লাল কাঁথা

অ+ অ-

 

বুড়িমা রোজ বিকেলে নাতনিকে নিয়ে শেলি আন্টির বাসায় আসেন। কোন কোন দিন তিনি আসতে না চাইলেও নাতনির জোরের কারণে যেতে হয়। বুড়িমার একমাত্র ছেলের মেয়ে জয়া, দেখতে বেশ আদরি হয়েছে। বয়স বছর চারে পড়েছে। সকালে ছেলে আর ছেলের বৌ দুজনে চাকরিতে চলে যায়। বৌ চাকরি করে গার্মেন্টসে, তাই খুব সকালে চলে যেতে হয়, তখন জয়া ঘুমে থাকে। মাকে একেবারে রাতেই পায় কাছে, মা যাবার ঘণ্টাখানিক পর বাবাও চলে যায় গ্লাস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে। আর তাই সারাদিন এই দাদিকেই কাছে পায়, দাদির উপর তার সব আবদার বাহানা। দাদি তাকে স্নান করিয়ে দেয়, খাইয়ে দেয় আর বিকেল হলে শেলি আন্টির বাসায় নিয়ে যায়। আর শেলি আন্টির বাসায় গেলে জয়া খুব খুশি হয়ে যায়। শেলি আন্টিকে তার খুব ভাল লাগে। তাকে নানান রকম খেলনা দেয়, কত কিছু খেতে দেয়, যেন তার আবদার সব বুঝে। তাই শেলি আন্টির বাসায় জয়া রোজ আসতে পারলে খুশি, কিন্তু রোজ রোজ বুড়িমার পক্ষে আনা নেয়া সম্ভব না।

শেলি আন্টির বাসা থেকে জয়াদের বাসা খুব দূর নয়, জয়াদের বাসার পেছনে দুটো বিল্ডিং ফেলে এর ভেতরের ছোটগলি আছে, গলির শেষ মাথায় শেলি আন্টির বাসা। পাঁচতলা বাড়িটার নিচতলায় থাকেন। একদিন বুড়িমা ওই দিক দিয়ে যাচ্ছিলেন, আর তখন শেলি আন্টি ঘরের পাশে নিজের ছোট টপের গাছের পরিচর্যা করছিলেন। প্রায় সবি ফুলের গাছজবা, মরিচ, সন্ধ্যামালতী আরো কত কি! শেলি আন্টির ফুল গাছের পরিচর্যা দেখে বুড়িমার ভাল লাগল, তারপর আলাপ করলেন। এইভাবে মাঝে মাঝে আলাপে একসময় শেলি আন্টির বাসায় আসা যাওয়া। মাঝে মাঝে বুড়িমা গ্রামের বাড়ি থেকে সবজি ফল নিয়ে আনেন। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায়। তিনি আসার সময় শেলি আন্টির জন্য অনেক কিছু নিয়ে আনেন।

শেলি আন্টির এক ছেলে এক মেয়ে, দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। যখন ছেলেমেয়েরা বাসায় থাকে না, তাই শেলি আন্টির বাসায় প্রায় একা কাটে ঘরের কাজকর্ম করেই। জয়াকে সবাই পছন্দ করে চঞ্চলা দুষ্টু মেয়েটি আদরের বেশ। শেলি আন্টির মেয়ে পারুল জয়ার জন্য চকলেট আনে, চিপস এনে দেয়। জয়া আরো খুশি হয়ে যায়। সেদিন শেলি আন্টির ছেলে জয়ার গালটা ধরে খুব আদর করলো। জয়া কদাচিৎ দেখে তাকিয়ে থাকে কারণ শেলি আন্টির ছেলের তেমন দেখা পাওয়া যায় না। কখনো কখনো রুমে গিয়ে জিনিস ধরে দুষ্টামি করে। তবে পারুলের সঙ্গে তার খুব ভাব হয়ে যায়। একবার বেশ কয়েক দিন বুড়িমার দেখা নেই, কিছুদিন পর শেলি আন্টির তাই বাজার থেকে আসার সময় বুড়িমার ঘরে গেলেন। দরজা খুললেন বুড়িমার ছেলেটা, এর আগেও ছেলের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা হয়ছিল। বেশ রোগাটে, বেঁটে আর হাসিখুশি স্বভাবের। 

কেমন আছেন দিদি?শেলি আন্টি হেসে বিনিময় করে ভেতরে গেলেন। সামনের রুমে বুড়িমার বিছানায় থেকে উঠে শেলি আন্টিকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। অনেক দিন বুড়িমাকে না দেখার কথা বলতেই পরিমল বলে, আমার মেয়ের বেশ জ্বর কয়েকদিন ধরে। তাই বের হয়নি দিদি।

বাইরের রুমের বিছানায় শুয়ে জয়া আন্টির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। আন্টি হেসে জয়ার গালে কপালে হাত রাখলেন,জ্বর তো প্রায় সেরে গেছে মনে হয়। কয়েকদিন ধরে জ্বর কাশিতে সে বেশ দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। ওর মা আজ নাকি গার্মেন্টসে গেছে দুদিন ছুটি কাটিয়ে।

এদিকে আবার ছুটি বেশি নিলে বেতন কেটে ফেলে। শেলি আন্টি জয়ার কপালে হাত রেখে চুমু খেল আদরে। এরপর বুড়িমার সঙ্গে আড্ডায় মেতে গেলেন। বুড়িমার ছেলে বেরিয়ে গেলেন কাজে। জয়াদের ঘরখানা বেশ ছোট, দুই রুমের ঘর, একটা ড্রয়িং রুম, আরেকটা ভেতরে বেডরুম, এটা সামনের কক্ষ থেকে একটু বড়। এর সাথে রান্নাঘর আর টয়লেট। উপরে টিনের চাল, আশেপাশে আরো ঘর আছে পাশাপাশি। শেলি আন্টি আরো কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর বাসায় ফিরে গেলেন। বুড়িমার মনটা বেশ ভাল লাগলো যেন জয়ারও অসুখ ভাবটা অনেক কেটে গেল। শরীরে কিছুটা দুর্বলতা থাকলেও তার মধ্যে হালকা চাঞ্চল্য ছন্দ দেখা গেল। জয়া  হাসছে আর খেলছে পুতুলটা হাতে নিয়ে। শেলি আন্টির সঙ্গে যতবার দেখা হতো জয়াকে কিছু না কিছু কিনে দিতেন এটা-ওটা। এতদিনে শেলি আন্টি বুড়িমাকে নিজের মায়ের মতো মনে করে, বুড়িমাও তাকে মেয়ের মতো করে আদর করে।

একদিন বুড়িমার ছেলে পোলাও, মাছ, মাংস, বিভিন্ন সবজিসহ খাবারের অনেক আয়োজন করে, শেলি আন্টিসহ তার পুরো পরিবারকে দাওয়াত করে আনে। সেদিন জয়ার জন্মদিন ছিল। জয়াও বেশ খুশি। বুড়িমার আত্মীয় স্বজন তেমন চট্টগ্রামে নেই, সবাই চট্টগ্রামের বাইরে তাই বলবার মতো এখানে তেমন কেউ ছিল না। এই ছোট্ট আয়োজনে শেলি আন্টির ছেলেমেয়েসহ সবাই অংশগ্রহণ করে। জয়া বেশ খুশি নতুন জামা পড়েছে কেক কেটেছে। এসব দেখে শেলি আন্টি জয়ার বাবাকে বলে, এতকিছু করার কি দরকার ছিলো! এমনিতে তোমার ছোট চাকরি! জয়ার মাও সেদিন সব রান্না করেছিল। আর সেদিনই প্রথম জয়ার মায়ের সঙ্গে প্রথম আলাপ হলো। তিনি শান্ত মনের মেয়ে, কথাবার্তায় বেশ লজ্জাবোধ করছিলেন।

সেদিনের পর থেকে প্রায় বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল বুড়িমাও অনেকদিন আসে না। পারুলকে বাসায় গিয়ে একবার খোঁজ নিতে বলে। পারুল মাকে এসে বলেন, ওরা সবাই গ্রামে চলে গেছে। পাশের বাসার মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করাতে পারুলকে বলল, বুড়িমা স্ট্রোক করেছেন এখানে দুদিন হসপিটালে ছিলেন, এরপর ওনাকে দ্রুত গ্রামে নিয়ে চলে গেলেন। শেলি আন্টির মনটা ভীষণ বিষণ্ন হয়ে গেল খবরটা শুনে। এতকিছু হয়ে গেল তিনি জানেন না কিছু, অথচ বাসার কাছেই থাকেন! অবশ্য জানবেই বা কি করে! পরিমলের ফোন নাম্বারটা তো নেয়া হয়নি। আর কয়েকদিনে ওদিকটাও তেমন যাওয়া হয়নি তাহলে অন্তত কিছু খবর হলেও জানা যেত। এখন কেমন আছেন তিনি? কে জানে, জয়া কি করছে?

পারুলকে জিজ্ঞেস করলো আর কিছু জানে নাকি। কিন্তু আর কোন খবর পেল না। জয়ার মা বাবা তো চলে আসার কথা ওদের চাকরি আছে না! মহিলাটি বলেছিল গত সপ্তাহে গিয়েছিল গ্রামে, তার মানে ৫ দিন গেল, আজ তো মঙ্গলবার যদি ওরা শুক্রবারে গিয়ে থাকে। তিনি খোদার কাছে দোয়া চাইলেন, আজকের নামাজে বুড়িমার জন্য সুস্থতা কামনা করলেন। তার কিছুই ভাল লাগছিলো না। বুড়িমার জন্য খারাপ বোধ হচ্ছে খুব। আরো দুদিন চলে গেল। জামাল সাহেব এতদিন কিছু জানতেন না আজকে পারুলের কাছ থেকে বিষয়টি জেনেছেন, তিনি অবশ্য বুড়িমাকে দু-একবার দেখেছিলেন মাত্র, যেহেতু সবসময় তো বাসার বাইরে থাকতে হয়। সেদিন দাওয়াতে যেতে পারেননি কাজের চাপে। শেলি আন্টির ঘুম হয় না সারাদিন উদ্বিগ্নে থাকেন।

বুড়িমা তাকে অনেক কথা শেয়ার করতেন, সেসময়ের তার সংসারের দিনগুলোর কথা কথা শেয়ার করতেন, তার যৌথ পরিবারের অনেক জনের কথা, তার যৌবনের সময়গুলো মন খুলে বলতেন। শেলি আন্টি এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যান। তার ছেলেও খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেছে, বাসায় গিয়ে দেখে তালা। কারো কাছ থেকে নাম্বারও পেল না। ঘরের বাইরে ফুল গাছে সন্ধ্যামালতী ফুটেছে, শেলি আন্টি দাঁড়িয়ে আছেন। পাশের বাসার দিদিটি তুলসী গাছে প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন। এখন সন্ধ্যার আরতি শুরু করবে। শেলি আন্টি ফুলগুলো ছিঁড়ে উনাকে দিলেন আর বললেন, দিদি বুড়িমার জন্য প্রার্থনা করবেন বেশি বেশি করে। উনার চোখে কাঁদো কাঁদো চোখ রেখে কথাটি বললেন।

দুদিন পর গলির মুখে হঠাৎ করে দেখা পরিমলের সঙ্গে শেলি আন্টির। তার মুখটা একেবারে কাহিল অবস্থা, কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। সে শেলি আন্টির বাসার দিকেই যাচ্ছিল। বলল,দিদি, আমার মা আমাদের দুনিয়া ছেড়ে থেকে চলে গেলেন চিরতরে। একটা প্যাকেট শেলি আন্টির হাতে দিলেন, বুড়িমা যখন অসুস্থ হয়ে গ্রামে চলে গেলেন তখন ছেলেকে বলেছিলেন এই প্যাকেটটা উনাকে দিতে। কি আছে এই প্যাকেটে? বুড়িমার ছেলে জানেন না। জয়া নাকি খুব মন খারাপ করে থাকে, দাদিকে চোখে দেখছে না, কাছে পায় না। ওরা আগামি মাসে বাসাটা ছেড়ে দিচ্ছে। জয়ার মা চাকরিটা আর করবে না গ্রামেই থাকবে। কেবল বুড়িমার ছেলে এখানে কোথাও মেসে থেকে চাকরি করবে। মাসে মাসে বাড়ি যাবে। এসব বলে চলে গেল তৎক্ষণাৎ সে। তাকে বাসায় আসতে বলেছিল, কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে তার ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে।

শেলি আন্টি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন। চোখের কোণে জলের রেখা উঠল। বারান্দার জবা ফুলের চারাটি আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। বাসায় ফিরে প্যাকেটটা খুলে দেখলেন একটি লাল রঙয়ের কাঁথা, পুরোটায় বিভিন্ন গ্রাম বাংলার নকশা করা, সেখানে অনেক রকমের ছবিও আঁকা আছেগ্রামের মহিলাদের ছবি, বয়স্ক বুড়ো-বুড়িদের ছবি, ফুলের ছবি আরো কত কি! শেলি আন্টি লাল কাঁথাটি বুকে জড়িয়ে ধরে বাতিটা নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন।