রাজনীতির আতশ কাঁচে চলচ্চিত্রকে দেখা

অ+ অ-

 

আর সকল মাধ্যমের মতো বিনোদন মাধ্যম হিসেবে পরিচিত হলেও, আজকের প্রচারণা ও একচেটিয়া পুঁজিবাদের যুগে শুধুমাত্র বিনোদন মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রকে নির্দিষ্ট করার সমূহ সমস্যা রয়েছে। তাছাড়া ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যমের উত্থান এবং এর সাথে সাথে এসব মাধ্যম ব্যবহারকারীদের উত্তরোত্তর সংখ্যাবৃদ্ধিও চলচ্চিত্র সংক্রান্ত আলোচনাকে আর চলচ্চিত্রাঙ্গণের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকতে দিচ্ছে না। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় চলচ্চিত্র পিপ্পা-তে ব্যবহৃত কাজী নজরুল ইসলামের কারার ঐ লৌহকপাট গানটির নতুন সুরারোপ নিয়ে যে কাদা ছোড়াছুড়ি হয়ে গেলো, তার মাধ্যমে একদিকে যেমন উপরোক্ত বক্তব্যের পক্ষের বয়ান হাজির করা যায়, একইভাবে গানটিতে নতুন সুরারোপের ফলে আমাদের কোন কোন ‘বাংলা সংস্কৃতিপ্রেমী’ যেভাবে তাদের সাংস্কৃতিক মৌলবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন, সেই দিকটিও আমাদেরকে ভাষিক জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক হুমকি সম্পর্কে আরো একবার ওয়াকিবহাল করে যায় বটে।

সূচনা বক্তব্যের লক্ষ্য ছিল চলচ্চিত্র যে তার বক্তব্য, বয়ান ও উপস্থাপনের মাধ্যমে নিজেকে সাংস্কৃতিক রাজনীতির উর্বর ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পরিণত করতে পারে, সে বিষয়ে এক ধরনের সিদ্ধান্তে আসার ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করা। এক্ষেত্রে সম্প্রতি প্রকাশিত আ-আল মামুনের সিনেমার সাংস্কৃতিক রাজনীতি: আধুনিকতা জাতীয়তা আত্মসত্তা শীর্ষক গ্রন্থটি চলচ্চিত্র ও রাজনীতি সচেতন পাঠকদের চিন্তার খোরাক যোগাতে পারে। ভূমিকাসহ ছয়টি অধ্যায় ও একটি পরিশিষ্টে সজ্জিত এই গ্রন্থে গত ২০ বছরের বাছাইকৃত বাংলা চলচ্চিত্রসমূহের মাধ্যমে কীভাবে বিদ্যমান কর্তৃত্বশীল সাংস্কৃতিক রাজনীতিকে একটি শক্ত ভিত্তি বা পাটাতন সরবরাহ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে লেখক তার বোঝাপড়া ও সিদ্ধান্তগুলো তুলে ধরেছেন।

চলচ্চিত্রের মতো একটি বিনোদন মাধ্যম কীভাবে সাংস্কৃতিক রাজনীতির ময়দান হয়ে উঠতে পারে সেটি নির্দেশ করতে গিয়ে লেখক আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, চলচ্চিত্র শুধু একটি শব্দ ও দৃশ্য মাধ্যম নয়, যাকে দেখতে ও শুনতে হয়। বরং চলচ্চিত্র একইসাথে এমন এক মাধ্যমও বটে, যাকে প্রতিনিয়ত অধ্যয়ন ও পাঠ করা যেতে পারে। আর এই পাঠপ্রক্রিয়া শুধুমাত্র চলচ্চিত্রের ‘রানটাইম’-এর ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং লেখক আমাদের পুনরায় মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে একটি চলচ্চিত্রের উৎপাদক কারা, চলচ্চিত্রের মূলবার্তা তথা আধেয়টি কী এবং কাদের উদ্দেশ্য করে বা কাদেরকে দেখানোর জন্য চলচ্চিত্রটি নির্মিত হলো, এই ত্রিমুখী বোঝাপড়া না থাকলে চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করে যে সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েমের প্রয়াস লেখক চিহ্নিত করতে চাচ্ছেন, তা আমাদের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পূর্ণ থাকে।

বিগত ২০ বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যাচেলর, চন্দ্রকথা, মনের মানুষ, কসমিক সেক্স, টেলিভিশন প্রভৃতি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বৃহত্তর রাজনীতির নানা বিষয়কে কীভাবে সাংস্কৃতিক আধেয় হিসেবে নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ-বিনির্মাণ করা হয়েছে, লেখকের সেই আলোচনার আলোকে চলচ্চিত্রকে রাষ্ট্রের এক শক্তিশালী আদর্শিক কলকব্জা হিসেবে চিহ্নিত করতেই হয়, যা কাজ করতে থাকে নিভৃতে, বিবিধ সন্দেহকে পাশ কাটিয়ে।

লেখকের মূল বয়ান গঠিত হয়েছে আমাদের ‘বাঙালি’ হয়ে ওঠার তীব্র প্রচেষ্টা, এই প্রচেষ্টার ফলে সেক্যুলার বাঙালি ও মুসলিম বাঙালির ভেতর সৃষ্ট মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব এবং এই দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে নতুন পরিচয় নির্মাণের চারপাশে, যার হাত থেকে খোদ লালন সাঁইও রেহাই পান না। মূলধারার বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষার নামে এই অঞ্চলের মানুষের ধর্মীয় তথা মুসলিম পরিচয় লঘুকরণের যে প্রয়াস ৯/১১ পরবর্তী বাংলা চলচ্চিত্রে পরিলক্ষিত হয়, তার সাথে লেখক মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে সেক্যুলার বনাম মুসলিম দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ চিহ্নিত করেছেন খুব সহজেই। বিশেষত ২০১৩ পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই দ্বন্দ্বের চরম আকার ধারণ করা ও দুর্দান্ত গতিশীল হয়ে ওঠার পেছনের নিয়ামক হিসেবে কীভাবে চলচ্চিত্র কাজ করেছে তা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক উল্লেখ করছেন আবু সাইয়ীদের অপেক্ষা, তারেক মাসুদের রানওয়ে ও জাকির হসেন রাজুর জ্বী হুজুর চলচ্চিত্রগুলোর কথা। তথাকথিত মূলধারার চলচ্চিত্র ও মূলধারার বাইরের মোট তিনটি চলচ্চিত্র ব্যবহার করে লেখক যে বয়ান দাঁড় করিয়েছেন সেখানে উক্ত তিনটি চলচ্চিত্র মিলে একটি আখ্যানে পরিণত হয়, যার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী স্থায়ী যুদ্ধ প্রপঞ্চের আলোকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নির্মাণের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রটি উন্মোচিত হয়। একই সাথে এসব চলচ্চিত্রে যেভাবে মাদ্রাসা ধারায় শিক্ষার্জন করা ব্যক্তিদের কিংবা ইসলামি বেশভুষায় সজ্জিত ব্যক্তিদেরকে জঙ্গিবাদের সাথে সম্পর্কিত দেখানো হয়, যা অনেকাংশেই অসত্য বলে প্রমাণিত, তার রাজনৈতিক অর্থনীতিটিও লেখক উন্মোচন করেছেন উপস্থাপন বা রেপ্রিজেন্টেশনের তাত্ত্বিক জমিন ব্যবহার করে। অর্থাৎ সেক্যুলার বাঙালিত্ব ও মুসলিম বাঙলিত্বের ভেতর চলমান দ্বন্দ্বে সংখ্যার বিচার হিসাবের বাইরে রেখে ক্ষমতা কাঠামোর কাছাকাছি থাকা সেক্যুলারগণ কীভাবে জঙ্গিবাদের বয়ান তৈরি করে মুসলিম বাঙালিত্বের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আধিপত্য তৈরির চেষ্টা জারি রাখে, এবং এই জারি রাখার কার্যক্রমে কীভাবে ঢাকাই চলচ্চিত্র ও স্বাধীন চলচ্চিত্রের মতো সব ধারাকে নামিয়ে দেয়া হয় তা উন্মোচনের ফলে সাংস্কৃতিক রাজনীতির বিস্তৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া যায়।

 

|| ২ ||

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সাংস্কৃতিক রাজনীতির পাশাপাশি আলোচ্য গ্রন্থের লেখক চলচ্চিত্রের সাংস্কৃতিক রাজনীতিকে কীভাবে ওপার বাংলার চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা ব্যবহার করছেন, সে বিষয়েও অনুসন্ধানের প্রয়াস পেয়েছেন। এক্ষেত্রে বৃহদার্থে লেখকের আগ্রহের জায়গা ফকির ও বাউল ধারার উপস্থাপন বলেই মনে হয়, আরও স্পষ্ট করে বললে চলচ্চিত্রে ফকির লালন সাঁই ও ফকিরি ধারার সাধনার উপস্থাপনকে কেন্দ্রে রেখেই লেখক তার বিশ্লেষণ এগিয়ে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে লেখকের মূল প্রস্তাবনা এই যে, সাম্প্রতিক নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোতে অত্যন্ত সক্রিয়তার সাথে লালন সাঁইকে তাঁর অনুসৃত ফকিরি ধারা থেকে সরিয়ে এনে বাউলবর্গে স্থাপনের জোর প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। গ্রন্থের একাধিক অধ্যায়ে বারংবার নানা প্রসঙ্গে নানা ভঙ্গিতে লেখক এই বিষয়টি নিয়ে এলেও, কেন তিনি একবারের জন্যও ফকির ও বাউলদের চর্চা বা সাধনাগত পার্থক্যগুলো নিয়ে তেমন কোন আলোচনার দিকে এগোলেন না, তা এক রহস্যের মতোই থেকে যায়। এক্ষেত্রে তিনি যদি ধরে নিয়ে থাকেন এই গ্রন্থের পাঠকদেরকে ফকির ও বাউল ধারা সংক্রান্ত প্রাথমিক পড়ালেখা করেই এ সংক্রান্ত অধ্যায়গুলো পড়তে হবে, তাহলে আলাদা কথা। তবে গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণে অন্তত লেখকের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোন ঘোষণা বা সতর্কবাণী চোখে পড়ে না।

যাই হোক, লালন ও ফকির-বাউল সম্পর্কিত চলচ্চিত্রগুলোর আলোচনায় ফকির লালন সাঁইয়ের হিন্দু চরিত্র আবিষ্কারের প্রতি সাম্প্রতিক ঝোঁকের দিকটি লেখক স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। গৌতম ঘোষের মনের মানুষ চলচ্চিত্রে মূল ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও পরিচালক গৌতম ঘোষের মিলিত প্রকল্পের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে যেভাবে চলচ্চিত্রটির দর্শকের মস্তিষ্কে লালন সাঁইয়ের ‘লালন চন্দ্র কর’ পরিচয়টিকে গেঁথে দেয়া হয়, তার মূল্য লক্ষ্য লেখক খুঁজে পান দুই বাংলার স্থানিক ও সার্বিক রাজনীতির ভেতর। অন্যদিকে, কসমিক সেক্স চলচ্চিত্রে যেভাবে ফকির পন্থানুসারীদের দেহসাধনাকে স্থূলভাবে দেখানো হয় এবং এর সাথে যখন চলচ্চিত্রটির অন্যান্য আখ্যান যুক্ত হয়ে একে একটি নিতান্ত দুর্বল চলচ্চিত্রগত নির্মাণ হিসেবে চিহ্নিত করতে লেখক উদ্যত হন, সেখানেও তিনি ফকির পন্থার দেহসাধনার গুপ্ত বিষয়গুলোকে প্রকাশ করে এবং বাউলপন্থার গুপ্ত বিষয়গুলোকে প্রকাশ না করার মাধ্যমে ফকিরপন্থার প্রান্তিকীকরণ, সাধারণীকরণ ও মনস্তাত্ত্বিক লঘুকরণের ইঙ্গিত দিয়ে যান। এক্ষেত্রেও মূল চলচ্চিত্রের অসামঞ্জস্যগুলো নির্দেশ করার জন্য লেখক ফকিরপন্থার সাধনার স্তরসমূহ ও দেহসাধনার শর্তসমূহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলেও বাউলপন্থার চর্চার সাথে তুলনামূলক কোন আলোচনায় যেতে লেখকের অনাগ্রহ দেখা যায়। তবে ফকির ও বাউলদের সাধনপন্থা গোপন রাখার বিষয়টিকে লেখক যেভাবে একাধিকবার স্মরণ করিয়ে দেন, সেই আয়নায় দেখলে এবারও লেখক নিজের পক্ষে যুক্তি হাতে রেখেছেন বলেই মনে হয়।

তবে, কসমিক সেক্স বা এই জাতীয় চলচ্চিত্রসমূহ সম্পর্কে লেখকের অবস্থান স্পষ্ট, আর এই অবস্থান নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন তোলার সুযোগ আসলে থাকে না। ফকিরপন্থার নামে আজকের দিনে প্রবল যৌনকাতর সমাজের অতৃপ্ত যৌনাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার ‘বটিকা’ হিসেবে যেভাবে ফকিরপন্থার দেহসাধনাকে সামনে নিয়ে আসা হয়, উপস্থাপন কায়দার কারণেই সেই বটিকাসমূহ যে আসলে একটি অবদমিত ও হতাশায় পূর্ণ যৌননেশাগ্রস্ত সমাজকে যৌন সংকীর্ণতা ও পর্নোগ্রাফিক জীবনের দিকে ধাবিত করে, তা বেশ শক্তিশালীভাবেই লেখকের আলোচনায় উঠে আসে। একই সাথে ফকিরপন্থায় দেহ সাধনার মাধ্যমে যেখানে কামার্ত জীবন থেকে নিষ্কামের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়, তার বিপরীতে এ ধরনের চলচ্চিত্রগুলোতে ফকিরপন্থাকে শুধুমাত্র মানুষের কামবাসনা চরিতার্থ করার এক তরিকা হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে এই পন্থর সাথে ধর্মীয় আচার ও শিক্ষিত সমাজের দৃশ্যমান আকাঙ্ক্ষাকে দূরবর্তী বিষয় হিসেবে চিহ্নায়িত করার সাংস্কৃতিক রাজনীতিও লেখকের চোখ এড়িয়ে যায়নি।

সিনেমার সাংস্কৃতিক রাজনীতি: আধুনিকতা জাতীয়তা আত্মসত্তা বইয়ের লেখক আ-আল মামুন © ছবি: বর্ষা জহীন

||  ||

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা সম্পর্কিত আলোচনায় লেখকের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য, যেখানে তাঁর প্রস্তাবে তথাকথিত অশ্লীল চলচ্চিত্রগুলোকে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র অডিয়েন্সের কথা মাথায় রেখে নির্মিত হওয়ায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গণ থেকে যখন শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিতাড়িত প্রায়, তখনই দেশের চলচ্চিত্রের মধ্যবিত্তদের দখল পুনরাধিকার করতে ব্যাচেলরচন্দ্রকথা-র মতো চলচ্চিত্রের আগমন বলে লেখক মনে করেন। এক্ষেত্রে তিনি এই চলচ্চিত্রগুলোকে সমানভাবে অশ্লীল হিসেবে চিহ্নিত করেন, যেখানে আগের ‘অশ্লীল’ চলচ্চিত্রগুলোর মতো স্থূল কায়দার বিপরীতে মধ্যবিত্ত দর্শকের আকাঙ্ক্ষিত যৌন সুরসুরি ও দ্ব্যর্থবোধক সংলাপের মাধ্যমে ভিন্ন ও সূক্ষ্ম পন্থায় একই রূপ অশ্লীলতা চলমান রাখা হয়, বদলে যায় শুধুমাত্র চলচ্চিত্রাঙ্গণের নিয়ন্ত্রকদের চেহারা। যার ফলে একটি সমাজের রাজনৈতিক বিষয়াদিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সাংস্কৃতিক বিষয়াদিকে ‘সঠিক পথে’ রাখার গুরুত্বটি ধরা পড়ে।

অন্যদিকে, গণমানুষের মাধ্যমরূপী গণমাধ্যমগুলো যখন মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর ব্যাপক প্রচার ও অব্যাহত জয়গান জারি রাখে, তখন গণমাধ্যমের নামে তারা সমাজের কোন শ্রেণিটির কথা মাথায় রেখে কার্যক্রম চালিয়ে যায় তাও আরেকবার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো অডিয়েন্সের ভেতর একটি বৃহৎ ভোক্তাশ্রেণি তৈরি করার লক্ষ্যে কাজ করে, রাজনৈতিক অর্থনীতির পর্যায়ে এই আলোচনা বেশ পুরনো। আর ভোক্তাশ্রেণি হয়ে ওঠার বাসনা ও কিছুটা আর্থিক সক্ষমতা সামাজিক শ্রেণিবন্যাসের মধ্যবিত্ত পর্যায় থেকে শুরু হওয়ার ফলেই মধ্যবিত্ত সমাজের সংস্কৃতি নির্মাণের দিকেই গণমাধ্যম ও চলচ্চিত্রের মনোযোগ ও আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয়, যার লক্ষ্যই থাকে হার্বার্ট মারকুইজের একমাত্রিক সমাজ ও মানুষ তৈরি করা, যেন ব্যবসায়িক স্বার্থ কোনভাবেই ক্ষুণ্ণ হতে না পারে।

 

||  ||

চলচ্চিত্রের সাংস্কৃতিক রাজনীতি প্রসঙ্গের এহেন আলোচনা থেকে লেখকের একটি সম্ভাব্য সমাধানের পথ অন্বেষণের প্রয়াস চোখে পড়ে গ্রন্থটির শেষ অধ্যায়ে, যেখানে তিনি তারেক মাসুদকে একটি কেইস হিসেবে গ্রহণ করে চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের মূল লক্ষ্য কী হওয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থেরই পূর্ববর্তী অধ্যায়ে তারেক মাসুদের রানওয়ে চলচ্চিত্রটিকে লেখক যেখানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ইসলাম ধর্মের জঙ্গিবাদী রূপায়ন ও কট্টর সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী মতাদর্শিক প্রকল্প অনুসৃত উপস্থাপন হিসেবে সিদ্ধান্তে আসেন এবং ঐ সময়ের তিনটি চলচ্চিত্রকে এক সুতোয় গেঁথে একটি মহাআখ্যান না হলেও সামগ্রিক বয়ান হাজির করেন, সেখানে শেষ অধ্যায়ে এসে তারেক মাসুদের জীবন ও কর্মদর্শনের ভেতর চলচ্চিত্রগত ক্ষেত্রে বর্তমান বাংলাদেশের গন্তব্য অন্বেষণের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে একজন লেখকের সময়ের সাথে সাথে নিজের সাথে নিজের বোঝপড়া জারি রাখার নিশানা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে পশ্চিমা ভাবধারা কর্তৃক আবৃত, এমন অভিযোগ এনে লেখক তারেক মাসুদের কাজগুলো নিয়ে সলিমুল্লাহ খান ও ফরহাদ মজহারের আলোচনাকে আংশিক খারিজ করে দিয়েছেন। একইসাথে আহমদ ছফা ও তারেক মাসুদ উভয়েই শিল্পী সুলতানের নৈকট্য লাভের ফলেও, সুলতানকে নিয়ে এই দুইজনের ভিন্ন তৎপরতা কীভাবে তাদেরকে ভিন্নভাবে তৈরি করেছে, সেই আলোচনাও পাওয়া যায়।

তবে এই অধ্যায়ের সর্বাপেক্ষা চিত্তাকর্ষক অংশ সম্ভবত এটিই হতে পারে যে, লেখক এখানে তারেক মাসুদের কাজগুলো বিশ্লেষণের জন্য শুধুমাত্র তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রের কাহিনী বা উপস্থাপনকে নয়, বরং তারেক মাসুদের ব্যক্তিজীবন, বেড়ে ওঠা, পারিবারিক অভিজ্ঞতা, আলোচনা ও সাক্ষাৎকারসমূহকেও সমানভাবে আমলে নেয়ার দিকে জোর দেন। একই সাথে তারেক মাসুদের কাজগুলোকে সিনেমা মাধ্যম ব্যবহার করে এমন এক যাত্রা হিসেবে উপস্থাপন করেন যা মূলত তারেক মাসুদের শেকড়সন্ধানী সত্তাকেই নতুন করে আরো একবার পাঠকের কাছে উন্মোচিত করে।

আবার, এই অঞ্চলে ধর্মের স্বরূপ ও সমাজ জীবনে ধর্মের ভূমিকাসমূহ পুনর্ব্যক্ত করে তারেক মাসুদের কাজে ধর্মের উপস্থাপন কেন অরাজনৈতিক নয় এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ানের বিপরীতে তারেক মাসুদের মুক্তিযুদ্ধের বয়ান নির্মাণের প্রচেষ্টাও আলোচিত হয়েছে আলোচ্য অধ্যায়ে। মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত বাঙালি শ্রেণি যেভাবে মুক্তিযুদ্ধকে একটি শহুরে ঘটনায় পরিণত ও আবদ্ধ করেছে, তার বিপরীতে আফসান চৌধুরীর গবেষণাসমূহের মূল বক্তব্যের মতোই তারেক মাসুদের কাজের দোহাই দিয়ে লেখক আমাদের দেখিয়ে দেন যে মুক্তিযুদ্ধের বৃহৎ ক্যানভাসটি আসলে বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলেই পরিব্যাপ্ত ছিল এবং তথাকথিত অশিক্ষিত ও অতিসাধারণ কৃষক শ্রেণিই ছিল যুদ্ধটির অন্যতম কারিগর, যেখানে যুদ্ধের নায়কোচিত উপস্থাপনের চেয়ে গণহত্যা ও মুক্তিলাভের বিষয়টির গৌণকরণও লেখকের চোখ এড়িয়ে যায় না।

একইসাথে ধর্ম কীভাবে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভেতরও প্রচণ্ডরকম ক্রিয়াশীল থাকে এবং সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচিতি নির্মাণে অত্যন্ত সক্রিয় ও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করা জারি রাখে, অর্থাৎ বিভিন্ন বাস্তবতায় সমাজে ধর্মের আঠালো ভূমিকা পালনের বিষয়টি তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা উপলক্ষ্যে লেখকের মাধ্যমে বারবার সামনে চলে আসে, এরই উল্টো পিঠ হিসেবে ধর্ম সম্পর্কে মার্ক্সের বয়ানের ভুল ব্যাখ্যা ও তা থেকে উদ্ভূত সঙ্কটসমূহও আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে প্রায়শই।

 

|| ৫ ||

এই গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত রচনাগুলোর বিভিন্ন অংশ থেকে এটি স্পষ্ট যে, লেখক তার বয়ান তৈরির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রসদ রণজিৎ গুহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র প্রমুখের আলোচনা তথা সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ ধারার তাত্ত্বিকদের থেকে গ্রহণ করেছেন। সেক্ষেত্রে বিকল্প বা ভিন্ন বয়ানের পাঠকদের গ্রন্থভুক্ত আলোচনা থেকে ভিন্নমত পোষণ করা খুব স্বাভাবিক। তবে, স্টুয়ার্ট হলের কোডিং-ডিকোডিং ধারণা মাথায় রাখলে বিষয়টি খুব বড় কোন প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে না। সেক্ষেত্রে প্রথমদিকের অধ্যায় দুইটিতে আলোচিত চলচ্চিত্রসমূহের সংলাপসহ দীর্ঘ বর্ণনার ফলে পাঠকমনে উদ্ভূত বিরক্তির ঝুঁকি ব্যতীত চলচ্চিত্র ও রাজনীতি সচেতন দর্শক ও পাঠকদের জন্য এই গ্রন্থটি চলচ্চিত্রগত চিন্তাকে বিস্তৃত করতে সক্ষম হতেই পারে।

দিনশেষে এই গ্রন্থটি আসলে চলচ্চিত্র বিষয়ক নাকি রাজনীতি বিষয়ক, অর্থাৎ চলচ্চিত্রের চোখে সাংস্কৃতিক রাজনীতিকে দেখা নাকি সাংস্কৃতিক রাজনীতির চোখে চলচ্চিত্রকে দেখা, নাকি এই বাইনারির বাইরে এসে এই দুই বিষয়ের অন্তর্নিহিত মিথোজীবীতা গ্রন্থকারকে আন্দোলিত ও আগ্রহী করেছে, সেটিও এক চিত্তাকর্ষক আলোচনা হতে পারে বটে।