বর্ণমালা ও কৃষ্ণচূড়ার গান

অ+ অ-

 

অদৃশ্য শূন্য চরাচরে বসন্তের আদর্শ বাতাস বইছে আজ। ফাল্গুনের উৎসব কেন্দ্র করে বিপনি বিতানগুলো পোশাকে বাসন্তীরঙ প্রাধান্য দিয়ে পসরা সাজিয়েছে। আর এ শহরের মানুষগুলোও একটা ছল-ছুতো পেলেই আদেখলা হয়ে ওঠে...।

ভাবী ফাল্গুনের শাড়ি কোত্থেকে কিনলেন? বাচ্চাদের পোশাক?

—‘অঞ্জন’ থেকে ভাবী; বাচ্চাদের জন্য ‘ইয়েলো’ থেকে।

আমি ‘আড়ং’ প্রেফার করি, ওদের কালার কম্বিনেশন, ম্যাটেরিয়াল সব সময় আনকমন...। দোকানগুলো ব্যবসার জন্য এখন ঈদ, পূজা ছাড়াও নানা উৎসবের ছল-ছুতো খোঁজে...।  

‘আড়ং’ আর ‘ইউনিকোড’ শপিংমলের রচিত অঢেল আলো এ এলাকা থেকে দিন ও রাতের পার্থক্য ঘাড় ধাক্কা মেরে তাড়িয়েছে। ঝলমলে আলোর তোড়ে বোঝার উপায় নাই, সময়টা দিন না রাত। রফিক বারবার বাসায় পৌঁছে দেবার কথা বলছিলো; পাত্তা দিইনি: দূর, এটুকু মাত্র পথ, চেনা এরিয়া! দেরি হলে তুমি মিরপুরে যাবার গাড়িটাড়ি কিচ্ছু পাবা না। ও আমার সাথে না পেরে হাল ছেড়ে নিজের গন্তব্যের দিকে চলে যায়। পপুলার পার হয়ে ওভারব্রিজে উঠবো কী উঠবো না এ ভাবনায় দোদুল্যমান ছিলাম, তখন সিটি কলেজের উল্টো দিকের রেকর্ডিং-এর দোকানে লাউড স্পিকারে বাজা একটা গান সঙ্গ নেয় আমার। বসন্ত বাতাসে সইগো বসন্ত বাতাসে...। গান এবং বিপনি বিতানের আলো ধরাধরি করে ওভারব্রিজে উঠিয়ে দেয় আমাকে। ব্রিজটা এ মাথা ও মাথায় অনেকটা দীর্ঘ। কুছ পরোয়া নেহি মনোভাবে, বাজতে থাকা গানের সুর ও উজ্জ্বল আলোর সাহসে রাত ১০টা হলেও এ শীত রাতে সাইন্সল্যাবের ওভার ব্রিজে রাস্তা পার হবার সিন্ধান্ত পাক্কা করে ফেলি। ব্রিজ পার হয়ে সিঁড়ির গোড়ায় প্রিয়াঙ্গনের পিঠেই আমার বাসা। কিছুটা পথ হেঁটে ডানে বাঁক নিতে হয়। আইসিসিবিআইআরের ভেতর জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকা কদম, কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো ওভারব্রিজের পূবদিকের কোণায় ডালপালা বাড়িয়ে রাখে সব সময়। বৃক্ষগুলো ফুল ফোটানো ছাড়াও রাস্তার গাড়ি-ঘোড়া, যানজট, ওভারব্রিজে বসে থাকা ভিখারি আর পথচারীদের কোলাহল পছন্দ করে। এখন কৃষ্ণচূড়ার দিন। স্পষ্ট আলোয় ফুটে থাকা থোক থোক লালফুলের রূপে দৃষ্টি না দিয়ে উপায় থাকে না। ওদের লাল রঙে চোখ রাখতেই চিরল পাতা ছাপিয়ে উজিয়ে থাকা পুষ্পদল বাতাসকে টলকে না দিয়ে ফিসফিস করে আমাকে বলে : আমরা ফুটেছি সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত আর নাম না জানা সকল ভাষা শহীদের জন্য...। কৃষ্ণচূড়ার কাণ্ডমাণ্ডে শামসুর রাহমান না এসে পারেন না। সৌম্য সৌন্দর্যে তিনি এসে আমার সঙ্গ নেন। যুগল গলায় আমরা আবৃত্তি করি:

আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে কেমন নিবিড় হয়ে।

কখনো মিছিলে কখনো-বা

একা হেঁটে যেতে মনে হয় ফুল নয়, ওরা

শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতি গন্ধে ভরপুর...

মন আবৃত্তিতে থিতু হতে না হতেই ব্রিজের নিচের সারি বাঁধা দোকানের হলুদ, বাসন্তী পোশাক পরিচ্ছদের পসরা ঠা ঠা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে: বসন্ত এসে গেছে, বাতাসে বহিছে প্রেম নয়নে লাগিল নেশা...। ওদের হাসি সম্ভবত কবির পছন্দ হয় না। আমার অনবধানে তিনি কখন যে অন্তর্নিহিত হলেন টের পাই না। কাল ২১শে ফেব্রয়ারি। প্রভাত ফেরির মিছিলে গলায় গলায় সেই পবিত্র গান আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১শে ফেব্রুয়ারি গাওয়া হবে।

আজকাল প্রভাতফেরির মিছিলে যাবারও আয়োজন আছে। রমনীদের কেউ কেউ বিনুনিতে গাজরা, বেলী জড়ায়, সাদা কালো ব্র্যাণ্ডের মিহি কারুকাজ করা সৌখিন পাঞ্জাবি পরা নবীন যুবক, কী মধ্যবয়সী যুবা-নারী কবরীর নানাবিধ নান্দনিক সজ্জায় মুগ্ধ হয়। ২১-এর শোক তখন একুশের সুখ এ পরিণত হয়।

ধানমন্ডি ১ নং সড়ক, যেটা সাইন্সল্যাবের পুলিশ বক্স পার হয়ে, ‘আড়ং’, ‘সিটি কলেজ’ পেছনে রেখে পশ্চিমদিকে গেছে সেটার নাম ভাষা সৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক। অনেকে এ নামে রাস্তাটাকে চেনে না। রেলিং টপকে চোখের দৃষ্টি সেখানে পাঠাতে চাইলে দৃষ্টি পরাভব হয়ে ফিরে আসে। ওভার ব্রিজের ওদিকে একজন মা তিন ছানাপোনা নিয়ে ভিক্ষা করে। সারাদিনই ওদের সংসার সেখানে। আসার পথে দেখলাম ছোট বাচ্চাদুটো ঘুমিয়ে গেছে। বড়মেয়েটা কী নিয়ে যেন মায়ের সাথে ঘ্যান ঘ্যান করছে। হয়তো রাতের খাবার জোটেনি...। অফিস যাওয়ার রোজকার পথ এটা। বাসা-অফিস কাছাকাছি হওয়ায় হেঁটে যাওয়া-আসায় এপথ, আর জড়িয়ে থাকা পথের মানুষেরা মুখস্ত আমার। পুলিশ বক্সের লাগোয়া মার্কেটের সিঁড়ির গোঁড়ায় একজন অন্ধ ভিখিরি বসে। জ্যোতিহীন চোখ ছাড়াও ওর আছে অদ্ভুত সুরেলা কণ্ঠ। নানা ধরনের গজল গেয়ে পথচারীদের আকৃষ্ট করে সে। এখানে সবাই চেনে ওকে। খিরাজ নেয়া মাস্তানগুলো পর্যন্ত চাঁদা তোলার সময় গজলের প্রশংসা করে। একদিন দেখলাম ওদের একজন খুচরা একমুঠ টাকা নিতে নিতে ভিখিরিকে—‘নূরের নবী মোস্তফা/ রাস্তা দিয়া হাইট্টা যায় গজলটা শোনাবার অনুরোধ করছে। তাড়া না থাকায় গজল শোনার লোভে আমি খুব ধীর গতিতে হাঁটছিলাম। মীরের কাজগুলো এ-তো সূক্ষ্ণ! প্রাণ-মন সে সুরে টুপটুপ ভরে ওঠে। যদিও খুব ইচ্ছে করছিলো চাঁদাবাজটাকে ওর টাকাগুলো ফেরত দেবার কথা বলি। গজলের কথা আর সুরের কারুকাজে এতোটাই আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম যে রাস্তা পার হয়ে দেখি বাসার গেটে চলে এসেছি। সেও ভালো। আমার অনুরোধ রাখতো নাকি চাঁদাবাজ বদমাশটা! একদিন দেখি ভিখিরি বড় মেয়েটা ওভারব্রিজের ঝুলন্ত টবের গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে নিচে ছুঁড়ে মারছে। মাতবর গোছের জনৈক পথচারী কষে ধমক লাগালে ৬/৭ বছরের মেয়েটা কান্না গিলে তুতলিয়ে কোনরকমে বলে: আমি শইদ মিনারে ফুল দিতাছি...। কৌতূহলী হয়ে জানতে চাই: এখানে শহীদ মিনার কই পাইলা তুমি? ও আঙ্গুল তুলে সড়কের ফলকটা দেখায়: ঐ যে। হয়তো কেউ ওর সামনে এ ফলক নিয়ে কোনদিন কথা বলেছে, হয়তো সে খেলতে গেছে ওখানে, কেউ নিষেধ করেছে ভাষা সৈনিকের স্মারক ফলকে না খেলতে। ভাসমান জীবনের এ আঙিনাটা ইতোমধ্যে, ও আপন ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে..., হতে পারে মায়ের সাথে ভিক্ষা করতে করতে কোনদিন শহীদ মিনারে ফুল দেয়া দেখেছে মেয়েটা। তবু তো ভালো একটা কিছু শিখেছে। অফিসের পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাবনায় সেদিন মেয়েটার কথাগুলোই খনন করতে থাকি; শিশুটি যে ফলকে ফুল দিয়েছে তাতো ওঁর প্রাপ্য। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ডা. গোলাম মাওলার বলিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। তিনি শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কই ছিলেন না, ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার তৈরির রূপকার। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র মিছিলে গুলিবর্ষণের পর ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী কৌশল নির্ধারণের জন্য আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ রাতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে একসাথে হোন। সে মিটিংয়ে নতুন গঠিত ছাত্র সংগ্রাম কমিটির নতুন আহ্বায়ক করা হয় ডা. মাওলাকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনের যেখানে ছাত্র মিছিলে জান্তারা গুলি করে সে জায়গায় ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে গোলাম মাওলার নেতৃত্বে প্রথম শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়। আমরা বাঙালি সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় ফাগুন উৎসব করবো, সে ঠিক আছে, কিন্তু উৎসবের তোড়ে মাতৃভাষার ইতিহাসকে ভাসিয়ে দেব এ ভাবে! আমার বিভোর ভাবনার ঘোরে ফোনের রিং টোন ঢুকে পড়ে টুংটাং। প্রিয় নামটা ঝলমল করছে স্ক্রিনে। ফোন রিসিভ করতেই ও পাশের গলা অনর্গল খুলে যায়: এখনও ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে আছো! বাস, সিএনজি কিচ্ছু পাচ্ছি না। তুমি কালো ব্যাজগুলো নিতে ভুলে গেছো। বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে প্যাকেটটা আবিষ্কার করলাম, ওটা আমার কাছেই রয়ে গেছে। দেবার জন্য আবার ব্যাক করে ওভারব্রিজে উঠে দেখি তুমি দাঁড়িয়ে আছো। ভাবছিলাম পেছন থেকে চমকে দেব। কিন্তু ভয় পাবে বলে এ চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে, ফোন দিলাম...। আমি পেছনে ফিরে দেখি রফিক দাঁড়িয়ে মিটমিট হাসছে। ওর দিকে হেঁটে যাই: প্যাকেট দেবার জন্য যে আসলা, বাসায় যেতে দেরি হয়ে যাবে না? আজ আর বাসায় ফিরবো না, ভাবছি, হলে বন্ধুদের কারো সাথে থেকে যাবো। রফিকের কথার জবাবে বলি: বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়ায় এখন ঢুকতে পারবা না। রাত বারোটা এক মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শহীদ মিনারে ফুল দেবেন। ভার্সিটিতে ঢোকার সব রাস্তা বন্ধ। রফিক পাত্তা দেয় না: আরে ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। প্যাকেটটা বরং আমার কাছে থাক। আমি সবার কাছে প্রভাত ফেরির আগে এগুলো পোঁছে দেব। বান্না ভাইকে দিলে হলের মেয়েরাও পেয়ে যাবে। ওর যুক্তি পছন্দ হয় আমার। বাংলা বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রছাত্রীরা এবার বিভাগের সব ইয়ারের জন্য প্রভাত ফেরিতে পরার জন্য কালো ব্যাচ সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছি। আমি রফিককে কৃঞ্চচূড়া ফুলের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করি: দেখ কত কৃঞ্চচূড়া ফুটেছে! ওভারব্রিজের নীচে মিরপুর রোডে কয়েকটা পিকনিক ফেরত বাস যাচ্ছে। লাউড স্পিকারে তুমুল শব্দে বাজছে ধুমধারাক্কা হিন্দি গান...। নির্জন রাস্তা বিজাতীয় শব্দ, সুরের অত্যাচারে নরক হয়ে ওঠে মুহূর্তে। বিকট শব্দ দূষণ দুর্বিসহ ওঠে। রফিকের চোখ ক্ষোভে, দুঃখে জ্বলে ওঠে: জান সঙ্গিতা, প্রাণের ভাষাকে স্বৈরশাসকদের কব্জা থেকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছি বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে গুলিটা লেগেছিল ঠিক আমার মাথার খুলি বরাবর। রফিকের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠি। গলগল করে রক্ত পড়ছে ওর মাথা থেকে। রফিকের মাথা, মুখ, বুক রক্তের ধারায় ডুবে যাচ্ছে। ভিখিরি মেয়েটা দৌড়ে আসে। ওর হাতে ফুল: আমি শইদের লাগি ফুল আনছি...। তখনই নজরে পড়ে ব্রিজের পশ্চিম দিকের সিঁড়ি বেয়ে হেঁটে আসা এক ভদ্রলোকের দিকে। লাইটের উজ্বল আলোয় তাঁর চশমা পরা অবয়ব চিনতে অসুবিধা হয় না। ভাষা সৈনিক ডা. গোলাম মাওলা। গোলাম মাওলার তর্জনী ধরে হাঁটছে শিশু মেয়েটা। বিভ্রমে পড়ি, মুহূর্ত আগেও মেয়েটা এখানে এসেছিল ফুল নিয়ে! গোলাম মাওলা বালিকাকে কোলে তুলে নেন। রফিকের রক্তাক্ত (কিংবা সালামের, জব্বারের, শফিউরের) দেহ এখনও ওভারব্রিজের পাটাতনে পড়ে আছে। শোকাকুল আমি, নিচু হয়ে আঁচলে রফিকের মুখের রক্ত মুছে শনাক্তকারির ভূমিকা পালন করি:

তুমি কি রফিক?

বরকত তুমি?

নাকি জব্বার?

তুমি সালাম?

শফিউর?

আমার কথার প্রত্যুত্তোর না দিয়ে শুয়ে থাকে ও। ভয় লাগে আমার, তীব্র ভয়। ফেব্রুয়ারির নির্জন বিষাদ মাখা রাতের ওজন আর বহন করতে পারছি না। কুচি কুচি ঘামের ফোটা জড়ো হয়ে সমস্ত দেহ ভিজিয়ে দেয়। সাইন্সল্যাবের ট্রাফিক বিহীন সিগনালে তখন একটা ট্রাক এসে থামে। শিশুটি হাত তালি দিয়ে ওঠেকী সুন্দর! ওর আনন্দ উদযাপনের ভঙ্গি আবার টেনে দাঁড় করায় আমাকে। তাকিয়ে থাকি, ট্রাকের পাটাতনে ইট দিয়ে নির্মিত হচ্ছে একটি মিনার। ড. গোলাম মাাওলাকে সেখানে নিবিড় তৎপর দেখি। তাঁকে সাহায্য করছে আরও কিছু কর্মী হাত। সাইন্সল্যাবের কৃষ্ণচড়া গাছগুলোও বুজরুগি কিছু কম দেখায় না। বৃক্ষের সব ফুল পাখির চঞ্চলতায় উড়াল দিয়ে মিনারের স্তম্ভগুলোকে পুষ্পহারের মতো জড়িয়ে ধরে। কৃষ্ণচূড়ার লাল ঔজ্জ্বল্যে হেসে ওঠে শহীদ মিনারটি। তবু বিষণ্নতা কাটে না আমার। রফিক এখনও নিথর শুয়ে আছে। ওর নীরবতা শোকাভিভূত করে তোলে আমাকে। ছোট শিশুটি ফ্রকের কুচি উড়িয়ে দৌড়ে আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে: কিসের ডর! আমি আছি না! প্রসন্ন চোখে মিনারের দিকে তাকিয়ে থাকে শিশুটি: কী সোন্দর শইদ মিনার! ওকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরি: কী নাম তোমার? আমার হাত জড়িয়ে শিশুটি অপার্থিব হাসে: আমি বর্ণ, বর্ণমালা। এ সময় সাইন্সল্যাবের নির্জনতা ফালাফালা করে আরো একটা ট্রাক ছুটে আসে। ট্রাফিক সিগনাল মানে না, থামে না। কিন্তু ছড়িয়ে দিয়ে যায় সেই মহান সুরের ধারা। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি...! ফাল্গুনের দামাল বাতাস সুরের এ পবিত্র বাণী নিয়ে উড্ডীয়মান হয়। হাওয়ার তীব্র স্রোত সে সুরের বানী ঠেলে দেয় উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম; বাংলাদেশের সমস্ত প্রান্তরে...।

উষ্ণ স্পর্শে সম্বিত ফিরে পাই; রফিক হাত ধরে আমার: চলো, অনেক রাত হয়ে গেছে। কাল আবার ভোর ভোর বের হতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি বর্ণমালা ব্রিজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। শ্যামল অবয়ব জুড়ে কী মায়া মাখানো! ওর সাদা ফ্রকের জমিনে কালো কালিতে লেখা অক্ষরগুলো মধ্যরাতেও সূর্যের মতো জ্বলছে।