গম্ভীর ধূসর রঙে

অ+ অ-

 

খুব সহজে, অনায়াসে, স্বতঃস্ফূর্ততায় নাজমা বেগম কথাটি বলেছিল। সে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি এটা নিয়ে পরিবারে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যেতে পারে। তাদের মিরপুর দশ নাম্বারের ফ্ল্যাটটায় তেরশ স্কয়ার ফিটের মধ্যে কয়টি রুম, কয়টি বারান্দা, কয়টি বাথরুম হবে সেই আলোচনাই হচ্ছিল বিকেলের নাস্তার টেবিলে। প্রায় বিকেলেই যেমন কথা হয়, এটা-ওটা নিয়ে। সেদিনের বিকেলটাও ছিল অন্যদিনের মতই। নাজমা বেগমের ছেলেমেয়ে দুটিই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। একটা ছোট্ট বিষয় নিয়ে যে তার ছেলেমেয়েরা এত উঁচু গলায় কথা বলতে পারে এটা নাজমা বেগমকে বিস্মিত করেছিল সেদিন। কেউ যেন পাথর দিয়ে দড়াম করে মেরেছিল মাথার ভিতর! ভিতরে তখনই একটা জ্বলন হয়েছিল।

এই সেদিনও তার ছেলেমেয়েরা তার আঁচল ধরে টানাটানি করত। এক সময় নাজমা বেগম একটি প্রজেক্টে কিছুদিন চাকরিও করেছিল। ছেলেমেয়েদের নিরাপদভাবে স্কুলে আনা নেওয়া করার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য শেষমেষ চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। তবে দীর্ঘ জীবনে এই নিয়ে তার কোন আক্ষেপ ছিলনা। বরং চাকরি ছাড়ার পর তার মনে হয়েছে, ভালই হয়েছে। প্রজেক্টের চাকরি আর সংসার দুটো একা হাতে সামলাতে তাকে ভয়ঙ্কর জটিল টানাপোড়েনের মধ্যে পড়তে হত। যাই হোক সেদিন খুব স্বাভাবিক ভাবেই চা এর সাথে দুটো টোষ্ট বিস্কুট খেতে খেতে নাজমা বেগম বলছিল, একটা বাথরুম আর বারান্দা বাদ দিলে আমারও একটা নিজস্ব রুম হতে পারে। ফ্ল্যাটে চারটি বাথরুমের দরকার নেই। এখন আমাদের বয়স হয়েছে। আর বাঁচবই কদিন! নিজের মত করে একটু থাকার ইচ্ছে হয়। আমার জন্যও একটা রুম করে দাও। হাল্কা রঙ দেব দেয়ালে!

ছেলে একেবারে আকাশ থেকে পড়ল এ কথায়। কী বলছ আম্মু! তোমার আর আব্বুর আলাদা বেডরুম! এমন কোথাও দেখেছ! লোকজন জানলে কী বলবে! তোমার হঠাৎ এমন মনে হল কেন?

নাজমা বেগম কিছু না বলতেই আনোয়ার সাহেব (নাজমা বেগমের স্বামী) বলে উঠলেন, বুড়া কালে ভীমরতি কারে কয়! বেডরুম তো একটাই হয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে থাকে। আরে তোর আম্মা মনে হয় পাগল হইয়া গেছে! কী কও তুমি যা তা কথা! দুদিন পর ছেলেমেয়ের বিয়া দিমু। আমাগো আলাদা বেডরুম শুনলে মাইয়ারে বিয়া-সাদী দিতে পারবা!

এবার মেয়ে মুখ খুলল, আম্মু তোমার সমস্যা কী কওতো! কী সুন্দর একটা টপিকস নিয়ে কথা বলতে লাগলাম! তুমি এর মধ্যে কী কও না কও! আমি ভাবছি আমার রুমটা হাল্কা গোলাপি রঙের করব। ছোটবেলায় খুব সখ ছিল গোলাপি রঙের একটা ঘর। আর ভাইয়ারটা হবে হাল্কা হলদেসবুজ।

নাজমা বেগম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অপলক চেয়ে থাকে সবার দিকে! পঁয়তাল্লিশ বছরে এসে সে যেন এক ঝলক দেখে নেয় তার পুরো জীবনটাকে। মধ্যবয়সের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে যেন হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করে এক অন্য সত্তায়। পুরো পরিবারের দিকে তাকিয়ে একটা গভীর অভিমান তাকে অনিবার্যভাবে স্তদ্ধ করে দেয়। সে কিছুই বলে না। নিরবে চা খেতে থাকে। গোলাপি আর সবুজ রঙের সাথে ভেসে ওঠে অনেক কিছু না পাওয়ার গম্ভীর ধূসর রঙ। ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ে, এদের ভবিষ্যৎ চিন্তায় সে ছেড়েছিল তার ভাল বেতনের নিশ্চিত চাকরি! সারাজীবন একবারও সে ভাবেনি কী পাইনি! তার নিজের ভিতর থেকে উৎসারিত ভালবাসার গভীর আনন্দের মধ্যে সে দেখেছিল সংসারকে! সবই কী ঘোরের মধ্যে ঘটে গেছে!

 

দুদিন পর থেকেই নাজমা বেগমের মনে হতে থাকে তার স্বামী আনোয়ার সাহেব যেন তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছেন। কোন ভাবেই পূর্ণদৃষ্টি নিয়ে নাজমা বেগমকে দেখছেন না। চোখে চোখে তাকাতে গেলেই চোখ নামিয়ে নিচ্ছেন। নাজমা বেগমকে ভাবনাটা ভিতরে ভিতরে অস্থির করে রাখে। তিনি ভাবতে থাকেন শেষ কবে আনোয়ার সাহেব পূর্ণদৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকিয়েছিলেন। আদৌ তাকিয়ে ছিলেন কী? কখনও! কোনদিন! সব ঝাপসা মনে হয়। তাদের বিয়ে হয়েছিল পারিবারিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। প্রেমের তোলপাড় আর উথালপাতাল ঘূর্ণি! না নাজমা বেগম এসব টেরই পায়নি। প্রেমের একরকমের বোবা অনুভব পেয়েছিল নভেল পড়ে আর সিনেমা দেখে। রাজ্জাক-ববিতার ছবি অনন্ত প্রেম, দস্যু বনহুরের গল্প, অমিতাভ-রেখার সিলসিলা। নাজমা বেগমের ভিতরে লুকিয়ে থাকা প্রেম ছিল তখন ঘরের দেয়ালে টাঙানো অমিতাভের ছবিতে অথবা রাজ্জাক-ববিতার ভিউকার্ডে। সেসব ভিউকার্ডগুলো পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে লুকানো থাকত। মাঝে মাঝে বিষণ্ন সময়ে একটা অদৃশ্য ভাল লাগার বোধ তৈরি হত।

কোনো আকস্মিক তোলপাড়ের দিকে নিয়ে যাবার আগেই পারিবারিক সিদ্ধান্তে ত্রিশ বছরের আনোয়ারের সাথে বিশ বছরের নাজমা বেগমের বিয়ে হয়ে যায়। কোন এক কাঙ্ক্ষিত পুরুষের জন্য মনের গভীরে পড়ে থাকা  প্রেমের তীব্র উন্মাদনা চাপা পরে যায়। তবু বিবাহিত জীবনের প্রথম দিকে শারীরিক মিলনের মুহূর্তে নাজমা বেগম নিজেকে ফ্যান্টাসিতে ভাসিয়ে রাখতেন। তার মনে হত রূপবান সেই সব পুরুষের সঙ্গেই তিনি মিলিত হচ্ছেন যাদের তিনি বিভিন্ন গল্পে ও সিনেমার মধ্যে দিয়ে অন্ধ আসক্তি নিয়ে অনুভব করেছেন। বিবাহিত জীবনের প্রথম দিনগুলিতে সংসার, বাচ্চা সামলানো আর পাশাপাশি পড়াশোনাটা চালিয়ে যাওয়াটা ছিল একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। অস্তিত্বের সংকটে ভিতরের সকল ঘুর্ণিই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। রোমান্টিক আত্মরতিতে ভরে থাকার কোন সুযোগই ছিল না। নারীত্বের দায়িত্ব আর পড়াশোনা চালাতে গিয়ে তার ভিতরের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বলতাগুলো শেষপর্যন্ত হারিয়েই যায়। সে আস্তে আস্তে আয়ত্ত করে তার উপর চাপিয়ে দেয়া আত্মসংযম। বিবাহিত জীবনের প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত সে পায়নি কোন নির্ভার জীবন। পরিবারের সবাইকে খুশি রাখার জন্য সে থামিয়ে দিতে বাধ্য হয় যাবতীয় উড়াল। প্রথম ছেলের পর পরেরটি মেয়ে না হলে হয়তো সে চাকরিটা চালিয়ে নিতে পারত। কিন্তু মেয়ে বাচ্চাটিকে বাসায় কাজের লোকের কাছে একা রেখে আসার ঝুঁকি শেষপর্যন্ত সে নিতে পারেনি। চাকরির বিষয়ে আনোয়ার সাহেবের প্রথম থেকেই ঘোর আপত্তি ছিল।

আজ পঁয়তাল্লিশে পৌঁছে নাজমা বেগম যেন হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার মনে হল জীবনের কিছুটা কী আছে তার হাতে এখনও! জীবন মানে কী!  জীবনকাল! কিছুটা সময়! বেঁচে থাকা! কার জন্য বেঁচে থাকা! সবার জন্য! নিজের জন্য! হাজার হাজার প্রশ্ন মাথার ভিতর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সারাজীবন ধরে এত প্রশ্ন লুকিয়েছিল তার নিজের মধ্যে! এত তীব্র সব গভীর প্রশ্ন জং ধরা বুকের সিন্দুকে?

 

আনোয়ার সাহেব যে সত্যিই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন এ ব্যাপারটি সত্যি সত্যিই স্পষ্ট হয়ে উঠল সেদিন যখন দুপুর বেলায় হঠাৎ না বলে কয়ে কলবেল বাজিয়ে  হাজির হলেন নাজমা বেগমের বড় ননদ। নাজমা বেগমের চেয়ে বয়সে চার পাঁচ বছরের বড়। সে বাসায় পা রেখেই অদ্ভুত মৃদু স্বরে, অনেকটা ফিসফিসানির স্বরে বলতে লাগল, ভাবী ভাইয়াতো ফোন করে করে অস্থির করে ফেলছে আমারে। তাই ভাইয়ার কথামত তোমারে ফোন না করেই আসলাম। ভাইয়া বলল তোমারে মনোরোগের ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। কী বলে উল্টা-পাল্টা কথা বলতেছো তুমি! নতুন ফ্ল্যাটে উঠবা খুশির খবর। এরই মধ্যে তুমি পোলাপাইনের মত আলাদা রুম চাইছ কোন আক্কলে! তুমি কি সত্যিই পাগল হইয়া গেলা! সারাজীবন তোমারে বিশ্বাস কইরা নিজের সব গোপন কথা তোমারে কইলাম। এহন এই বয়সে আইসা কী শুরু করছ তুমি? তোমার সমস্যা কী?

আমি তো কোন সমস্যার কথা বলি নাই সাহানা! বলেছি আমাদের বয়স বাড়ছে। নিজের মত করে একটু অবসরের দরকার। নিজের একটা আলাদা রুম হলে অন্তত এই বয়সে এসেও নিজেকে বুঝার একটু সুযোগ থাকে।

ওহ্! এই বয়সে আইসা প্রেমে পড়লা নাকি! লোকটা কে? আরে প্রেম টেম হইলে আমারে কও। আমিই সব ম্যানেজ কইরা দিমু। আমারতো মোবাইল ফোনে বেশ কয়টা প্রেম হইছে। দু-একটার কথাতো তোমারেও বলছি।

লোক! হা হা হা। প্রেম! পড়লে নিজের প্রেমেই পড়লাম!নাজমা বেগম অসহায় ভাবে হেসে ফেললেন।

না ভাবী এটা হাসির কথা না। ভাইয়াতো বিষয়টা খুব সিরিয়াসলি নিছে। ভাইয়ার ধারণা তোমারে কেউ তাবিজ-তুমার করছে। সে আমারে সিরিয়াসলি বলল, যত তাড়াতাড়ি পারস তোর ভাবীরে নিয়া মনোরোগের ডাক্তারের কাছে যা। তারপর বলল, আরিফরে এখনই কিছু বলিস না। আগে ডাক্তার কী বলে দেখ! রিপোর্ট খারাপ হলে তো সবাই এমনিই জানবে।

নাজমা বেগম পাথর চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে ননদের দিকে। তার মুখে কথা সরে না। তার স্বামী আর ননদের কাছে তাদের নিজের বক্তব্যই শেষ কথা। তাদের ধারণা তারাই ঠিক ভাবছে। কেউ একজন যদি জীবনের মানেটাকে একটু অন্যভাবে বুঝতে চায় সে কী পাগল! উন্মাদ! তাকে যেতে হবে ডাক্তারের কাছে!

এসব ভাবনা নাজমা বেগমকে ক্লান্ত করে। ভিতরটা ছিন্নভিন্ন হতে থাকে। কিন্তু নাজমা বেগম তার ননদকে কিছুই বুঝতে দেয় না। স্বাভাবিক আচরণের মধ্যে দিয়ে ঘুরিয়ে দেয় কথার মোড়। তারপর হাসতে হাসতেই বলে, তোমার ভাইয়ার চিন্তা দেখে আমার হাসি পাচ্ছে। সেদিন বিকেলে চা খেতে খেতে আমি এমনিই বলেছিলাম কথাটা। এসব কথা এখন থাক। তোমারতো দুপুরে ভাত খাওয়া হয়নি। খাবে চল। খেতে খেতে কথা বলব।

 

ইনজাস্টিস শব্দটিকে সেদিন বিকেলে লেকের ধারে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে আরেকবার উপলব্ধি করল নাজমা বেগম। এই বয়সে হাঁটু ব্যথায় আক্রান্ত হওয়া থেকে ভাল থাকার একমাত্র উপায় পার্কে নিয়মিত এক ঘণ্টা হাঁটা। বিকেলের দিকে একটু সময় বের করে রোজই হাঁটার রুটিন মেনে চলার চেষ্টা করে নাজমা বেগম। তার সাথে তার অ্যাপার্টমেন্টে থাকে এমন দু-চারজন মহিলাও হাঁটতে বের হন। কিন্তু তাদের সাথে বেশিক্ষণ কথাচালানো নাজমা বেগমের কাছে বিরক্তিকর। স্বামী-সংসার-শাড়ি আর টিভি সিরিয়ালের বাইরে আর কোন কথা নাই। এক কথা আর কতবার! নাজমা বেগম দেখেছেন তার বাসার কাজের মেয়েটিরও জীবন সর্ম্পকে নানা অভিজ্ঞতা আছে যা একই সাথে চ্যালেঞ্জিং ও জীবনের অনেক রকমের সত্যকে চোখের সামনে নিয়ে আসে। সে সব গল্প নাজমা বেগম শোনেন খুব আগ্রহ ভরে।

ননদ চলে যাবার পর আজও সে হাঁটতে বের হল। মাথাটা যেন ঠিকঠাক কাজ করছে না আজ। একটা সামান্য কথা কতদূর গড়াতে পারে! কথাটি কী সত্যিই সামান্য! আলাদা রুম। আলাদা সত্তা। সমস্ত অস্তিত্বকে খুব কাছ থেকে পাওয়া! আনোয়ার সাহেব কী খুব মানসিক যন্ত্রণায় আছে? তা না হলে বোনকে এতবার ফোন করে জ্বালাতন করে! তাহলে কী এই যে তার একটা আলাদা রুমের আর্তি এটা কী পরিবারের সবার প্রতি ইনজাস্টিস! কিন্তু ওর নিজের ভিতরে বেঁচে থাকা এক অন্য নাজমা বেগম যেন ঠিক সেই মুহূর্তেই নিঃশব্দে সমস্ত অস্তিত্ব নিয়ে যেন কথা বলে উঠতে চায়। সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের তোয়াক্কা না করে তার হাঁটার গতির চলমানতার মধ্যে তার স্বর স্থির হয়ে দাঁড়ায়। ইনজাষ্টিস! তা যদি কোথাও হয়ে থাকে তা শুধু তুমিই তোমার ওপর করেছ! নিজের ভিতরের অন্য স্বরের চমকে দিশেহারা হয়ে উঠে সে। নাজমা বেগম যেন অনেক দিন পর তার মুখের উপর ঝুঁকে থাকা অন্য এক নাজমা বেগমকে আবিষ্কার করতে থাকে। জীবনের এই চলমানতার মধ্যে একজন গতিশীল, অন্যজন স্থির। গতিশীলতার মধ্যে দৈনন্দিনতার চাপে নিজেকে অনেক ফাঁকি দিয়েছেন নাজমা বেগম। আজ বড় সেই সব ফাঁক বিশাল এক অন্ধকারের রূপ ধরে আসে। আজকাল তার ইচ্ছাই করে না সংসারের একই বৃত্তের মধ্যে একইভাবে আবর্তিত হতে। তার ভাল লাগে না প্রতিদিনের একই রান্নাঘর, ধোয়া-মোছা, অতিথি আপ্যায়ন। স্বামীর গায়ের গন্ধও বিরক্তিকর লাগে। অথচ এই শরীরের টানেই এত বছর একসঙ্গে থাকা! যেন জীবন সীমার মধ্যে কোথাও অদ্ভুত কিছু ঘটে গেছে। তার ভাল লাগে শুধূ নিজের সাথে একা, একাকী বিচরণ। তার স্বপ্নের ধূসর রঙের ঘরে তার নিজের মত করে বেঁচে উঠতে ইচ্ছে করে। যেমন জলের তলা থেকে জেগে উঠে কোন বিস্তৃত ভূমি। কেউ যেন হঠাৎ করে তাকে চোখে আঙুল দিয়ে বলে গেছে এই জেগে উঠা আর বেঁচে থাকাই আসলে জীবন। যার অধিকার এ জীবনে পায়নি নাজমা বেগম। সমাজ, পরিবার আর সে নিজেও নিজেকে তার নিজস্ব অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। ইনজাস্টিস সে করেছে নিজেরই ওপর সবচেয়ে বেশি। হাঁটতে হাঁটতে সে হিসেব করতে থাকে পুরো জীবনসীমার মধ্যে তার কতটুকু স্বতঃস্ফূর্ত জীবন ছিল আর কতবার নিজের একটা মৃত শরীরকে সে বয়ে বেরিয়েছে।

দুবছর আগে পার্কে হাঁটতে এসেই তার সাথে পরিচয় হয়েছিল শরীফ সাহেবের। তার স্বামীর বয়সি। হঠাৎ করে স্ত্রী মারা যান রোড অ্যাক্সিডেন্টে। ভদ্রলোক একাই থাকেন। একমাত্র ছেলেটি মনবসু স্কলারশিপ নিয়ে জাপান চলে গেছে, ওখানেই সেটেলড। শরীফ সাহেবের সাথে পরিচয় হবার পর পার্কে হাঁটতে এসে নাজমা বেগম আবিষ্কার করে চারপাশের বাতাসগুলোও সুগন্ধময় আর সবুজ। চারপাশের বাতাস কী এই বয়সেও বুকের মধ্যে প্রেম ঢেলে দিতে পারে! কী জানি! সবই অষ্পষ্ট, এলোমেলো। ওদের দুজনের প্রায়ই দেখা হয়ে যেত। ওরা হাঁটত, মাঝে মাঝে দু-চারটি কথা বলত এইটুকুই। নিজেদের ভিতর থেকে উঠে আসা ডাকে ওরা সাড়া দেয়নি। সে চাইলেই পারত মোবাইল ফোনের মধ্যে দিয়ে এই অদৃশ্য সর্ম্পকের একটা বাস্তব রূপায়ণ। আসলে তার ইচ্ছেই হয়নি। যা এসেছে অর্তকিতে তাকে নীরবে অনুভব করেছে। ভিতরের ঢেউয়ের সাথে এগিয়ে যাবার মত শক্তি বা সাহস নাজমা বেগমের ছিল না। তবু মনটা যেন ভিতরে ভিতরে বদলেই গেল।

 

মিরপুরের ফ্ল্যাটটা অতি দ্রুত উঠে যাচ্ছে। নাজমা বেগম প্রায়ই দেখতে যায়। কখনও ননদকে নিয়ে, কখনও মেয়ে বা ছেলে সঙ্গে থাকে। আনোয়ার সাহেব এখন খুবই উচ্ছসিত। কারণ সেদিনের পর আর কোনদিনই নাজমা বেগম নিজের একটি নিজস্ব ঘরের কথা আর মুখেও আনেননি। এতে আনোয়ার সাহেব তার স্ত্রীকে নিয়ে অনেকটাই নিশ্চিত। তার হিসেবে সবসময়ই দুয়ে দুয়ে চার হতে বাধ্য। কারণ তিনি ওভাবেই ভাবেন। সমস্ত ক্ষমতাবানেরাই এমন করে ভাবে। তাদের ক্ষমতার নীচে কত রকমের অন্ধকার গহ্বর পড়ে থাকে! সেখান থেকে তীব্র হাহাকারগুলো কখনও আনোয়ার সাহেবদের স্বস্তিকর জীবনে প্রবেশ করে না। নাজমা বেগম ছেলেমেয়ের ঘরের রঙ সবুজ আর গোলাপী করার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন। তবু একটা অদৃশ্য প্রশ্ন ঘরের দরজায় এলেই তাকে ঘিরে ধরে। কারণ সে তার সীমাটুকুর মধ্যেই নিজস্ব একটা মুক্তি চেয়েছিল। এই চাওয়ার মধ্যে ছিল তার জীবনের এক গভীর আর্তি। যা এখন স্তব্ধ হয়ে গেছে। সে জেনে গেছে দড়িবাঁধা ক্রীতদাসের মত যে জীবন সে যাপন করতে বাধ্য হয়েছে এটা তার প্রকৃত জীবন নয়।

নতুন ফ্ল্যাটটিকে ঘিরে পরিবারের সবার আনন্দ নাজমা বেগম প্রাণ ভরে দেখে। নতুন নতুন জিনিসে ঘরগুলো সাজতে থাকে। ছেলেমেয়েরা খুশি। কিছুটা সময় অনিবার্যভাবে দৌড়ের উপর দিয়ে পার হয়। এটা-সেটা কেনা, নতুন পর্দা লাগানো, কিচেনের যাবতীয় কেবিনেটগুলো ঠিকঠাক ভাবে সেটিং করা, ড্রইং রুমটাকে নতুন ভাবে সাজানো এসবের পিছনে খুব দ্রুতই সময়গুলো পার হয়ে যায়। এইসব নানা রঙের দিনের পর নাজমা বেগম লম্বা দৌড়ের জীবন পেরিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে লম্বা নিঃশ্বাস নিতে চায়। হয়তো তখন তার পাশেই শুয়ে থাকে তার স্বামী বা সন্তান। কিন্তু তার নিজেকে উড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করে তার স্বপ্নের সেই একান্ত নিজের ঘরে। সে ঘর বাস্তবে সে কোনদিন হয়ত পাবে না। সমস্ত আত্মমর্যাদা, প্রেম, তাচ্ছিল্য. নিজেকে লুটিয়ে দেয়া সব অনুভব মিলেমিশে গভীর ধূসর রঙের সেই ঘর অপ্রতিরোধ্য ভাবে হানা দেয়। বাইরের পৃথিবীর ঘূর্ণিকে সে ঘরে ঢুকতে দিতে চায় না নাজমা বেগম। সব প্রতিকূলতার মাঝে এক কঠিন সংকল্পের মত স্বপ্নের সেই ঘরে নিজেকে নিজের কাছে বাঁচিয়ে রাখার অবিরাম চেষ্টা করে যায় পঁয়তাল্লিশ বছরে এসে।