আসাদ চৌধুরীর আলোচিত কবিতা

অ+ অ-

 

আসাদ চৌধুরী

বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত কবি, প্রাবন্ধিক ও উপস্থাপক। জন্ম ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে। তিনি ১৯৫৭ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর তিনি। অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে আসাদ চৌধুরীর চাকুরি জীবন শুরু। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ সাল নাগাদ শিক্ষকতা করেন। তারপর ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ভয়েজ অব জার্মানীর বাংলাদেশ সংবাদদাতা। ঢাকায় বাংলা একাডেমীতে দীর্ঘকাল চাকুরীর পর তিনি এর পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি মনোগ্রাহী টেলিভিশন উপস্থাপনা ও চমৎকার আবৃত্তির জন্যও জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ তবক দেওয়া পান [১৯৭৫]; বিত্ত নাই বেসাত নাই [১৯৭৬]; প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড় [১৯৭৬]; জলের মধ্যে লেখাজোখা [১৯৮২]; যে পারে পারুক [১৯৮৩]; মধ্য মাঠ থেকে [১৯৮৪]; মেঘের জুলুম পাখির জুলুম [১৯৮৫]; আমার কবিতা [১৯৮৫]; ভালোবাসার কবিতা [১৯৮৫]; প্রেমের কবিতা [১৯৮৫]; দুঃখীরা গল্প করে [১৯৮৭]; নদীও বিবস্ত্র হয় [১৯৯২]; কবিতা-সমগ্র [২০০২]; ঘরে ফেরা সোজা নয় [২০০৬]। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার [১৯৭৫]; বাংলা একাডেমী পুরস্কার [১৯৮৭]; শম্ভুগঞ্জ এনায়েতপুরী স্বর্ণপদক [১৯৯৯]; একুশে পদক [২০১৩]-সহ অসংখ্য সম্মাননা লাভ করেন। ২০২৩ সালে ৫ অক্টোবর তিনি ইহকাল ত্যাগ করেন। প্রয়াত কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতিধ্বনির পাঠকদের জন্য তাঁর আলোচিত কবিতাগুচ্ছ প্রকাশ করা হলো।

 

সত্য ফেরারী

কোথায় পালালো সত্য?
দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো
রেষ্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে,
গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,
টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে,
নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো!

গুড়ের কলসি, বিষের কৌটো,
চিনির বয়াম, বাজারের ব্যাগ,
সিগারেট কেস, পানের ডিব্বা,
জর্দার শিশি, লক্ষ্মীর সরা,
নকশী পাতিল, চৌকির তলা,
সবি খুঁজলাম, খুঁজে দেখলাম নেই তো!
সাংবাদিকের কাঠের ডেস্কে,
কাগজে, কেতাবে, পুঁথিতে, কলমে,
ইনজেকশনে, দাঁদের মলমে,
ভ্যানিটি ব্যাগে বা পকেটে, আঁচলে
ড্রয়ারে, ব্যাংকে, আয়রণ সেফে
সত্য নামক মহান বস্তু নেই তো!

কবিতায় নেই, সঙ্গীতে নেই
রমণীর চারু ভঙ্গিতে নেই
পাগলের গাঢ় প্রলাপেও নেই
নাটকের কোন সংলাপে নেই
শাসনেও নেই, ভাষণে নেই
আঁধারেও নেই, আলোতেও নেই
রেখাতেও নেই, লেখাতেও নেই,
উত্তরে নেই, প্রশ্নেও নেই
লেবাসে নেই, সিলেবাসে নেই
পারমিটে নেই, বোনাসেও নেই
হতাশায় নেই, আশাতেও নেই
প্রেম-প্রীতি ভালবাসাতেও নেই
এমন কি কালোবাজারেও নেই
কোথায় গেলেন সত্য?

 

তখন সত্যি মানুষ ছিলাম

নদীর জলে আগুন ছিলো
আগুন ছিলো বৃষ্টিতে
আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার
উদাস-করা দৃষ্টিতে।

আগুন ছিলো গানের সুরে
আগুন ছিলো কাব্যে,
মরার চোখে আগুন ছিলো
এ-কথা কে ভাববে?

কুকুর-বেড়াল থাবা হাঁকায়
ফোসে সাপের ফণা
শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায়
জ্বলে বালির কণা।

আগুন ছিলো মুক্তি সেনার
স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়-
প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে
কাঁপছিলো সব-অন্যায়।

এখন এ-সব স্বপ্নকথা
দূরের শোনা গল্প,
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম
এখন আছি অল্প।

 

শহীদদের প্রতি

তোমাদের যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ?
শেষ কথাটি সুখের ছিল?
ঘৃণার ছিল?
নাকি ক্রোধের,
প্রতিশোধের,
কোনটা ছিল?
নাকি কোনো সুখের
নাকি মনে তৃপ্তি ছিল
এই যাওয়াটাই সুখের।

তোমরা গেলে, বাতাস যেমন যায়
গভীর নদী যেমন বাঁকা
স্রোতটিকে লুকায়
যেমন পাখির ডানার ঝলক
গগনে মিলায়।
সাঁঝে যখন কোকিল ডাকে
কারনিসে কি ধুসর শাখে
বারুদেরই গন্ধস্মৃতি
ভুবন ফেলে ছেয়ে
ফুলের গন্ধ পরাজিত
স্লোগান আসে ধেয়ে।
তোমার যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ?

 

বারবারা বিডলারকে

|| এক ||

বারবারা,
ভিয়েতনামের উপর তোমার অনুভূতির তরজমা আমি পড়েছি
তোমার হৃদয়ের সুবাতাস
আমার গিলে-করা পাঞ্জাবিকে মিছিলে নামিয়েছিল
প্রাচ্যের নির্যাতিত মানুষগুলোর জন্যে অসীম দরদ ছিল সে লেখায়
আমি তোমার ওই একটি লেখাই পড়েছি
আশীর্বাদ করেছিলাম, তোমার সোনার দোয়াত কলম হোক।
আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে বারবারা, তুমি এখন কেমন আছ?
নিশ্চয়ই তুমি ডেট করতে শিখে গেছ।
গাউনের রঙ আর হ্যাট নিয়ে কি চায়ের টেবিলে মার সঙ্গে ঝগড়া হয়?
অনভ্যস্ত ব্রেসিয়ারের নিচে তোমার হৃদয়কে কি চিরদিন ঢেকে দিলে।
আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা।
তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়
বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো
ওটা একটা জল্লাদের ছবি
পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠাণ্ডা মাথায় সে হ্ত্যা করেছে
মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সে গলা টিপে হত্যা করেছে
অদ্ভুত জাদুকরকে দেখ
বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়।
দেশলাইয়ের বাক্সর মতো সহজে ভাঙে
গ্রন্থাগার, উপাসনালয়, ছাত্রাবাস,
মানুষের সাধ্যমতো ঘরবাড়ি
সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ফুলকে সে বুট জুতোয়
থেতলে দেয়।

 

|| দুই ||

টু উইমেন ছবিটা দেখেছ বারবারা?
গির্জার ধর্ষিতা সোফিয়া লোরেনকে দেখে নিশ্চয়ই কেঁদেছিলে
আমি কাঁদিনি, বুকটা শুধু খাঁ খাঁ করেছিল
সোফিয়া লোরেনকে পাঠিয়ে দিও বাংলাদেশে
তিরিশ হাজার রমণীর নির্মম অভিজ্ঞতা শুনে
তিনি শিউরে উঠবেন।
অভিধান থেকে নয়
আশি লক্ষ শরণার্থীর কাছে জেনে নাও, নির্বাসনের অর্থ কী
জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিওলা ডাকটিকেটে খোঁজ থাকবে না স্বাধীনতার
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাছে এসো
সাধু অ্যাবের মর্মর মূর্তিকে গণতন্ত্র আর মানবতার জন্য
মালির ঘামে ভেজা ফুলের তোড়া দিও না
নিহত লোকটি লজ্জায় ঘৃণায় আবার আত্মহত্যা করবে।

বারবারা এসো,
রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাই
বিবেকের জংধরা দরোজায় প্রবল করাঘাত করি
অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসে ক্রুদ্ধ হই, সংগঠিত হই
জল্লাদের শাণিত অস্ত্র
সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে,
দর্শন ও সাহিত্যকে হত্যা করার পূর্বে
এসো বারবারা বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে।