রণজিৎ গুহ: সাহিত্য ও ইতিহাসের দ্বৈরথ

রণজিৎ গুহ নিয়ে কিছু লেখা সহজ নয়, অন্তত আমার পক্ষে, একদিকে তাঁর দীর্ঘজীবনের সুবিস্তীর্ণ কর্মকাণ্ড, অন্যদিকে বিপুল পাঠ-অভিজ্ঞতা এবং চিন্তার নানারকম বাঁক-বদল—আমার ছকবন্দি চিন্তাকে বিপন্ন করে তোলে। তাঁর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসার আগে বলে নিতে হয়, তিনি তথ্য ও জ্ঞানের এক প্রবাহমান ধারা; ভূগোল ও ঋতু-বৈচিত্র্যের মতো নিজেকে বদলে নিয়েছেন বারবার। জ্ঞানকণ্ডের এক নদীতে অবগাহন তাঁর ধাতে ছিল না। তাই বলে এই পরিবর্তন তাঁর আগের চিন্তা-পদ্ধতিকে বাতিল করে দেয় না। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেছেন, উত্তরের মধ্য সমাধান খুঁজে পেয়েছেন, আবার নতুন করে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। আর এসব সম্ভব করে তুলেছিল তাঁর অধীত বিদ্যার সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতার বিপুল সমারোহ।
তিনি সর্বদায় নতুন কিছু বলতে চেয়েছেন, বলার চেষ্টা করেছেন। এই বলার আকাঙ্ক্ষা যত না তাঁর স্বকপোলকল্পিত তারচেয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যজাত এবং সৃজনশীল মনের ব্যাখ্যা হাজির করার ক্ষমতা। তিনি চর্চা করেছেন ইতিহাস, তৈরি করেছেন নতুন পাঠ-পদ্ধতি। সম্ভবত বিশ শতকের শেষের দিকে ইতিহাস দেখার সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতির অন্যতম পুরোধা তিনি। বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন—‘বিশ শতকের সবচেয়ে সৃজনশীল ভারতীয় ঐতিহাসিক’। রণজিৎ গুহের ইতিহাস গবেষণা তাঁর কালের বা আগের কারো সঙ্গে খুব একটা মেলে না। সম্ভবত তিনি এই দৃষ্টিভঙ্গিটি পেয়েছিলেন কাল মার্কসের কাছ থেকে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ থেকেই তিনি অর্থনীতি, সমাজ-রাজনীতি, ভাষা ও সাহিত্যকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এক সময়ের নিষ্ঠাবান মার্কিস্টি হওয়া সত্ত্বেও সারা-জীবন তিনি রাজনৈতিক কমিউনিজমের প্রতি আস্থা রেখে চলতে পারেননি। আর এর কারণও তাঁর জীবনের বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা, দেশ-বিদেশের মার্কসবাদি সংগঠন ও তাত্তি্বকদের সঙ্গে কর্মসূত্রে সম্পর্ক। একদা যিনি কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসকে বাইবেলের মতো পড়ার কথা বলতেন, সেই তিনিই বললেন, ‘এটা ঠিক যে, আমি বিভিন্ন তথাকথিত কমিউনিস্ট দেশে গিয়ে দেখলাম যে আমরা কমিউনিজম বলতে যা বুঝতাম, সেটা আরপিডি আর কিং স্ট্রিট, লন্ডন, যা বোঝাতো, তাই বুঝতাম।’
তবে মার্কসবাদে আস্থা না রাখলেও মার্কসের প্রতি তাঁর মোহ কখনো কাটেনি। তার অন্যতম কারণ হয়তো তাঁর গবেষণার প্রণালী অনেকখানি মার্কসের কাছে ঋণী। তিনি মনে করতেন, ক্যাপিটালিজমের নেচার না জানলে পোস্ট-মার্কেন্টাইল যুগের ইতিহাস লেখা সহজ নয়। মার্কসীয় পদ্ধতি ব্যবহার সত্ত্বেও তাঁর ইতিহাস-চর্চা ও গবেষণা বিশ্বাসী মার্কসবাদীদের কাছে তেমন আদৃত হয়নি। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘তিনি আসলে খুব পলিটিক্যাল লোক নন ভেতরে ভেতরে।’ ফলে পদ্ধতিগত রাজনীতির চেয়ে জ্ঞানতত্ত্ব, ইতিহাস, ভাষা ও সাহিত্য তাঁর চর্চার প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
নিশ্চয় তাঁর সাবঅল্টার্ন ইতিহাস এতটাই প্রভাবশালী ও মনোগ্রাহী হয়েছিল যে, প্রতিভাবান একঝাঁক তরুণ ইতিহাস গবেষক তার দিকে ঝুঁকে পড়েন; এবং এই ধারার প্রাতিষ্ঠানিক মান্যতা আদায় করে নেন। এমনকি বিশ শতকের শুরুতে ইতিহাসের ছাত্রদের মধ্যে, উত্তর-ঔপনিবেশি তাত্ত্বিকদের মধ্যেও এটি দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এমনকি সর্বশেষ স্মার্ট ইতিহাস গবেষক হিসাবে তারা স্বীকৃতি পান। তাঁর চিন্তার ঘরানায় স্ববৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, শাহিদ আমিন, গৌতম ভদ্র, ডেভিড হার্ডিম্যান ও দীপেশ চক্রবর্তীর মতো প্রমুখ প্রতিভাবান ইতিহাস-গবেষক। তাদের অধিকাংশ রণজিৎ গুহের শ্রেণিকক্ষের ছাত্র না হয়েও তাঁর শিষ্যপদে বরিত হয়েছেন। নিম্নবর্গের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে একই সঙ্গে তাদের নাম উচ্চারিত হয়ে থাকে। ভারতে ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে সরকারি যে ভাষ্য গড়ে উঠিছিল, রণজিৎ গুহের ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়ে তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। বিশেষ করে ইংরেজ শাসনের ফলে এ দেশীয়দের যে সুফলের গল্প বলা হয়েছে তা মূলত ব্রিটিশ শাসনজাত বয়ান। তার কোনটাই জনগণের ইতিহাস নয় বলে তিনি প্রমাণ করেন।
অভিক্ত বাংলার বরিশালের মানুষ তিনি, এ কথা বলতে ভোলেননি যে, ‘ফজলুল হক আমাদের বাড়ির বন্ধু ছিলেন। তিনিই আমার বাবাকে ঢাকা নিয়ে গেলেন। তিনি চিফ মিনিস্টার হলে বাবা পার্টি দিয়েছিলেন।’ ফজলুল হকের দু-একটি স্মৃতি তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘ফজলুল হক খাচ্ছেন আর তার হাত দিয়ে রসগোল্লার রস গড়াচ্ছে।’ শেরে বাংলা এক সঙ্গে চল্লিশটি ফজলি আম আর এক পাতিল পান্তাভাত খেতে পারতেন বলে যে মিথ গড়ে উঠেছিল—এটি তাকে সমর্থন করে। গান্ধী নিয়ে কাজ করতে গিয়েও তিনি এ ধরনের বহু লোকভাষ্যের সম্মুখীন হন। তালুকদার বংশের সন্তান হয়েও দেখার দৃষ্টি পেয়েছিলেন তিনি দলিত, মুসলমান ও শ্রমিকশ্রেণির প্রজাসমষ্টির মাধ্যমে। আর এ কারণেই সম্ভবত তাঁর গবেষণা অভিসন্দর্ভ, ‘আ রুল অব প্রপার্টি ফর বেঙ্গল: অ্যান এসে অন দি আইডিয়া অব পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট’ এখনো গুরুত্বপূর্ণ কর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়। কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এ দেশে কিভাবে একটি খাজনাখোর পরনির্ভর শ্রেণির জন্ম হয়েছিল—ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে, তিনি তাঁর গবেষণায় বহু উপাত্তসহ দেখিয়েছেন। এ ধারার গবেষণার প্রতি তাঁর কৌতুহলের কারণ জানা যায়—‘আমার বাবা ছিলেন হাইকোর্টের উকিল। জীবিকার প্রয়োজনে অনেক বই পড়তেন ও কিনতেন। একদিন দেখি ফ্লুড কমিশনের রিপোর্ট ছয় খণ্ড এসে গেছে। শুনেছিলাম যে তাতে নাকি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভার পক্ষ থেকে একটা বিবৃতি ছাপা হয়েছে। কৃষকসভায় যে কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালিত গণ-সংগঠন তা জানা ছিল। তাই কলেজ কামিয়ে রিপোর্টটা নিয়ে বসে গেলাম। সেই পড়ার ফলেই গ্রাম-সমাজে ক্ষমতার সম্পর্ক নিয়ে আমার বালকবয়সের কৌতূহল প্রথম যৌবনে রাজনৈতিক জিজ্ঞাসায় রূপায়িত হয়।’
অভিক্ত বাংলার বরিশালের মানুষ তিনি, এ কথা বলতে ভোলেননি যে, ‘ফজলুল হক আমাদের বাড়ির বন্ধু ছিলেন। তিনিই আমার বাবাকে ঢাকা নিয়ে গেলেন। তিনি চিফ মিনিস্টার হলে বাবা পার্টি দিয়েছিলেন।’ ফজলুল হকের দু-একটি স্মৃতি তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘ফজলুল হক খাচ্ছেন আর তার হাত দিয়ে রসগোল্লার রস গড়াচ্ছে।’ শেরে বাংলা এক সঙ্গে চল্লিশটি ফজলি আম আর এক পাতিল পান্তাভাত খেতে পারতেন বলে যে মিথ গড়ে উঠেছিল—এটি তাকে সমর্থন করে। গান্ধী নিয়ে কাজ করতে গিয়েও তিনি এ ধরনের বহু লোকভাষ্যের সম্মুখীন হন।
বর্তমানে এ ধারার গবেষণা পদ্ধতির কিছু পরিবর্তন আসলেও নিম্নবর্গের ইতিহাস-চর্চার গুরুত্ব এখনো কমেনি। এমনকি জীবনের শেষ পর্বে এসে রণজিৎ গুহের প্রধান কর্মকাণ্ড হয়ে উঠেছিল—ভাষা-সাহিত্য। তিনি মনে করতেন—সাহিত্যই ইতিহাস রচনার প্রধান ও নির্ভরযোগ্য নিয়ামক। আর এসব করতে গিয়ে ভাষা তাঁর প্রধান সহায়ক হয়ে পড়ে। ভাষা যেমন সাহিত্যের বাহন, মানুষের ইতিহাস ভাষার শরীরে প্রকীর্ণ থাকে। তাঁর যুগান্তকারী ইতিহাস চর্চার মধ্যে ঢুকে পড়ে—‘আমরা যে ইতিহাস লিখি পড়ি পড়াই ইংরেজের ক্ষমতা লিপ্সা’র দ্বারা তাঁর সৃষ্টি।’ আর এর আলোকে তিনি বিশ্লেষণ করেন, আধুনিকতা, স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবাদ।
তাঁর মতে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ফলে মৌলিক কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি। ব্রিটিশ শাসন ভারতীয়দের কখনো উন্নতি দেখতে চায়নি। আপাত যে ধরনের হিতৈষা দেখা যেতো—তা মূলত শাসন করার মানসজাত। ভারত শাসনে তাদের একটি নীতির কথা আমরা জানি—‘ডিভাইড এন্ড রুল’ কিন্তু খুব কমই জানি—‘কিপ পউর এন্ড রুল।’ ধনতন্ত্রের অসম বিকাশ ছিল ইংরেজের শাসক-শাসিতের সম্পর্ক। তাদের আইন-কানুনও গড়ে উঠেছিল বৈষম্যের ভিত্তিতে। ঔপনিবেশিক রাজ্যের প্রজারা সর্বদা পরাধীন অ-নাগরিক। ব্রিটিশ শাসনের অর্ধেক সময় পাবলিক বলতে কেবল তাদের বোঝানো হতো শাদা চামড়ার ব্রিটিশ আর ইংরেজি জানা কিছু ভারতীয়কে। প্রজার প্রতি যতটুকু সুসম্পর্কের বয়ান দেয়া হতো—তার পেছনেও ছিল শান্তি রক্ষার পেছনে কম ব্যয় করা; কারণ সেনাবাহিনী দিয়ে শান্তি রক্ষা করতে গেলে খরচ একটু বেশিই পড়ে।
পাশ্চাত্য সভ্যতার তথাকথির উদারনীতির উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের ‘সভ্য’ করে তোলা। তারা জানত- সামরিক ক্ষমতা দিয়ে শান্তি বজায় রাখতে গেলে পশ্চিমা যুক্তিবাদ ও মানবিকতা পরাধীন জনতার ওপরে পবিত্রতাসহ প্রয়োগ করতে হবে। উদারতাবাদের গীত গাইলেও ‘১৯৬১ সালে নীলদর্পনের মামলায় রেভারেন্ড জেমস লং-এর জরিমানা ও কারাদণ্ড’ প্রমাণ করে দেশিজনতার ওপর তা কাজ করেনি। দেখা গেছে খারাপ শ্বেতাঙ্গদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেও ইংরেজ শাসকগণ আইনের দ্বারা প্রজাসাধারণের কণ্ঠ রোধ করে দিতো। তবে ব্রিটিশ শাসনের উষা-লগ্নে এদেশে যে আধুনিকতা ও রেনেসাঁসের সূচনা হয়েছিল তার ভিত্তিমূল নিয়ে রণজিৎ গুহ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন—রামমোহনের সংস্কার-আন্দোলনের চরিত্র বিশ্লেষণ করে। তাঁর সহমরণ-বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার অনুভূতির মর্মস্থ যে শ্রদ্ধা, তা কর্তব্যবোধে পরিণত হয় আন্তমর্যাদা ও সহানুভূতির মাধ্যমে। তিনি আসলে বলতে চেয়েছেন, তাঁর এই পরিবর্তন ভারতীয় লৌকিক জ্ঞানের ভিত্তিতে সাধিত হয়েছে, ইংরেজ তার জন্য কমই ভূমিকা রেখেছে। তাঁর মতে লৌকিক জ্ঞানের ধারণায় দেশকালগত পরিবর্তন নতুন নয়। একই সাথে রামমোহনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কান্ট ও জেরেমি বেনথামের হিতচিন্তা।
রণজিৎ গুহ ‘দয়া: রামমোহন রায় ও আমাদের আধুনিকতা’ নামে এই বইটি লিখেছিলেন ভারতীয় রাজনীতির বিশেষ মুহূর্তে; ২০০২ সালে গুজরাট হত্যাকাণ্ডের বীভৎস সময়ে। তিনি বলতে চেয়েছেন, নির্দয়তাই শেষ কথা নয়। পেশিনির্ভর সাম্প্রদায়িক উগ্ররাজনীতি ভারতীয় চেতনার প্রধান অংশ নয়। এই আলোচনার একটি বিশেষ দিক হলো—ধর্ম শাস্ত্র ও যুক্তির দ্বারাই প্রমাণ হাজির করা যে, হিন্দুত্বের নামে এতটা পিশাচনৃত্য আগে কখনো দেখা যায়নি—একুশ শতকের উদ্বোধনকালে যেটি গুজরাটে দেখা গিয়েছে। স্বাধীন ভারতের ইতিবৃত্তের সঙ্গে গুজরাটের নৃসংশতাকে তিনি কখনো মেলাতে পারেননি। রণজিৎ গুহের ভাষ্যে—‘সংখ্যালঘু গরিবের বস্তি, মধ্যবিত্তের পাড়া, দোকানপাট জ্বালিয়ে সেই চিতায় দেবদেবীর জয়জয়াকার; আবালবৃদ্ধ নির্বিশেষে নিরস্ত্র নিরীহকে ত্রিশূলে বল্লমে খুচিয়ে খুচিয়ে উল্লাসের জিগির; নিহত গর্ভবতীর ভ্রূণ তলোয়ারের ডগায় বিঁধে তুষ্টির হুঙ্কার; ঘরে ঘরে মাবোন সহধর্মিণীর স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে সেই বীরত্বের সাদর স্বীকৃতি; নাগরিক মারণযজ্ঞে রাষ্ট্রযন্ত্রের অকপট সহযোগিতা; নরমেধের হোতা দল ও দলপতিদের কথায় ও কাজে চরিতার্থতার প্রকাশ্য আস্ফালন; আর কৃতিত্বের পুরষ্কার স্বরূপ গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনে সেই ঘাতকদেরই অবিসংবাদিত সাফল্য।’ অথচ জনসাধারণের অনুমোদনেই তারা ক্ষমতায় এসেছে। এই নির্মমতার উৎস অনুসন্ধানই ছিল রণজিৎ গুহের এই বইয়ের প্রতিপাদ্য। যে শাস্ত্রের অধীনে তারা নৃসংশতার রসদ খুঁজে পায়, তারই আলোকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন উদ্ভূত বিপর্যয়। ‘মানুষ হয়েও যারা মানুষের প্রতি এ ধরনের আচরণ করে, দয়া বলতে কি কিছুই নেই তাদের মনে?’ রণজিৎ গুহের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাংলা বই হলো—‘কবির নাম ও সর্বনাম।’ কবিতা-সাহিত্য সমালোচনা এবং ভাষার অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পাঠকের কিছুটা কৌতূহল মেটাতে পেরেছে এই বইটি। কাব্যপাঠের পথে ভাষাদর্শনের প্রলেপ বিছানো। নাম সর্বনামে মোড়ানো শব্দ-প্রতীকের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে তার বেদনাময় চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য, গীতালি, বলাকা ও গীতবিতানের কিছু গানে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে কিভাবে হয়েছেন লীন। কবির সঙ্গে বিশ্বচরাচরের সম্পর্ক নাম ও সর্বনামের সম্বন্ধে ধরা পড়েছে এতে। এই আমির সঙ্গে ‘সে’ ‘তুমি’ ‘তার’ এর সম্পর্ক স্থাপনই যেন কবির সর্বনামের কাজ। একের ভেতর দিয়ে অপরের প্রকাশ ‘তাই তোমার আনন্দ আমার ‘পর তুমি তাই এসেছ নীচে।/ আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে।’ ব্যক্তি আমি-র সঙ্গে বিশ্ব-আমির মিলনের সূত্রগুলির এক অজানা আনন্দ বেদনায় গাথা। তুমি না থাকলে আমার অস্তিত্ব কিসে থাকবে বাঁধা। ‘তুমি থাকলেই জোড়বাঁধা ‘আমি’টিও থাকবে।’ রণজিৎ গুহের দাবি অনুযায়ী ভাষার সর্বনাম এতটাই সার্বত্রিক যে কোনো রূপে তা সব ভাষাতেই বিদ্যমান। মি. গুহের ভাষায়, ‘স্বভাববশে ভাষা মানুষকে সর্বনামের কবচকুণ্ডল পরিয়ে রেখেছে যাতে নামের একনায়কতা সে আত্মরক্ষা করতে পারে। সর্বনামের কাজ হলো ভাষাকে সচল রাখা।’
এই আমিকে রবীন্দ্র-বিজ্ঞজনেরা কিভাবে দেখেছেন তারও একটা তুলনামুলক আলোচনা করেছেন তিনি। আবু সয়ীদ আইয়ুব কিভাবে এই ‘আমি’কে পাঠ করেছেন, কিভাবে দেখেছেন সুকুমার সেন—সে-সব যেমন আছে, তেমন ভারতীয় মনীষী ভর্তৃহরি থেকে শুরু করে এলিয়টের কাব্যপাঠের রুচি নিয়ে তিনি এই বইতে আলোচনা করেছেন। কেন তিনি পি.বি. শেলিকে নিতে পারছেন না, অথচ দান্তে ও লুক্রেসিয়াস তাঁর প্রিয় কবি হয়ে উঠছে। নিশ্চয় ভাষার একটি পদ নিয়ে এ আলোচনা উচ্চতর ভাষাতাত্ত্বিক সীমানার মধ্যে পড়ে। ভাষার জগতের জ্যাক দেরিদা, স্যোসুর, হাইডেগারও বাদ পড়েনি। তাঁর মতে, ‘কোনো মতবাদ, তত্ত্ব, বিশ্বাস কিংবা যাকে বলে ‘জীবনদৃষ্টি’ যখন কবিতায় এমনভাবে প্রদর্শিত হয় যে পাঠক তাকে সুসংবদ্ধ, পরিণতবৃদ্ধি ও অভিজ্ঞতার তথ্যে স্থাপিত বলে মেনে নিতে পারে, তখন সে মতবাদ ইত্যাদি তার কাছে গ্রাহ্য বা অগ্রাহ্য, অনুমোদনের যোগ্য বা অযোগ্য যাই হোক, রসভোগের ক্ষেত্রে তা অন্তরায় নয়।’ এ ক্ষেত্রে দোহাই হিসাবে তিনি টি.এস. এলিয়টের ‘শেলি এন্ড কীটস’ রচনাটি ব্যবহার করেছেন।
সাহিত্যে ধর্ম ও নৈতিকতার অবস্থান নিয়েও রণজিৎ গুহ মীমাংসা করেছেন, লিখেছেন—‘প্রেম না প্রতারণা’। সাহিত্য থেকে শুরু করে সমাজ সংস্কার পর্যন্ত বহুবিধ জিজ্ঞাসায় পরহিতাকাক্ষী নৈতিকতার সংঘর্ষে ও সমন্বয়ে যে বাদানুবাদের সৃষ্টি হয়, সেখানে ধর্মের একটা অবস্থান থেকে যায়। মধ্যযুগের সাহিত্যে যেভাবে ধর্ম ছিল, এবং আধুনিককালে এসেও ধর্মের নৈতিকতা রসাগ্রহীর কাছে আরো তৃপ্তিকর হয়ে উঠেছে। ১৮৬০ সালে বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’ প্রকাশের পরপরই গ্রন্থটি খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এটির মূলে বিদ্যাসাগরের বাংলার প্রতি পাঠকের অপরিমেয় কৌতূহল কাজ করে থাকবে বলে লেখকের ধারণা। বঙ্কিমও ভাষার কারণে পাঠকের মাঝে খুব দ্রুতই প্রচারিত হয়েছেন। তবে ধর্ম ও নৈতিক বিষয়ের সঙ্গে পাঠকের হৃদয়াবেগের ফলে সহজে ঘনিষ্টতা তৈরি হয়। উপরস্তরে ধর্মের প্রলেপ লাগানো থাকলেও ‘বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস, ভবভূতির উত্তররামচরিত, এবং বাল্মীকির রামায়ন—এই তিন গ্রন্থেরই বিষয় ক্ষমতা তথা রামরাজত্ব।’ বঙ্কিম ‘ধর্ম এবং সাহিত্য’ বিষয়ক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘সাহিত্য ধর্ম ছাড়া নহে, কেন না, সাহিত্য সত্যমূলক। যাহা সত্য তাহা ধর্ম। কিন্তু সাহিত্য যে সত্য ও যে ধর্ম, সমস্ত ধর্মের তাহা এক অংশ মাত্র।’ তাই বলে সাহিত্যের মহত্বকে ধর্মের সীমানার মধ্যে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করা হয়নি, বরং সাহিত্যের মহত্বকে ধর্মের সোপানের মধ্যে ঠাঁই দেয়া হয়েছে।
সাহিত্যে ধর্ম ও নৈতিকতার অবস্থান নিয়েও রণজিৎ গুহ মীমাংসা করেছেন, লিখেছেন—‘প্রেম না প্রতারণা’। সাহিত্য থেকে শুরু করে সমাজ সংস্কার পর্যন্ত বহুবিধ জিজ্ঞাসায় পরহিতাকাক্ষী নৈতিকতার সংঘর্ষে ও সমন্বয়ে যে বাদানুবাদের সৃষ্টি হয়, সেখানে ধর্মের একটা অবস্থান থেকে যায়। মধ্যযুগের সাহিত্যে যেভাবে ধর্ম ছিল, এবং আধুনিককালে এসেও ধর্মের নৈতিকতা রসাগ্রহীর কাছে আরো তৃপ্তিকর হয়ে উঠেছে। ১৮৬০ সালে বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’ প্রকাশের পরপরই গ্রন্থটি খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আধুনিক কবিতা নিয়েও রণজিৎ গুহের আগ্রহ ছিল প্রবল। চল্লিশের অন্যতম প্রধান কবি, অনুবাদক ও ফ্রন্টিয়ারের সম্পাদক সমর সেন রণজিৎ গুহ ও তাঁর স্ত্রী মেখটিল্ডকে বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য চিঠি লিখেছেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত গ্রন্থে তার সত্তরটির মতো ছাপা হয়। চিঠিগুলো বিশ্লেষণ করলে এই দুই মহান সাহিত্যিকের সময়, কাজের পরিধি ও চিন্তার ধরন অনেকখানি উপলব্ধি করা যায়। এখানে দু-একটি উদাহরণ দেয়া যায়: ৭ নং চিঠিতে সমর সেন লিখছেন, ‘আপনার প্রবন্ধটি আমার অত্যন্ত ভালো লেগেছে।... ছাপাখানা থেকে গত বছরের মধ্যে দুটন সীসে [যা দাম ১৭০০০ টাকা] চুরি হওয়াতে ওরা তাড়াতাড়ি কাজ করতে অপারগ।... আপনার লেখাটি অত্যন্ত টপিক্যাল; প্রলোভন হচ্ছে ২রা জানুয়ারি ও ৯ই জানুয়ারি দুটো সংখ্যায় বের করি।’ ১২ নম্বর চিঠিতে লিখছেন, ‘আপনি যদি কোলকাতায় থাকেন, হয়তো বৃদ্ধিজীবীদের বিষয়ে চিন্তা ছেড়ে দেবেন, কেননা সংকটের সময়ে প্রয়োজনীয় শুভবুদ্ধি নিয়ে আলোচনা করা শ্মশানে বাঁশির মতো।’ ১৮ নম্বর চিঠিতে লিখছেন—‘কাল সুমন্ত ব্যানার্জী বলল [বাংলাদেশে কয়েকদিন কাটিয়ে এসেছে] মুক্তি বাহিনীর উপদ্রব এখনো চলছে। যেসব মেয়েরা গর্ভিনী একটা ক্লিনিকে তাদের বেশির ভাগ চারমাসের পোয়াতি—অর্থাৎ বাংলাদেশ হবার পর।’ রণজিৎ গুহের চেতনায় সাহিত্যসৃষ্টি ও সাহিত্য-জিজ্ঞাসা যে একই ভাবনাসূত্রে ঘনিষ্টভাবে সম্পৃক্ত লেখক ও পাঠকের মনে তা বলাই বাহুল্য। এ কথা বললে দোষের হবে না যে, রণজিৎ গুহ কমিউনিজমের চেয়ে সাহিত্য ও স্বাদেশিকতার মধ্য দিয়ে বঙ্কিমের সাম্যতত্ত্বের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছিলেন। বঙ্কিম-সাহিত্যের ভেতর দিয়ে ইতিহাস দেখেছিলেন। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন রাজনীতির চেয়ে সাহিত্যে তাঁর মুক্তি। স্বাদেশিকতা থেকেও রাজনীতি তাঁর কাছে বড় কথা হয়ে ছিল। রবীন্দ্রনাথের মধ্য থেকে বঙ্কিমের প্রভাব এবং তার থেকে রাজনীতিতে আসা। তাঁর ভাষ্যে—‘আমি আসলে বঙ্কিমী প্রভাব রবীন্দ্রনাথের মধ্য থেকে পেয়ে কমিউনিস্ট হয়েছিলাম।’—এ এক আশ্চর্য কথা বটে। তাঁর কাছে লেখকে পাঠকে, পাঠকে-লেখকে যে ভাবের বিনিময় হয় তার মূল্য অনেক। তাঁর কালের, এমনকি পরবর্তী সময়ের কবিদের প্রতিও তিনি ছিলেন সমান আগ্রহী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ ও উৎপল বসুকে নিয়ে তিনি বিস্তৃত লিখেছেন। তিনি এই বইয়ের নাম দিয়েছেন, ‘তিন আমির কথা’। নানা পরিবর্তনের মাঝে তরুণ সাহিত্যিকগণ যেভাবে তাদের কালের চিত্তবিত্ত ও সমকালীন সময়কে নিজেদের করে আঁকেন, তার মধ্য দিয়ে সময়ের চরিত্র ধরা পড়ে। আর তা হয়ে ওঠে কালের ইতিহাস গবেষণারও অন্যতম উপাদান।
বিশ শতকের শুরুর দিকে তাঁর মতো অরেকজন বাঙালির দেখা পাই আমরা; তাঁর নাম নীরদচন্দ্র চৌধুরী, তিনিও দীর্ঘজীবন পেয়েছিলেন—ব্রিটিশ ঔপনিবেশের প্রতি তাঁর ছিল মোহ-মুগ্ধতা, ব্রিটিশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছিলেন তিনি, জীবনের শেষ প্রান্তে প্রধানত বাংলায় লিখেও একইভাবে মধ্য ও উচ্চবিত্তের হিন্দু বাঙালির মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন নীরদ সি.। অবশ্য রণজিৎ গুহের সঙ্গে তাঁর মিল দুর্লক্ষ্য হলেও চট করে নামটি নানা কারণে মাথায় চলে আসে। বয়সের হিসাবে দুজনই দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন। ঔপনিবেশিত নাগরিক হয়েও ইংরেজির কাছে তাদের লেখ্য ইংরেজি মান্যতা পেয়েছিল। একজন অক্সফোর্ডে আর একজন কিছুদিন সাসেক্সে শিক্ষকতা করেছিলেন। ইতিহাস চেতনার ভেতর দিয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা চালিয়ে গেছেন তাঁরা; প্রধানত ইংরেজি লেখার দ্বারা প্রশংসিত হলেও জীবনের শেষপ্রান্তে বাংলা লিখে সর্বাধিক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন উভয়। এমনকি শেষের দুই দশক রণজিৎ গুহ ইংরেজি লেখা ছেড়েই দিয়েছিলেন। বলতেন, ইংরেজি লেখা সময়ের অপচয়। তবে এই স্থূল মিলটুকু বাদ দিলে অমিলের ফিরিস্তি কম নয়। শ্রীমান নীরদচন্দ্র শাদা-চামড়ার প্রতি মোহবিষ্ট ছিলেন চিরকাল। ব্রিটিশ শাসনের পরিপ্রেক্ষিত, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অভিজাত-তন্ত্র তাঁর আলোচনার বিষয়চ্যুত হয়নি কখনো। আরেকজন ব্রিটিশ শাসনের ঘোর সমালোচক হলেও শাসক ও শাসিতের ইতিহাস এবং ভাষা নির্মাণের পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে কথা বলেছেন বেশি। তবে এই দুই প্রবীণ বাঙালির আপাত মনোগঠন এবং কাজের ধরনে পার্থক্য মনে হলেও পরিণামে অবচেতন মনঃস্তত্বে পার্থক্য খুব বেশি ছিল বলে মনে হয় না। নীরদচন্দ্রের মতো বঙ্কিমের প্রতি রণজিৎ গুহের পক্ষপাত ছিল প্রবল। রণজিৎ গুহের বাংলা রচনার একটি বড় অংশ দখল করে আছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি আধুনিক সাহিত্যের নন্দনতত্ত্ব বিচারে ইউরোপীয় তাত্ত্বিকদের পাশে ভবভূতিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন দৃঢতার সাথে। যেমন, তাঁর উল্লেখযোগ্য বাদ-বিবাদের মধ্যে রয়েছে, ‘উত্তরচরিত: ভবভূতির কূটজিজ্ঞাসা ও বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যতত্ত্ব’, ‘উপন্যাসের নাটকীয়তা: বিষবৃক্ষ’, ‘ইন্দিরা: বিষাদগাথার আনন্দের সুর’, ‘নাটকীয়তা আর ঐতিহাসিকতা: সীতারাম’, ‘নাটকীয়তা আর ঐতিহাসিকতা: রাজসিংহ।’ অপরাপর লেখার অংশবিশেষ বাদ দিলেও ‘প্রেম না প্রতারণা’ বইটি তিনি মূলত বঙ্কিম সাহিত্যের বিচার নিয়েই সম্পন্ন করেছেন। তবে সেরা বাঙালি হিসাবে বিদ্যাসাগরের গুরুত্ব নীরদ সি. বাদ দিলেও রণজিৎ সাহিত্যিক বিদ্যাসাগরের আলোচনায় সরব ছিলেন। তাঁর দাবি অনুসারে বিদ্যাসাগর এবং বঙ্কিম তার বাংলা ভাষার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। একই সঙ্গে নৈতিকতার শিক্ষাটি তিনি নিয়েছিলেন সাহিত্যের কাছ থেকে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে তিনি খুঁজেছিলেন মুক্তি। কিন্তু উভয়ের রচনায় ‘নজরুল’ সাহিত্যের অনুপস্থিতি ধরা পড়ে, যেটি বিশেষ করে রণজিতের সাহিত্য ও ইতিহাস চেতনার অনুগামী নয়। তিনি যখন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত তখনো নজরুল পুরো স্থবির হয়ে যায়নি। তখনো নজরুলের বন্ধু মুজফ্ফর আহমেদ পার্টির সবচেয়ে সম্মানিত ও প্রভাবশালী নেতা। কবি গোলাম কুদ্দুসও ছিলেন রণজিৎ গুহের বন্ধু, পেশাদার কমিউনিস্ট হয়েও সাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত ছিলেন। শ্রীমান গুহ বলছেন—‘সে নদীয়ার কোন এক গ্রাম থেকে গরুর পাল নিয়ে বিক্রি করতে যেতো।’ অবশ্য সাহিত্য সমালোচনা ও সৃষ্টির ক্ষেত্রে রুচি ও প্রবণতা গুরুত্বপূর্ণ, কি করেননি সে আলোচনা অবান্তর। যেমন পার্টি সদস্য হিসাবে সাহিত্যিক ঐতিহাসিক গোপাল হালদারকে মোটেও পছন্দ করতেন না।
রণজিৎ গুহ-র মতে, ‘মানুষ সত্তাময় জীব। এই সত্তাময়তার প্রকাশই মানুষী চৈতন্য, সেই চৈতন্যের উচ্চারণ ভাষা-ভাবনায় বিধৃত হয়। সত্তা, চৈতন্য ও ভাষা-ভাবনার ত্রিভুজে প্রকাশিত ইতিহাসবিদ্যার রূপানুসন্ধান প্রসারিত হল মানবিক অভিজ্ঞতার ভিন্ন অবয়বে, নিছক কার্য-কারণ অন্বিত যুক্তিবোধ থেকে রসগ্রাহী সাহিত্য-আলাপে।... কোনও এক অতীতকালের অভিজ্ঞতাকে বর্তমানের বোধিতে ধরা, কোনও এক গোষ্ঠীর প্রাত্যহিক খণ্ড অভ্যাসের বৈশিষ্ট্য থেকে বৃহত্তর কোনও এক সমূহের অভিজ্ঞানে উত্তরিত হওয়া হল ইতিহাসবিদ্যার ঈপ্সা। ইতিহাসবিদের চিন্তনে জাত যুক্তির বিন্যাসে ও লেখনী নিঃসৃত ভাষাসজ্জায় যাচাই করা তথ্যাবলি আকাঙ্ক্ষিত আখ্যানের আকার নেয়। সদৃশার্থে নিজস্ব ঐকান্তিক অভিজ্ঞতাও অনুভূতি-সচেতন কবি-সাহিত্যিক শব্দের ব্যঞ্জনায় ভাসিত ও প্রসারিত করে নানা দেশে ও কালে নিজের রচনাকে ভিন্ন ভিন্ন সহৃদয়ের হৃদয় সংবাদী করে তোলে।’
প্রকৃতপক্ষে নিম্নবর্গের ইতিহাসের এই হোতা সাহিত্যের সঙ্গে নিবিষ্ট হতে চেয়েছিলেন মূলত মানুষের সত্তাময় সজীব-সংস্থানের সঙ্গে আরো গভীরভাবে নিজেকে যুক্ত থাকার মানসে। সাহিত্যের মধ্যেই ধরা থাকে ইতিহাসের মানুষের সজীব উপস্থিতি। তাই রণজিৎ গুহের ইতিহাস, ভাষা ও অর্থনীতি চর্চায় সারাজীবন সাহিত্য জয়ী থেকেছে।

অত্যন্ত পরিশ্রমী ও সত্যনিষ্ঠ লেখা। অনেক সমৃদ্ধ হলাম
গার্গী সেনগুপ্ত
জুন ০১, ২০২৩ ০১:২৪

"শান্তি রক্ষার পেছনে কম ব্যয় করা; কারণ সেনাবাহিনী দিয়ে শান্তি রক্ষা করতে গেলে খরচ একটু বেশিই পড়ে।" ইংরেজ শাসনকালে একই সাথে বিচার ব্যবস্থা সক্রিয় রেখে এবং ভারতবাসীকে দারিদ্র্যে রেখে দেশ শাসনের এক কারণ দেখিয়েছেন রণজিৎ গুহ।l আর নীরদ সি চৌধুরী আর রণজিৎ গুহের লেখক জীবন নিয়ে লেখকের আলোচনা খুব প্রাসঙ্গিক হয়েছে। নয় নয় করেও প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদ রণজিৎ গুহের সামগ্রিক একটা ছবি তুলে ধরতে পেরেছেন। সুপাঠ্য এবং তথ্যসমৃদ্ধ। কিন্তু বানান সম্পর্কে সম্পাদক আর একটু সতর্ক থাকতে পারতেন।
রতন কুমার ঘোষ
জুন ০১, ২০২৩ ০১:৩৫

খুবই তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। লেখক কবি মজিদ মাহমুদ-এর জন্য অনেক অনেক শুভকামনা। প্রকাশককেও এমন একটি লেখা পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।
শামসুজ্জামান প্রিন্স
জুন ০১, ২০২৩ ১০:২৯

সুন্দর ও দীর্ঘ লেখা। এমন লেখার জন্য লেখকের সম্মানী প্রাপ্য।
নোমান প্রধান
জুন ০৩, ২০২৩ ১০:৫৬
আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে
বাকী বিল্লাহ
জুন ০১, ২০২৩ ০০:৩২