ণ থেকে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। মহাকালে বর্তমান আর ভবিষ্যত বলে কিছু নেই। তিনি সরিয়ে ফেলছেন অপ্রয়োজনীয় টুকরোগুলো। তিনি এ মুহূর্তে মনোযোগ নিবিষ্ট করেছেন একটা কলাগাছের ওপর। একটার পর একটা খোল ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন একটা বাস্তব কাঠামোর দিকে। একমাত্র অতীত সত্য ও চিরস্থায়ী। সর্বব্যাপী ও ঐশ্বর্যময়। কাঙ্ক্ষিত টুকরোটা খুঁজে পাওয়ার পর ছেঁটে ফেলতে চাইলেন অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো। বর্তমান হলো অতীতের সর্বশেষ অবস্থা; অত্যন্ত নাজুক ও অস্তিত্বহীন। বর্তমান বলতে বা লিখতে যে শব্দ বা বর্ণ ব্যবহার করা হয় সেগুলোও যে এতক্ষণে আপনা আপনি কাল ক্ষেপণ না করে অতীত হয়ে উঠে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর ভবিষ্যত অতীতের পুনারাবৃত্তি মাত্র।
সময়ের প্রকৃত ধারণা পেতে হলে মানুষকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছাতে হবে। যেখানে মানুষ মুখ্য নয় তুচ্ছ। মানুষের কাছে সময় অতি গুরুত্বপূর্ণ হলেও সময়ের কাছে মানুষ আণুবীক্ষনিক জীব মাত্র। সময়কে অনুধাবন করতে হবে মহাজাগতিক দৃষ্টি নিয়ে। তিনি আবার প্রসারিত করলেন তার হাত দুটিকে। প্রসারিত দুই হাতে যেন সদ্য তা দেওয়া দুটো ডিম। তিনি হাত দুটোকে নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখলেন [যেন সূক্ষ্ম যোগ-বিয়োগ শেষে]। পৃথিবীর নিজ অক্ষের ওপর বা সূর্যের চারিদিকে ঘুর্ণনকে নিছক একঘেঁয়ে পুনরাবৃত্তি ছাড়া কিছুই বলা যাবে না। আর একই পথে বার বার একটা ঘূর্ণনশীল বস্তুর সামনে আর পেছনে অতীত ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তাই একটা মনোমুদ্ধকর সূর্যাস্তে দাঁড়িয়ে পরবর্তী সূর্যোদয়কে ভবিষ্যত ভাবাটা বোকামি। তিনি কিছুক্ষণের জন্যে থামলেন। আকাশের দিকে তাকালেন ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে, যেন আরেকবার মিলিয়ে নিচ্ছেন নিজের সূত্রগুলোকে। হাতের আঙুলের ফাঁকে ঘুরছে দুটো ডিম। নিজেকে কল্পনা করলেন ডিম দুটোর মাঝখানে। দুই হাতের মধ্যবর্তী মহাশূন্যে এখন তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন আরও নিশ্চিত হতে, তার ধূসর ছানি পড়া বিচক্ষণ চোখ নিয়ে। উল্টেপাল্টে পরীক্ষা করছেন গ্রহ ও নক্ষত্রপুঞ্জকে, জিরিয়ে নিচ্ছেন ছায়াপথের ওপর গা এলিয়ে, হারিয়ে যাচ্ছেন কৃষ্ণগহব্বরে। আর যখন ফিরে এলেন ততক্ষণে চোখ দুটো আরও ধূসর আর গম্ভীর হয়ে উঠেছে। তার মুখের ঝুলে পড়া চামড়া চকচক করছে। হাতির শুঁড়ের মতো নাকের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসছে সন্দেহের শেষ উষ্ণ বাতাস। কয়েক আলোকবর্ষ পথ মাড়িয়ে তিনি তার সমস্ত মহাজাগতিক ভাবনাগুলোকে একত্রিত করলেন একটা ছোট্ট ঘড়ির মধ্যে। আর বললেন, একটা গোল ঘড়ি যার কাঁটাগুলোর মূল কাজ হলো বার বার এটাকে চক্কর দেওয়া আর অতীতকে নির্দেশ করা। একটা ঘড়ি সবসময় পার হয়ে যাওয়া সময়কে নির্দেশ করে।
বৃদ্ধ অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকালেন। যেটা হেলে পড়েছে বাঁশবনের ওপরে; ঝলসানো আর অর্ধরক্তিম। এখন বিকেলটা হয়ে উঠেছে আরও মনোরম। রোদ পড়ে গেছে, বাতাসের বেগ কমেছে আগের চেয়ে। শরীর বুলিয়ে যাচ্ছে ঠান্ডা ঝিরঝিরে বাতাস। জলাধারের পাশে ঢোলকলমির শাখাগুলো দুলছে। জলে ঘুরে বেড়াচ্ছে দুটো হাঁস। আর রাত্রিযাপনের জন্য ঝাঁক ঝাঁক সাদা বকের দল উড়ে যাচ্ছে বাঁশবনের গভীরে। এমন একটা শান্ত সময়ে যখন পৃথিবী তার কর্কশ রূপ লুকিয়ে ফেলেছে, সকল বস্তু ও প্রাণিজগতের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে প্রশান্তির আবেশ, তার সাথে বিশেষ একটা দিন আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বিশেষ একটা বিকেল। নব্বইতম জন্মদিন। নব্বইতম বিশেষ বিকেল। যেটার শুরু হয়েছিল ১৯২৮ সালের ৩১ অক্টোবর যখন সূর্যটা ঠিক মাথার ওপরে। তিনি অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন রাত থেকে। মায়ের পেটে লাথি মারতে থাকলেন। ব্যথায় কুঁকড়ে গেলেন মা। আর তিনি শেষমেশ অবতরণ করলেন মাথার ওপর একটা ঝলসানো সূর্য নিয়ে। তার পিতা সন্ধ্যার আগে পুত্রের মুখ দর্শন করলেন না। কারণ তার ভেতর ছিল সূর্য সম্পর্কিত একগাদা কুসংস্কার। তিনি মনে করতেন, মাথার ওপর সূর্য নিয়ে পুত্র-সন্তানের পিতা হওয়ার মতো দুর্ভাগ্য পৃথিবীতে আর একটাও নেই। তার ধারণা ছিল, ভোর বেলায় পিতা হওয়াটা অত্যন্ত গর্বের যখন পৃথিবী নির্মল আর পবিত্র থাকে। এবং একজন গর্বিত পিতার পক্ষে একটা নতুন দিন শুরু করার জন্য এর চেয়ে ভাল সময় আর হতে পারে না। এভাবেই তিনি এসেছিলেন তার মতে বিকেলের শেষের শুরুতে।
ইতোমধ্যে আশে পাশের বারান্দাগুলো বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। বৃদ্ধরা সব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন। তবে ওদের বেরিয়ে পড়াটা ওই বারান্দা পর্যন্ত এবং বড়জোর মাঠের সামান্য অংশ অবধি। ওদের কেউ কেউ একটানা তাকিয়ে আছে জলাশয়ের দিকে। জলাশয়ের ওপারের বাঁশবনটা ওদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ বেড়ে যাই। এটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়, যেখানে দমকা বাতাসের মধ্যে নিজের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। পাশের বারান্দায় বসে দুই বৃদ্ধ আড্ডা দিচ্ছেন। তবে ওটাকে ঠিক আড্ডা বলা যাবে না, কারণ ওদের কণ্ঠ নিঃসৃত শব্দগুলো বাতাসে কম্পন ধরাতে ব্যর্থ হচ্ছে। যেভাবে ব্যর্থ হয়ে মাঠের ঘাসের উপর বসে আছেন আরেক বৃদ্ধ। বৃদ্ধের নাম বিশ্বজিৎ রায়। শৈশবে খুব দুরন্ত ছিলেন। যৌবনে ফুটবল খেলতেন, আর এখন তিনি প্রতি বিকেলে চেষ্টা করেন মাঠ পেরিয়ে জলাশয়ের পাশে একটু গা এলিয়ে বসতে। কিন্তু তার ভঙ্গুর দেহ তাকে থামিয়ে দেয় প্রতিবারই। বিশ্বজিতের কাছে এই মাঠটা জয় করাটাই এখন দুরূহ ব্যাপার। এসব বৃদ্ধেরা জীবনের ব্যস্ত, জটিল সময়গুলো পার করে আজ একই পাটাতনে একত্রিত হয়েছেন এবং এদের চাহিদাগুলোও একইরকম। জৈবিক চাহিদা, শুধুমাত্র টিকে থাকার জন্য জীবন যা দাবি করে, ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। খাওয়া, ঘুম আর বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমান বাড়ানো।
বৃদ্ধ এবার একত্রে মাপতে শুরু করলেন জীবন ও সময়কে। তিনি বললেন, জীবন আর সময়কে একই পথে দেখার কোনো সুযোগ নেই। দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা। অনেকটা পাশাপাশি দুটো উল্টো তীরের মতো। জীবন শেষের একটা পর্যায় থেকে চলতে চলতে শেষের আরেকটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যায়। আর সময় সেই থেমে যাওয়া সর্বশেষ মুহূর্ত থেকে চলতে শুরু করে অতীতের দিকে এগিয়ে যেতেই থাকে অনন্তকাল ধরে। বিষয়টাকে আরও পরিষ্কার করতে তিনি নিজের জীবনকে উদাহরণ বানিয়ে ফেললেন। ১৯২৮ সালে আমার জীবনের শেষের শুরু আর ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবরের বিকেলে আমার জীবনের সমাপ্তি। এটা একটা জীবনের চলার পথ। আর সময়ের শেষের শুরু ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে অনন্তকাল পিছনের দিকে। কারণ সময়ের ক্ষেত্রে শুধু অতীত সত্য।
বৃদ্ধের সময় সম্পর্কিত ধারণা বেশ কৌতুহলোদ্দীপক। বয়স ও অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন বিষয়ে তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিকে যে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার ভাবনাগুলোর মধ্যে সবসময় একধরনের বৈপরীত্য রয়েছে আর সেটা হলো দর্শন আর বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব। জীবনের ক্রান্তিলগ্নে এসে, যখন হৃদপিণ্ডটা তার বুকে আর স্বল্পসংখ্যক আঘাত করতে সক্ষম, তখন সবকিছু ছাপিয়ে তার ব্যক্তি দর্শনটাই চরম সত্য হয়ে উঠেছে, আর এদিক থেকে বিচার করলে তার সিদ্ধান্তগুলো যেগুলো পরিবর্তনের আর সুযোগ ও সময় কোনোটিই নেই, বেশ অর্থবহ বলা যায়। তার সময় সম্পর্কিত ভাবনাটা যেখানে অস্বীকার করা হয়েছে বর্তমান আর ভবিষ্যতকে আর এগুলোকে ফেলে দেওয়া হয়েছে অতীতের গহ্বরে। অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত যেগুলো সময়কে একটা ছন্দে রেখেছে আর আমরা এর একটা রূপরেখা আঁকতে পারছি। আমরা শিখছি অতীত থেকে, বর্তমানে ভাবছি আর ভবিষ্যতে রেখে দিয়েছি স্বপ্নগুলোকে। বর্তমানের ক্ষণস্থায়িত্বকে উদার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাদ দেওয়া গেলেও ভবিষ্যতকে অস্বীকার করা কি সম্ভব?
তিনি বিপরীতমুখী করেছেন জীবন ও সময়ের মতো চিরঘনিষ্ঠ দুটো অনুষঙ্গকে। কিন্তু আমি জীবনকে দেখি সময়ের সমান্তরালে, যেটা বিকশিত হয় সময়ের সাথে সাথে। সময় এগিয়ে নিয়ে যায় জীবনকে আর সময়ের এই অগ্রসমান পথেই একদিন এর সমাপ্তি ঘটে। তারপর হয়তো নতুন কোনো জীবনকে সঙ্গী করে সময় চলতে থাকে বিরতিহীন…। অসংখ্য জীবন জ্বলে নেভে সময়ের পথে ও সাথে। কিন্তু তার একমুখী সময়ের ভাবনা যেটা শুধুমাত্র সম্প্রসারিত হচ্ছে পেছনের দিকে, সেটা মেনে নিলেও আমার সরল মস্তিষ্ক প্রশ্ন তোলে জীবনের বিকাশ কি পশ্চাৎমুখী?
বৃদ্ধ নিজের ভগ্ন শরীরের দিকে তাকালেন। শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলো পরস্পরের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছে। ঐক্যের অভিন্ন স্বার্থ ছেড়ে তারা বেছে নিয়েছে বিচ্ছিন্ন আর সন্ন্যাস জীবন। এটাকে আর শরীর ভাবা চলে না, শরীর বলতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবিচ্ছিন্ন সংযোগের যে সমষ্টিকে সংজ্ঞা দাবি করে, সেটার সাথে এটাকে মেলানো বেশ কঠিন। চোখ দুটো অনেকাংশই হারিয়ে ফেলেছে ত্রিমাত্রিক অনুভূতি, চামড়াগুলো অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার দায়িত্ব থেকে অবসর নিয়ে ঝুলে আছে। ফুসফুসের অরুচি ধরে গেছে একঘেঁয়েমিপূর্ণ অক্সিজেনের প্রতি, পা দুটো অস্বীকার করেছে তার ওজন এলাকাগুলোকে। বৃদ্ধের সীমিত চলাফেরার দায়িত্বটা নিষ্ঠার সাথে এখনও নিশ্চিত করে রেখেছে একটা বাঁশের লাঠি। তিনি এটার নামকরণ করেছেন ‘বড়শি’। নামটা লাঠিটার বাঁকানো হাতলের সাথে যতটা জড়িত তার চেয়ে সাদৃশ্য রয়েছে বর্তমান পরিস্থিতির সাথে। তিনি বললেন, তার অবস্থা বড়শির হুকে ঝুলে থাকা মাছের মতো, যার আর কোনোভাবেই জলে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই এবং সামনে একমাত্র স্মরণীয় ঘটনা অপেক্ষা করছে—মৃত্যু! তুমি তখনই বুঝতে পারবে পৃথিবীতে তোমার আর কিছুই করার নেই, যখন দেখবে টয়লেট সেরে ওঠার সময় দেয়ালে ঘষা খেতে খেতে পাছার চামড়া শক্ত হয়ে গেছে। আর তোমার জন্য অপেক্ষা করছে একটা চমৎকার বড়শি।
আমার কাছে অন্তত একটা বিষয় বেশ পরিষ্কার আর তা হলো, বার্ধক্যের মধ্যে একটা গভীর তাৎপর্য রয়েছে। বার্ধক্য জীবনের সেই স্তর যেখান থেকে একজন মানুষ প্রকৃতিতে মিশে যাওয়ার মহান যাত্রা শুরু করে। এই ওল্ডহোমটা সেই বিরল মুহূর্তগুলোর সাক্ষী! আর এই বৃদ্ধেরা যারা প্রকৃতির মহাবিধান অনুসরণ করছে, এদের মস্তিষ্ক ক্ষয়ে যাচ্ছে, শরীরের সমস্ত শক্তি ধীরে ধীরে শূন্যের দিকে চলেছে, প্রস্তুতি নিচ্ছে এক বিরাট অনুজৈবিক রূপান্তরের জন্য; এ এক মহা আয়োজন!
প্রকৃতির আছে একটা মারাত্মক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। যেটাকে ধর্ম, মত, দর্শন, বিজ্ঞান দিয়ে চক করে ভেঙে ফেলা যায় না। শৈশব এবং বার্ধক্য জীবনের দুটি পর্যায়ই প্রকৃতি ঘনিষ্ঠ ও নির্দেশিত। একটা শিশুর জন্ম ও একজন বৃদ্ধের বার্ধক্যজনিত মৃত্যুর মধ্যে মৌলিক কোনো বৈসাদৃশ্য নেই। দুই ক্ষেত্রেই জীবন সরল, অসহায় ও দূর্যোগপূর্ণ। প্রকৃতির সৃষ্টি ও ধ্বংসের প্রক্রিয়া একইরকম। এটা অনেকটা কোনো রচনার সূচনা আর উপসংহারের মতো ঘুরিয়েফিরিয়ে একই কথা। তিনি ঢুকে যাচ্ছেন জীবনের গভীরে, যেটা প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, শোষিত এবং প্রতারিত। তিনি বলে চললেন, একটা শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন সে হাঁটতে পারে না, চিন্তা করতে পারে না, চোখ থাকার সত্ত্বেও উপলদ্ধি করতে পারে না। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে শেখে, কথা বলে, ভোগ করে, উপভোগ করে, চিন্তা করে, উপলদ্ধি করতে শেখে, সঙ্গম করে, সন্তান উৎপাদন করে। আবার এখান থেকেই তাকে প্রস্তুত হতে হয় আগের অবস্থায় ফিরে যেতে। শক্তি ক্ষয় হতে শুরু করে, জীবনের বৈচিত্র্যগুলো গুটিয়ে যেতে থাকে, মস্তিষ্ক শূন্য হতে থাকে, চলাফেরার শক্তি হারিয়ে ফেলে। জীবন শেষ পর্যন্ত প্রকৃতিতে মিশে যাওয়ার আগে সদ্যজাত শিশু হয়ে ওঠে।
প্রকৃতি জীবনকে সেই অবধি সমর্থন যোগায় যতক্ষণ না সেটা পরবর্তী প্রজন্ম নিশ্চিত করে। নানা পর্যায় পেরিয়ে জীবন অলঙ্ঘনীয় লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়। পরিপূর্ণ করে তার মস্তিষ্কের অলঙ্ঘনীয় উৎসহীন সংকেতকে। আলোড়িত হয় নিজের নতুন প্রশাখা দেখে [মৃত্যুর হতাশার বিপরীতে]। এই ভেবে প্রশান্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নিজের অস্তিত্ব টিকে থাকবে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে। আর এইখানেই প্রকৃতি জীবনের সাথে ক্ষমাহীন প্রতারণাটা করে। মস্তিষ্ককে ধাঁধায় ফেলে দেয়। তাকে দিয়ে নিঃসৃত করায় উর্বর হরমোন। জীবন বার বার ছুটে যায় প্রবল কামনার কেন্দ্রে আর প্রত্যেকবার হতাশ হয়ে ফেরে। প্রকৃতির প্রয়োজনকে জীবন একান্ত নিজের ভেবে উচ্ছ্বসিত হয়, প্রতারিত হয় এবং বিলীন হয়ে যায় চিরতরে। এটা অনেকটা ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকারের মতো। জলের তলা তন্নতন্ন করে মাছ ধরে গিলতে গিয়ে বোঝে, তার গলায় বিঁধে আছে শক্ত দড়ির গিঁট। এই প্রতারণাটার ফাঁদে নির্মমভাবে ধরা পড়ে কয়েক প্রজাতির পুরুষ মাকড়সা আর ফড়িংগুলো। পুরুষেরা সঙ্গমে লিপ্ত থাকা অবস্থায় উদারভাবে বিসর্জন দেয় তাদের মুণ্ডুগুলো ডিমের উর্বরতা বৃদ্ধির মহান কাজে।
বৃদ্ধ তার হাতির শুঁড়ের নাকের সুড়ঙ্গে আঙুল চালালেন, কয়েকবার হাঁচি দিলেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ভঙ্গিতে। দেহটাকে নৌকার পাল করে থুতনিটা রাখলেন বারান্দার গ্রিলে। তিনি যেন বসে আছেন কাঠগড়ায় একমাত্র রাজসাক্ষী হয়ে। ততক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার গিলতে শুরু করেছে বাঁশবন, সাদা বক, জলাশয়, মাঠ, সবুজ ঘাস, বারান্দা ও বৃদ্ধকে। এই নব্বইতম বিশেষ অন্ধকার, যেটা সঙ্গে করে আনছে আরও বিশেষ গাঢ় অন্ধকার এবং কিছুক্ষণের মধ্যে মুড়ে ফেলবে এই ওল্ডহোমকে। বৃদ্ধ বলে চললেন, পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ভাবনা মস্তিষ্কের নির্বুদ্ধিতা মাত্র। এই আত্মঘাতী ভাবনায় বুঁদ হয়ে আছে পৃথিবীর সকল মস্তিষ্ক ও অমস্তিষ্কবিশিষ্টরা। তিনি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আবার হাঁচি দিলেন, হাতড়ে বেড়ালেন র্ছিটকে বেড়িয়ে যাওয়া বাষ্পীয় থুথুগুলোকে তারপর উচ্চারণ করলেন জীবনবিনাশী শব্দমালা। অনেকটা যেন বানান করে… ধীরে… সময় নিয়ে…। সন্তানহীন জীবন! দীর্ঘজীবন পেতে হলে মুছে ফেলতে হবে মস্তিষ্কের উৎসহীন অনিবার্য সংকেত। এ এক একান্ত-নিজস্ব-ব্যক্তিগত টিকে থাকার যুদ্ধ প্রকৃতির বিরুদ্ধে, সন্তানের বিরুদ্ধে, প্রজন্মের বিরুদ্ধে। যেখানে পিতৃত্ব-মাতৃত্ব, আবেগ, আলোড়ন, রূপান্তরিত অস্তিত্ব, বংশধারা তুচ্ছ।
আমি দেখতে লাগলাম বৃদ্ধ মিলিয়ে যাচ্ছেন বিশেষ গাঢ় অন্ধকারে, তার সমস্ত জীবন, অভিজ্ঞা, সময়, চিন্তা, হতাশা, হাতির শুঁড়, পাখির বাসা আর বড়শিটা নিয়ে। কিন্তু এখন বরং আমাকে উঠতেই হবে। অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার আগে, সব কিছু নিরর্থক হওয়ার আগে, হতাশায় নিমজ্জিত হওয়ার আগে, মস্তিষ্ক বিকৃতির আগে, শহরের উদ্দেশ্যে শেষ বাসটা ছেড়ে যাওয়ার আগে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন