চীনা রূপকথা ‘ছিইউ ও হুয়ানতির লড়াই’
|| কথা প্রসঙ্গে ||
চীনের রূপকথা বেশ প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। ধারণা করা হয়, চীনাদের প্রথম ঊনিশ শ’ বছরের ইতিহাস রূপকথা ও লোককাহিনীর ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। প্রাচীন চীনা ইতিহাসের সঙ্গে রূপকথা ও লোককাহিনীগুলো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ইতিহাসবিদেরা চীনাদের রূপকথা ও লোককাহিনী থেকে নিখাদ ইতিহাসকে কখনও আলাদা করে দেখাতে পারেননি। ফলে তাদের ইতিহাস থেকে এসব রূপকথা ও লোককাহিনী বাদ দিলে ইতিহাস অর্থহীন হয়ে পড়ে। রূপকথা ও লোককাহিনী নির্ভর এ ইতিহাসকে তারা শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে লালন করছে। প্রাচীন চীনের ড্রাগনের যুদ্ধ থেকে শুরু করে বীরকন্যা মুলার, ফিনিক্স পাখি, যাদুবিদ্যার প্রভাব বা কোনো রাজা-রানীর গল্পগুলোতে আমরা চীনা ইতিহাসেরই ইঙ্গিত পাই। যা কয়েক হাজার বছর ধরে পঠিত হয়ে আসছে। এসব রূপকথা চীনের প্রাচীর টপকে তা আজ বিশ্ব সাহিত্যেরও অংশ হয়ে উঠেছে। নানা দেশের রূপকথার প্রতি ব্যাপক দুর্বলতা রয়েছে আমার। আর সে কারণে পেশাগত কারণে চীনে অবস্থানকালে আমি বেশ কিছু রূপকথা অনুবাদ করি। রূপকথাগুলো বিভিন্ন ইংরেজি বই ও সংকলন থেকে নেওয়া হয়। ‘ছিইউ ও হুয়ানতির লড়াই’ নামের রূপকথাটি সিলেকটিভ চাইনিজ ফেইরি টেলস থেকে নেওয়া হয়েছে।
অনুবাদ || আইরীন নিয়াজী মান্না
চীনা রূপকথা || ছিইউ ও হুয়ানতির লড়াই
কয়েক হাজার বছর আগের কথা। সে সময় চীনের হোয়াংহো ও ইয়াংসি নদীর অববাহিকায় অনেক আদিবাসী বাস করত। হুয়ানতি ছিলেন হোয়াংহো নদীর তীরে বাস করা সবচেয়ে বিখ্যাত আদিবাসী সর্দার। তার প্রতিবেশী অন্য আরেকজন আদিবাসী সর্দারের নাম ছিল ইয়েনতি। হুয়ানতি ও ইয়েনতি বেশ ভালো বন্ধু। সম্পর্কে তারা আসলে দুই ভাইও বটে।
অন্যদিকে ইয়াংসি নদীর অববাহিকা অঞ্চলে চিউলি নামে একদল আদিবাসী ছিল। এই আদিবাসীদের সর্দারের নাম ছিল ছিইউ। ছিইউ ছিলেন নিষ্ঠুর ও স্বার্থপর ধরনের লোক। তার দয়া-মায়া কম ছিল। আর তিনি ছিলেন প্রচুর ক্ষমতালোভী।
ছিইউদের গোষ্ঠী বেশ শক্তিশালী। কারণ ছিইউ’র একাশিজন ভাই ছিল। তাদের মুখের গড়ন ছিল মানুষের মতো। কিন্তু শরীর পশুর মতো শক্তপোক্ত। এই আদিবাসী লোকরা তলোয়ার ও তীর-ধনুক নিপূণভাবে তৈরি করত এবং চালাতে পারত। সর্দার ছিইউ প্রায়ই তার ভাইদের নিয়ে অন্য আদিবাসীদের ওপর আক্রমণ চালাতেন। ছিইউ খুব নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতেন অন্য লোকদের। তার হিংস্রতা দেখে নিজের গোত্রের লোকজনই ভয় পেয়ে যেত।
একবার ছিইউ ও তার ভাইরা ইয়েনতির এলাকায় আক্রমণ করলেন। তারা ইয়েনতির বেশ কিছু জায়গা দখল করে ফেললেন। ইয়েনতি সৈন্যদের নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করলেন। কিন্তু ইয়েনতির সৈন্যরা ছিইউর সৈন্যদের মতো শক্তিশালী ছিল না। তাই অল্পদিন পর তারা পরাজিত হলো। ইয়েনতি কোনো উপায় না দেখে সাহায্যের জন্য হুয়াংতির কাছে গেলেন। হুয়াংতি অনেক আগে থেকেই চাইছিলেন ছিইউকে নিশ্চিহ্ন করতে। তাই আশেপাশের আদিবাসীদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। পরে চুলু নামে একটি জায়গায় ছিইউর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন তারা দুই ভাই।
প্রথম দিকে ছিইউর সৈন্যরা নিজেদের তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করে বিজয় লাভ করল। পরে হুয়াংতি ড্রাগন ও অন্যান্য পশুদের লড়াইয়ে অংশ নেয়ার অনুরোধ জানালেন। যদিও ছিইউর সৈন্যবাহিনী শক্তিশালী, তবে হুয়াংতির বাহিনী ও হিংস্র পশুর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে না পেরে তারা পালিয়ে গেল।
এই সুযোগে হুয়াংতির বাহিনী ছিইউর বাহিনীকে ধাওয়া করতে লাগল। হঠাৎ অন্ধকার ঘনিয়ে আসল। প্রবল বাতাস বইতে শুরু করল। বাজ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুশলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। এমন প্রতিকুল আবহাওয়ায় হুয়াংতির সৈন্যরা আর পিছু ধাওয়া করতে পারল না। ছিইউ বাতাসের দেবতা ও বৃষ্টির দেবতার কাছে সাহায্য চাইলেন। হুয়াংতি এই অবস্থা দেখে স্বর্গের খরার দেবতাকে সাহায্যের অনুরোধ জানালেন। খরার দেবতার সাহায্যে মুহূর্তে মধ্যে প্রবল বাতাস ও ঝড়বৃষ্টি থেমে সূর্য উঠল।
এই সময় ছিইউ আবার মন্ত্র পড়ে কুয়াশা সৃষ্টি করলেন। ঘন কুয়াশায় হুয়াংতির সৈন্যরা দিক-নির্ণয় করতে পারল না। তারা আর অগ্রসরও হতে পারল না। এই সময় হুয়াংতি একটি উপায় খুঁজে বের করলেন। আকাশের সাত তারকা বিশিষ্ট তারকামণ্ডলী সপ্তর্ষি সবসময় উত্তর দিকে থাকে বলে হুয়াংতি একটি দিক নির্ণয় গাড়ি তৈরি করে ঘন কুয়াশার মধ্যে সৈন্যদের পরিচালনা করল।
অবশেষে প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর হুয়াংতি ছিইউর একাশিজন ভাইকে হত্যা করল। ছিইউকে জীবিত ধরে আনলেন। হুয়াংতি ছিইউকে হাত-পা বেঁধে হত্যা করলেন। তারপর তার মাথা ও শরীর দুটি জায়গায় সমাধিস্থ করলেন। ছিইউকে বাঁধার দড়িগুলো পাহাড়ে ছুঁড়ে ফেলা হলো। সঙ্গে সঙ্গে ওই পাহাড়ে প্রচুর ম্যাপেল গাছ জন্ম নিল। এসব গাছের লাল পাতায় আজও নাকি ছিইউর রক্তের চিহ্ন দেখা যায়।
ছিইউর মৃত্যুর পরও অনেকে তার হিংস্র মুখ দেখে ভয় পান। হুয়াংতি তার ছবি নিজের সৈন্য বাহিনীর পতাকায় এঁকে দিলেন। অন্য আদিবাসী লোকেরা এই পতাকা দেখে ভয়ে হুয়াংতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহস পায় না। ধীরে ধীরে হুয়াংতি অনেকের সমর্থন পেয়ে পুরো আদিবাসী এলাকার সর্দার নির্বাচিত হলেন।
হুয়াংতি একজন বুদ্ধিমান ও কাজের মানুষ। তিনি অনেক কিছু তৈরি করতে পারতেন। তিনি প্রাসাদ, গাড়ি, নৌকা ও নানা ধরনের জামা-কাপড় তৈরি করতেন। তার স্ত্রী লোচুও বুদ্ধিমতী নারী। প্রাচীনকালে মানুষ রেশমপোকা চাষ করত না। তারা রেশমগুটির উপকারের কথাও জানত না। লোচু স্থানীয় অধিবাসীদের রেশমগুটি থেকে রেশমী কাপড় তৈরি করতে শেখান। সে সময় থেকে চীনের তৈরি রেশমী কাপড় ক্রমেই বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত হয়। লোচু বৃষ্টির দিনে ব্যবহার করার জন্য ছাতা আবিষ্কার করেন।
প্রাচীন চীনের উপকথাগুলোতে হুয়াংতির ভুয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। চীনা জাতির উত্তরসুরীরা হুয়াংতিকে তাদের পূর্বপুরুষ মনে করেন। তারা মনে করেন তারা সবই হুয়াংতির নাতি-নাতনি। ইয়েনতি ও হুয়াংতির সম্পর্কে দুই ভাই। তাই চীনারা নিজেদের এই দুই বীরের উত্তরসুরীও মনে করে। রূপকথার এই পূর্বপুরুষদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য চীনারা হোয়াংহো নদীর অববাহিকায় অবস্থিত শানসি প্রদেশের হুয়াং লিন জেলার উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ে হুয়াংতির সমাধি তৈরি করেছে। প্রতিবছর বসন্তকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চীনাদের প্রতিনিধিরা হুয়াংতির সমাধিতে গিয়ে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন