ছায়াল

অ+ অ-

 

সকাল থেকে বাড়ির সবাই একটা অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কখন কি হয় কেউ জানে না। নানু মারা গেছে সপ্তাহখানেক হলো। এই সময়টাতে মা, নানাসহ আমরা সবাই নানুকে হারানোর শোকে বিহ্বল। এই অবস্থায় নতুন কোনো ভাঙনকে প্রতিহত করার মানসিক বা শারীরিক সক্ষমতা আমাদের কারোরই নেই।

নাস্তা শেষ করে নানা বাজারে যাবার পর আম্মা ঘরের বারান্দা থেকে উঠোন পর্যন্ত বারবার পায়চারি করছে। দুপুরে কি রান্না হবে এ নিয়ে প্রতিদিন নানা ভাবনা থাকলেও আজ মায়ের মনোযোগ উঠোনের একপাশের জায়গাটা জুড়ে। সেই জায়গায় দা, কুড়াল, করাত হাতে অনেকেই একত্রিত হয়েছে। তারা সকলেই জোয়ান পুরুষ। বুদ্ধিতে, শক্তিতে সামর্থ্যবান।

আমি অবাক দৃষ্টিতে ঘরের জানালার গ্রিল ধরে তাকিয়ে থাকি সেই জায়গার দিকে। ভাবিকেন আজ এতগুলো লোক এসেছে, কি করবে এই জায়গায়। আশেপাশের ঘরের দু-একজনও আমারি মতো কৌতূহলী হয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফিরে যায় অন্য কাজে। গাছ-গাছালিতে ভরা জায়গাটিতে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ে যায়, কুতকুত, ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার দিনগুলোর কথা! সেই আলো ঝলমলে রূপালি দিন! যখন এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে বেড়াতাম! মধ্যদুপুরে পুকুরে সাঁতার কাটা আর চালতা, কাঁঠালের মোচায় মাখানো ভর্তায়, সময়টা হতো টকটক, ঝালঝাল! গ্রীষ্মের রোদমাখা দুপুরে উঠোনে ধান রেখে, পুকুরের ঘাটে গাছের ছায়ায় বসে গামলায় করে সেই চালতা আর কলার মোঁচা মাখানো খেতে খেতে সঙ্গীদের কেউ একজন হঠাৎ সেই গামলা নিয়ে দৌড়! পিছনে ছুটতাম তখন অন্য সকলে। এক এক করে ছুটি তো ছুটি! কিন্তু গামলা যে নিলো, তাকে আর কে পায়! পেলেও টকঝাল মাখানো সেই চালতা তো আর নেই! সবার অগোচরে তা ফুরিয়ে যায়! যেমন করে ফুরিয়েছে জোলাভাতি খেলার সকল আয়োজন। একটু বড় হয়ে বুঝেছি, সবার তরে আমরা সবাই এই অমূলক কথাটিরও প্রয়োজন হয়তো ফুরিয়ে গেছে। কেননা সময়ের দোলাচলে দুলতে দুলতে এক সময় টের পেলাম আগের সেসব সঙ্গী আজ আর নেই কোনো আয়োজনে। মায়েরও নিশ্চয়ই এমনটাই হয়েছে। জীবনের শুরু থেকে এই পর্যন্ত এতোটুকু সময়ের মধ্যেই এই বাড়ি থেকে কতজনকে বিদায় দিয়েছে সে। আর সেই শূন্য থেকেই তৈরি হয়েছে কত উটকো ঝামেলা। কেউ কেউ সেই শূন্যতার সুযোগেই নিজের উপস্থিতিকে জানান দিতে চায় তার সর্বস্ব দিয়ে। আর তাইতো, নানু মারা যাবার পর শোকে যখন আমারা সকলে কাতর ঠিক তখনি গ্রামের একদল মানুষ তাদের যা কিছু ছিলো সব নিয়ে হাজির হলো দুর্বলের উপরে আঘাত হানতে। লুটে নিতে আমাদের শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্যের স্মৃতি! মুহূর্তেই মুছে দিতে চায় সব কিছু!

এমন অবস্থা আন্দাজ করতে পেরেও নানা কেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন, এই বিষয়টা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। তাই মাকে ঘরের ভিতর ডেকে খাটের একপাশে মুখোমুখি বসলাম।

কি রে, কেন ডাকছিস?

আচ্ছা মা, তুমিই বলো, এসময় বাড়িতে নানার থাকাটা দরকার ছিল না? আমরা তো আর এ বাড়িতে থাকি না, ওরা কি করবে না করবে আমাদের পক্ষে কি তা বোঝা সম্ভব?

মা আমার কথা শেষ হবার আগেই বলল, আরে, ওরা উল্টাপাল্টা কিছু করতে নিলে ওদেরকে বাধা দিলেও তো হইতো। আর বাধা যদি সে নিজে না দিতো তাইলে অন্তত বলতো কি করতে হবে! না, কথা নাই বার্তা নাই, বাজারে গিয়া বইসা রইছেন।

মা একটু থেমে আবার বলে, শুন আমার মনে হয় আজ বাড়ির বাইরে যাবার অন্য কোনো কারণ আছে।

কি কারণ? বেশ কৌতূহল নিয়েই জানতে চাই।

বাজার থেকে হয়তো থানার দিকে যাবেন। আব্বা নিজের জমি এমনি এমনি ওদেরকে ছাইড়া দিবেন, আমার সেইটা মনে হয় না।

মায়ের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলি, তুমি ঠিকই বলছ, নানাভাই ছেড়ে দেবার মতো লোক না। অন্যায়, উনি মেনে নিবেন না। আর আমাদের পক্ষে যে ওদেরকে প্রতিহত করা সম্ভব না তাও উনি জানেন।

মা তার বিয়ের পর থেকেই শহরে ছিলো। বাবা মারা যাবার পর আমাকে নিয়েই মায়ের সংসার। চাকরি, আমার দেখাশোনা, বাজার করাসহ সংসারের আরও সবদিক সামলে মায়ের হাতে সময়ই থাকত না। চব্বিশ ঘণ্টাকে যদি ৭২ ঘণ্টা করা যেতো, তবে হয়তো মায়ের জন্য ভালোই হতো। এতোকিছুর মধ্যেও সময় বের করে মাঝে মাঝে বাড়িতে আসতো। নানা-নানুর একমাত্র সন্তান আমার মা। কিন্তু বাড়ির সম্পত্তি বিষয়ে মায়ের তেমন কোনো ধারণা নেই। নানা-নানুই সব সামলাতেন। মা যেহেতু অনেকদিন বাড়ির বাইরে ছিলো, সেহেতু সবদিক ভেবে কোনো সঠিক স্বিদ্ধান্তে আসাটা মায়ের জন্য কষ্টকর! আর জনবল না থাকাটাও এই সমাজে এক ধরনের অক্ষমতা। নাকি অক্ষমতাকে মেনে নিয়েই নানা বাজারে গিয়েছেন? এই অক্ষমতা বিষয়টি আমার পনেরো বছরের মাথায় হঠাৎ করে এলেও মাকে এই নিয়ে কিছু বলি না।

কি হবে বা এই মুহূর্তে কি করা উচিত এইসব ভাবতে ভাবতে মা ঘর থেকে আবার উঠোনের দিকে যায়। কিছুক্ষণ উঠোনে দাঁড়িয়ে আমার কাছে ছুটে আসে। কেন নোবেল এবং তার লোকেরা এখানে এসেছে? কি চায় তারা? আর কেনই বা বাড়ি থেকে একটু দূরে পুকুরপাড়ে খালি জায়গাটায় জমা করা হয়েছে ইটের পর ইট?  অনেক প্রশ্ন মনের মাঝে উঁকি দিচ্ছে অথচ এগুলোর সঠিক কোনো উত্তর নেই।

নানা হয়তো বুঝতে পেরেছেন কী ঘটতে চলেছে! তাই তিন-চারদিন আগে আসরের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বাড়ি ফেরার পথে নোবেলের সাথে দেখা হওয়াতে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী রে এতো ইট দিয়া কী করবি?

উত্তরে নোবেল তার পান খাওয়া তেলাপোকা রঙের দাঁতগুলো বের করে নানার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলেছিল, দেখি মামা, কী করন যায়!

নোবেল যেহেতু উত্তরটা কৌশলে এড়িয়ে গেছে, নানাও আর এ নিয়ে কোনো কথা বলেননি শুনেছি। স্ত্রীকে হারিয়ে মানসিক এবং শারীরিকভাবে তিনি সুস্থ নন। গত কয়েকদিনে ব্লাডপ্রেশার ফ্ল্যাকচুয়েটের কারণে কয়েকবার ডাক্তারের কাছেও যেতে হয়েছে তাকে। তাছাড়া নানা ভালোভাবেই চিনেন নোবেলকে। সরকারি দল করে সে। তাই রাজনৈতিক ক্ষমতাও রয়েছে ঢের। এলাকার লোকজন তাকে সামনাসামনি সমীহ করলেও মূলত তারা তাকে ভয় পায়। পিছনে অনেকেই নোবিল্ল্যা বলেই সম্বোধন করে চল্লিশোর্ধ্ব নোবেলকে। নানার কাছে শুনেছি, তার প্রয়োজনে আর ইশারায় অনেক ছেলে, বুড়ো এমনকি প্রশাসনের লোকও নাকি হাজির হয়ে যায়।

নানু বেঁচে থাকাকালীন কথাপ্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন, ভাই, ওগো দিলে কোনো রহম নাইরে। ওগোরে নিয়া গেরামের মইধ্যে নানান কতা অয়! হুনছি, মানুষরে মারতেও নাকি ওগো হাত কাঁপে না।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে বেরিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। দেখি বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলছে আর মা তা বোঝার চেষ্টা করছে। দূর থেকে বলা কথাগুলো এতটাই অস্পষ্ট শোনাচ্ছিল যে মা অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও কিছুই বুঝতে না পেরে হতাশ হয়ে ঘরের সামনে থাকা ইট-সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। আর তার চোখ থেকে একনাগারে ঝরতে থাকে জলের ফোঁটা।

আমি মায়ের এই অস্থিরতা আর চোখের জল দেখে চুপ থাকতে পারলাম না। ঘরের ভিতর ঢুকে নানাকে ফোন করে বললাম, তুমি বাড়িতে আসবা কখন? নোবেল আর তার লোকেরা কখন যে কি করে, বুঝতেছি না তো।

যা ইচ্ছা করুক।

তুমি ওদেরকে কিছু বলবা না?

না রে ভাই। দেখতাছিসই তো আমার শরীর মন কিছুই ভালো না। তার মধ্যে এইসব নিয়া আর কোনো ঝামেলা করতে পারুম না।

এখন যদি না বল, তাইলে আজ খালি জায়গা দখল করবে তারপর তোমার ঘর দখল করবে, আর তুমি চুপ করে থাকবা?

আমি একলা মানুষ কী করতে পারুম? গ্রামের সবাই তো ওগো ভয়ে চুপ কইরা থাকে!

তাইলে পুলিশরে খবর দাও। তুমি না দিলে বল, আমি দেই।

তুই মাইয়া মানুষ, তুই কি করবি? একটু থেমে নানা আবার বলেন, "শুন, তোগো কিছুই করার দরকার নাই। চুপচাপ থাক। আমি সময়মতো চইলা আসুম।

নানার এই সহজভাবে বলা কথা শুনে মা হা করে মুখে হাত দিয়ে কিছু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে রইল। শুধু মা নয়, অবাক আমিও হয়েছি। যে মানুষটাকে গ্রামের সবাই একসময় সমীহ করতো, যার কথা ছাড়া গ্রামের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তই নেওয়া হতো না, সে মানুষটা কি করে এমন নির্বিকার থাকতে পারেন! তাও তারই কেনা জমি দখলের ব্যাপারে। হতাশার স্বরে মা বলে, কি আর করবো তোর নানা, তাদেরকে কারো কিছু বলার সাধ্য আছে? আব্বারতো এখন বয়স হইছে। এলাকা এখন নোবিল্লা আর তার দলবলের গায়ের জোরেই চলে। সেই নোবেল যদি কিছু করতে চায়, তারে থামাবার সাধ্য কার আছে? আর আম্মা মারা যাবার পর দেখতেছিসই তো সবকিছু কেমন যেন বদলায়া গেছে। আপন মানুষরাও বিপদের দিনে পাশে নাই।

মা, আমিতো নানারে বলছিলাম, পুলিশে খবর দিবো কি না? উনি মানা করলেন। উনার জায়গা, উনি যদি কিছু করতে মানা করেন, তাইলে তো আমার কিছু করার থাকে না।

ঠিকই তো বলছে তোর নানা। তুই শহরে থাকিস, গ্রামের কাউরে চিনিস না। একলা মেয়ে মানুষ, তুই কী করবি? ওদেরকে এখন কেউ কিছু বলতে গেলেই ওরা গায়ের জোর দেখাবে। আমাদের কি গায়ের জোর আছে, যে ওদেরকে ঠেকাব? আর থানা পুলিশের কথা বলতেছিস তুইওদের খবর দিয়া কোনো লাভ নাই। ওইগুলা তো সব নোবিল্ল্যার কেনা গোলাম!

মায়ের কথায় আমি চুপ থেকে ভাবি, সত্যিই ওদেরকে প্রতিহত করার কোনো উপায় তো আমার জানা নেই। কিন্তু মা আর নানার এই অসহায়ত্বও আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। ভেবে খারাপ লাগে, বেহাত হতে যাওয়া ওই জায়গাটা জুড়ে মায়ের কত স্মৃতি! বৈশাখ মাসে ঝড় শুরু হলেই মা, আমি, নানু আর আশেপাশের ঘরের খালারাও জেগে যেতো কাঁচা আমের টুপটাপ ঝরে পড়ার শব্দে। আর হুড়মুড় করে ঘুম থেকে উঠে হাতে টর্চ নিয়ে বারান্দায় দাঁড়াতাম ঘরের সবাই মিলে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর পাশাপাশি টর্চের আলোও চমকে উঠত, হাতের আঙুলের আলতো চাপে। তখন দেখতাম উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ছোট-বড় অনেক আম। তার বেশিরভাগই ছিলো যে জায়গার গাছগুলো কাটা হবে করে আজ সবাই একত্রিত হয়েছে সেই জায়গার। শুধু গাছই নয়, হয়তো সেই জায়গাটাই দখল করতে এসেছে আগন্তুক লোকগুলো। সেখানে আম গাছ ছাড়াও আরও বেশ কিছু গাছ রয়েছে। তার কিছু লাগিয়েছিলো বাবা আর কিছু নানু। বলা যায়, তাদের রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্নটুকুও আজকের পর আর থাকবে না।

একটি গাছ কিংবা একখণ্ড ভূমি তা তো কেবল ভূখন্ডই নয় তার সাথে মিশে থাকে বহু মানুষের শৈশব, যৌবন এমনকি কারো কারো জীবনের শেষ পরিণতিও । সেই দিক থেকে ভাবলে বলতে হয়, কেবল মানুষই স্মৃতির ধারক বা বাহক নন। একসাথে বেড়ে ওঠা গাছগুলোও বন্ধু, সহোদর হয়ে পাশে থাকে। তারাও পাশাপাশি চলা সেই বন্ধুদের গত হওয়া দিনের স্মৃতি বহন করে বেড়ায়, বুকের ভেতর, নিরবধি। হয়তো কখনো কখনো মানুষের মতো তাদেরও বুক ভারী হয়ে আসে হারানোর বেদনায়!

এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কানে ভেসে এলো কুড়ালের কোপের শব্দ। মাও ইটের বেঞ্চ থেকে দাঁড়িয়ে যায়। যেন তাকেই কেউ আঘাত করেছে। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকে নোবেল ও তার সাথে আসা লোকগুলোর দিকে। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা সেই চোখ দুটি থেকে জল গড়িয়ে পড়ে মায়ের গাল বেয়ে। আবারো কানে ভেসে আসে একের পর এক অনেক কোপের শব্দ। গাছের ডালপাতাগুলো নড়ে ওঠে। যেন বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে তাদের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হওয়ার আর্তনাদ। মা এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে দ্রুত পায়ে বাগানের দিকে এগিয়ে যায়। আমি মাকে এগিয়ে যেতে দেখে মায়ের হাত ধরে টেনে আনার চেষ্টা করি, তাকে বাধা দিতে চাই। মা তখন এক ঝটকায় আমার হাতটা ছুঁড়ে ফেলে সামনের দিকে যেতে থাকে। আমি থমকে দাঁড়াই। জোরালো কণ্ঠে মা বলে, কি করতেছিস নোবেল? তোরে এই অধিকার কে দিছে?

মায়ের কথায় কেউই চমকে উঠে না। সবাই যার যার কাজ করে যায়। যেন তারা আগে থেকেই জানতো এরকমই কোনো দৃশ্যের সূচনা হবে। সকল পরিস্থিতিকে মাথায় রেখেই হয়তো তাদের এই আয়োজন। নোবেল গাছে কোপ দেয়া থামিয়ে হাঁটু পর্যন্ত উঠানো লুঙ্গিটা আবারো শক্ত করে কোমরে গুঁজে নেয়। গায়ের সাদা গেঞ্জিটা তার ঘামে ভিজে গেছে। কপালে জমে থাকা ঘামটুকু হাতের আঙ্গুল দিয়ে টেনে মাটিতে ফেলে দেয়, তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে রাবারের মতো ঠোঁট দুটিকে টেনে হাসিমুখে বলে, বুবু, নিজেগো খারাপ অবস্থা দেখবার না চাইলে, ঘরে গিয়া চুপচাপ বইসা থাকেন। কাম করতাছি, প্যাঁচাল পাইড়েন না তো!

মা, তার এই সহজভাবে বলা অথচ কঠিন কথা শুনে একটুও অবাক হয় না। বরং চুপ হয়ে যায়। মা জানে, নোবেলের এই সহজ কথার মানে কতটা ভয়ংকর! তাছাড়া, চুপ করা ছাড়া মায়ের আর কীইবা করার আছে! জনবলহীন আমার মা অন্যপক্ষের এতোগুলো মানুষকে একা কীভাবে প্রতিহত করবে? আশেপাশের ঘরের প্রতিবেশীরা যারা আছেন, তারাও সবাই চুপ করে আছেন। যদিও এটাই স্বাভাবিক। নোবেল যেখানে আছে, সেখানে গ্রামের অন্য সকলে নির্বাকই থাকবে। তাইতো সত্যি যত কঠিনই হোক তা মেনে নেয়া ভালো মনে করেই হয়তো মা চুপ হয়ে গেছে।

ঠিক তখন সকালটা হেলে পড়ছে দুপুরের গায়ে। আজ রোদ নেই। কেমন ছায়া ছায়া মায়া মাখানো বিষণ্ন একটি দিন। নানা তখনই বাজার থেকে ফিরছেন। মাকে সেই জায়গার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, কিরে এইখানে দাঁড়ায়া রইছস ক্যান? আয়, ঘরে আয়। বলে নানা ঘরের দিকে চলে গেলেন। নানার সামনেই তার জায়গার গাছগুলো এক এক করে কেটে ফেলছে অথচ, নানা সব দেখেও কিছু না বলেই ঘরে চলে গেলেন। যেন আশেপাশে কিছুই ঘটছে না। কিছুই দেখেননি তিনি। সবকিছু স্বাভাবিক!

নানার দরাজ কণ্ঠের আহবানে মা ঘরে ফিরেনি। তবে সেই জায়গা থেকে ফিরে যায় তখনই। ঘরের সামনে ইটের বেঞ্চিতে বসে নীরবে আবারো কাঁদতে থাকে। আর শাড়ির আঁচল দিয়ে ঝরে যাওয়া অশ্রু বারবার মুছে নেয় অজান্তেই।

আমি মায়ের কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকি। কেউ কোনো কথা বলি না। নানা তখন ঘরের ভিতর তার খাটের পাশে রাখা দুই সিটের পুরনো কাঠের সোফায় দৃষ্টি নত আর মুখ ভার করে বসে থাকেন। যেন ঘরের মেঝের মাঝেই সকল অক্ষমতার, সকলকিছু হারানোর বেদনা লুকাতে চান তিনি। ভালোবাসার মানুষকে হারানোর বেদনা, অনেক যত্নে আগলে রাখা সম্পত্তি, সব, সবকিছু হারানোর বেদনা ঘুচাতে চান। আমি ঘরে গিয়ে নানার কাঁধে হাত রাখতেই স্পর্শ পেয়ে তিনি কেঁদে উঠেন। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যান জানালার কাছে। বলেন, দ্যাখ, তাকাইয়া দ্যাখ, একটা ভূখণ্ড কী কইরা অনাথ হয়! ক্যামন কইরা গায়ের জোরে ভূখণ্ডও চিরতরে হারায় তার প্রিয় মানুষগুলানরে!

আমি নানার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরি। ভাবি, এমনি করেই হয়তো আজ থেকে বহু বহুদিন পর, যখন ফুরিয়ে যাবে নানার শেষ নিঃশ্বাস, তখন হয়তো এসে দেখবো, বাড়িটির অস্তিত্ব জুড়ে খেলা করছে অন্য মানুষেরা! কিংবা বাড়িটির চারধারে ভাট আর শ্যাওড়া ঘিরে আছে। বিছুটি পাতা জড়িয়ে রয়েছে চারপাশ থেকে। দু-একটা বড় কড়ই গাছ, এসব পার হয়ে অন্ধকার দরজার কাছে গেলে দেখা যাবে, ভিতরে গভীর অন্ধকার, ধূলোর ধূসরতা, কিছু চড়ুই পাখি ডেকে উঠবে। কয়েকটা সাদা বক শাঁই শাঁই করে উড়ে গিয়ে বসবে পুকুরের কাছের বাঁশ বাগানের ওপর! বাড়িটি হয়তো পড়ে রইবে একলা!

একটা প্রকাণ্ড ঘর, সেখানে আঁধারের বসবাস, ধুলোটে ফার্ণিচার আর মেঝে, গাছেরা ফিসফিস কথা কয়, হঠাৎ তক্ষক ডেকে ওঠে...।