হুমায়ূন আহমেদের জীবন, প্রকৃতি ও প্রয়াণ

অ+ অ-

 

হুমায়ূন আহমেদের শিল্পসত্তার সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় যোগ। জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত প্রকৃতি তাঁর জীবনে বহুরূপে এসেছে। কখনো আনন্দ হয়ে কখনো বেদনা হয়ে, কখনো বা ভয়ংকর কোনো সত্য হয়ে। অতি শৈশব হতেই তিনি পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সিলেট, জগদ্দল, পঞ্চগড়, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, বগুড়া, কুমিল্লা ও পিরোজপুরে অবস্থান করেছেন। ফলে বিভিন্ন স্থানের ভূ-প্রকৃতির সঙ্গে সূচিত হয়েছে তাঁর গোপন প্রণয়। তাঁর স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থে জগদ্দলের যে স্মৃতি প্রবাহ সেখানে মহারাজার বাড়ি নির্জনতা তাকে নতুন করে চিনিয়েছে নিজেকে। জগদ্দলের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন এভাবে

বাড়ির সামনে বিশাল বন, একটু দূরেই নদী। যে নদীর পানি কাকের চোখের মত স্বচ্ছ, নদীর তীরে বালি ঝিকমিক করে জ্বলে। নদীটিই পাকিস্তান এবং ইন্ডিয়ার সীমানা। সারাক্ষণ অপেক্ষা করতাম কখন দুপুর হবেনদীতে যাবো গোসল করতে। দিনাজপুরের পচাগড়ে [পঞ্চগড়] ভোরবেলায় দাঁড়ালে তিনি দেখতে পেতেন কাঞ্চনজঙ্ঘা। তাঁর তখন মনে হতো পাহাড়টা রূপার পাতে মোড়া। সূর্যের আলো পড়ে সেই রূপা চকচক করছে। কৈশোরের শেষদিনগুলোয় ছিলেন রাঙামাটি, বান্দরবান, সেখানকার শঙ্খ নদীর স্মৃতি হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিতে ভাস্কর। তাঁর ছিল প্রবল জ্যোৎস্না প্রীতি। এ জ্যোৎস্না প্রীতি সম্পর্কে পূরবী বসু লিখেছেন:

নিউইয়র্ক শহরে বিশাল বিশাল গগনছোঁয়া সব দলান, কর্মব্যস্ত কোটি জনতা আর লাখ লাখ গাড়ির কানফাটা আওয়াজের মধ্যে বসেও গভীর রাতে পূর্ণিমার স্নিগ্ধ সৌন্দর্য আবিষ্কার করা বা তা উপভোগ করা হয়তো কেবল হুমায়ূন আহমেদের পক্ষেই সম্ভব। [...] ফকফকে দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ জ্যোৎস্না থেকে শুরু করে মাঝারি রকমের জ্যোৎস্না, এমনকি ম্লান হালকা জ্যোৎস্না, সবরকম জ্যোৎস্নাকেই সে উপভোগ করত। ভালোবাসত।

বড় হতে হতে তিনি বিচিত্র দেশ পরিভ্রমণ করেছেন। উপভোগ করেছেন প্রকৃতির বিচিত্ররঞ্জিত রূপ। তিনি বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়েছেন জলপ্রপাত দেখে। মরুভূমি অতিক্রম আর গিরিখাদের দীর্ঘপথ ভ্রমণে হয়েছেন অভিভূত। তড়িতাহত হয়েছেন, বিমূঢ় হয়েছেন এবং আরও বেশি ধাবিত হয়েছেন প্রকৃতির সান্নিধ্যে। তিনি অ্যান্টার্কটিকার জনমানব শূন্য ধূধূ বরফের দেশে রাত কাটাতে চেয়েছেন। আর দেখতে চেয়েছেন রাতের আকাশে মরুর খেলা দেখা।

পুরোপুরি লেখক হয়ে ওঠার পর নাগরিক জীবনের কোলাহল তাঁকে গ্রাস করে অষ্টেপৃষ্ঠে। তবু তাঁর অন্তর্দেশে প্রবাহিত ছিল প্রকৃতির আশ্রয়ে লুক্কায়িত থাকার অভিপ্রায়। ফলে সমুদ্রের বিশাল জলরাশিকে সম্মুখে রেখে বানিয়েছেন ঘর। সমুদ্র বিলাস। আবার গাজীপুরের পিরুজালিতে নুহাশপল্লীকে গড়ে তুলেছেন অরণ্যের আদলে। নুহাশপল্লী এক অর্থে হুমায়ূন আহমেদের বৃক্ষপ্রীতির নৈবেদ্যও। তিনি একে সাজিয়েছেন নয়নাভিরাম বৃক্ষ, দীঘি ও ভাস্কর্য দিয়ে। প্রায় দুশ প্রজাতির ঔষধি গাছ রোপন করেছেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদ বর্ষা যাপনকে দেখতেন উৎসবের আমেজে। তার শৈশব-স্মৃতির উজ্জ্বলতম অংশ মীরাবাজারের বৃষ্টি। বৃষ্টিকে যাপন করার উদ্দেশ্যে নুহাশপল্লীতে তাঁর বৃষ্টিবিলাস নামে একটি টিনের ঘরও রয়েছে।

স্বভাবই শিল্পীর সমস্ত সত্তা বহুস্বরে ধ্বনিত হয় তাঁর সৃষ্ট শিল্পে। ফলে প্রকৃতি বন্দনা আর হুমায়ূন আহমেদের রচনার অনিবার্য অনুষঙ্গ একসূত্রে গাঁথা হয়ে আছে। অমর কথাশিল্পী  বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আরণ্যক উপন্যাসে লবটুলিয়ার নির্জন বন, পথ হারানো অন্ধকার আর আদিম আরণ্যকে সত্যচরণের চোখে যেভাবে দেখেছেন হুমায়ূন আহমেদের কে কথা কয় উপন্যাসে মতিনের বন্ধু আশরাফের দৃষ্টিও তেমন। নাইক্ষ্যংছড়ি নামক কোন এক গহীন বনে থাকে সে। সেখানে ইলেকট্রিসিটি নেই, মোমের আলোয় চিঠি লিখে মতিনকে অরণ্যচারী জীবনের খবরাখবর জানায় আশরাফ। রেইনট্রি গাছের উপর ট্রি-হাউজ বানিয়ে থাকার রোমাঞ্চ আশরাফের জীবনকে লেখক বাস্তব রূপ দিয়েছেন। আশরাফ পাহাড়ে কলা চাষ করে, কফিগাছের চারা লাগায়। মাসি-পিসি নাম রেখে হস্তি শাবক পোষে। শঙ্খ নদীর পানি তার অতি প্রিয়। তার কাছে অরণ্য জীবিত সত্তা। নক্ষত্রের রাত উপন্যাসেও জীবন যুদ্ধে পরাজিত পাশার কাছেও প্রকৃতি জীবন্ত। তার জীবন সংকটে সবশেষে কোনো আত্মীয় বন্ধু বা সুহৃদ তার আপন হয়ে ওঠে না কেবল আপন হয় প্রকৃতি। জীবনের সকল আয়োজন থেকে স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করে ফিরে যায় প্রকৃতির আশ্রয়ে। ঔপন্যাসিকের ভাষ্যে

অনেক রাতে পাশা তার গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামল। [...] রাস্তা নির্জন। দুপাশে প্রেইরির সমভূমি, বরফে সাদা হয়ে আছে। বিশাল একটি বাটির মতো আকাশটা চারদিক ঢেকে রেখেছে। আকাশে নক্ষত্রের মেলা। কী অদ্ভুত তাদের আলো! নক্ষত্রের আলোয় কেমন অন্যরকম লাগে বড়ো ইচ্ছে করে কাছে যেতে।

হুমায়ূন আহমেদ তাঁর উপন্যাসে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনোজগতে প্রকৃতিকে ঈশ্বররূপে প্রতিস্থাপন করেছেন, যেখানে তিনি দেখিয়েছেন চমৎকার স্নিগ্ধ প্রকৃতি পরিস্থিতি অনুযায়ী কোমল ও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। তাঁর সমুদ্র বিলাস উপন্যাসে রিমির স্বামী তৌহিদের মাঝেমধ্যেই তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর জানা যায় সমস্যাটা মানসিক যেদিন যেদিন তার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া হয় শুধু সেদিনই এই সমস্যা শুরু হয়। ফলে ডাক্তারের পরামর্শে তারা জীবনের প্রথম সমুদ্র দর্শনে আসে। সমুদ্র রিমির ভেতরের আবরণ খুলে দেয়। এক ভয়ংকর সৌন্দর্যের কাছাকাছি এসে সে অনুভব করে তৌহিদের প্রতি তার ভালোবাসাহীনতা। তৌহিদের নিস্পৃহ আচরণ ঝামেলা মুক্ত থাকার ইচ্ছে রিমির কাছে কাপুরুষতা বলে মনে হয়। তৌহিদের সবকিছুতে প্রতিবাদহীনতা, গুটিয়ে থাকার প্রবণতা রিমিকে তার প্রতি আরো বেশি বিরাগ করে তোলে। দুজন হাত ধরে সমুদ্রে নামার অব্যক্ত অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা থেকেই অবশেষে রিমির প্রতিরোধ ভেঙে যায়। রিমি একটু একটু করে এগিয়ে যায় মহামৃত্যুর দিকে। প্রচণ্ড একটা ঢেউ এসে প্রবল বেগে রিমির গায়ে আছড়ে পড়ে। এই ঢেউ রিমিকে তীরে ছুরে ফেরতে পারে আবার অদ্ভুত কৌশলে নিজের কাছে টেনেও নিতে পারে। সে কী করবে, কে জানে!

আবার বৃষ্টি বিলাস উপন্যাসে আতাউরের সঙ্গে শামার বিয়ে পুরোপরি ঠিক হয়ে যাওয়ার পর তার অসুস্থতা জনিত কারণে তা ভেঙে যায়। আতাউরের চিঠিতে শামা জানতে পারে আতাউর শুধু বৃষ্টির দিনেই অসুস্থ হয়। কারণ কোনো এক বৃষ্টির দিনে তার চোখের সামনেই আতাউরের সামনে তার বাবাকে শত্রুরা মাংস কাটার ছুরি দিয়ে জবাই করেছিল। ভয়ংকর সেই বৃষ্টির ফোঁটায় মিশে গিয়েছিল তার বাবার লাল রক্ত। এরপর থেকে বৃষ্টি হলেই আতাউর দেখতে পায় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো লাল। এক অপ্রকৃতস্থ আতঙ্কে সে তখন ছুটে পালাতে চায় বাস্তব থেকে। মেঘ বলেছে যাব যাব [১৯৯৭] প্রকৃতির আবার ভিন্নরূপ। উপন্যাসে তিতলী তার বিবাহপূর্ব প্রেমের বিচ্ছেদ যন্ত্রণায় এতটাই বিমূঢ় ও হতবাক থাকে যে দাম্পত্য জীবনকে সে আর সহজভাবে নিতে পারে না। বিয়ের প্রথম দিনেই সে তার স্বামী শওকতকে বুঝিয়ে দেয় তিতলীর শরীর ও মনে তার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু নগরকোটের হোটেল লবিতে হিমালয় থেকে যখন একটুকরো মেঘ ভেসে আসে তখন তিতলীর মনে এর প্রভাব পড়ে ভিন্ন রকম তিতলীর সে মানসিক অবস্থা লেখক চিত্রিত করেছেন এভাবে

জলভরা একখণ্ড মেঘ কি তাকে জড়িয়ে ধরেছে? অবশ্যই তাই। [...] কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! চেখের সামনে হিমালয়ের রং বদলে যাচ্ছে। এটি কি কোন স্বপ্নদৃশ্য? না স্বপ্ন দৃশ্য নয়। এত সুন্দর কখনো একা দেখা যায় না। তার শরীর জেগে উঠেছে। সে গভীর মমতা ও ভালোবাসায় শওকতকে জড়িয়ে ধরল।

হুমায়ূন আহমেদ আশৈশব যে প্রকৃতির সন্তান হতে চেয়েছেন সেই প্রকৃতির এক উজ্বলতম রাতে তিনি নিজের মৃত্যু প্রার্থনা করেছেন। তিনি নিজের জন্য যে মরণসঙ্গীত লিখেছেন তার কয়েকটি পঙ্‌ক্তি হচ্ছে

ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়
চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়।

কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের শেষ মনোবাসনা পূরণ হয়নি তাই, এক অন্ধকার রাতে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে স্বদেশের প্রকৃতি থেকে বহু দূরে নিউইয়র্ক শহরে। তারিখটি ছিল ১৯ জুলাই। প্রয়াণ দিবসে এই মহান লেখককে শ্রদ্ধা জানাই।