ভোলাগ্রাম পাইস হোটেলের আগন্তুক পাখিগুলো
|| এক ||
মুদ্রাস্ফীতির উল্লম্ফনে নাভিশ্বাস ওঠা মূল্য তালিকা থেকে চোখ নামিয়ে প্লেটে দু’টুকরো সাপের মাংস দেখে লাফ দিয়ে উঠল লুলু বাঙাল। সদ্য মুখে দেয়া প্রথম লোকমার ভাতটুকু নিচে নামেনি তখনো। তর্জনী দিয়ে নেড়েচেড়ে প্লেটটা হাতে নিলো সে। খুলে রাখা স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা পায়ে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর অবশিষ্ট ভাতগুলো গিলতে গিলতে বলল,
এত্ত নোব তোগের, ট্যাকার এত্ত নোব? আঁ?
আশপাশের কয়েকজন ওর দিকে তাকালো। খাবারের অপেক্ষা করছিল যারা তাদের কেউ কেউ উৎসুক চোখে দেখছে। লুলু বাঙাল আবার শুরু করল,
দাম বাড়াতি বাড়াতি আসমানে তুলে দিইছিস। তাও ট্যাকার নোব কোমে না তোগের? শ্যাষ পর্যন্ত সাপ কোপ খাওয়াতি শুরু করে দিলি?
দ্যাখেন, দ্যাখেন, দ্যাখেন আপ্নেরা। নিজির চক্ষেই দ্যাখেন।
বলেই প্লেটের টুকরো দুটোকে নেড়ে চেড়ে উল্টে-পাল্টে দেখাতে লাগলো সবাইকে।
আশ্বিন মাসের বিনম্র দুপুর। ভোলাগ্রাম পাইস হোটেল কাস্টমার ঠাসা। অফিসগুলোতে লাঞ্চ ব্রেক। মার্কেটের কর্মচারি আর নির্মাণ শ্রমিকদের ভিড়। উচ্চমূল্যের বাজারে স্বল্প আয়ের মানুষ সস্তায় খেতে আসে এখানে। প্রতিদিন ভোর বেলা জিয়াবুল মৃধা আর রিজিয়া খাতুন বাজার করে। সঙ্গে থাকে তিনজন কর্মচারী। তারপর যোগ বিয়োগ গুনভাগ করতে বসে। খরচ-খরচা বাদে সামান্য লাভ রেখে মূল্য লিখে দেয় একটা সাদা বোর্ডে। প্রতিদিনই নতুন নতুন রেট। বাজার মূল্যর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ওঠানামা করে। শুধু তাই না, পাইস হোটেলের বৈশিষ্ট্য ধরে রেখে চালু আছে তিন ধরনের পেটচুক্তি খাবার। যেকোনো দুটো আইটেম সঙ্গে ডাল-ভাত যত লাগে খাও। এতে করে ঢাকা শহর গড়ে তোলা নির্মাণ শ্রমিকদের কিছুটা উপকার হয়। আর বাহারি আলোকজ্জ্বল শপিংমলগুলোর নিম্নআয়ের কর্মীদেরও পেট ভরে। তাই ঢাকার অদূরে ঝিম ধরা নিভৃত একটা গ্রামের বুকে বুলডোজার চালিয়ে ক্রমশ অভিজাত হয়ে ওঠা গুলশান আবাসিক এলাকা এই হোটেলে ভিড় সামলাতে পারে না রোজ দুপুরে।
অনেকে ভ্রূক্ষেপ না করে খেয়েই চলছে। দু’একজন এসে উঁকি দিলো প্লেটে। দেখা গেল সত্যি সত্যি লুলু বাঙালের প্লেট ইঞ্চিতিনেক লম্বা দুটো সাপের মাথা। হোটেলের পেছন দিকে রান্নাঘর। চওড়া এলুমিনিয়ামের গামলায় থরে থরে সাজানো আট দশ আইটেম খাবার। রিজিয়া খাতুন অর্ডার অনুযায়ী বেড়ে দিচ্ছিল। ক্যাশে বসে থাকা জিয়াবুল মৃধার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলল সে,
আগায়ে গিয়ে দেখতি পারছেন না লুলা বাঙাল কি নাটক শুরু করছে?
লুলু বাঙাল তখন ব্যস্ত। অন্য কাস্টমারদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে। দড়াম করে ক্যাশবাক্স বন্ধ করে দিলো জিয়াবুল মৃধা। উঠে এসে দাঁড়ালো লুলা বাঙালের কাছে।
ওই মিয়া বসেন। বেচাকিনার টাইম। আজাইরা চিল্লায়েন না। বলেন সমস্যা কি আপ্নের।
লুলু বাঙাল থামলো না। আরো চেঁচিয়ে বলল,
দেখো দেখো কাস্টমারেক কি খাওয়াইতাছো। বলেই প্লেটটা তার মুখের সামনে ধরলো।
জিয়াবুল মৃধা দেখল দুই টুকরো সাপের মাথা। ঢোড়া সাপ অথবা সুতানলী হতে পারে। পানি নিয়ে ধুয়ে নিলো। আরো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন।
কি মিয়া চুপ মারে গেলে ক্যান? আরো ধোও। ভালো করে সাবান লাগায়ে ধোও। দেকো।
বলেই ওয়াক ওয়াক করে বমি করার ভান করল। জিয়াবুল মৃধা ভাবছে। প্লেটে তো সত্যি সত্যি দু’টুকরো সাপ। সরাসরি অস্বীকার করাও যাচ্ছে না। তবে কি বিশ বছরের পুরোনো মাছ সাপ্লায়ার বেইমানি করলো? তাই বা হবে কিভাবে। তাহলে তো কাটাকুটি বা ধোয়ার সময় চোখে পড়তো। তবু নিজের মধ্যে একটা সন্দেহ ঢুকে গেল। ওই প্লেট ঘিরে জটলা বাড়ছে। কেউ কেউ ছবি তুলছে।
জিয়াবুল মৃধা তবুও জোর গলায় বলল,
এইডা আমাগের হোটেলের পদ না। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি ইডা আমাগের খানা না। সঙ্গে সঙ্গে রিজিয়া খাতুনও পেছন থেকে ঝন ঝন করে উঠলো।
প্রেত্যেকদিন শয়ে শয়ে লোক খায়। কুনোদিন কেউ কুনো কতা বলতি পারলো না আর আইজ আইসে ওই হারামিডা চিল্লা পাল্লা করতিছে। হ্যারে পাক ঘরে পাঠান। বাইর করুক কনে সাপের গোস্ত রানছি। সাপ-কোপ রানলি তো আর খালি দুই পিচ্ রানবো না।
ওই মিয়া, তুমার হোটেলের খানায় সাপ, চক্ষের সামনে দেকতিছ। তাও স্বীকার যাও না? গুলশান থানায় রিপোর্ট করা লাগবি দেকতিছি। লুলু বাঙাল খেকিয়ে উঠল।
এইডা আমাগের হোটেলের খানা না। এর মদ্যি কুনো ষড়যন্ত আছে। আর কেউ পাইছেন আপ্নেরা? বোলেন। বোলেন আর কেউ পাইছেন নাকি হেই একাই পাইলো? জিয়াবুল মৃধার গলায় তেজ বাড়লো।
সবাই চুপ।
কন। কন। হেই একাই পাইলো ক্যান? আমি সাপ বেচলি তো আরো কাস্টমার তো পাবি। না কি কন?
ঠিক সেই সময় আরো একজন কাস্টমার ওয়াক থু ওয়াক থু করতে করতে দাঁড়িয়ে বলল,
আমার পাতেও সাপ।
আর যায় কই। এরপর কেউ আর যুক্তি প্রমাণের জন্যে অপেক্ষা করে না। সুযোগ বুঝে বিল না দিয়েই কেটে পরল অনেকে। কয়েকজন লাথি মারা শুরু করে দিল বেঞ্চ, ক্যাশ টেবিল আর সাজানো খাবারের গামলাগুলোতে। জিয়াবুল মৃধা, রিজিয়া বেগম, তিনজন কর্মচারী প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। বাইরে থেকে কিছু লোকজন এসে যোগ দিল ভাঙচুরে। সবার মুখে শুধু সাপের গোস্ত। কাঠের বাটাম, বেড়ার বাঁশ, বেঞ্চ ভেঙে তক্তা বের করে পেটানো শুরু হয়ে গেল। মিনিট দশেকের মধ্যে দুপুরে জমজমাট ভোলাগ্রাম পাইস হোটেলটা তছনছ।
আরো লোক আসছে। কারা নাকি ফেসবুকে একটা ছবি ভাইরাল করেছে। লিখেছে ভোলাগ্রাম পাইস হোটেলের মেনুতে বিষধর সাপ! অনেক শেয়ার আর কমেন্টস হয়ে গেছে এর মধ্যেই। একজন লিখেছে এই হোটেলে আগে কুকুর বিড়ালের টুকরো পেয়েছে তারা।
আরো একজন কমেন্ট করেছে যে ষাটের দশকের শুরুতে মানুষের হাতের আঙ্গুল পাওয়া গিয়েছিল এখানে। আগুন ছড়াতে যতটুকু সময় লাগে গুজব ছড়ায় তার আগে। প্রমাণের অপেক্ষা করে না কেউ।
কাছেই থানা। ভিড়ের মধ্যেই খুব দ্রুত একটা পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ালো। তরুণ স্মার্ট দারোগা নেমে এসে টিনের জংধরা সাইনবোর্ডটা শব্দ করে পড়ল, ভোলাগ্রাম পাইস হোটেল। সস্তায় রুচিশীল আহারের বিশ্বস্ত নাম। পড়া শেষ করে নির্বিকার এদিক-ওদিক তাকিয়ে হাক দিল সে,
এই হোটেল কার?
জিয়াবুল মৃধার মাথার পেছন থেকে থেকে রক্ত ঝরছে। কাছেই একজন কর্মচারি নিজের বাম হাতের কনুই দেখছে বার বার। আঘাত লেগে গোলাপি মাংস বের হয়ে গেছে। হয়তো জ্বলছে খুব। একজন গামছা ভিজিয়ে চেপে ধরলো জিয়াবুল মৃধার মাথা। কিন্তু কেউ কোনো উত্তর দিল না। দারোগা আবার বলল,
ওই মিয়া, হোটেল কার?
জিয়াবুল ভেজা গামছা দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে উত্তর দিল,
আমার।
নাম কি?
নাম জিয়াবুল মৃধা, পিতা জুনাব আলী মৃধা।
হোটেল দিছ কয় বছর?
পার্টিশনের সুমায়।
পার্টিশন? মানে কি?
মানে উন্নিশশো সাতচল্লিশ সাল।
উন্নিশশশ সাতচল্লিশ? ইয়ার্কি চুদাও?
জ্বী না স্যার, আমি ঠিক বলতিছি।
ওই বোকাচোদা, পার্টিশনের সুমায় এই গুলশানের জন্ম হয়ছে নাকি যে তুমি হোটেল খুলবা?
গুলশানের জন্ম হয় নাই ঠিক। কিন্তু মাটি তো ছিল। গিরাম ইলাকা। ভোলা গ্রাম। লোকে কইতো ভোলার ট্যাঙ্গর।
শালা পাগল-টাগল হয়ে গেল নাকি। পাবলিকের ঝার খায়ে ফাউল বকতিছে। পুলিশ হেড কোয়ার্টারের কল সেন্টারে কমপ্লেন পরছে। তুমি হোটেলে বিষধর সাপের গোস্ত বেছতিছ।
সার, আমার দাদার রুটির দুকান দিয়ে এই হোটেল শুরু। তিন পুরুষির ব্যবসা। আমরা সাপ-ব্যাঙ বেচি না। চিটারি বাটপারি করি না। বন্দুক-পিস্তল ঠেকায়ে চাঁদাও চাই না।
শেষ কথাটা কানে লাগলো দারোগার।
এই বাঞ্চোৎ বেশি বকে। সঙ্গের কনস্টেবলকে বলল, হ্যান্ডকাফ লাগাও। গাড়িতে তোল। এই হোটেল অবৈধ। উচ্ছেদ হবে।
আমার লাইসেন্স আছে।
এই শালার গলার ত্যাজ কমে নাই। কিসির লাইসেন্স। নিয়ে আসো যাও। আর যেই কয় প্লেটে সাপের গোস্ত পাওয়া গেছে জব্দ করা হলো। বলেই সঙ্গের পুলিশগুলোর দিকে তাকালো। এমন সময় দুজন লোক এগিয়ে এসে বলল আমরা সিটি কর্পোরেশনের লোক।
ভেরি গুড। ওই মিয়া, সব কাগজপত্র নিয়ে আসো। ইনরাও দেখুক।
ভাঙাচোরা জিনিসপত্র সরিয়ে টিনের দেয়ালে ঝোলানো দুটো বাঁধায় করা ফ্রেম খুলে নিয়ে আসলো জিয়াবুল মৃধা। লেখা আছে ‘ট্রেড লাইসেন্স। ভোলাগ্রাম পাইস হোটেল, প্রোপাইটর মোঃ জুনাব আলী মৃধা।’ একটা গুলশান পৌরসভার দেয়া। আরেকটা ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের।
উল্টে পাল্টে দেখে কাগজদুটো পাশের লোকদের হাতে দিল দারোগা।
জিয়াবুল মৃধা বলল, আমার পিতার নামে হোটেলের লাইসেন্স। তিনি এখনো জীবিত। বয়স বিরাশি।
রিজিয়া খাতুন আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে এসে বলল আমাগের সব শ্যাষ করে দিল সার। আমরা এই অনাচারের ন্যায্য বিচার চাই। ওই লুলা বাঙাল সারাডা বচ্ছর আমাগের হোটেলে খায়। পয়সা না থাকলিও আমরা তাক খাওন দিই। খাতা ভরা বাকির হিসাব।
পুলিশ অফিসার বলল,
তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অবৈধ হোটেলে বিষধর সাপের গোস্ত বিক্কি। সত্যি কি না?
না, ওইডে আমাগের দুকানের পদ না।
খানার প্লেটে পাওয়া গিয়েছে। আমরা পাক করার জায়গা তল্লাশি করব।
কয়েকশ লোক এর মধ্যে এসে পরেছে। মোবাইল সাংবাদিকরা ফেসবুক লাইভ শুরু করেছে। শিরোনাম, গুলশানের অভিজাত এলাকায় সাপের মাংস বিক্রি। একজন গ্রেফতার। দুপুরের খাবার সময় এই খবরটাই লোকে খাচ্ছে বেশ।
|| দুই ||
এজাহারের একটা কপি হাতে নিয়ে থানা ভবন থেকে বেরিয়ে এল একজন অফিসার। বলল,
আসামি চালান হয়ে গেছে। আমি এই মামলার আইও। কাল সকাল দশটায় স্পটে যাব। আপনারা থাকবেন।
রিজিয়া খাতুন বলল,
এতো কাঁদাকাটি করলাম তবু চালান করে দেলেন সার?
এরপরই দেখা গেল কোমরে দড়ি বেঁধে জিয়াবুল মৃধাকে নিয়ে হেটে আসছে পুলিশ। দাঁড়িয়ে থাকা একটা পিকআপে তোলা হলো। গন্তব্য পুরোনো ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট। এজাহারে প্রাথমিক অভিযোগ বিষধর সাপের মাংস বিক্রি, প্রতারণা, সরকারি জমির জবর দখল আরো বেশ কিছু ধারা।
সেদিন সন্ধ্যায় প্রতিদিনকার মতো হিসেব নিকেশ নিয়ে বসা হলো না আর। তছনছ হোটেলের আসবাব গুছিয়ে তার মধ্যেই রাতে থাকার ব্যবস্থা করল তিন কর্মচারি। একজন দুজন করে লোক আসছে তখনো আর মন্তব্য করছে।
|| তিন ||
বহুতল অফিস, হোটেল আর রংচঙা বিপনি বিতানগুলোর ফাঁকে কালিমাখা মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভোলাগ্রাম পাইস হোটেল। অভিজাত্যর দাপটে চেপ্টা জীবন। একসময় রামপুরা হাতিরঝিল ধানমণ্ডিকে যুক্ত করে শান্ত নদীর মতো একটা খাল এলোমেলো গ্রাম পেরিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল বহুদূর। মেছো বাঘ শেয়াল আর বিভিন্ন প্রজাতির পাখির জগৎ ছিল নিভৃত নির্জন ভোলাগ্রাম। দেশ ভাগ হলো।
দলে দলে লোক ঢাকা ছুটতে লাগলো। নতুন নতুন অফিস আদালত, ব্যাবসা, ঘরবাড়ি। কিন্তু অতটুকু ঢাকা এদের ধারণ করবে কিভাবে? তাহলে বাড়াও ঢাকা। আশপাশের নিভৃত গ্রাম, নদী, খাল বিল জলজ লতাগুল্ম পাখি আর বন্যা প্রাণীর আবাস কেড়ে নিয়ে গড়ে তোলো মানুষের কায়কারবার।
দেশভাগের আগে নফর আলী মৃধা কাজ করতো আদমজী জুট মিলে। ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী। তখনো একা মানুষ। লিডারের সঙ্গে এখানে ওখানে যায়। মিটিং করে। বক্তৃতা শোনে। শ্রমিকদেরকে ন্যায্যতা বোঝায়। চারিদিকে স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ। একবার লিডার তাকে নিয়ে গেল কলকাতা। থাকলো একমাস। বিভিন্ন জায়গায় মিটিং মিছিল চলছে। দুপুর হলে উড়িষ্যার কালী মাইতির পাইস হোটেলে জমায়েত। কলাপাতার থালায় শুকনো লঙ্কার ফোড়ন দেওয়া খানা। এখানে প্রতিদিন বাজার হয় প্রতিদিন রান্না। কোনো কিছু জমানো থাকে না। নফর আলী মৃধা আলাপ জমালো ময়মনসিংহের এক কর্মচারির সঙ্গে। ওদের হেঁসেলে ঢুকে জুড়ে দিল আদমজী জুট মিলের গল্প। খাতির জমে গেল। শিখে নিলো রান্না। ওদের কাছেই ধারণা পেলো, পাইস হোটেলগুলো আসলে একধরনের সেবা। নগরে আসা গরিব মানুষের মুখে স্বল্প পয়সায় আহার তুলে দেয়ার সেবা। পয়সায় খাবার মিলতো বলেই সবাই বলে পাইস হোটেল।
ফিরে এসে জুট মিলের চাকরি দিলো ছেড়ে। স্বাধীন কাজ করবে। ভাটারা, সাঁতার কুল, বাড্ডা এসব এলাকা থেকে কৃষিজীবীরা বর্ষাকালে এসে থাকতো সামনের উঁচু এলাকায়। হাতির ঝিল বেগুনবাড়ি খাল পার হয়ে সুতিখোলা খাল পর্যন্ত মাটির ঢিবি। টিলার মতো। ঝোপঝাড়, কাঁঠাল আর শাল বাগান ঘেরা জঙ্গল। চলে গেছে সোজা ভাওয়াল গড়ের দিকে। এখানেই নফর অলীদের বাড়ি। বিঘে তিনেক জলাভূমি। শুকোনোর সময় ধান হয়। কিন্তু নফর আলীর মাথা টানছে সেই পাইস হোটেল। মহাখালী থেকে একটা কাঁচা রাস্তা চলে গেছে দূরে ভোলার ট্যাঙ্গর ছাড়িয়ে। সেই রাস্তার ধারেই তার খুলে বসল এক রুটির দোকান। ঢাকা বাড়ছে। কাঁচা বাড়ি টিনের ঘর ভেঙে লোকে গড়ছে দালান। আসছে শত শত শ্রমিক। রুটি খেয়ে হয় না তাদের। তাই নফর আলীর রুটি দোকান বদলে গেল ভাতের দোকানে। নাম দেওয়া হলো ভোলাগ্রাম পাইস হোটেল।
|| চার ||
নিঃসঙ্গ হিজল গাছটা ভোলাগ্রাম জলাভূমির শেষ প্রতিনিধি। নরম কাদা মাটি জলের জীবন বদলে তার চারপাশ এখন কংক্রিটে ঢাকা। রাস্তা ফুটপাত আর বিশাল অট্টালিকার আন্তঃমানসিক চাপে বেঁচে থাকা কষ্টকর। তবুও সে দেখছে ভোলার টেঙ্গর থেকে ভোলাগ্রাম রূপান্তর। তারপর একদিন সেই ভোলাগ্রামের গুলশান হয়ে ওঠা।
তদন্ত শুরু হলো অস্বাভাবিক দ্রুততায়। খবর পেয়ে বৃদ্ধ জুনাব আলী মৃধা এসেছে কালিয়াকৈরের আন্ধারমানিক গ্রাম থেকে। বিরানব্বই বছর বয়সে তাঁর দিশেহারা চোখ দৃষ্টিহীন ভাস্কর্যের মতো স্থির।
তদন্ত কর্মকর্তা রিজিয়া খাতুন আর জুনাব আলী মৃধার মুখোমুখি বসল। কাগজ কলম বের করে প্রশ্ন শুরু হলো,
আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক। বেআইনি হোটেল খুলে বন্যা প্রাণীর মাংস বিক্রি। প্রতারণা।
ইসব এক্কেবারে মিত্তে কতা। সব ষড়যন্ত্র। পাকিস্তান আমলে আমাগের গিরামখান খায়ছে। তিন বিঘে জমি খায়ছে। এখুন হোটেলটা খাওয়ার ষড়যন্ত্র।
কিন্তু হোটেলের খানার প্লেটে সত্যি তো সাপের মাথা পাওয়া গিয়েছে। এক নম্বর আসামি স্বীকারোক্তিও দিয়েছে।
সিডা মিশানো হয়েছে সার। সিডা কোনোভাবেই আমাগের হোটেলের খানায় পাওয়া যায়নি। কেউ উদ্দিশ্য নিয়ে মিশায়ে দেছে।
কিন্তু আপনি কি এইটা প্রমাণ করতে পারবেন?
ক্যান পারবো না সার, আপ্নে তদন্ত করতিছেন। যার পাতে পাওয়া গেল তাক জিরা করেন। পোদের পর দুই বাড়ি দ্যান ব্যার ব্যার করে বলে ফেলবিনি আসল ঘোটনা কি?
আপনাদের কি কারো প্রতি সন্দেহ হয়?
হয়। তারা আমাগের ডানে বায়েই আছে।
মানে?
মানে আমাগের ডানে যে ফাইভ ষ্টার হোটেল তারা বহুদিন থিকে আমাগের এই জায়গাখান দখল করে নিয়ার ষড়যন্ত্র করতিছে।
তারা কিন্তু পাওয়ারফুল লোক।
শোনেন সার, এই জায়গা একোয়ার করা হয়েছে সেই পাকিস্তান আমলে। উনিশশো একষট্টি সালে। ডিআইটি আশপাশের মাটিভরাট খানাখন্দ ভরাট করে গুলশান বানালো। আমার বাপ দাদার জাগার ওপর দিয়ে এই রোড গেলো। এই যে দেখেন, এই পাশেই ভোলাগ্রাম জামে মসজিদ। শুনিছি আমাগের পূর্বপুরুষরা শরিকানা জমি দান করে বানাইছে। আঠারোশো ছিয়াত্তর সালে। সিডার নাম বদল করে দিয়া হলো গুলশান জামে মসজিদ। জমি দিলাম আমরা নাম হলো ভেন্ন। বসত বাড়িসমেত আমাগের ধানি জমি বিঘে তিন একোয়ার হলো। হোটেল উচ্ছেদ করা হলো দুইবের। ওই যে মাদানী সাব, ওই যে ডিআইটির চিয়ারম্যান ছিল। করাচি থিকে উড়ে আসে ভোলাগ্রাম খায়ে ফেলা দিলো। বললো করাচির গুলশানের মতো ঢাকায় একখান গুলশান বানাবি। কালো গগলস পরে এই এই খানে একদিন দাড়ায়ে আমাক বল্ল,
জুনাব আলী, লিস্টমে নাম লিখাও। কম্পিনসেশন পায়ে জায়েগা। প্লট পায়ে জায়েগা।
হ্যারপর কতলোক কতবার লিস্ট করে নিয়ে গেল।
ক্ষতিপূরণ পান নাই?
পাইছি। তিন বিঘে জমি ছিল। ক্ষতিপূরণ দিল একটু-ফুটা প্লট। তাও আবার দুইনম্বরি করে কারে নিয়ে নিলো। শুদু আমরা না। আরো লোক ছিল।
তারা কোথায়?
সব উচ্ছেদ হলো। কেউ আশপাশের ইলাকায় বাঁচার পথ খুঁজে চলে গেল। তবে বেশিরভাগ মিলে আমরা একসঙ্গে গ্যালাম আন্ধার মানিক গিরাম। কাইল্ল্যাকোর।
কালিয়াকৈর।
হ। কিন্তু এই হোটেলটারে ছাড়তি পারলাম না।
ক্যান?
কারণ এইডা শুদু হোটেল না। শুদু ব্যবসা না। গরিব মানষের মুখের আহার যুগানোর জায়গা। যারা লেবার, যারা এই রাজধানী তিল তিল করে গড়ে তুলতিছে ত্যাগের জন্ন্যি তো খাওনের জায়গা লাগবি নাকি? তারা তো গিয়ে ওই ফাইভ ঈস্টারে খাতি পারে না।
এইরকম কথাবার্তার মধ্যে তদন্ত শেষ হলো। সাক্ষী থাকলো ওই লুলা বাঙাল আরো একজন।
যাবার সময় তদন্ত কর্মকর্তা শুধু বলল, মুরুব্বি আপ্নেরা কি এই হোটেল আর ধরে রাখতে পারবেন?
কারণ কি?
কারণ জানি না। কিন্তু ফলাফলটা জানি।
এই কথাটার পর হু হু করে একটা প্রাচীন বাতাস উড়ে এসে মাকড়সার জালের মতো জড়িয়ে নিলো জুনাব আলী মৃধাকে। যা চোখে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু জড়িয়ে রেখেছে শক্ত করে।
|| শেষ ||
জীবনে সত্যের চাইতে অনুভূতিই প্রধান হয়ে ওঠে মাঝেমধ্যে। অথবা মিথ্যা সত্য হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। জুনাব আলী মৃধার মনে পরছে তার পিতা তিনটা উপদেশ দিয়েছিল। বলেছিল মানুষের খাদ্য নিয়ে কোনোদিন দুই নম্বরি করবি না। খাদ্যের ব্যবসায় দুই নম্বরি আর মানুষেক বিষ খাওয়ানো একই অপরাধ। আর হোটেলে কুনোদিন ফিরিজ কিনবি না। ডেলি বাজার করবি ডেলি বিক্রি। নিজিরা সব কিছু খায়ে শ্যাষ করে ফেলবি না। খাওন একটু বাচায়ে রাখে পশুপাখিরে খাওয়াবি। এই দুনিয়ায় তাদেরও হক আছে। সেই থেকে প্রতিদিন খুব সকালে পাখিদের খাওয়ানো শুরু। একটা দুটো করে পাখি আসতে আসতে এখন সকালে শত শত পাখি এসে ভিড় করে। বিচিত্র সব পাখি। এই কংক্রিটের নগরে কোথায় থাকে কোন জায়গা থেকে আসে কেউ জানে না। কিন্তু কর্মচারীদের ঘুম ভাঙার আগেই ওরা এসে জড়ো হয়।
খবর এলো পরদিন বুলডোজার আসবে। যেভাবে একদিন বুলডোজার এসেছিলো ভোলাগ্রামে। হোটেলের কর্মচারিরা আর রিজিয়া খাতুন অসহায় ছুটোছুটি করলো। অনেকের হাতে পায়ে ধরলো। ক্ষমতাহীন ক্রন্দনে উজাড় করলো চারিদিক। কেউ ওদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। আর একরাত পর মিশিয়ে দেয়া হবে বহুবছর আগে জ্বলে ওঠা কাঠের উনুন। ধ্বংস হবে কালিমাখা টিনের চাল, চেয়ার টেবিল বেঞ্চ, সাইনবোর্ড, বড় লোকের এলাকায় গরিব মানুষের খাবার যোগান। বন্ধ হয়ে যাবে দেশের শেষ পাইস হোটেল।
আভিজাত্য গড়ে ওঠার পেছনে থাকে বঞ্চনার ইতিহাস। ঢাকা আরো বাড়বে। জুনাব আলীদের হয়তো আরো দূরে সরে যেতে হবে। গরিব হবে আরো গরিব। আরো অনেক গুলশান হবে নতুন নতুন নামে। আরো কিছু জুনাব আলী, জিয়াবুল মৃধা অথবা রিজিয়া খাতুন কাঁদবে। সেই কান্না সবাই দেখতে পায় না। না দেখার ভান করে।
সন্ধ্যা নেমে গেছে। ঝলমলে শপিংমলে রঙিন আলো জ্বলে উঠেছে এক এক করে। নতুন সাইনবোর্ড পরেছে। তার ওপর তিনটা পাখি এসে বসলো। অচেনা পাখি। দীর্ঘ দেহ। ঠিক যেমন ভোরবেলা যখন খাবার খেতে দিতো তখন আসতো। কলতান মুখর আহার শেষ করে উড়ে যেত দূরে।
ধীরে ধীরে অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে। কোলাহল ছাপানো আলোক রোশনাই চোখ ধাঁধাচ্ছে। কতগুলো মেশিন রেখে গেল একদল লোক। ট্রাক ভর্তি ইট আসছে। উচ্ছেদের পরই দেয়াল উঠবে। অচেনা যুবকদের সদর্প মহড়া। জুনাব আলী মৃধা ফিরে গেলো না তবু। একটু দূরে রাস্তার ধারে ফুটপাতে বসে আছে নিশ্চল। ঠায় তাকিয়ে নতুন সাইন বোর্ডটার দিকে। আগন্তুক পাখিগুলো লম্বা গলা উঁচু করে কথা বলছে। দূর থেকে কান পাতলো জুনাব আলী মৃধা। পাখিদের মুখে ঠিক যেন মানুষের মতো বুলি। কি বলছে তারা? আরো ভালো করে কান পাতলো সে। এতদূর থেকে সেই আলাপ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু মানুষের ভাষায় কথা বলছে। জুনাব আলী মৃধার ধন্দ লাগল। কান খাড়া করে শুনল আবার। হ্যাঁ ঠিক। ওই পাখিগুলো মানুষের ভাষায়ই কথা বলছে।
একবার, দুইবার, তিনবার শুনলো সে। তারপর বিড় বিড় করে বলল, আর মনে হয় টিকা গেল না। দুন্নিয়ার মানুষগুলানরে জানোয়ারগের মতো লাগতিছে আর পাখপাখালির মুখে ফুটতিছে মানষির বুলি? আর টিকতি পারলাম না।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন