অবসেশন
ফাল্গুন সন্ধ্যা, ছটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ। সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে, আজ পূর্ণিমা তাই চাঁদের অস্ফুট আলোয় অন্ধকারটা খুব বেশি জমাট বাঁধতে পারছে না। ছোট-বড় রাস্তাগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে, মাঝে মাঝে দুএকজন লোক আবছা অন্ধকারের মধ্যে এদিক ওদিক ঘোরা ফেরা করছে, কেউ কেউ এখানে সেখানে নিঃশব্দে বসে আছে অন্ধকারের মধ্যে গা ঢেকে। তাদের মধ্যে একজন পরী, আসল নাম মনে হয় এটা নয় কিন্তু এই অন্ধকারে যারা আসে তারা এই নামেই তাকে চেনে এমন কি এই এলাকার পুলিশও।
সন্ধ্যার এই দৃশ্যটা পরীর ভালোই লাগলো। আলো অন্ধকারের সঙ্গে আসন্ন সন্ধ্যার এই বিষাদময় দৃশ্য বেশ খাপ খেয়ে গেল। সন্ধ্যা তাঁর কাছে জীবিকার চাবি। সময় যত রাতের দিকে এগোবে সেই চাবি তত খাজানার সন্ধান দেবে। জীবনযুদ্ধে পরাজিত যারা, নারীর বঞ্চনা ও গ্লানি যারা গোপন করতে চায়, তারা এই ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যেই নির্জন গৃহকোণ থেকে বাইরের জগতে বেরিয়ে আসে—কারণ এসময় তাদের অপরিচ্ছন্ন পোষাক আর নৈরাশ্যম্লান মুখ একটা শরীর খুঁজে ফেরে একান্ত নিজের মতো যাকে ব্যবহার করা যায় অনুযোগহীন। অন্ধকারে যারা পায়চারি করছে তারা চায় অপরের কৌতুহলী দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে। তাই তারা বাদুড়ের মতো এই সন্ধ্যাবেলায় এসেছে, যখন পৃথিবী থেকে ঝকঝকে রোদ বিদায় নিয়েছে। রেলিঙের বাইরে আলো আর আনন্দের রাজ্য। ওই যে বড় বাড়িটার সারি সারি জানালা অন্ধকারের মধ্যে আলোয় ঝলমল করছে ওটা তাদেরই আস্তানা যারা জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করেছে—অন্তত পরাজয়ের বেদনা যাদের বিবাহিত বা অবিবাহিত জীবনকে বিদ্ধ করেনি। নির্জনে বসে পরী এমন নানান কথা ভাবতে থাকে। তাঁর মনের অবস্থা এখন এমন যে নিজেকে সে পরাজিতের দলের মনে করে। অর্থের অনটন যে তাঁর দুঃখের কারণ তা নয়। ইচ্ছে করলে সে ওই আলো ও আনন্দ-ভরা রাজপথে আর সকলের মতো বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে পারে। অর্থের সচ্ছলতা তাঁর আছে।
তার পাশে এক মধ্যবয়েসী ভদ্রলোক এসে বসলেন। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ না থাকলেও তাঁর মুখ দেখে মনে হয় যেন এককালে তাঁর যথেষ্ট তেজ ও আত্মসম্মানবোধ ছিল। তবে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে যুঝে এখন যেন তাঁর সে উগ্রতা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। তাঁর পোষাক-পরিচ্ছদ অপরিচ্ছন্ন বলা চলে না। অন্ততঃ সেই স্বল্পালোকের মধ্যে তাঁর ত্রুটি-বিচ্যুতি নজরে পরবার মতো নয়, তবে এটা ঠিক যে তাঁর পোষাক দেখে কেউই কল্পনা করতে পারবে না তিনি নিঃসন্দেহে তাদেরই একজন যাদের সঙ্গ ও সোর্হাদ্য কেউ আর কামনা করে না, সংসারে যাদের প্রয়োজন একান্তই ফুরিয়ে গিয়েছে।
ভদ্রলোটি যখন উঠে দাঁড়ালেন, তখন পরীর মনে হল, হয় তিনি ফিরে চলেছেন তাঁর ঘরে যেখানে তাঁর কোনো সমাদর নেই, আছে শুধু গঞ্জনা। ভদ্রলোকটি ধীরে ধীরে অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন এবং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁর জায়গাটি অধিকার করল পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক যুবক। পোষাকে তার পারিপাট্য আছে বটে, কিন্তু মুখখানা পূর্ববর্তী ভদ্রলোকের মতোই বিমর্ষ ও নিরানন্দ। দুনিয়ার উপর সে যে অত্যন্ত অপ্রসন্ন, বোধ করি এই ভাবটিকে ব্যক্ত করার জন্যই আগন্তুক আসন অধিকার করার সঙ্গে সঙ্গে একটা ক্রুদ্ধ স্বগতোক্তি করল। কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা থাকায় উক্তিটা আত্মগত হলেও পরীর কানে এসে পৌঁছল।
‘লাগবে নাকি ফুল নাইট, দিল খুশ করে দেবো,’ মৃদুস্বরে বলল পরী। এ অবস্থায় কিছু না বলা তাঁর কাছে নিতান্ত অপেশাদার বলে মনে হয়।
যুবকটি সরল দৃষ্টিতে তাঁর দিকে ফিরে তাকাল। ‘আমি যে অবস্থার মধ্যে পড়েছি, আপনার যদি সেই অবস্থা হতো, তাহলে বুঝতেন। আমি অত্যন্ত বোকার মতো কাজ করেছি—যা আমি জীবনে কোনদিন করিনি।’
‘ও’ পরী জবাব দিল নিতান্ত নির্বিকারভাবে।
‘আজ বিকেলে আমি এখানে এসেছি। কিছুক্ষণ আগে এখানকার ঠিকানা জানিয়ে বাড়িতে কল করেছি আর তার পরই বেরিয়ে এসেছি। সেখান থেকে বেরিয়ে খানিকক্ষণ আমি এদিক –ওদিক পায়চারি করেছি, ঘুরে ঘুরে নানান দোকানের জিনিসপত্র দেখছি এবং তারপর যখন হোটেলে ফিরব বলে মনস্থ করেছি তখন আমার খেয়াল হল যে, হোটেলের নামও আমার মনে নেই আর কোন রাস্তায় যে সেই হোটেল তাও ভুলে গেছি। সঙ্গে মোবাইল নিয়ে বের হইনি এদিকে হাতে টাকাকড়ি কিছুই নেই, মাত্র একটা পাঁচশত টাকার নোট নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়েছিলাম মদ্ খেয়ে তার প্রায় সবই খরচ হয়ে গেছে, আমি এখন রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি, রাতটা যে কোথায় কাটাবো তার ঠিক নেই।
গল্পটি শেষ করার পর যুবকটি থামল, কিন্তু পরক্ষণেই বেশ একটু উষ্মার সঙ্গে বললো, ‘আপনি হয়তো ভাবছেন, আমি নিশ্চয় একটা মিথ্যা কাহিনী বানিয়ে বানিয়ে বলছি, তাই না?’
‘না, মিথ্যা হবে কেন?’ গম্ভীরভাবে উত্তর দিল পরী।
পরীর কথায় যুবকটি যেন একটু উৎফুল্ল হয়ে উঠল, এমন কোনো সহৃদয় ভদ্রলোককে যদি পাই যিনি অদ্ভুত গল্পটা বিশ্বাস করে আমায় কিছু টাকা ধার দিতে রাজি হন, তবেই মঙ্গল—নয়তো সারা রাত আমায় রাস্তায় কাটাতে হবে নিশ্চয়। যাই হোক, আমি ভারি খুশি হয়েছি এজন্যে যে আপনি আমার গল্পটা একেবারে অসম্ভব মনে করেননি।
তার শেষের কথাটির মধ্যে আন্তরিকতার সুর ধ্বনিত হয়ে উঠল, যেন তার আশা পরী ওই সহৃদয়তাটুকু দেখাতে কুণ্ঠিত হবেন না নিশ্চয়ই।
পরীরও ইচ্ছে করছে তাঁর জমানো টাকা থেকে যুবককে কিছু টাকা দিতে কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে পড়ে এই টাকা তাকে মুক্তির পথ দেখাবে। তাঁর মায়ের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে কবেই, বছর খানেক হলো পুরুষদেরকে বাড়িতে আনা বন্ধ করেছে। বয়স পঞ্চাশ বা পঞ্চাশের বেশি হলে বড়শিতে গেঁথে তোলার মতো কোন পুরুষ পাওয়া যায় না। তাঁর মায়ের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে তার চেহারা সুঠাম, যদিও সে আর নিজেকে পুরুষের কাছে সঁপে দেওয়ার জন্য এখন আর তেমন সুন্দরী নয়। তাই তার রাতের চাকরি পরীর ওপর বর্তেছে। এই কাজটা করতে পরীর ভালো লাগে না তবুও মায়ের জন্য করতে হয় আর তাই পরী খুব করে চায় রাতের এই কাজটা ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে আর তাই কয়েকদিন পরে, পরী তাঁর মায়ের হাতে পাঁচ লাখেরও বেশি টাকা তুলে দেবে। তারপর তাঁর মুক্তি আর সে অন্ধকারে আসবে না। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মুক্তির পরে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে সোশিয়লোজি পরীক্ষায় বসবে।
মনে মনে এই কথা ভাবতে ভাবতে পরী উঠে দাঁড়ায়। এক হাজার ধার পেলে আপনার যদি উপকার হয়, আমি আপনাকে ওই টাকাটা—যুবকটি তাঁর কথাটা শেষ হবার আগেই তাড়াতাড়ি টাকাটা নিয়ে পকেটে পুরল।
‘এই আমার কার্ড—এতে আমার মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর দেয়া আছে,’ পরী প্রফুল্ল মুখে বলল, ‘এই সপ্তাহের মধ্যে যে-কোনো দিন ফেরত দিলেই চলবে...
‘আপনি যে আমাকে বিশ্বাস করে এই টাকাটা দিয়ে সহযোগিতা করলেন এ আমার পরম সৌভাগ্য,’ যুবকটি বলল। তারপর আবেগঘন কণ্ঠে সংক্ষেপে ধন্যবাদ জানিয়ে সোজা পার্কের ফটকের দিকে এগিয়ে চলল।
‘বেচারা ভারি মুষড়ে পড়েছিল,’ মনে মনে বলল পরী, ‘টাকাটা পেয়ে এ যাত্রা বেঁচে গেল।
—এই সারা রাতের জন্য যাবে? এক মাঝ বয়সী যুবকের কথায় পরীর ঘোর কাটে।
—হ্যাঁ যাবো।
—রেট কত?
—কয়জন?
—দুই জন।
—দশ হাজার।
—পাঁচ হাজার।
অনেক দরাদরির পরে সাত হাজারে রফা হয় পরীর সাথে। পরী যখন কোথায় যেতে হবে জানতে চায় মাঝ বয়সী যুবক আঙুল তুলে যা বলে পরী অবাক হয়। সারা জীবন সে যা ভেবেছে এমনকি খানিক আগেও সে যা ভেবেছে তা ভুল যুবকটি তাকে রেলিঙের বাইরে আলো আর আনন্দের রাজ্যের যে বড় বাড়িটার সারি সারি জানালা অন্ধকারের মধ্যেও আলোয় ঝলমল করে সেই বাড়িতে যাবার কথা বলছে। মনে মনে কথাগুলো ভাবলেও মুখে কিছু না বলে পিছু পিছু হাঁটতে থাকে পরী।
ঘটনার সাহায্যে কোনো কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া যে কত অন্যায় তা আজ বুঝতে পারে পরী। মাঝ বয়সী যুবক বাড়ির সদর দরজা দিয়ে পরীকে নিয়ে যখন ঢুকছে দেয়ালে চোখ পড়ে পরীর যেখানে বিশাল প্রমাণ সাইজ এক ছবিতে হুবহু সেই যুবক যাকে খানিক আগেই টাকা ধার দিয়েছে পরী। পরী থেমে ছবিটা খুব ভাল করে দেখতে ছবির কাছে এগিয়ে যায়।
আরে থামলে কেন? মাঝ বয়সী যুবক কথাটা শেষ করে একটা হাসি দেয়, আরে জলদি ভেতরে এসো ছবিতে যাকে দেখে থেমে গেছো সে এই বাড়ির মালিক, বাইরে গেছে মদ আনতে এখনই এসে পড়বে। সারা রাত তো তোমার সাথে আমরা দুজনই থাকবো।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন