জাপানি কবি শুনতারো তানিকাওয়ার কবিতা

অ+ অ-

 

শুনতারো তানিকাওয়া

শুনতারো তানিকাওয়ার জন্ম ১৯৩১ সালে, জাপানের তোওকিয়োতে। তিনি জাপানের জীবিত কবিদের মধ্যে অতি-সৃষ্টিশীল এবং অন্যতম প্রধান। শতাধিক কাব্য রচনা করেছেন তিনি। ২০১৪ সালে তাঁর ষাটতম কবিতাগ্রন্থ ভবিষ্যতের শিশুরা প্রকাশিত হয়। আঠারো বছর বয়সে দার্শনিক পিতার দ্বারা জিজ্ঞাসিত হয়ে তিনি তাঁকে জানিয়ে দেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়ে, শুধু কবিতা লিখেই তিনি জীবনটা কাটাবেন। তাঁর পিতার নাম তেতসুজো তানিকাওয়া, যিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ এবং দার্শনিক। বুদ্ধবাদের সময় ধারণায় তানিকাওয়া প্রভাবিত। সময় প্রবহমাণ, আদিঅন্তহীন, রহস্যময়এই চিন্তা তাঁকে আক্রান্ত ও আচ্ছন্ন করে রাখে সদাই। যোগাযোগ-স্থাপনে কবিতার দায়কে স্বীকার করেও আঙ্গিক নিয়ে তিনি প্রচুর নিরীক্ষা চালান যা শেষাবধি রহস্যময়তার আভাসকে উদ্ভাসিত করে। তাঁর সবচেয়ে বিক্রিত ও জনপ্রিয় বই নিঃসঙ্গতার দুই বিলিয়ন আলোকবর্ষ। এছাড়াও ৬২ টি সনেটযেদিন আকাশ  থেকে হারিয়ে গেল পাখিরা, প্রেম-বিষয়ে প্রভৃতি তাঁর জনপ্রিয় কাব্য। তিনি শিশুদের জন্যও লিখেছেন। অধিবিদ্যা এবং আধা-আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার মিশেলে তাঁর লেখা ভিন্নতা পায়। সরল বাক্যে গভীর বোধ আর জীবন ও জাগতিক সত্যকে উন্মোচনে তিনি অনন্য। গীতিকাব্য, মহাকাব্য থেকে শুরু করে বর্ণনাত্মক গদ্যগন্ধি ও নিরীক্ষাধর্মী কবিতা লিখে জাপানি সাহিত্যে তিনি নিজের অবস্থানকে বিচিত্র ও বিশেষ  করে রেখেছেন। অনেক ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে। তিনি তোওকিয়োর উপকণ্ঠে বসবাস করছেন। তিন তিনটি বিয়ে এবং তালাক নিয়ে নিজ বাড়ির বিশাল পাঠকক্ষে তিনি তাঁর জীবনের ভ্রমণ চালিয়ে যান, পাঠকক্ষটিতে রয়েছে একটি জানালা যা দিয়ে মৃদু বাতাস আর ঝাপসা আলোকরশ্মি এসে এলিয়ে পড়ে। বাইরে ফুলের বাগান। কক্ষটির দেয়ালে তাঁর পিতামাতার একটি সেপিয়া-টোনড ছবি। এসবই যেন সময়ের এক আপেক্ষিক উপস্থাপনা, ঠিক তাঁর কবিতার মতো।

তাঁকে বলা হয় যুদ্ধোত্তর পর্বের কবি। মানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের কবি। তিনি নিজেও বলেছেন: পরাজয়ের পর জাপানিদের সব বিশ্বাসী মূল্যবোধ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেল। এটা ছিল আমাদের কাছে এক ধরনের ফাঁকা সময়, আর কেউই জানত না আসলে কীসে বিশ্বাস করতে হবে। তবে এই যুদ্ধোত্তর পর্বের কবি অভিধাটিও তাঁর জন্য আসলে খাটে না, কারণ  তানাকাওয়ার কবিতা ভাবপ্রধান, চিন্তনমূলক এবং আধ্যাত্মিকও। টু লিভ কবিতায় তিনি বেঁচে থাকার নানান সংজ্ঞার্থ অনুসন্ধান করেন এবং অবশেষে জানান যে, বেঁচে থাকা হলো, শয়তান যা-কিছু আমাদের ভিতরে লুকিয়ে রাখছে সম্ভবত তাকে খুঁজে বের করা। সমালোচকদের মতে তিনি গুহাবাসী সন্ন্যাসী নন, শিল্পের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা বিশাল। বিপুল কবিতা লেখা ছাড়াও তিনি নাটক লিখেছেন যা পরে পুরস্কৃত হয়েছে, হায়ায়ো মিয়াজাকির হাউলস মুভিং ক্যাসল-এর কাহিনি লিখেছেন, করেছেন মাদার গুজ এবং চার্লস সুলজ-এর পিনাটস-এর জাপানি অনুবাদ, যার জন্য শিশুসাহিত্যে অবদানস্বরূপ তিনি হান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্দেরসেন পুরস্কারও পেয়েছেন।

তানিকাওয়ার কবিতা ধ্রুপদি জাপানি বৈশিষ্ট্যকে সাঙ্গীভূত করেই পুরোমাত্রায় উদ্ভাসিত। প্রকৃতির যে গোপ্যতা তার প্রকাশে তিনি উন্মুখ। একসময় তানিকাওয়া ভাবতে ভালোবাসতেন যে  কবিতা হলো স্বর্গীয় প্রেরণা। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে এ ভাবনা দানা বাঁধে যে কবিতা আসলে মাটি থেকেই উৎকলিত হয়। এই নব্বই বছর বয়সে কবিতা প্রথমে একটি শব্দ বা পঙ্‌ক্তিচূর্ণ আকারে  ভোরবেলায় তাঁর কাছে আসে। শব্দরা বাইরের পৃথিবী থেকে এগিয়ে আসে আর তা কবিতা হয়ে ওঠে অন্তস্তলের ছোঁয়ায়। কিন্তু এই বয়সে কবিতা লেখা তাঁর কাছে হাস্যকর বলেই মনে হয়। সমালোচকেরা তাঁকে জাপানি কবিতার টি এস এলিয়ট বলে আখ্যায়িত করে থাকেন এজন্য যে তাঁর হাত ধরেই আধুনিক জাপানি কবিতা নব্যধারায় রূপায়িত হয়ে চলেছে। তাঁর এখনকার কবিতা বিমূর্ত, ছোটো আঙ্গিকের। জাপানি ভাষাই তাঁর একমাত্র আশ্রয়স্থল বললে মিথ্যা বলা হবে না একবর্ণও। তিনি বলেছেন: জাপানি ভাষাই আমার জমিন। একটি উদ্ভিদের মতো তাতেই আমার শিকড় প্রোথিত, জাপানি ভাষার পুষ্টি পেয়েই আমার পাতারা গজায়, ফুল ফোটে আর তা পরিণত হয় ফলে।

কবিতাগুলো Shuntaro Tanikawa: New Selected Poems, Translated by William I. Elliot and Kazuo Kawamura থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।

শুনতারো তানিকাওয়া © বিবিসির সৌজন্যে

 

চতুর্দশপদী ২৯

স্মৃতিগুলোকে টুকে রাখছি আমি।
পুরানো কল্পদৃশ্যগুলো সবই তো সুন্দর।
আমার আঙুলগুলোকে উষ্ণ করে তোলা শীতের সূর্যালোকও
এলিয়ে পড়েছে আজকের শূন্য চেয়ারটার ’পর। 

জানলার বাহির আর ভিতরের মাঝখানে
এক ফালি জগৎ ভেসে আছে।
আমি তাকে ধরতে গেলেই—
দ্রুত যে সরে যায় সুন্দর।

সবকিছুকেই স্থিরভাবে দেখি।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার মন নিঃশব্দে কথা কয়ে ওঠে
কিন্তু ভালোবাসা তাকে স্তব্ধ করে দেয়।
আজকের দিনটা তো ঘুরেফিরে আসে;
গতকাল এক অস্পষ্টতা;
আমি ভাবতেই পারছি না আগামীর রূপ।

 

চতুর্দশপদী ৩০

শব্দগুলোকে আর শান্তিতে থাকতে দেব না।
মাঝেমধ্যে তারা নিজেরাই হয়ে ওঠে লাজুক, আর
আমার ভিতরে, মরে যেতে চায়।
এমনটা ঘটে আমার প্রেমে পড়ার সময়টিতে।
অপরদিকে শান্তিময় এই জগতে
মানুষেরা, মানুষেরাই, বকবক করে যায়।
অধিকন্তু, সূর্য আর গাছপালা আর মেঘেরা
নিজ নিজ সৌন্দর্যে থাকে উদাসীন।
একটি দ্রুতগতির বিমান মানবিক অনুভূতির প্রতিরূপে উড়ে যায়।
যদিও নীলাকাশ যেন এক দৃশ্যপট,
বস্তুত ওখানে কিছুই নাই।
আমি খুব মৃদুস্বরে ডাকলেও
পৃথিবী রয়ে যায় নিরুত্তর।
ওইসব পাখিদের চেয়ে আমার শব্দরা নয় কিছু অন্যতর।

 

চতুর্দশপদী ৪৩

আকাশের উপচেপড়া আলোগুলোকে
আহরণ করছে মেঘেরা।
হাওয়া ফিসফিস করছে আমার কানে
আর  হঠাৎ করেই জেগে ওঠে বিশাল শূন্যতা।
ফিরে একজনকে দেখতে পাই।
নিরিবিলিভাবে পেছনে ফেলে-আসা  
আমার কথাগুলো মানুষেরা নিচ্ছে ভালোভাবেই।
চেয়ারে বসে-পড়ার মতোই পৃথিবীর ওপর বসে পড়ি 
মানুষেরা কুড়িয়ে নিচ্ছে পার্থিব ধ্বনিসমগ্র।
কিন্তু কোনো গোপন মর্মরধ্বনি আমারে করে না প্রণোদিত।

নির্মোহ বস্তুপুঞ্জ থেকে  
মাঝে মাঝে আমার কাছে জেগে ওঠে এক ধরনের
হাওয়ার মতো সুখ, আর 
যখন তা ঘটে তখন আবারও এখানেই  আমি রয়ে যাই।

 

চতুর্দশপদী ৫৬

জনবসতি থেকে দূরে এ পৃথিবী কি সামান্য এক নক্ষত্র নয়?
গোধূলি...
অলসমদির দাঁড়ানো এই পৃথিবী ,
যেনবা নিজেই ব্রীড়ানত।
এমনই মুহূর্তে
বস্তুসমূহের ডাকনামগুলো সংগ্রহ করি আমি
আর কোনো না কোনোভাবে 
আবারও নীরবতায়  ডুবে যাই।

দূরবর্তী সিঁটি, চ্যাঁচামেচি, হকারের
কথাবার্তা মাঝে মাঝে আমার গানের চেয়েও অধিক বিশ্বস্ততায় 
পৃথিবীকে ডেকে যায়।

সেসব মুহূর্তে গোধূলির মতো প্রগাঢ় আবিষ্টতা নিয়ে 
পৃথিবী তা শুনে যায়
আর ধ্বনিতে ধ্বনিতে নিজেকে পুনরায় প্রত্যয়িত করে চলে।

 

চতুর্দশপদী ৫৭

আমি যে গান গাই তার
জগৎটা আঘাতপ্রাপ্ত।
আমি চেষ্টা করি তারে গাইতে
কিন্তু সে নিশ্চুপই রয়ে যায়।
শব্দরা চিরকালের জন্য 
খোয়ানো অসহায় শিশু,
ঘনীভূত নীরবতার মাঝে
কম্পিত গঙ্গাফড়িঙের মতো 
বসে থাকে বস্তুর ওপরে।
তারা বস্তুর মধ্যে আশ্রয় নিতে চায় কিন্তু 
শব্দরা ভালোবাসে না জগৎকে।
তারা অভিশাপ দেয় আমাকে আর মরে যায়,
নক্ষত্র-উজ্জ্বল আকাশ তাদের ছিনতাই করে নেয়।
আমি বিক্রি করে চলি তাদের মৃতদেহ। 

 

চতুর্দশপদী ৫৮

দূরত্বই পর্বতকে পর্বত করে তোলে।
কাছ থেকে দেখলে
তারা আমার নিজের মতোই হয়ে পড়ে।
বিশাল দৃশ্যাবলি মানুষের পথকে থামিয়ে দেয়
আর আচ্ছন্নময় দূরত্বগুলো সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
ওইসব দূরত্বময়তাই মানুষকে 
নিজ নিজ মতো মানুষ করে তোলে।
যেহেতু মানুষও নিজের ভিতরে 
দূরত্বকে ধারণ করে রাখে,
সে কারণে তারা আকুলতা প্রকাশ করে বেড়ায়...
শীঘ্রই তারা জানতে পারবে যে 
তারা যেন শুধু দূরত্বের দ্বারা  লঙ্ঘিত কিছু জায়গা
যা কেউ দেখছে না এখন।  ‍

ভূমিকা ও অনুবাদ : কুমার চক্রবর্তী