নাজমার অনিশ্চিত যাত্রা
দ্বিতীয় স্বামীর সাথে ঘর ভেঙে যাবার পর ঘরের খালি খালি ভাব দূর করতে নতুন একজন মানুষ ঘরে আনতে এবং ছেলেকে ঘরে বেঁধে রাখতে নাজমা তার পনেরো বছরের ছেলেটাকে বিয়ে দিয়ে দেয় ভাইয়ের চোদ্দ বছরের মেয়েটার সঙ্গে। সাত বছর আগে নাজমার প্রথম স্বামী অন্য এক মহিলার সাথে চলে যাবার পাঁচ বছর পর নাজমা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল। মেসের যেসব ড্রাইভারদের জন্য সে ভাত রেঁধে দিত সেখানেই থাকতো ভ্যানচালক আজগর। রান্নাবান্নার ফাঁকেফোকরে মাঝে মধ্যে আজগরের সাথে দুচারটা সুখ-দুঃখের কথাবার্তা হতো, আজগর বলতো তার বউয়ের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার কথা, আর নাজমা বলতো তার তার স্বামী হারানোর ব্যথা। এই করতে করতে দুজন অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়ে, এবং এক সময় বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়; কিন্তু, সৎ বাপকে দুচোখে দেখতে পারে না নাইমুল। মাকে সে যা-তা বলে গালাগালি করে যখনতখন, এবং যতটা পারে বাইরে বাইরে থাকে। অল্প বয়সেই পোলাটা কুসঙ্গ এবং নেশার খপ্পরে পড়ে। অন্যদিকে আজগরও নাইমুলকে সহ্য করতে পারে না। স্বামী ও সন্তানের এমন সাপে-নেউলে সম্পর্কে নাজমা দিশাহারা হয়ে পড়ে। বারবারই তার মনে হয়, বিয়েটা না করলেই তার ভালো হতো; কিন্তু, নিজের বুকের ভেতর যে তার কেমন খালি খালি লাগছিল এ-কথা সে কাউকে বোঝাতে পারে না।
অল্প বয়সেই নাজমার প্রথম বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, বিয়ের পর পরই ছেলে হলো, ছেলে তরতরিয়ে বড় হয়ে গেলেও নাজমা এখনো বুড়ি হয়ে যায় নাই, তাই যৌবনধর্মের স্বভাববশতই বিয়েটা না করে তার উপায় ছিল না। দুবছর পর আজগর তার আগের স্ত্রীর কাছে চলে যাবার পর নাজমা এই দিক দিয়ে অন্তত সান্ত্বনা পেয়েছিল যে, এবার বোধহয় তার ছেলেটা ঘরে ফিরবে। কিন্তু বাইরের দুনিয়ায় মজা পেয়ে যাওয়াতে ছেলের মন আর ঘরে বসে না। পরিচিত একজনকে বলেকয়ে বড় এক মুদির দোকানে নাজমা ছেলেটাকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল; কিন্তু, কদিন বাদে বাদেই সে শুনে পোলার নাকি কাজেকর্মে মন নাই, ফাঁক পেলেই সে পালায়। ছেলেকে বিয়ে না করিয়ে দিয়ে নাজমার তখন উপায় থাকে না।
কিন্তু ভাইয়ের মেয়ে পুত্রবধু হয়ে ঘরে আসার পর দেখা দেয় অন্য সমস্যা। পুত্রবধু জানতে পারে শাশুড়ি মানুষের বাড়ি কাজ করে, সে জানতো তার ফুফু বা শাশুড়ি একটা অফিসে আয়ার কাজ করে, তাতেও তার একটু মান ছিল; সেটাও নাজমা করে বটে, তবে, সন্ধ্যার পর এক ম্যাডামের বাসায় সে রান্না করে দেয়; এতেই পুত্রবধুর ইজ্জতে লাগে; সারাক্ষণ সে মুখভার করে থাকে এবং ঘরের কোনো কাজেই হাত লাগায় না। এতে নাজমার কিছু আসে-যায় না; সে-ই কাজ করে ছেলে ও ছেলের বউকে খাওয়ায়; তবুও, ছেলেটা ঘরে থাকে তাতেই তার মন ভরে যায়; কিন্তু, এই সমাধানও স্থায়ী হয় না। সামান্য ঝগড়ার কারণে পুত্রবধু বাপের বাড়ি চলে যায়। এতে করে ছেলের ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দৌড় বাড়ে। ভাইকে বুঝিয়েও নাজমা ভাইয়ের মেয়েকে তার নিজের বাড়ি আনতে পারে না। বরং ছেলেটাকেই ভাই কব্জা করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক আড়তে ছেলেটাকে কাজে লাগিয়ে দেয়।
এর মধ্যে ছেলের ঘরে ছেলে হয়। নাতির মুখ দেখতে নাজমাকেও ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া দৌড়াতে হয় মাসে দুচারবার। চাকরি ও ম্যাডামের বাসায় রান্না করে সে কুলিয়ে উঠতে পারে না। শুক্রবার দিনটাই তার ছুটি। বৃহস্পতিবার রাতে বি.বাড়িয়ার ট্রেনে উঠে শেষরাতে তাকে পৌঁছাতে হয় ভাইয়ের বাড়ি। এতে ভাই, ভাইয়ের বউ, ছেলে, ছেলের বউয়ের মুখ কালো দেখতে হয়। তবে, নাতির হাসিমুখ দেখলে নাজমার কলিজা জুড়িয়ে যায়।
এই দৌড়ঝাঁপের মধ্যেই নাজমা তার দ্বিতীয় স্বামীকে ঘরে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। আজগর তার প্রথম স্ত্রীর কাছে চলে যাবার পরও কাগজে-কলমে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়নি। তাই নাজমার মনে আশা ঝুলে থাকে, যদি কোনোরকমে হাতে-পায়ে ধরে আজগরকে আবার ফিরিয়ে আনা যায়।
কিন্তু, আজগরের খোঁজ সে পাবে কোথায়? একশবার মোবাইলে কল করলে আজগর দয়া করে দুএকবার ধরে, কল ধরেই যা মুখে আসে তা-ই গালাগাল করে, ‘খানকি মাগী, চোদানি মাগী, বারবার ফোন চোদাস কী জন্যে? তোরে কইছি না তোরে নিয়া আর ঘর করুম না। তাও জ্বালাইতাছস কী জন্যে! বোদার মধ্যে খাওজানি হইছে! খাওজানি অইলে কুত্তা দিয়া চোদা। আমারে আর কল করছস তো চুতমারানি, তোর বোদার মধ্যে বাঁশ ভইরা দিমু।’
আজগর কল কেটে দেয়। তাও নাজমা কল করেই যায়, করেই যায়। কল করা ছাড়া তার আর কী-ইবা করার আছে?
এর মধ্যে আজগরের খোঁজ পায় এক পরিচিত ভ্যানচালকের কাছে। আজগরকে নাকি নারায়ণগঞ্জে চাষাড়া মোড়ে দেখা গেছে এক পিঠাওয়ালীর লগে। এক বুধবার সন্ধ্যায় অফিস সেরে ম্যাডামের বাসায় যাওয়া বাদ দিয়ে নারায়ণগঞ্জ যায় নাজমা। চাষাড়া মোড়ে চারটা ঘুরান দিয়ে আজগরকে সে পেয়ে যায়, পিঠাওয়ালীর কোলের কাছে বসে চিতই পিঠা খাচ্ছে। পিঠাওয়ালী যে আজগরের পয়লা বউ এটা বুঝতে নাজমার সময় লাগে না। মাগীর শইলে কিচ্ছু নাই, বুক-পিঠ শুকাইয়া কাঠ হইয়া গেছে, তাও মাগী আজগররে আবার ফিরিয়ে আনল কী জাদু কইরা!
পিঠাওয়ালীর সামনে নাজমা যায় না। দূরে দাঁড়িয়ে আজগরকে খেয়াল করে। ঘন্টাখানেক পরে আজগর উঠে পাশের দোকানে সিগারেট আনতে গেলে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তাকে দেখে আজগর তেমন অবাক হয় না, মুখ খিঁচিয়ে গাল দিয়ে বলে, ‘খানকী মাগী, এত বড় সাহস তোর! এইখানেই আইছস কী জন্যে!’
নাজমা শান্ত সুরে বলে, ‘ঘরে যদি না ফিরো কেইস কইরা দিমু। কাবিনের এক লাখ টেকা শোধ দিতে হইব কইলাম।’
আজগরের ভাবান্তর হয় না। মুখ খিঁচিয়েই বলে, ‘কী বাল ফালাইবি ফালা গিয়া।’
কেইস করার আগে পরের সপ্তাহে নাজমা আরো তিনবার চাষাড়া যায়। একবার আজগরের দেখা পায়, আরেকবার আজগরের পয়লা বউয়ের মুখোমুখি গিয়েই দাঁড়ায়, আজগরের পয়লা বউ নাজমাকে চিতই পিঠা খেতে দিয়ে বলে, ‘শম্পার বাপের আশা তুমি ছাইড়া দেও, বইন। পোলাপাইন বড় হইছে, উনি পোলাপাইনের কাছে ফিরা আইছে। তোমার ঘরে তো আর ওনার বালবাচ্চা নাই, কী দিয়া ধইরা রাখবা?’
ভালো উপদেশ বটে। কিন্তু, উপদেশে নাজমার পেট ও মন ভরে না। কদিন সে নাতির মুখও দেখতে যায় না। ঘর-সংসার না, শরীর-মনের টানও না, একলা লাগার হাত থেকে বাঁচতেই নাজমা ঠিক কী করবে বুঝতে পারে না। আজগর যে আর ফিরে আসবে না এটা সে বুঝতে পারে, কিন্তু, হারামজাদাকে তো এমনি এমনি ছাইড়া দেওন যায় না।
নাজমা থানায় গিয়ে জিডি করে। তিনদিন পর ওয়ারি থানা থেকে ফোন আসে, নাজমাকে সন্ধ্যার পর থানায় যেতে বলা হয়, এও বলা হয় আজগরকেও খবর দেয়া হয়েছে, সেও আসবে। আজগর তার প্রথম স্ত্রীকে নিয়ে আসে। পুলিশের সামনে আজগর কথা দেয় এক মাসের মধ্যে সে কাবিনের এক লাখ টাকা দিবে এবং নাজমাকে তালাক দিবে।
নাজমার জয় হয়। কিন্তু, এমন জয় তো সে চায়নি। নাজমার মনটা মরে যায়। কদিনের জন্য একলা একলা লাগার অনুভূতিটাও তার মধ্য থেকে চলে যায়। দিন-রাত চোখমুখ বুঁজে সে কাজ করে। ম্যাডামের বাড়ি থেকে রাত দশটায় এসে সে রিকশা-ভ্যানচালকদের মেসের ভাত-তরকারি রেঁধে দেয়। তাতে কোনো কোনোদিন রাত একটা-দেড়টা বেজে যায়। নিজের জন্য আর রান্না করতে হয় না। হয় ম্যাডামের বাসা থেকে খেয়ে আসে, বা মেসেই দুলোকমা খেয়ে নেয়। খাওয়া-পরা নিয়ে তার চিন্তা করতে হয় না। নাজমা জানে যদ্দিন শরীরে শক্তি আছে, সে টিকে থাকবে।
মাঝে মাঝে ছেলে ফোন করে, কী করো, মা? আছো কেমন? আসো না অনেকদিন।
নাজমা আর আগের মতো সোহাগ-আহ্লাদ দেখায় না। নিজের মনে পাথর বেঁধে চুপ থাকে।
মাস তিনেক যায় এভাবে। এর মধ্যে আজগরের সাথে নাজমার ভালোয় ভালোয় ছাড়াছাড়িও হয়ে যায়, নগদ এক লাখ টাকাও সে হাতে পেয়ে যায়। আজগর তাকে এক লাখ টাকা দিয়ে দিল, এটা নাজমার মানে লাগে এই কারণে, তাও তার সাথে ঘর করল না, কেন? ওই মাগীর মধ্যে সে কী পেল!
এর মধ্যে আরেক রিকশাচালকের সাথে নাজমার একটু সখ্যতা গড়ে ওঠে। এই রিকশাড্রাইভার মোসাদ্দেক আজগরকে ভালোভাবেই চিনত, সবই সে জানে, তার বউবাচ্চা থাকে গ্রামে, সে-ই নাজমার প্রতি আগ্রহী হয়, নানা সুযোগে নাজমার সাথে রস-মস্করা করে, নাজমা বুঝতে পারে বিছানায় নেবার ধান্ধা। মেয়ে হয়ে আরেক মেয়ের ঘর ভাঙতে চায় না বলে নাজমা হাসিমুখেই মোসাদ্দেক মিয়াকে শাসন করে, ‘বাড়ি যান ড্রাইভার সাব। বউবাচ্চা পথ চাইয়া রইছে না?’
মোসাদ্দক মিয়া বুক কাঁপায়, ‘বাড়ি কি আর আছে গো? বাড়ি থাকলে কি আর না যাই?’
‘কী হইল বাড়ির? শুনছি আপনের বউ-পোলাপাইন আছে। পোলা না ইস্কুলে পড়ে কইছিলেন।’
‘তা পড়ে। মাসে মাসে টেকা পাঠাই তাতেই চইলা যায়। বউয়ের উপ্রে আমার মন নাই, আমার উপ্রেও বউয়ের মন নাই।’
এবার বুক কাঁপায় নাজমা, ‘ক্যান মানুষের উপ্রে মানুষের মন উইঠা যায়, ড্রাইভার সাব?’
‘শইলে টানে না, হ্যাছা কইরা কইতে কি, আমার বউয়ের শইলে আর আমারে টানে না।’
এর মানে যে নাজমার শরীর তাকে টানছে, এটা নাজমা বুঝতে পারে। অফিসে আয়ার কাজ ও ম্যাডামের বাসায় বুয়ার কাজ করলেও, নাতি হয়ে গেলেও নাজমাকে এখনো ভালো দেখায়। ম্যাডামের দেয়া পুরনো জামাকাপড় পরে সে। দীর্ঘদিন শহরে থাকার কারণে ম্যাডামদের মতো চলাচল ও কথাবার্তাও সে শিখেছে কিছু কিছু। আবার নতুন একটা সম্পর্কে জড়ানো যায় কি না এটাও নাজমা ভাবে মাঝে মাঝে। নিজের আজান্তেই মোসাদ্দেকের সাথে সে কিছু ছলাকলা শুরু করে। মেসে যায় ভালো জামা পরে, যাবার আগে চুলটা বেঁধে দেয়, মুখে একটু স্নো-পাওডার দেয়, ঠোঁটে একটু লিপস্টিক দেয়, তাতেই মোসাদ্দেক কেমন পাগল হয়ে পড়ে, প্রায় প্রতিদিনই নাজমা যাওয়ামাত্রই সে মেসে ফিরে আসে। নানা ছুতোয় রান্নাঘরে এসে উঁকি দেয়। নানা ছুতোয় গায়ের লগে একটু গা লাগিয়ে দেয়। নাজমাও সুযোগটা দেয়, একরাতে সে বুক দিয়ে ইচ্ছে করেই ঘষা দিয়ে দেয় মোসাদ্দেকের পিঠে, তাতে মোসাদ্দেক একেবারে দিশাহারা হয়ে পড়ে।
এক বিকেলে মোসাদ্দেক নাজমাকে রিকশায় ঘুরাতে নিয়ে যায়। তখন শীত গিয়ে বসন্ত এসেছে। ফুরফুরে বাতাস। মোসাদ্দেক নাজমাকে মান্ডা নিয়ে যায় চটপটি খাওয়াতে। মান্ডার ওদিকটাতে এখনো অনেক খোলামেলা জায়গা, নিরিবিলি। রাতে ফেরার পথে রাস্তার পাশে রিকশা থামিয়ে মোসাদ্দেক সিটে ওঠে আসে, নাজমাকে চুমো খায়, বুক হাতায়, কাকুতিমিনতি করে বলে, ‘নাজমাকে না পেলে সে মরে যাবে।’
‘আজ না, আরেকদিন, আরেকদিন,’ বলে নাজমা সপ্তাহ পার করে দেয়। এর মধ্যে একদিন ছেলে এসে উপস্থিত। খুশিতে নাজমা কী করবে না করবে বুঝতে পারে না। ছেলেকে গরুর গোস্ত এনে খাওয়ায়, পোলাও রেঁধে খাওয়ায়, জিন্সের প্যান্ট কিনে দেয়, মতিঝিল মোড় থেকে কেড্স কিনে দেয়, ছেলে যেরকম চায় সেরকম রঙচঙা শার্ট-গেঞ্জি কিনে দেয়, নাতির জন্য যা মন চায় কিনে ফেলে, বউয়ের জন্যও দুটো থ্রিপিস কিনে, ভাই-ভাবীর জন্যও কিছু কেনাকাটা করে, ছেলেকে বলে, বৃহস্পতিবার রাতে ছেলেকে নিয়ে সে বি.বাড়িয়া যাবে। নাতিকে দেখে আসবে।
দুদিন থাকবে বলে এসে ছেলে চারদিন থাকে। পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করে। আজগর ফোন দিলেও নাজমা না ধরার চেষ্টা করে। মেসের রান্না সেরে তাড়াতাড়িই ঘরে ফেরার চেষ্টা করে। আজগরকে বোঝায়, ‘পোলা আইছে, কয়েকটা দিন একটু সামলাইয়া চলেন ড্রাইভার সাব।’
তিনদিনের মাথায় ছেলের মুখ গম্ভীর দেখায়। চারদিনের দিন একরাতে মেস থেকে ফেরার পথে মেসাদ্দেক নাজমার পিছু নেয়। কিছুটা পথ এগিয়ে দিতে চায়। নাজমা যতই মোসাদ্দেকের কাছ থেকে সরে গিয়ে দূরে দূরে হাঁটতে চেষ্টা করে মোসাদ্দেক ততই শরীরের ওপর এসে পড়ে। মোড়ের কাছে আসতেই নাজমা দেখে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মোসাদ্দেক পিছু ফিরে চলে যায়। নাজমা ছেলের দিকে এগিয়ে যায়। ছেলে মাকে বলে, ‘খানকী মাগী, ছিনালী করার স্বভাব তোর এখনো যায় নাই?’
ছেলের জন্য, ছেলের বউয়ের জন্য, ছেলের ছেলের জন্য, ছেলের শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য যা কেনাকাটা হয়েছিল তা না নিয়েই ছেলে চলে যায়। নাজমা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ না করেই বিছানায় পড়ে থাকে। পরদিন সে অফিসে যায় না। দুপুরবেলা নাজমার মোবাইলে একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে, নাজমা কল ধরতেই ও-প্রান্ত থেকে এক অসহায় নারী কণ্ঠ মিনমিন করে বলে, ‘আপনে নাজমাবু কইতাছেন?’
‘হ। আপনে কে?’
‘বুবু গো, বুবু, আমি আপনের পায়ে পড়ি, আপনে ওনার কাছ থাইকা সইরা যান। আমার সংসারটা ভাইঙ্গেন না। আপনে আমার মার পেটের বইন লাগেন।’
নাজমার বুঝতে বাকি থাকে না কে? নাজমা চুপ। ওপাশের নারী কাঁদতে থাকে, ‘আমি যে আপনেরে ফোন করছি এইটা ওনারে কইয়েন না। তয় উনি বাড়ি আসব না। আসলেও আমারে মারব। আপনে ওনার কাছ থাইকা সইরা যান, তয় উনি বাড়ি আসব। বুবু গো, বুবু। আমার ছোট ছোট দুইটা ছেলেমেয়ে। আমি এদের নিয়া অহন কই যাব?’
তার পরদিনও নাজমা ঘর থেকে বেরোয় না। অফিস থেকে ফোন আসে, ম্যাডামে ফোন করে, মোসাদ্দেক ফোন করে, নাজমা কারো ফোনই ধরে না। মোবাইলটা বন্ধ করে রাখে। দুদিন না খেয়ে বিছানায় পড়ে থেকে নাজমা যে কী ভাবে আর কী ভাবে না তা সে নিজেও জানে না। একলা লাগার যে-অনুভূতিটা কদিন চলে গিয়েছিল তা-ই আবার ফিরে আসে কয়েকশগুণ শক্তি নিয়ে। সারাজীবনের সব কথা তার একসাথে মনে পড়তে থাকে। তার ছোটবেলার কথা, বাপের কথা, মার কথা, ভাইয়ের কথা, বইনের কথা, দুটো সংসারের কথা, ছেলেটার কথা, আদরের ধন নাতনিটার কথা, কচি মুখটার কথা মনে হলেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
বৃহস্পতিবার ব্যাংকে গিয়ে নাজমা পঞ্চাশ হাজার টাকা ওঠায়। একাউন্টে খোঁজ নিয়ে দেখে তার আরো সাত লাখ টাকা জমা আছে। মনে শক্তি পায় নাজমা। এই সাত লাখ টাকা দিয়ে যা খুশি তা-ই করতে পারে। একটা দোকান দিলেও তার বাকি জীবন চলে যাবে।
ব্যাংক থেকে বেরিয়ে হীরাঝিল হোটেলে ঢুকে নাজমা ভরপেট কাচ্চি খায়। কাচ্চি খেয়ে একটা ফালুদা খায়। ঘরে এসে জরুরি জিনিশপত্র, কাপড়চোপড় একটা বড় ব্যাগে আর বস্তায় ভরে। চকিটা আর হাড়িপাতিলগুলো দিয়ে দেয় পাশের ঘরের লতার মাকে। লতার মা খুশি হলেও দু্একবার জিজ্ঞেস করে, ‘কী হইছে? কই যাও তুমি?’
নাজমা বলে, ‘কই যাই জানি না। বাইচা থাকলে দেখা হইব, বইন।’
সন্ধ্যাবেলা গিয়ে নাজমা বরিশালের লঞ্চে উঠে বসে। বরিশাল তার কেউ থাকে না। কেউ থাকে না বলেই নাজমা বরিশাল যাচ্ছে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন