টিন আর্ট
তালপাতার সেপাই নয়; টিনেরতরবারিও নাই—শুধু রংতুলির আর্টিস্ট ঠিকঠাক মতো সে আরকি! তার ক্যানভাসে অবিরাম ঘটে চলে টিনের কারবার: টিনের আর্টিস্ট, টিনের সেপাই ও টিনের তরবারি—এই তিনে মিলেমিশে ভরপুর, একাকার উদ্ভাস–ক্যানভাস।
টিনের সেপাই যুদ্ধ করে; টিনের তরবারি চমকে চমকে ওঠে, ঝলসিত নৃত্য করে; সেপাই-সেপাইয়ে, তরবারি-তরবারিতে!
কিন্তু টিনের আর্টিস্ট এসব কিছু পারে না—কেবল সে ছবি আঁকতে পারে; তখন টিনে-টিনে টংকার; টিনে-টিনে ঝংকার; টিনে-টিনে হুংকার!
টিন হয় রূপবান, নানা সাইজের। ছোট-বড়-মাঝারি আয়তাকার। রং ছাড়া রূপবতী ইস্পাতিনি টিন নিজগুণে স্বকীয়। এবং দর্পণ। মুখ ও মুখশ্রী হয় উদ্ভাসিত, বিম্বিত: বেঢপ কিংবা কিমাকার কেউ বাদ যায় না; রৌদ্র-স্নানকালে টিনপৃষ্ঠ প্রতিফলিত সূর্য কিরণে বিকিরণশীল।
এইসকল নানাপ্রকার ও আকারের টিনপৃষ্ঠ রোমানা বাহার রঙে, টিন আর্টিস্টের একটি একটি তুলির পরশে—ব্রাশের টানে, রঙের ছিটায়, বিভায়, খেলায় ছবি আঁকা হতে থাকে—চলন্তকে করে স্থির, ঐ ছবি কথা বলে! ছবি রঙিন, বাঙ্ময়। ছবি, নজরকাড়া!
টিন আর্টিস্ট ছবি আঁকে। ছবি আঁকায় তার কারিশমা আছে। এই কথা কেউ কেউ জানে। কারিশমার কথা। টিন আর্টিস্টের ছবির মাজেজা অন্যরকম।
যে, সে ছবি আঁকে
নসীবের রং বেগুনি
তাজমহল, ধবধবে শাদা
অতঃপর তুলির পরশে ধবধবে শাদা তাজমহল, নসীবের বেগুনি রং ও আরও যতপ্রকার আঁকাআঁকি: একটা একটা রং-বেরঙের চিত্র, টিন আর্টিস্টের স্পর্শ লাভে, সগৌরবে বহুরঙা রিকশায়-রিকশায় শোভিত হয়ে রাস্তায়-রাস্তায়, অলিতে-গলিতে সর্বত্র ক্রিং ক্রিং শব্দযোগে গালিগালাজ, কী খিস্তি উচ্চারণে ও সঙ্গীতকর্মে শহরের মধ্যে বিরাজিত, জাজ্বল্যমান-বিদ্যমান।
টিন আর্টিস্টের হাতযশের কথা রিকশার গ্যারেজ, মেকারের দোকানে, বস্তির ঘরে-ঘরে, রিকশাস্ট্যান্ডে সর্বত্র প্রচারিত ও প্রসারিত।
একটি নতুন রিকশা নামাবার আগে রিকশার মালিক; একজন নতুন রিকশাচালক অথবা রিকশা বদলে পুরোনো চালক অপেক্ষা করে, কামনা করে রিকশা আর্ট: নসীবের রং বেগুনি অথবা তাজমহল, ধবধবে শাদা–বড় পয়মন্ত; সন্তান বাঁচবে দুধে-ভাতে, বউ ছেঁড়া শাড়ি পরবে না, টসটস করবে যৌবন–প্যাডেল মারতে-মারতে প্যাসেঞ্জার নিয়ে যেতে-যেতে কণ্ঠে নিঃসৃত হবে সুখের সঙ্গীত, আনন্দের সঙ্গীত, প্যাসেঞ্জার ও পথচারী হবে মোহিত। রিকশাচালক ফুরফুরে হাওয়ায় ভাসতে-ভাসতে কিশোরীকে, সুন্দরী যুবতীকে পৌঁছে দেবে গন্তব্যে! সিনেমা হলের রঙিন তারকাখচিত পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে হাঁ করে তাকিয়ে দেখবে। ছেলের দল খেলবে মাঠে, রিকশা থামিয়ে তালি বাজাবে।
টিন আর্টিস্টের আঁকা নানা ছবি রিকশার পিছনে, দুই চাকার মাঝখানে টাঙিয়ে শহরময় রিকশায় চলতে-চলতে, প্যাসেঞ্জার তুলে পয়সা কামিয়ে আবার পয়সা ওড়াতে-ওড়াতে, ঘুরতে-ঘুরতে, মহাসুখের সমুদ্রে মনের আনন্দে হবে আত্মহারা।
একটা রিকশার পেছনে ছবি আঁকলে—পঞ্চাশ টাকা; অতঃপর পঞ্চাশ টাকা দামের এই টিন আর্টিস্টের কর্ম দেশসেরা না-হলেও রিকশার জগতে সেরা চলমান, সেরা গুণমান, সর্বেসর্বা।
টিন আর্টিস্ট তবে জিন্দাবাদ।
দুই
আরেক কাণ্ড; দোয়া পর্ব। কোনও এক দুষ্মন্তকালে, টেম্পু-বাস-ট্রাক-অটোসড়কে বাণিজ্যিক পরিবহনের চেহারাধারণের পূর্বকালে টিনার্টিস্টের রঙিন রং-তুলির স্পর্শে দোয়া আবশ্যক হলো।
অতঃপর বর্ণিল দোয়া।
দিগ্বিদিক দোয়া।
বাবার দোয়া। মায়ের দোয়া। বাপ-দাদার দোয়া। এমন বিচিত্র সব দোয়া।
দিগ্বিজয়ী দোয়া সব করে কলরব। মুরব্বিদের দোয়ার দান ছোটাছুটি করে, শহরময়; শহর হতে দূরে; দূর হতে শহরে, শহরে।
দোয়ার ওজন অনেক; ফলে একটা বাস হতে দুইটা, দুইটা হতে চারটা; আবার একটা টেম্পো হতে তিনটা, তিনটা হতে ছয়টা—ঠিক এইভাবে শনৈঃ শনৈঃ দোয়াযোগে সুফল। প্রমাণ মিলল হাতেনাতে। বিফলে মূল্য ফেরতের ঘটনা নাই, তাই ফেরতদন্ডি ঠিক করা হয় নাই কখনো।
দোয়া চলে; দোয়া চলিষ্ণু। দোয়া যেন জ্যান্ত। চলমান দোয়া বাসের গায়ে, ট্রাকের শরীরে, টেম্পোর বডিতে। তুলির পরশে খোলতাই দোয়া। দোয়ার গুণে শয়তান হাওয়া।
দোয়ার খারাবি নাই। ফলবান দোয়া। লাভবান দোয়া। উন্নতি দোয়া। দোয়ায় উড্ডীন ভবিষ্যৎ সুন্দর। দোয়ায় সন্তানগণ ফের বাঁচে অন্নে, ধান্যে। স্ত্রীগণ ফুলবনে। কর্তা টেকে মদে-ভাতে। মায়েরা কাঁথায় ফুল তুলিতে, বোনেরা হাসিতে হাসিতে।
পঞ্চশ টাকার আর্টিস্ট; টিনার্টিস্ট টিনে-টিনে বহু বর্ণময় চিত্রমালা আঁকতে-আঁকতে অতঃপর বর্ণচ্ছটায় পরিবহনগাত্রে দোয়া করতে-করতে রেখা ও রঙে পরিণত হয়ে যায়। এবং ট্যাঙ্গন নদীতে বহে জলবতী ধারা; ডানার মতো ব্রিজে জমায়েত মানুষের মনে-শরীরে শান্তির সমীরণ যেমন টিনার্টিস্ট ভাসতে-ভাসতে প্রলয় বাতাসে শান্ত, উড্ডীন। লোকে নাম রেখেছে টিনটিস্ট। এবার টিনটিস্ট, ভাঙাচোরা নিজ দোকানটা সাজিয়ে গুছিয়ে মন খুলে নাম দেয় আর্ট-গ্যালারি।
বাস-ট্রাক-টেম্পো-রিকশাঅলারা বেশ বুক উঁচিয়ে সামনের মোড়টার এবার তবে নাম দেয় আর্ট-গ্যালারির মোড়।
এই যে তবে আর্ট গ্যালারির মোড়। বাস হতে নামবে কয়জন—উঠবে ততজন। টেম্পোতেও তেমনি। ট্রাক এসে শহর ছাড়ার আগে, শহরে ঢোকার পরে আর্ট গ্যালারির ননীদার চায়ের দোকানে পেয়ালায় চুমুক, গরম শিঙাড়া চিবাবে বেশ। একটা রিকশার স্ট্যান্ড জাঁকজমক করে ‘দশটা থাকিবে’ সাইনবোর্ডসহ মোড়ের মধ্যে সগর্বে বিরাজমান। এই রিকশাস্ট্যান্ড শুভ আরম্ভ করে, ফিতা কেটে নয়, হাততালি দিয়ে রিকশা পেইন্টিং-এর বাপ টিনটিস্ট। ঠাস ঠাস করে টিনটিস্টের তালি, সমবেত সকলের তালির শব্দে, করতালির চোটে কান ঝালাপালা। তালি বাজিয়ে দুই হাত ব্যথা, দুই চেটো রক্তজমে লাল, তবু মনে আনন্দ ধরে না।
রাজা এসে একটা সংবাদ করে রাজধানীর খবরের কাগজে পাঠিয়ে দিয়েছিল সেই সময়। রাজা গল্প লেখে, সাংবাদিক নয় তবুও ওর প্রেরিত ও প্রকাশিত সংবাদ বিবরণ লোকজন বেশ খায়। চমকে চমকে যায়। আর্ট গ্যালারির মোড় জমজমাট। রাতের বেলায় অন্ধকার দেখে মিউনিসিপ্যালিটির লোক বাতি লাগিয়ে গেলে উজ্জ্বল এক মৃদু আলোয় ভুবনভরা।
সহসা একটি মোটরসাইকেলের শো-রুম স্থাপিত ও শিরোমণি হয়ে ওঠে। এই শহরে, যেকোনো কন্যার বিবাহসূত্রে অলিখিত অনিবার্য যৌতুক জামাইকে দিতে হয় মোটরসাইকেল। এক কন্যার বিয়ে অর্থ মোটরবাইক আগে-পরে কোনো পাত্রের প্রাপ্তি আর তাতে হয় বিক্রি।
কন্যাগণের দায়গ্রস্ত পিতারা সর্বস্বান্ত হলেও মোটরবাইকের যথাস্থানে নাম্বার ফলক লিখিয়ে নেয় এবং টিনটিস্ট পরম মমতায় পয়মন্ত দুই আঙুলে এহেন আটপৌরে সংখ্যা ও শব্দপুঞ্জ লিখতে-লিখতে সামাজিক দায়িত্বপালনে হাত করে প্রসারিত; কন্যাদের পিতাগণ তদুপরি এমন অংকন-লিখন কর্মে উচ্ছ্বসিত, উপুড়হস্ত।
এবার টিনটিস্ট রণপা ভর করে ঘুরে বেড়ায়। আর্ট গ্যালারিতে।
তিন
টিনটিস্ট সংবাদ সর্বত্র ফলাও প্রচারিত ও আলোড়ন সৃষ্টি রীতিমতো।
একদিন বেলা দ্বিপ্রহর। একটি জাম্বু আকার গাড়ি আর্ট গ্যালারির মোড়ে উপস্থিত। গগলস কাচ-জানালা খোলা হতেই একরাশ ফরাসি বাসনা পৈপৈ করে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। একটা চাঁদপনা মুখ জানালায় ভেসে ওঠে, মুখ নড়ে মৃদু, কী যেন বলে—গাড়িটা শাদা, ধীরে এসে থামে আর্ট গ্যালারিতে।
একটা সুন্দর মতো বান্দর ছেলে গাড়ি হতে পয়লা তিড়িং বিড়িং করে নামে, পেছনে ফরাসি সৌরভমাখা দ্যুতিময় ডানাকাটা পরী, এক নারী।
বারটা বেজে গেছে তখন।
আর্ট গ্যালারির। রিকশা পেইন্টিংয়ে।
মোড়ে এবার জটলা, ক্রমে বাড়ন্ত। দুই চাকা আর চার চাকার জমাট জ্যাম বেতাল।
ফরাসি সৌরভের প্রাণকাড়া গন্ধে টিনটিস্ট বিভোর। ট্যাঙ্গন নদী হতে একটা কুবাতাস বয়ে আসে,—কেউ টের পায়; একটা বুড়া কেবল হাঁচি দিয়ে ওঠে। ওঁর নাকে কেবল একটা আদা-পাদা গন্ধ।
ডানাকাটা পরীটা আর্ট গ্যালারিতে ঘুরে চক্কর খায়; তিড়িং-বিড়িং ছেলেটা টিনটিস্টের সামনে আর টিনটিস্ট ফ্যাল ফ্যাল।
টিনটিস্টের আঁকার পর শুকাতে দেওয়া অথবা শুকানো একগাদা ছবি জড়ো করে রেখে
ডানাকাটা নারীপরীটিনটিস্টের দিকে চোখ রাখল, আর ছেলেটা বলল:
কত দাম?
টিনটিস্ট পঞ্চাশ টাকা+পঞ্চাশ টাকা করতে-করতে চিন্তাকপাটি লেগে নুয়ে পড়ে, ঝুলে থাকে আর একটা ছবির মতো অনেকক্ষণ।
ছেলেটা অদ্ভুত উচ্চারণে বঙ্গভাষায় অনেক কথা বলে তখন টিনটিস্ট দুই কানের যথাযথ ব্যবহার টের পায় যে, সব কথা এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে পলাতক হয় অবিরাম—ফেরারি কথা! তবু রক্ষা, রণপায়ে দাঁড়িয়ে কথামালার দুই চারটা শব্দ, বাক্য মগজের কোষে অবলীলায় বিদ্ধ করে তাকে টাঙিয়ে রাখে, অবিশ্রান্ত।
বিষয়টি হচ্ছে যে, রাজধানীতে এইসব পেইন্টিং প্রদর্শনী হবে! প্রদর্শনী হবে ধানমন্ডিতে! টিনটিস্টকে রাজধানীতে যেতে হবে প্লেনে! টিকিট ফ্রি! তাছাড়া টাকা দেওয়া হবে। পুরস্কার!
টিনটিস্ট এখন এক বড় মস্ত শিল্পী!
যে, একজন রূপকথার রাজকন্যা এসেছিল, আধা রাজত্ব দেয়া হবে, রাজকন্যা বধূ সেজে অপেক্ষা করবে, টিনটিস্ট পরে বাজনার তালে তালে প্রবেশ করবে রাজকন্যা ও রূপকথার দেশে।
এখন জানুয়ারি, আসছে পনেরো তারিখ প্রদর্শনী; আর মাত্র দশদিন বাকি–
টিনটিস্টের দিন কাটে স্বপ্নে এবং ঘুমের মধ্যে। রাতে এক আশ্চর্য বায়ুযানে চড়ে বসে আসমান ভেদী অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো অনন্তকাল ওড়ে। সুবাতাস দিকে দিকে। খ্যাপা সময় কাটে।
একদিন সত্যি সত্যি ঠাকুরগাঁও হতে রাজধানীর উদ্দেশে প্লেনে উঠে নার্ভাস টিনটিস্ট প্লেনের আসনে কষে সিটবেল্ট দিয়ে নিজেকে আটকে টানটান, বসে থাকে, ঢাকা হতে নেয়ার জন্য লোক এসে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে চলেছে।
প্লেনটা প্রথমে দৌড়ায় ভোঁ-ভোঁ–, পরে ওড়া শুরু করে; মেঘ ফুঁড়ে ওঠে, বায়ুশূন্য, শব্দশূন্য চলতে থাকে। টিনটিস্টের এবার ডানা গজায়, সিটবেল্ট সুরেলা কণ্ঠের আহ্বান সত্ত্বেও খোলে নাই বটে, তবে এবার, দুইটা ডানায় উড়তে-উড়তে সে মনে ও শরীরে প্লেনের বাইরে মেঘের গায়ে শরীরকে ভাসিয়ে দেয়। চলে, ভাসে এবং ভাসতে থাকে, চলতে থাকে অক্লান্ত। বাতাস কেটে সপ্ত আসমান পাড়ি দিয়ে উড়াল এক টিনটিস্টের।
চারদিকে আকাশ আঁকা; মেঘের দল আঁকা; রৌদ্র আঁকা। এই রং সে কোনো দিন দেখে নাই; এই ছবি সে কোনো দিন দেখে নাই; এই রৌদ্রের রং চুরি করা শেখা হয় নাই।
নিজেকে বাতাসের মধ্যে শূন্য হতে শূন্যতর মনে হয় শেষপর্যন্ত। কান্না, কণ্ঠ ছিঁড়ে নিয়ে যায়; সে পারে না। নিজেকে মনে হয়, রিক্ত খালি হাত। টের পায়, তার দেখার কোনো চোখ নাই; হৃদয়ের মধ্যে রেখাপাত নাই; কঠিনের মধ্যে আকার নাই; কাঠির মধ্যে তুলি নাই; হাতের মধ্যে দুই আঙুল নাই; প্রেমের মধ্যে আগুন নাই; আত্মার মধ্যে খোশবু নাই; ছন্দের মধ্যে তাল, লয় কোনো নাই; দিনের মধ্যে বিকাল নাই; বর্ষার মধ্যে বৃষ্টি নাই; গ্রীষ্মের মধ্যে রৌদ্র নাই; শরতের মধ্যে মেঘ নাই; ফলের মধ্যে বীজ নাই; পোড়ার মধ্যে ছাই, ধোঁয়া নাই; প্রান্তরের মধ্যে শস্য নাই; গাভির বাঁটে দুগ্ধ নাই; স্বদেশের মধ্যে সবুজ নাই; ট্যাঙ্গন নদীতে পানি নাই, মৎস্য নাই; শাড়ির মধ্যে আঁচল নাই; গভীরের মধ্যে কোনো কুঠুরি নাই; পলায়নের জায়গা নাই; স্থানের মধ্যে কাল নাই; সময়ের কোনো ঘড়ি নাই, ঘণ্টা নাই, সূর্য নাই ; মনস্তাপে কোনো ক্রন্দন নাই; ভালোবাসায় শীৎকার নাই; দেহের মধ্যে সাড়া নাই ; ফিরে যাওয়ার তাড়া নাই; ছবির মধ্যে জীবন নাই; বাসর ঘরে বেহুলা নাই। জীবনের মধ্যে ইতিহাস নাই; বাঁচা নাই, মরণ নাই; মরণের পর আবার বেঁচে ওঠা নাই; স্বপ্ন নাই। নাই, নাই এবং নাই; শুধু নাই; শেষপর্যন্ত নাই, অতঃপর নাই: স্বপ্ন, বীজ, ফল, ভবিষ্যতের গান, অনুপান কিছুই নাই। সে, অসীম প্রান্তরে একটা অবয়ব, নিঃসীম শূন্যে এক আলখাল্লা।
তারপর দুম করে অতলান্ত হতে ফিরে, উঠে, ভেসে, জেগে ওঠে একটা আলোকিত মঞ্চে।
অসংখ্য দর্শক সারি-সারি চেয়ারে টানটান উপবিষ্ট। বিশাল হাততালি।
মঞ্চের মধ্যে সমাসীন সে, ফরাসি রাজার দূত আর দেশসেরা চিত্রকর।
রিকশা পেইন্টিং নিয়ে চমৎকার কথার ফুলঝুরি।
আবার করতালি।
ধন্য, ধন্য।
সম্মাননা:ফুলের তোড়া—নগদ টাকা—পুরস্কার পদক প্রদান।
মুহুর্মুহু হাততালি।
ক্যামেরার আলোক ঝলকানি।
বিরতি।
সঙ্গীতমূর্ছনা। একটা কী যেন সুর বাজে। মন্দ্র-কণ্ঠ। স্বর্গে হয়তো এমন সঙ্গীত বাজে; তল-ব্যাস-বেধ, নাড়িনক্ষত্র বিলীন হয়ে যায় সঙ্গীতবাদনে। হৃদয়ে স্রোত তোলে। একটা কম্পন। একটা দিশাহারা। একটা আলোছায়া। একটা অনুরণন।একটা ভীষণরকম উষ্ণতার সিঞ্চন।একটা হাসিখেলা। সুরের মধ্যে বেদম বেসুরো তবু টিনটিস্ট।
সুসজ্জিত টেবিলে রাখা খাদ্যসম্ভার, উপচানো। মদের গেলাস টলমল। হাতে হাতে পানপাত্র। চারপাশে আগ্রহী মানুষ, সে নির্বাক, বিধ্বস্ত, কত কথা, শোনে না সে।
মন চলে যায় আর্ট গ্যালারির মোড়ে, চাখানায়; ননীদার হাসি বড় সুন্দর।
টিনটিস্ট ভাষা আবিষ্কার করতে পারে না। রণপা ব্যতীত নিজকে ক্ষুদ্র এক প্রাণী মনে করে; অতীত, ভবিষ্যতের খোঁজ পায় না। চিৎকার করে বলতে পারে না—আমার ছবি দেখো! এই হচ্ছে আমি। আমি টিনটিস্ট। তোমরা সব ভুয়া। আমার কারিশমা তোমরা কখনো জানবে না। তোমরা মূর্খ। তোমাদের আমি দয়া করি। আমি টিনটিস্ট।
কোনো ইন্দ্রজাল হয় না; সে, স্রোতের বিপরীতে নিজেকে সাঁতরাতে পারে না; পরাজিত হয়, সৌরভের কাছে, পুনর্বার।
ফরাসি সুরভিত হাসিন লাড়কি, ঐ ডানাকাটা পরী, সূক্ষ্ম পায়ে হেঁটে, পানপাত্র হাতে এসে, সুমধুর হাসি মেখে, অপার মুগ্ধ চোখে, স্তনাগ্র ব্যগ্র করে, অমোঘ লাস্যে, দেহবল্লরী ছড়িয়ে, বক্রভাবে বাস্তবতাকে চৌচির বানিয়ে নয়ন সম্মুখে স্থির। এই নারী পরাবাস্তব সৌন্দর্যে কামনার শরীরে একটা অঙ্গুরী পরিয়ে দিল।
নারীটির টকটকে ওষ্ঠ গেলাসের কানায় অস্পষ্টভাবে স্থাপিত হলো।
পানপাত্র হতে অনন্ত তৃষ্ণায় অমৃতটুকু চুমুক দিল। লাল টুকটুকে একফালি ফণার মতো জিহ্বা উঁকি দিয়ে বুকের মধ্যে ছবি আঁকল। বেজে ওঠে তন্ত্রীতে রাগ-রাগিণী। নারীটির অপার্থিব মৃসণ ত্বক, সোনালি অদৃশ্য রোম সত্ত্বেও ছবি আঁকার, তার জন্য, টিনের ক্যানভাসের মতো উজ্জ্বল, দেদীপ্যমান; অজস্র বাতির নিচে বিকিরণশীল! একটা তাপ, কবোষ্ণ উষ্ণতা শিরশির করে প্রবাহিত হয়ে শরীরের এককোণে দপ দপ তাপিত করে অলঙ্ঘনীয়।
নারীটির দেহবল্লরী স্বর্গের ঐ নিষিদ্ধ ফলবৃক্ষের মতো। নিষিদ্ধ ফলবৃক্ষের মতো ঐ দেহবল্লরী শরীরের মধ্যে বেজে চলা রাগ-রাগিণীর গভীর আলাপে ঝড় তোলে। একটা তোলপাড়, বুকের মধ্যে দ্রিমিকি, দ্রিমিকি।
টিনটিস্টের চোখ বিস্ফারিত। সকল শব্দ, টুংটাং, হাস্য-লাস্য, জন পাশ আকস্মিক বিলীন।
শ্বাস-প্রশ্বাস ঘনঘন, অনবরত; টিনটিস্টের একটা-একটা ছবি আঁকা তাঁর এক-এক নিশ্বাস ছিল—আবার ছবি আঁকার মতো এখন নিশ্বাস লহরী।
টিনটিস্ট, এই কোলাহলে জনতায় নির্জন হয়ে পড়ে ক্রমশ শুধু অভূতপূর্ব এক দেহবৃক্ষ সম্মুখে যাবতীয়রূপ-রস-গন্ধ-ফল-বীজ-পাতা-ছায়া-
আলোর নাচন দিয়ে অবারিত ও উন্মূল।
নারীটির অতি নিকটে, জাফরি কাটা আলোছায়াবারান্দার এক কোণে অনেকক্ষণ।
ধীরগতি চলচ্চিত্রের মতো, বৃক্ষনারী আলতো করে হাত বাড়িয়ে প্রসারিত পাঁচ আঙুলে খুব মাদকতায় যেন মনে হয় টিনটিস্টের কাঁধ স্পর্শ করে—স্পর্শমাত্র বিস্ফোরণ; কাচের মতো বেশুমার টুকরা টুকরা খানখান হয়ে আলোর মধ্যে ছিটিয়ে-ছড়িয়ে বিচ্ছুরিত হয়, কৌণিক ও তির্যক।
নীরবে এক রয়েল বাংলার বাঘ ঝাঁপিয়ে লাফিয়ে ওঠে এই মুহূর্তে। শরীর জুড়ে একটানা নিভৃত হুংকার। আমূল বিদ্ধ সে অল্পক্ষণ, হয়তো দীর্ঘকাল ঝটপট করে, একটা কম্পন বিস্তৃত হয়, ঝরনার মতো কোথাও পাথর গলে জলধারা বেগবান হয় অথচ। কোলাহলে ডুবে গিয়ে, পুনরায় ভেসে উঠে, জাগ্রত বাঘের সওয়ারে জেগে ওঠে নির্নিমেষ।
অলক্ষে পাথরের নিচে জমা জল উচ্ছ্বাস করে ওঠে; তো এই স্থির একসময়ে জেগে ওঠা বাঘ, পাথরের তলাকার জলোচ্ছ্বাসের প্রান্তে দাঁড়িয়ে, দুরন্ত এক কিশোর যেন অ্যাডভেঞ্চারের রোমাঞ্চে অতঃপর প্রথম ও শেষবার অদ্ভুত তৃপ্তি আদায় করে নিল।
পুরস্কার, এই সম্মান; হাততালি; ক্যামেরার বাতির ছটা; ভোজসভা; পানাহার—এক লহমায় সবকিছু উপড়ে ফেলে, টিনটিস্টের শরীরের মধ্যপ্রদেশের উচ্ছৃত শিশ্ন হতে, এত সম্মান সত্ত্বেও সম্ভব হয় নাই যে আনন্দ ও উত্তেজনা—এমন এক সীমাহীন অমোঘ কম্পনে, টংকারে, ঝংকারে অত্যন্ত আড়ালে, নিজের ভেতর, শরীরভেদী রুপালি তরলময় আশ্চর্য, সচল এক বীর্যপাত, চরম শিহরণের মধ্যে ঘটে গেল; সমস্ত শরীর আবিষ্ট; একটি সফল দীর্ঘ সঙ্গমের শেষে আনন্দ সাঁতারে বিজয় পতাকা উড্ডীন: তৃপ্তিময় ক্লান্তির কোরক।
এক উষ্ণতায় বীর্যপাত টিনটিস্টকে শিরোপা অর্জনের মহিমা ও স্মারক প্রদান করল!
এই ভোজসভায় গোপনে নীরব বীর্যপাতের সুখানুভূতি সে রং ও বর্ণের বহুমাত্রিকতা সৃজনে, শিল্পীর ভান্ডারের যত সংবেদনশীলতায়, উচ্ছলিত কারুকাজে কোনদিন, একবারও সতত প্রকাশ, উন্মোচন, চিত্রভাষাময় করে টিনের ক্যানভাসে কারিশমা দিয়ে জীবন্ত করতে পারবে না; এই অগ্নিময় অভিজ্ঞতা ভাস্বর হবে না, কেবল ব্যর্থতার সুদীর্ঘ অন্ধকার কেশ, উপরে অন্ধকারের উঁচুতে আকাশময় নক্ষত্ররাজি বরাবর জাল বুনতে ব্যর্থতায়, অবিরাম উন্মোচনে গড়িয়ে-গড়িয়ে হারিয়ে যাবে অপার অন্ধকারে; অন্ধকার বপন করা হয় অন্ধকারে।
আহ্ বীর্যপাত! আহ্ নীরবতা! আহ্ কোলাহলের মুক্তি! আহ্ ভোজসভা! আহ্ পানপাত্র! আহ্ মাদক সন্ধ্যা। আবার আহ্ রেতঃপাত: রুপালি তরল জাগানিয়া। একটা ক্ষয় এবং একটা শক্তি।
রেতঃপাত: বেঁচে থাকা অথবা রতির অন্য নাম মৃত্যু।
চার
শিল্পীর অহংকারে যখন ঘুম ভাঙে তখন বেদম তৃষ্ণা। একটা সুশ্রী অন্ধকারে জেগে ওঠে; বসে সে। খোলা জানালায় হাওয়ায়-হাওয়ায় দোলে পর্দা, মায়াবী। বাইরে প্রকৃতি কৃষ্ণপক্ষে কাতর। ওখানে অন্ধকারের ওপারে অন্ধকার। আলোর বাইরে আলো।
আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিবারণ করে সে আলো জ্বালায়। ঠিকরে পড়ে যে আলো ঘরের ভেতর এই রাতে মনে হয় অবাস্তব। অদ্য শেষ রজনী। কাল ফিরে যাবে ঠাকুরগাঁও। আবার আর্ট গ্যালারি। আবার টিনে-টিনে ছবি আঁকা: তাজমহল, ধবধবে শাদা অথবা নসীবের রং বেগুনি অথবা অন্যান্য চিত্রমালা বহুবর্ণ দোয়ামন্ডিত রেখায়ন: পুরোনো সমাচার দর্পণ।
একতাড়া খবরের ইংরাজি দুর্বোধ্য ভাষায় ও দুষ্পাঠ্য বাংলায় ওকে নিয়ে বিস্তর লেখা, আঁকা ছবির নমুনা চিত্র, নিজের অনেক ভঙ্গিমাতে ফটোগ্রাফ, সব যেন হঠাৎ ব্যঙ্গ শুরু করে।
টিনটিস্টের বিশাল ছবিঅলা, রঙিন ও বর্ণিল সুন্দর ছাপা বাংলা-ইংরাজি লেখায় আকীর্ণ ছিপছিপে মনোরম একটা বই অট্টহাস্য আরম্ভ করে; ঘুম ভেঙে তামাশা শুরু হয়ে গেছে যেন আজ মাঝরাতে।
কড়কড়ে নগদে প্রাপ্ত অর্থের গন্ধ নাকে শুঁকতে শুঁকতে কোথাও হতে উড়ে এসে নাকের মধ্যে হাজির হয় ফরাসি ঘ্রাণের মদিরতা। একটা কামজ দ্যোতনা পুনর্বার কামড় দিল।
রয়েল বাংলার বাঘটা এবার গরগর শব্দে-শব্দে ভীষণ এক লম্ফ দিয়ে ওঠে।
টিনটিস্ট, দ্রুত এই শরীর, ধনুকের মতো করে, তীর নিক্ষেপ করতে সক্ষম হলো। শরীরজোড়া কাঁপতে-কাঁপতে এই শীত রাতে, বাইরে হিম সত্ত্বেও, উষ্ণ প্রস্রবণে নিজেকে ভাসিয়ে হারিয়ে আরেকবার রতি স্খলন করল। নির্বাপিত করল নিজেকে। এক অদ্ভুত নির্বাণ অর্জন।
রেতঃপাতের রুপালি তরলে ভূমিময় এক অবিস্মরণীয় চিত্র অঙ্কিত ও উল্লসিত হয় অতঃপর যে, চিত্রভাষা টিনের ক্যানভাসে অজানা; তুলির কোনো প্রক্ষেপে এই চিত্র অবশ্যম্ভাবী তা অজ্ঞাত। নিজেকে গ্রাস করল না-পারা হতদরিদ্র এক বেদনা, যে, আর কখনো টিনের ক্যানভাসে কেবল ছকে আবদ্ধ চিত্রমালা ব্যতীত আর সব চেতনা, পান্না পাথরের সবুজ হয়ে যাওয়া রং, বৃত্ত ও শূন্যতার হাহাকার, প্রেমিকার আলো-আঁধারি অবয়ব, হেমন্তের কাঁচাসোনা ধানের মাঠ, কৃষকের পেশিবহুল উত্থান, গুন টানা নৌকা, গর্ভবতী নারীর শরীরের ছায়া, ইউসুফ-জোলেখার জারিগান, পালাগান, এই আমাদের বেঁচে থাকার অন্তর্ভেদী চিত্র, অভ্রভেদী আলোর বন্যা, দীপ্তি—এ-যাবৎ সবকিছু কেমন দুরস্ত, সুদূর, মরীচিকাবিশেষ। হাত বাড়ায়, স্পর্শ করতে পারে না; কেবল তৃষ্ণার সঙ্গে দূরত্ব রচনা চলে অনবরত।
রিক্ত করবে টিনটিস্ট নিজেকে, নিঃস্ব করবে নিজেকে; দলিত করবে নিজেকে, নিষ্পেষণ করবে; আগুনে পোড়াবে-জ্বালাবে, ছাই ওড়াবে, ভস্ম হতে উঠে দাঁড়াবে আবার। নতুন হবে রং-তুলি-ক্যানভাস! চেতনার সমুদ্রে একটা ডুব-সাঁতার এবার তবে অবশ্যম্ভাবী; সৃষ্টি ছাড়া সৃষ্টির কাঙালিপনা! দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে প্রথম মৃত্যুর গান। মৃত্যুর আগে জবান বন্ধ হয়ে যায় যেমন শিল্পীর তুলি বন্ধ হয়ে যায় সহসা, হয়তো সামনে নতুন দিগন্ত আর নয়, থমকে পড়া এক কদর্য পরিণাম ভেংচি কাটে, মুখ ব্যাদান করে।
শিল্পের আয়োজনে, শিল্পীর অহংকারে আমূল বিনাশী এক আর্তনাদ করে সে, যে, অব্যয় ধ্বনি-প্রতিধ্বনি অতল ভেদ করে, তল স্পর্শ করে এই বহমান রাত্রি ও কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার; চরাচর; গগন-নক্ষত্রপুঞ্জ-বায়ুপ্রবাহ-মেঘের চলাচলতা, তামাম চৌচির, খানখান: অজস্র টুকরা হয়ে পড়ে অভ্রভেদী ঐ সে-ই নিনাদে।
অতলান্তে ডুবে যেতে-যেতে টিনটিস্ট, মধ্যযামে, তুলিতে রঙের হাহাকার জড়িয়ে বাতাসে শূন্যতার বৃত্ত রচনা করতে চায় অথচ পরিধি নাই বৃত্তে; অন্ধকারের গোলকধাঁধা কেঁপে-কেঁপে ওঠে; নসীবের বেগুনি রং, হালকা হতে-হতে অকস্মাৎ নীলরূপ, বেদনার; ধবধবে ছবির শুভ্রতা ক্রমান্বয়ে ধূসর, অথবা ফ্যাকাশে; শূন্যগর্ভে হতাশার উৎপাত; এবং জ্যা-মুক্ত নিক্ষিপ্ত সে।
শিল্পের আকুতি ও সক্ষমতা, আকাঙ্ক্ষা ও শপথে জাগরণ ও নিদ্রার মধ্যখানে সুতায় ভর করে শক্তির উদ্বোধনের অপেক্ষায় ক্রমে এক অনিবার্য রূপান্তর, বদল, দূরে চলা, নির্বান্ধব।
অতঃপর নিদ্রিত টিন আর্টিস্ট! টিনটিস্ট।
পাঁচ
দীপ্তি নিভে যায়; নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে রমরমা আর্ট গ্যালারির মোড়; কে যেন উজ্জ্বলতা হরণ করে; চারপাশ চারদিক নিভু নিভু, অপহৃত।
আর্ট গ্যালারির মোড় আর উচ্চগ্রামে হেসে ওঠে না; কোনো কণ্ঠস্বর আর বাজে না। শিস দিয়ে গানে গানে মাতে না আর কেউ এখানে: চা-খানায় চা খেতে-খেতে, দম নিতে-নিতে, প্যাসেঞ্জারের জন্য অপেক্ষা করতে-করতে, রেডিওতে গান শুনতে-শুনতে কেউ কোথাও নাই, সাড়া! চোরাই হয়ে গেছে সময়। কোনো ধুরন্ধর বাজিকর যেন-বা গোলাপ খুন করে অজস্র মৃতদেহ দিয়ে কালো নিকষ একটার পর একটা ম্যাজিক প্রদর্শন করে যাচ্ছে।
নিষ্প্রভ আর্ট গ্যালারির মোড়; ছবি আঁকে না টিনটিস্ট! রূপবান টিন অসুখী মুখে ঘুরে বেড়ায়; হাস্য ও কলরোল নাই; রিকশার টুংটাং শব্দ কোনো ছন্দমুখ সৃষ্টি করে না এখন এখানে, ঐ অবেলা কালবেলায় সমস্ত নিমজ্জিত, ডুবন্ত।
আর্ট গ্যালারির মোড়টা এক মৃতপ্রায়, নিছক স্থান দখল করে রয়েছে—শোকসভায় এক আশ্চর্য পিনপতন নীরবতা—অশেষ প্রস্তর যুগ।
টিন-আর্টিস্ট ছবি আঁকে না! সকলের হাসি মলিন। ছবি আঁকার বরকতে পরিশ্রম যুক্ত ঘাম আর ঝরবে না; মানুষের, খেটে খাওয়া লোকের দল আশা-ভরসায় উদ্বেলিত হবে না; সম্ভাবনার আলো কেউ জ্বালিয়ে দেখাচ্ছে না; বেঁচে থাকার নেশার মধ্যে আগুন ধরে না; ঝুঁকিপূর্ণ কঠোর জীবনে নিষ্প্রদীপ মহড়া কেবল। টিনটিস্টের আঁকা ছবিতে যেভাবে এতদিন, ঐভাবে সৌভাগ্যের নতুন-নতুন দরজা ও ভ্যাগের চাকা খুলবে না তবে!
শূন্যস্থান পূরণ তথাপি যে, ডিজিটাল রিকশা পেইন্টিং আচানক ঠাকুরের ভূমিতে, এক্ষণে, যেহেতু টিনটিস্টের স্বেচ্ছা নির্বাসন; আর ছবি-টবি আঁকবে না এই যেমন সিদ্ধান্ত তাঁর। ডিজিটাল প্রিন্টিং চলে এসে জায়গা দখল করে ফেলেছে; মুহূর্তে যেন ছবিতে-ছবিতে রিকশার পেছনপানে সব সয়লাব; পয়সা-টাকা কম আর মোহময় রূপের ঝলক এ তাবৎ ডিজিটাল পেইন্টিং মাত্র যেন!
এতদিন হাত গুটিয়ে বসে ছিল টিনটিস্ট আর একটা ছবি আঁকতে চেয়েছিল মনের মতো যে, সুশোভিত আলোকোজ্জ্বল প্রান্তরে মহিমা বিচ্ছুরণ করবে—ছবি তাঁর কথা বলবে—নিজের কথা ছবির ভাষায়; রঙে-রঙে রঙিন অথবা যেমন ইচ্ছা কবিতার খাতার মতো হবে ক্যানভাস—টিনের কোনো ক্যানভাসে নয় বরং বিশাল মাপের পটে—দেশের যেকোনো সীমানায় দাঁড়িয়ে কেবল চোখে পড়বে এই ক্যানভাসে আঁকা এমন ছবি একটা—প্রাণের ছবি!
ছবি, তাঁকে ধরা দেয় নাই আর; সে স্পর্শ করতে পারে নাই ছবির হৃদয় অথবা হৃদয়ের ছবি শুধু তুলি হাতে রং মেখে অপেক্ষায় তার এখন এই প্রহর গোনা। অধরা ক্যানভাসে কোনো দাগ, কোনো আঁচড় কাটা হয় না–কেবল এক ধরনের দূরত্ব ও তৃষ্ণা দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হয়—প্রলম্বিত হয়—বিস্তারিত হয় টিনটিস্টের।
একদম ভেতর হতে কেউ—একজন বেরিয়ে এসে পড়ে—শূন্যতায় খোপা খোলে—অবিরাম ক্রন্দন করে চলে; এই ক্রন্দনের রং আঁকতে পারে না সে; ভেতর হতে বেরিয়ে আসা একজনের মাত্রা ও আকার সে পারে না আঁকতে।
নিজের কষ্টে অমোঘ যন্ত্রণায় জর্জরিত, কুপিত ও প্রকটিত সে, উপরন্তু ডিজিটাল রিকশা পেইন্টিং-এর আকস্মিক শূন্যস্থান পূরণ ও তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড টিনটিস্টের আর্ট গ্যালারি, ট্যাঙ্গন নদীর কিনারায় অনিবার্য এক চৌরাস্তার পাশে ঝোড়ো এক ধ্বংসাবশেষের মতো লুটিয়ে থাকে পরিশ্রান্ত, হৃত গৌরবে, অবশিষ্ট মাত্র।
আর্ট-গ্যালারির মোড় জমজমাট আর নাই; সন্ধ্যা গড়ালে সব কেমন যেন সুনসান; পৌরসভার বাতি আর জ্বলে না; রিকশাস্ট্যান্ড হালকা-পাতলা হয়ে যায়; চা-খানায় চা-পাতা টগবগ ফোটে না; দুই একটা দোকান তাড়াতাড়ি ঝাঁপ মেরে দেয়—আর টিনটিস্ট, গ্যালারিতে মিটমিটে সলতের মতো আলোতে অনেকক্ষণ ভূতের মতো কাটিয়ে রণপা বাদ দিয়ে লোকটা অতঃপর আঁকাবাঁকা হাঁটতে-হাঁটতে কোনো এক শূন্যগর্ভ শূন্যতার তিমিরে হারিয়ে যায় আবার বেলা হলে আসে একরাশ চুল-দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল নিয়ে—উবু হয়ে বসে চায়ের পর চা খায়—এই খাওয়াটাও আর বেশিদিন জুটবে না—সিগ্রেট ধরায় একটার পর একটা—এই সিগ্রেটে আর দম দিতে পারবে না বেশিদিন;পয়সা ফুরাবে।
কপর্দকশূন্য, নিঃশেষিত সে, ক্রমে টের পাবে যখন ক্ষুধার আগুন পাকস্থলি হতে টেনে তুলিতে ধারণ করবে, এমত সক্ষমতা খুঁজে এ পর্যন্ত পায় না টিনটিস্ট।
টিনটিস্ট, নিজের ভেতর জ্বলতে-জ্বলতে, পুড়তে-পুড়তে কয়লা দিয়ে একটা তালগোল পাকানো কদাকার অস্তিত্বে সহবাস করে—শেষপর্যন্ত।
টিনটিস্টের হেলপার ক্ষুধার যন্ত্রণায় চেঁচায় খামোখা। একটার পর একটা বাস-ট্রাক না-থেমে হুড়মুড় করে ধুলা উড়িয়ে বেগবান প্রস্থান করে আর বালক হেলপার দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে অহেতুক লাগামহীন মুখখিস্তি করে যায়; এই দৃশ্যটা এখন আর্ট-গ্যালারির মোড়ে চলমান ছবি হয়ে যেন আটকে আছে।
কালেভদ্রে দুই একজন মালিক নতুন বাস-ট্রাক অথবা টেম্পো নামাবার আগে দোয়ার কথা লিখতে এসে তুলির পরশের ক্ষান্ত চেহারা দেখে অপেক্ষা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়।
যতক্ষণ অপেক্ষা, হেলপার বালক মনে-প্রাণে এই যাচনা করে যে, মালিকদের নতুন যানবাহনের বডিতে আবার টিনটিস্টের হাতের তুলি ও ব্রাশ গান গেয়ে দোয়ার কথামালা বুনে চলবে। এই আশার দোলায় টিনটিস্টের বালক হেলপার, দুই পয়সা কামাবে—মজুরি হবে, এই অকাট্য ভাবনায় একধাপ করে বাঁচে আর বাঁচে। মরে আর মরে। মরে আর বাঁচে।
যখন হতাশা গ্রাস করে, কাজ করবার কোনো ক্ষমতা থাকে না, একটা লম্বা দুপুর-বিকাল পিচ্ছিল, সর্পিলাকার সটান শায়িত থাকে—চেহারা ভেংচে নাকে-মুখে খিস্তি-খেউড় উগড়ে দিতে-দিতে যুগপৎ নিজের আগমন ও বিদায়, জয় ও পরাজয়, ক্ষরণ ও রক্তবন্ধ প্রত্যক্ষ করে অবিরাম।
বালক হেলপার ধুলামাখা শেষ বিকেলে আর একটা ক্ষুদে ভুতুড়ে শরীরে টিনটিস্টের রণপাটা নিয়ে খেলা করতে করতে ঝাঁপবন্ধ গ্যালারির ভেতর অনেক রাতে ক্ষুধায় ডুকরে কাঁদে। কান্নার মধ্যে একটা কুকুরের চিৎকারের মতো একটানা ধ্বনি প্রান্তরে-প্রান্তরে, গ্রহে-গ্রহান্তরে ক্রমে ছড়ায়।
বাইরে হয়তো একটা প্যাঁচা ডাকাডাকি করে। রাত মানে অমাবস্যা অথবা পূর্ণিমার চেহারার বদল। ট্যাঙ্গন নদী হতে হুঁ হুঁ হুঁ কান্নার মতো বাতাসের আর্তনাদ ভাসে। দূরে কোথাও বয়াতির গান অস্পষ্ট হতে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। হিমেল রাতে হিমের চাদর শবাধারে কাফনের কাপড়ের মতো, খুব ধীরে ধীরে, মন্থরতায়, আর্ট-গ্যালারির উপর ঢাকনা বিছিয়ে দেয়; এই নিষ্ঠুর সময়ে, এই পৌষ মাসে, সর্বনাশে।
ছয়
টিনটিস্ট অন্ধকারে নাচে–তুলি ওঠানামা করে বাতাসে; টিনের বদলে এই হাওয়ার জগৎ যেন একটা বিশাল ক্যানভাস সম্মুখে ও চারপাশে—সর্বত্র।
এই ক্যানভাসে, প্রতি রাতে—তুলি হাতে আঁচড় কাটে–নৃত্যরত ও আগুয়ান, তবু টিনটিস্ট আর ক্যানভাসে কোনো রেখাপাতে অক্ষম–ক্লান্ত হয়ে বাতাসের গায়ে সে লটকে ঝুলে থাকে; হাতের আঙুলের ফাঁক গলে তুলিবিচ্যুত হয়–ঘাড় মটকে মাথাটা হেলিয়ে পা দুইখানা একটু শূন্যে তোলা থাকে তখন! নিজে সে বিধাতার চিত্রের মতো ঝোলে কিন্তু নিজের ভেতর হতে ঠিকঠাক চিত্রটা টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনতে পারে না একবারও; তাঁর হাতের মুঠায় বন্দি হয় না চিত্র। কোনো চিত্র জ্যান্ত হয় না কেবল অনবরত ছোবল আর ছোবল, দংশন আর বিষময় আবিষ্ট সেকেন্ড/মিনিট/ঘণ্টা, দিন ও রাতের পর রাত চলে অবিরাম।
এতদিন নসীবের রং বেগুনি আর তাজমহলের ধবধবে শাদার ঘোরের মধ্যে যে বরকত লুকায়িত ছিল, ইদানীং ঐ চিত্রটা অনুপস্থিত; যখন আবার শিল্পীর কাতরতা ও ক্ষুধা বহ্নিমান—বরকত এক্ষণে বড় অনুপস্থিত চিত্রে ও অচিত্রে; অন্য চেহারায় চিত্র কেবল এক নিরন্তর মুখভেংচি কাটে, পরাজিত একজন, সে, টিনটিস্ট। কোনো কুদরত-বরকত নাই—অনুপস্থিত ও বাষ্পীভূত সবটা যেন যখন তখন। চিত্র আর জন্ম নেয় না, পলাতক ও ফেরারি চিত্র! চিত্র নাই, চিত্রে বরকত নাই!
এক-একটা রাত্রি; ভয়ঙ্কর রাত্রি; বিস্ফোরণের অপেক্ষায় রাত্রি; মরা রাত্রি শেষপর্যন্ত; অন্ধকার কেবল নিকষ, ঘনবন্ধ; একটা রাত্রি, নিঃশব্দে অট্টহাসি করে, দাঁত দেখা যায় না—হিংস্রতা কেবল। অন্ধকার কিলবিল করে; চারদিকে ঘিরে উল্লম্ফন করে, অক্টোপাসের মতো জাপ্টে রাখে; কোনোকাচের পাখির গান শোনা, জলতরঙ্গ, উচ্ছ্বাস বিভারশ্মিময়তার আকার-ইঙ্গিত দেখা যায় না; মাতাল বেহেড অন্ধকার করোটি ভেদ করে মগজে গেঁথে স্থাণু। অন্ধকারের কোপানলে কুপিত টিনটিস্ট অন্ধকার বিদ্ধ চেনে না অন্ধকারের রং—কালো না ধূসরিত!
অন্ধকার ও রাত্রি, দিনান্তে, জুড়ে বসে জগদ্দল পাথরের মতো, আবার, অজস্র পাথরের মতো অন্ধকার নিক্ষিপ্ত ও আঘাত চালায় বেশুমার; আঘাতে ও চাপে-প্রচাপে বিশাল অন্ধকারের ঘনঘটায় একটা আহত, থ্যাঁতলানো মানুষ—টিনটিস্ট দীর্ণবিদীর্ণ।
নিঃশেষিত টিনটিস্ট, অন্ধকার শুষে, নিশ্বাসে বাঁচে পুনর্বার। একটা অজগরের মতো অন্ধকার, নিশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ ও মৃতভাবে নির্গত হলে বেঁচে থাকার একটা তীব্র শিস বেজে ওঠে অশেষ।
অন্ধকার একটা স্রোতের মতো উজানে যখন, সে, সাঁতার কাটে বিপরীতে, রিক্তের যাত্রায়, প্রত্যয়ে। অন্ধকার কেটে, অন্ধকার ভেদ করে অন্ধকারের ভেতর অন্ধকার যাত্রায় দিগ্বিদিক টিনটিস্টের তল-অতল,নিমজ্জন-ভাসান।
জীবনে কত রাত্রি এসেছিল—রাত্রিতে ঝেঁপে অন্ধকার; অন্ধকারের পথ অন্ধকার দেখায়—এই জীবনে আরও কত না অন্ধকার কতভাবে মোকাবেলা কতবার; তবুও এইবারের অন্ধকার আলাদা: পাথরের মতো অন্ধকার; অজগরের মতো অন্ধকার; গর্তের মতো অন্ধকার; রংহীন অন্ধকার; হন্তারকের মতো অন্ধকার; পঙ্কিলের মতো অন্ধকার; কবরের মতো অন্ধকার।
এমন অন্ধকার, অভিজ্ঞতার মধ্যে নাই
স্মৃতির মধ্যে নাই
দৃষ্টির মধ্যে নাই
চিত্রের মধ্যে নাই
রাত্রির মধ্যে নাই
অন্ধকারের মধ্যে নাই
অন্ধকারের মধ্যে বপন নাই, সৃজন নাই, ফলন নাই, পুষ্প নাই, সবুজ নাই: শুধু প্রস্থান আর প্রস্থান, প্রত্যাহার।
এই নির্গলিত অন্ধকারে, অকস্মাৎ হিমভেজা রাত্রি ছিঁড়ে এসে চাঁদ পড়ে—ঝিঁকিয়ে ওঠে একটা ফলাকা—তীব্র—তীক্ষ্ণ ধারালো ফলার আলো অন্ধকার কুটিকুটি করলেও কোনো এক জাদুমন্ত্রে অন্ধকার আঠায় অন্ধকার জোড়া লাগে: অখণ্ড অন্ধকার।
টিনটিস্ট, রং খুঁজে পায়: অন্ধকারের মধ্যে রক্তের রং। লাল টকটকে ফিনকি মারা রং, অন্ধকারে ডুবিয়ে, নতুন একটা রঙের বাহারে, চিত্রে-চিত্রে চিত্রিত হবে অন্ধকারের পর্দায় আখ্যানে-উপাখ্যানে এক নতুন অন্ধকার। নতুন চিত্রিত অন্ধকার।
ঠিকরানো চাঁদের ধাক্কা খেয়ে ঝকমকিত ফলা এবার টিনটিস্টের হাতে; ওর এক হাতে তুলি, আরেক হাতে ইস্পাতিনী, ধারালো ও চকচকে টিনের পাত।
অন্ধকার স্তব্ধ হয়ে আছে। কোথাও কোনো সাড়া নাই। দৈত্যের মতো অন্ধকারের দাঁত নাই, নখ নাই, শিং নাই। অন্ধকারে কেবল একটা টিনের পাত নীরবে, চাঁদের কণায়, শব্দহীন জেগে ওঠে।
টিনটিস্ট, রঙের পাত্র, রঙের তুলি ঝেড়ে ফেলে দেয় দূরে কোথাও,—হারিয়ে যাক তুলি ও রংপাত্র!
এবার সে, রক্তকে রং আর পাঞ্জাকে ব্রাশ বানিয়ে অন্ধকারের ক্যানভাসে লেপ্টে দেবে, রক্তে রক্তে রক্তাক্ত—
ফিনকি দিয়ে ওঠে রক্ত, অন্ধকারে বুদ্বুদ রক্ত হতে পিচকারির মতো রক্তস্রোত, তীব্র ধারা, তীক্ষ্ণরেখার ধারালো গতিতে রক্তপাত অন্ধকার চিরে, অন্ধকার কেটে, অন্ধকার ভেদ করে
রক্তপাত ধারাপাত এই অন্ধকারে
টিনটিস্ট আবিষ্কার করেছিল রক্তের মানচিত্র
বায়ান্নতে একাত্তরে যেমন অনেকে
এবং
এক্ষণে, অন্ধকার কারাগারে, টিনটিস্ট।
টিনটিস্ট, খুঁজে পায় তখন একটি ধারালো অস্ত্র
তিমির হননের ধারালো ইস্পাত ফলা;
এবং অনুভব করে অন্ধকারে ক্রমাগত বধির তাঁর ভ্যানগঘের মতো কান: মাথার দুইদিকে ঝুলন্ত, নড়বড়ে কান, টিনটিস্টের।
মস্তক হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুইকানে রক্তের ধারায় উত্তাল স্রোত প্রাণবান এবং অতঃপর।
বিচ্যুত কানের পাশে তীব্র যন্ত্রণা, ক্রমে মর্মভেদী, যন্ত্রণার মহার্ঘ ছটফটানিতে টিনটিস্ট ক্রমান্বয়ে অতি উচ্চে অন্যমাত্রায় উৎক্রান্ত হয়: যন্ত্রণাকে ধারণ করে শরীরের ওপরে শরীরে তার অন্য এক সত্তায় উন্নয়ন হয়।
নিজের কান কাটে টিনটিস্ট। ধারালো ছুরি দিয়ে মুহূর্তে খণ্ডিত, বিচ্যুত করে ফেলে দুই কান। আঙুল: অনামিকা, মধ্যমা, বৃদ্ধাঙ্গুলি—নৃত্যপরায়ণ বিচিত্র মুদ্রায় ও কেরামতিতে—হাতের পাঞ্জার সংঘর্ষে ও মর্মস্পর্শে কাটা কানের রক্তে স্নাত কিংবা ছোপ-ছোপ রক্তে কিংবা রক্তের হোলিতে কিংবা রক্তের বর্ণমালায় দ্রুত চিত্রপট রঙিন ও অন্ধকার–রক্তাপ্লুত করে তোলে শেষপর্যন্ত।
রক্তের সঙ্গে গাঢ় অন্ধকার মিলে যে রং শিল্পীর তুলিতে নেচে ওঠে নাই, শিল্পী যে রং কখনো দেখে নাই, শিল্পী যে রং ধারণা করে নাই—এবার সেই রং রাত্রি হনন করে বন্ধ্যা সময়ের নাগপাশ ছিন্ন করে সূর্যের মতো জ্বলে ওঠে সহস্র শক্তিতে। রক্তপান করে জাগ্রত অন্ধকার।
কাচের পাখি, গান করল:
রিনি ঠিনি! রিনিঠিনি!
সূর্যখচিত ভোর: বিগত রজনীর স্মৃতিমেদুর প্রভাতকাল।
শিশির পড়ে; শিশির পড়ার শব্দে অনবরত
লুটিয়ে পড়া ফুল: কিশোরীর বোনা মালা,
এই সতেজ কুয়াশামাখা ভোরে কাটাকান একজন মানুষ রণপায়ে মাঠ ভেঙে যায়, চোখে অজস্র চিত্র, অজস্র রং;
দুরন্ত মানুষটা আদিগন্ত ধানক্ষেতে দিগন্ত রেখায় একটা নতুন বড় লাল টকটকে গনগনে আঁচে-ভরা সূর্য আঁকল,—সূর্যালোকে প্রকৃতি ভরে গেল;
বৃক্ষের পাতায় আলো পড়েছে—ছবি আঁকল: আলোর নাচন তখন পাতায় পাতায়;
জলের গায়ে আলোর ছটা—মানুষটা ছবি আঁকল: জলের গায়ে ঝিলমিল করে আলোর বৈভব;
ধানের ক্ষেতে আলোর বর্ণচ্ছটা, বাতাস বয়ে যায়—মানুষটা ছবি আঁকল:সোনালি ধানে ধানে সোনাঝরা আলোর খেলা;
ফুল কৃষকের পেশী
পাখি মাঝির বাহুবল
বৃক্ষের নিচে ছায়াতামাটে শরীরের মানব
গরুজল
লাঙলমাটি
রাখালের মাথায় মাথালকাদা
নির্মাণ আর নির্মাণ—
কালো নৌকা
রঙিন পাল
উজান গাঙ বাহিয়া বাংলার মাটি, জল, মানুষ করে কলরব
রণপায়ে মেঠোপুরুষ–প্রকৃতির অফুরান ছবি আঁকে এবং ছবির ছোঁয়ায় প্রকৃতি ছবি হয়ে যায়, ছবিময়...
সাত
সর্বশেষ প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী টিনটিস্ট আবার ছবি আঁকতে শুরু করেছে। সে এখন কানকাটা, আর্টিস্টিক এক কর্ণচ্ছেদনে পয়মন্ত তার দুনিয়া আবার। নতুন পর্যায়ে কান কেটে, কান টেনে ফেলে আসা সেই সোনালি সময়কে আবাহন তাতে;
বাস্তবতা হয়ে ওঠে—
রূপবান মার্কাটিনে আঁকা ছবির দিন ফিরে আসলো।জ্বলে উঠল। উত্তাল হলো এবার কানকাটা টিনটিস্ট, নয়া কলেবরে।
ডিজিটাল প্রিন্টিং রিকশা পেইন্টিং ব্যবহারকারী আপামর রিকশা মালিক ও চালকগণ শেষপর্যন্ত উপলব্ধি করেছে যে, এই জাতীয় পেইন্টিং সুলভ হলেও টিনে আঁকা ছবির মতো বরকত নাই, টেকসই, চকচকে ও স্থায়ী নয় বরং এইসব ছবি ডিজিটাল মুদ্রিত পেইন্টিং অচিরেই মলিন, ক্ষয়িত ও রংচটা হয়ে পড়ছে—তা দেখা যাচ্ছে; টিনে আঁকা রিকশার পেইন্টিংয়ের মতো ডিজিটাল রিকশা পেইন্টিংয়ের কৌলীন্য কোনো নাই।
রিকশাচালক ও মালিকগণ ডিজিটাল পেইন্টিং—চাকচিক্য হতে মুখ ফিরিয়ে আবার উদ্গ্রীব হয়েছে টিনে আঁকা পুরাতন ছবির জন্য নতুন করে উদ্যমী আয়োজনে।
আর্ট-গ্যালারির মোড় পুনরায় সরব হয়ে ওঠে—
আবার রিকশার টুংটাং আবার;
পেয়ালা পিরিচের টুংটাং আবার;
রূপবান টিনের ঝংকার আবার;
পরিচিত চেহারা—পরিচিত হাসি—পরিচিত গান—পরিচিত চিত্র: সকাল হতে সন্ধ্যা, প্রতিদিন আর্ট-গ্যালারিতে ভিড়-ভাড়াক্কা, ধুম-ধাড়াক্কা, কাজের ছড়াছড়ি। রূপবান টিনে বিচিত্র চিত্রের আয়োজন চলে।
রিকশাচিত্রে বিশাল একটা স্থানজুড়ে থাকে নারীর অবয়ব, কখনো নারী ভঙ্গিমা!
টিনটিস্টের আর্ট-ওয়ার্ক তুলির পরশ সহসা নতুনতর আরেক সংযোজনে এই নব পর্যায়ে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে এবার।
রূপবান মার্কা চকচকে এক-একটা টিনের গায়ে যে অবিরাম ক্লান্তিহীন শুধু আঁকায় মত্ত থাকে যে, অজস্র নারী অবয়ব—এক অবয়ব, বারবার, প্রতিবার, অনবরত; অবয়ব বদলে যায় না বরং স্থির, অনুরূপ; দীপ্তিময়, উদ্ভাসিত, সময়ান্তরে, পুনর্জন্মএই সেই চেহারা; হারিয়ে যাওয়া, ফিরে পাওয়া: চেহারা পুনরুদ্ধার—চেহারা মালিন্য হারায় নাই এতটুকু যেন তেইশ বৎসর আগে যেমন ছিল খেলার সাথী—কখনো অভিমানী, কখনো বিরাগ, কখনো নম্র, কখনো ভীরু, কাঁপা-কাঁপা, কখনো লজ্জাতুর, কখনো কৌতুকময়, কখনো বিস্ময়-বিমুগ্ধ, কখনো কাজল নদীর জলে, কখনো জলভরা, কখনো আহ্লাদী, কখনো আবেগী, কখনো চঞ্চলা, কখনো নিস্তরঙ্গ, কখনো মায়াভরা, কখনো ঘন নিশ্বাস, কখনো কম্পমান ওষ্ঠ, কখনো বুকের ভেতর ধুকপুক, কখনো চেনা-অচেনা, কখনো প্রলয় কিংবা ধ্বংস—ভ্রুচোখ—কপাল-চিবুক-ঠোঁট-গ্রীবা-গণ্ডদেশ, এক অমোঘ আকর্ষণ।
লায়লা বানু। প্রেমিকা। ছেলেবেলার খেলার সাথী। একসময় লায়লা বানু হারিয়ে যায়। একটা উড়ো বাতাস সব এলোমেলো করে দেয়। একরত্তি লায়লা। হঠাৎ নিশ্চিন্তপুর হতে কোথায় যেন কোনো এক অজানা বাতাসের বেমক্কা দমকা আচরণে, আঘাতে উড়ে যায়, ভেসে যায়, চলে যায়—হয়তো যাযাবর নতুবা ট্যাঙ্গন নদীতে নাইয়র।
টিনটিস্ট, একঘুম পরে, এক শীতভোরে খুঁজে পায় মাণিক্য যেন; লায়লা বানু, প্রিয়তমা—
এবার নারীকে যখনই আঁকে, ফুটে ওঠে লায়লা বানু। চিত্রের মধ্যে লায়লা একমাত্র নারী, বারবার তুলি ও রং-কে বাধ্য করে আঁকাতে। লায়লা যেন ঘন নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে টিনটিস্টকে পাগল করে আঁকায়, নিজেকে দেখায়, রূপ খুলে দেয়—অপরূপ চেহারা ও ভঙ্গিতে, রূপবান টিনের শরীরে—পূর্ণতা ঘটে ক্রমাগত।
সমবেত সকলে লক্ষ করে, টিনটিস্টের আঁকা শ্রেষ্ঠ নারী; চলচ্চিত্রের কোনো নায়িকা নয়, কোনো সাথী নয়, চেনা কেউ নয়—কোনো এক জন্মে ছিল হয়তো, ফের, জন্মান্তরে, সাত আসমানের ওপর—হয়তো বেহেশত হতে, ক্রমাগত নেমে আসে আর ছবি হয়, ছবি শুধু ছবি, ছবির পর ছবি, একাদিক্রমে ছবি।
টিনটিস্ট বুঁদ হয়ে ছবি আঁকে। ছবি একটা অথচ অজস্র হয় বারংবার। যখন সে শূন্যে তাকায়, তেজ মরে গেলে সূর্যের গোলাকার লাল বর্ণে, গোধূলি বেলায়, আলো-আঁধারির মায়াজালে, কারুকার্যময় পালঙ্কে শায়িত প্রেমিকা লায়লা বানু স্মিত হাসি ছড়ালে টিনটিস্ট শিল্পীর অহংকারে ভূষিত হয় এবং এক্ষণে সোনার কাঠি রুপার কাঠি পাল্টে ঘুমিয়ে পড়ে রাজকন্যা।
বেদনার মতো অবশেষে হিম পড়ে।
প্রকৃতিতে এবং রক্তে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন