সুকুমার রায়ের আলোচিত কবিতা

অ+ অ-

 

সুকুমার রায়

সুকুমার রায় [১৮৮৭-১৯২৩] একজন বাঙালি সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও চিত্রশিল্পী। ভারতীয় সাহিত্যে ননসেন্স্ রাইমের প্রবর্তক। তিনি জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সন্তান। তার মা বিধুমুখী দেবী ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম প্রতিনিধি দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। পড়াশোনা কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায়। পরে মুদ্রণ বিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে বিলেতে যান। কালক্রমে তিনি ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার বিলেত থেকে ফেরার কিছুদিন পর উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর সুকুমার সন্দেশ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। সেখানেই তার সাহিত্যের নবযুগের সূচনা হয়। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে সুকুমার চৌধুরীর মৃত্যু বরণ হয়। কিন্তৃ তার লেখা শুদ্ধ বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও সম্মানের দাবিদার। বলা হয়, বাংলা শিশু সাহিত্যের স্বর্ণযুগের সূত্রপাত হয় সুকুমারের হাতেই। মৃত্যুর একশ বছর পরও তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম সাহিত্যিকদের একজন। প্রতিধ্বনি কিংবদন্তি এই লেখকের আলোচিত কিছু কবিতা প্রকাশ করছে, যা আজকের সমাজ বাস্তবতায় সমান আবেদন বহন করছে।   

 

|| একুশে আইন ||

শিবঠাকুরের আপন দেশে,
আইন কানুন সর্বনেশে!
কেউ যদি যায় পিছলে প’ড়ে,
প্যায়দা এসে পাকড়ে ধরে,
কাজির কাছে হয় বিচার—
        একুশ টাকা দণ্ড তার।।
সেথায় সন্ধে ছটার আগে
হাঁচতে হলে টিকিট লাগে
হাঁচলে পরে বিন্ টিকিটে
দম্‌দলমাদম্ লাগায় পিঠে,
কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে—
        একুশ দফা হাচিয়ে মারে।।
কারুর যদি দাতটি নড়ে,
চার্টি টাকা মাশুল ধরে,
কারুর যদি গোঁফ গজায়,
একশো আনা ট্যাক্সো চায়—
খুঁচিয়ে পিঠে গুঁজিয়ে ঘাড়,
        সেলাম ঠোকায় একুশ বার।।
চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়
এদিক্ ওদিক্ ডাইনে বাঁয়,
রাজার কাছে খবর ছোটে,
পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে,
দুপুরে রোদে ঘামিয়ে তায়—
        একুশ হাতা জল গেলায়।।
যে সব লোকে পদ্য লেখে,
তাদের ধরে খাঁচায় রেখে,
কানের কাছে নানান্ সুরে
নামতা শোনায় একশো উড়ে,
সামনে রেখে মুদীর খাতা—
        হিসেব কষায় একুশ পাতা।।
হঠাৎ সেথায় রাত দুপুরে
নাক ডাকালে ঘুমের ঘোরে,
অম্‌নি তেড়ে মাথায় ঘষে,
গোবর গুলে বেলের কষে,
একুশটি পাক ঘুরিয়ে তাকে—
        একুশ ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখে।।

 

|| মূর্খ মাছি ||

মাকড়সা 
          সান্-বাঁধা মোর আঙিনাতে 
          জাল বুনেছি কালকে রাতে, 
          ঝুল ঝেড়ে সব সাফ করেছি বাসা। 
          আয় না মাছি আমার ঘরে, 
          আরাম পাবি বসলে পরে, 
          ফরাশ পাতা দেখবি কেমন খাসা! 

মাছি 
          থাক্ থাক্ থাক্ আর বলে না, 
          আন্ কথাতে মন গলে না— 
          ব্যবসা তোমার সবার আছে জানা। 
          ঢুক্‌লে তোমার জালের ঘেরে 
          কেউ কোনদিন আর কি ফেরে? 
          বাপ্‌রে! সেথায় ঢুক্‌তে মোদের মানা। 

মাকড়সা 
           হাওয়ায় দোলে জালের দোলা 
           চারদিকে তার জান্লা খোলা 
           আপ্‌নি ঘুমে চোখ যে আসে জুড়ে! 
           আয় না হেথা হাত পা ধুয়ে 
           পাখ্না মুড়ে থাক্ না শুয়ে— 
           ভন্ ভন্ ভন্ মরবি কেন উড়ে? 

মাছি 
           কাজ নেই মোর দোলায় দুলে, 
           কোথায় তোমার কথায় ভুলে 
           প্রাণটা নিয়ে টান্ পড়ে ভাই শেষে। 
           তোমার ঘরে ঘুম যদি পায় 
           সে ঘুম কভু ভাঙবে না হায়— 
           সে ঘুম নাকি এমন সর্বনেশে! 

মাকড়সা 
           মিথ্যে কেন ভাবিস্ মনে? 
           দেখ্ না এসে ঘরের কোণে 
           ভাঁড়ার ভরা খাবার আছে কত! 
           দে-টাপাটপ ফেলবি মুখে 
           নাচ্‌বি গাবি থাক্‌বি সুখে 
           ভাবনা ভুলে বাদ্শা-রাজার মতো। 

মাছি 
           লোভ দেখালেই ভুলবে ভবি, 
           ভাবছ আমায় তেমনি লোভী! 
           মিথ্যে দাদা ভোলাও কেন খালি, 
           করব কি ছাই ভাড়ার দেখে? 
           প্রণাম করি আড়াল থেকে— 
           আজকে তোমার সেই গুড়ে ভাই বালি। 

মাকড়সা 
           নধর কালো বদন ভরে 
           রূপ যে কত উপচে পড়ে! 
           অবাক দেখি মুকুটমালা শিরে! 
           হাজার চোখে মানিক জ্বলে! 
           ইন্দ্রধনু পাখার তলে! 
           ছয় পা ফেলে আয় না দেখি ধীরে। 

মাছি 
           মন ফুর্ফুর্ ফুর্তি নাচে— 
           একটুখানি যাই না কাছে! 
           যাই যাই যাই—বাপ্‌রে একি বাঁধা। 
           ও দাদা ভাই রক্ষে কর! 
           ফাঁদ পাতা এ কেমন তরো। 
           পড়ে হাত পা হল বাঁধা। 

 

|| খাই খাই ||

খাই খাই করো কেন, এসো বসো আহারে—
খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে।
যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে,
জড় করে আনি সব—থাক সেই আশাতে।
ডাল ভাত তরকারি ফল-মূল শস্য,
আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য,
রুটি লুচি, ভাজাভুজি, টক ঝাল মিষ্টি,
ময়রা ও পাচকের যত কিছু সৃষ্টি,
আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে—
খুঁজে পেতে আনি খেতে—নয় বড়ো সিধে সে!
জল খায়, দুধ খায়, খায় যত পানীয়,
জ্যাঠাছেলে বিড়ি খায়, কান ধরে টানিয়ো।
ফল বিনা চিঁড়ে দৈ, ফলাহার হয় তা,
জলযোগে জল খাওয়া শুধু জল নয় তা।
ব্যাঙ খায় ফরাসিরা (খেতে নয় মন্দ),
বার্মার ‘ঙাপ্পি’তে বাপ্ রে কি গন্ধ!
মান্দ্রাজী ঝাল খেলে জ্বলে যায় কণ্ঠ,
জাপানেতে খায় নাকি ফড়িঙের ঘণ্ট!
আরশুলা মুখে দিয়ে সুখে খায় চীনারা,
কত কি যে খায় লোকে নাহি তার কিনারা।
দেখে শুনে চেয়ে খাও, যেটা চায় রসনা;
তা না হলে কলা খাও— চটো কেন? বসো না—
সবে হল খাওয়া শুরু, শোনো শোনো আরো খায়—
সুদ খায় মহাজনে, ঘুষ খায় দারোগায়।
বাবু যান হাওয়া খেতে চড়ে জুড়ি-গাড়িতে,
খাসা দেখ ‘খাপ্ খায়’ চাপ্‌কানে দাড়িতে।
তেলে জলে ‘মিশ খায়’, শুনেছ তা কেও কি?
যুদ্ধে যে গুলি খায় গুলিখোর সেও কি?
ডিঙি চড়ে স্রোতে প’ড়ে পাক খায় জেলেরা,
ভয় পেয়ে খাবি খায় পাঠশালে ছেলেরা;
বেত খেয়ে কাঁদে কেউ, কেউ শুধু গালি খায়,
কেউ খায় থতমত—তাও লিখি তালিকায়।
ভিখারিটা তাড়া খায়, ভিখ্ নাহি পায় রে—
‘দিন আনে দিন খায়’ কত লোক হায় রে।
হোঁচটের চোট্ খেয়ে খোকা ধরে কান্না
মা বলেন চুমু খেয়ে, ‘সেরে গেছে, আর না।’
ধমক বকুনি খেয়ে নয় যারা বাধ্য
কিলচড় লাথি ঘুঁষি হয় তার খাদ্য।
জুতো খায় গুঁতো খায়, চাবুক যে খায় রে,
তবু যদি নুন খায় সেও গুণ গায় রে।
গরমে বাতাস খাই, শীতে খাই হিম্সিম্,
পিছলে আছাড় খেয়ে মাথা করে ঝিম্ঝিম্।
কত যে মোচড় খায় বেহালার কানটা,
কানমলা খেলে তবে খোলে তার গানটা।
টোল খায় ঘটি বাটি, দোল খায় খোকারা,
ঘাব্ড়িয়ে ঘোল খায় পদে পদে বোকারা।
আকাশেতে কাৎ হ’য়ে গোঁৎ খায় ঘুড়িটা,
পালোয়ান খায় দেখ ডিগ্‌বাজি কুড়িটা।
ফুটবলে ঠেলা খাই, ভিড়ে খাই ধাক্কা,
কাশীতে প্রসাদ খেয়ে সাধু হই পাক্কা।
কথা শোনো, মাথা খাও, রোদ্দুরে যেও না—
আর যাহা খাও বাপু বিষমটি খেয়ো না।
‘ফেল্’ ক’রে মুখ খেয়ে কেঁদেছিলে সেবারে,
আদা-নুন খেয়ে লাগো পাশ করো এবারে।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ো নাকো; যেয়ো নাকো ভড়্‌কে,
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে বসে খাও খড়্‌কে।
এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা—
খাও তবে কচু পোড়া খাও তবে ঘণ্টা।

 

|| সাহস ||

পুলিশ দেখে ডরাইনে আর, পালাইনে আর ভয়ে,
আরশুলা কি ফড়িং এলে থাকতে পারি সয়ে।
আধাঁর ঘরে ঢুকতে পারি এই সাহসের গুণে,
আর করে না বুক দুর্ দুর্ জুজুর নামটি শুনে।
রাত্তিরেতে একলা শুয়ে তাও ত থাকি কত,
মেঘ ডাকলে চেঁচাইনেকো আহাম্মুকের মত।
মামার বাড়ির কুকুর দুটোর বাঘের মত চোখ,
তাদের আমি খাবার খাওয়াই এমনি আমার রোখ্!
এম্‌নি আরো নানান দিকে সাহস আমার খেলে
সবাই বলে ‘খুব বাহাদুর’ কিংবা ‘সাবাস ছেলে’।
কিন্তু তবু শীতকালেতে সকালবেলায় হেন
ঠান্ডা জলে নাইতে হ’লে কান্না আসে কেন?
সাহস টাহস সব যে তখন কোনখানে যায় উড়ে—
ষাড়ের মতন কণ্ঠ ছেড়ে চেঁচাই বিকট সুরে!

 

|| গোঁফ চুরি ||

হেড আফিসের বড়বাবু লোকটি বড় শান্ত,
তার যে এমন মাথার ব্যামো কেউ কখনো জান্‌ত?
দিব্যি ছিলেন খোসমেজাজে চেয়ারখানি চেপে,
একলা বসে ঝিম্‌ঝিমিয়ে হটাত্‍‌ গেলেন ক্ষেপে!
আঁত্‍‌কে উঠে হাত‐পা ছুঁড়ে চোখটি ক’রে গোল!
হটাত্‍‌ বলেন, “গেলুম গেলুম, আমায় ধ’রে তোল!”
তাই শুনে কেউ বদ্যি ডাকে, কেউ‐বা হাঁকে পুলিশ,
কেউ‐বা বলে, “কামড়ে দেবে সাবধানেতে তুলিস।”
ব্যস্ত সবাই এদিক‐ওদিক করছে ঘোরাঘুরি—
বাবু হাঁকেন, “ওরে আমার গোঁফ গিয়েছে চুরি!”
গোঁফ হারানো! আজব কথা! তাও কি হয় সত্যি?
গোঁফ জোড়া তো তেমনি আছে, কমেনি এক রত্তি।
সবাই তাঁরে বুঝিয়ে বলে, সামনে ধরে আয়না,
মোটেও গোঁফ হয়নি চুরি, কক্ষনো তা হয় না।

রেগে আগুন তেলে বেগুন, তেড়ে বলেন তিনি,
“কারো কথার ধার ধারি নে, সব ব্যাটাকেই চিনি।
নোংরা ছাঁটা খ্যাংরা ঝাঁটা বিচ্ছিরি আর ময়লা,
এমন গোঁফ তো রাখত জানি শ্যামবাবুদের গয়লা।
এ গোঁফ যদি আমার বলিস করব তোদের জবাই”—
এই না বলে জরিমানা কল্লেন তিনি সবায়।
ভীষণ রেগে বিষম খেয়ে দিলেন লিখে খাতায়—
“কাউকে বেশি লাই দিতে নেই, সবাই চড়ে মাথায়।
আফিসের এই বাঁদরগুলো, মাথায় খালি গোবর
গোঁফ জোড়া যে কোথায় গেল কেউ রাখে না খবর।
ইচ্ছে করে এই ব্যাটাদের গোঁফ ধরে খুব নাচি,
মুখ্যুগুলোর মুণ্ডু ধরে কোদাল দিয়ে চাঁচি।
গোঁফকে বলে তোমার আমার—গোঁফ কি কারো কেনা?
গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।”