সুকান্ত ভট্টাচার্যের আলোচিত গল্প ‘হরতাল’
ভূমিকার বদলে
সুকান্ত ভট্টাচার্য [১৯২৬-১৯৪৭] একজন কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট মাসে, কলকাতায় মাতুলালয়ে। আদি পৈতৃক নিবাস ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়ায়। পিতা নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন কলকাতাযর পুস্তক ব্যবসায়ী। সুকান্ত প্রথমে কলকাতার কমলা বিদ্যামন্দিরে; পরে বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। সে সময় বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটান তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন একজন অগ্রগণ্য লেখক। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন ১৯৪৪ সালে। সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের পক্ষে আকাল [১৯৪৪] নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন। কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার [১৯৪৫] ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন তিনি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ—ছাড়পত্র [১৯৪৭], পূর্বাভাস [১৯৫০], মিঠেকড়া [১৯৫১], অভিযান [১৯৫৩], ঘুম নেই [১৯৫৪], হরতাল [১৯৬২], গীতিগুচ্ছ [১৯৬৫] প্রভৃতি। পরবর্তীকালে দুই বাংলা থেকে সুকান্ত সমগ্র নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়। বেশির ভাগ লেখা পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয় মৃত্যুর পরে। বেচে ছিলেন মাত্র ২১ বছর। কিশোর বয়সেই তিনি অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। পাঠকের কথা বিবেচনা করে প্রতিধ্বনি তাঁর আলোচিত গল্প ‘হরতাল’ প্রকাশ করেছে। এটি মূলত রেল শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে এক প্রতীকী গল্প। গল্পের চরিত্র রেলের বিভিন্ন কলকব্জা। কলকব্জারা রেল শ্রমিকদের নানা অধিকার ও সমস্যা নিয়ে কথা বলছে। একটা শ্রমিক আন্দোলনের আদ্যোপান্ত যেন গল্পটিতে ফুটে আছে। বর্তমান বাস্তবতায় যার আবেদন এখনো ফুরোয়নি।
গল্প || হরতাল || সুকান্ত ভট্টাচার্য
রেলে ‘হরতাল’ ‘হরতাল’ একটা রব উঠেছে! সে খবর ইঞ্জিন, লাইন, ঘণ্টা, সিগন্যাল এদের কাছেও পৌঁছে গেছে। তাই এরা একটা সভা ডাকল। মস্ত সভা। পূর্ণিমার দিন রাত দুটোয় অস্পষ্ট মেঘে ঢাকা চাঁদের আলোর নীচে সবাই জড়ো হল। হাঁপাতে হাঁপাতে বিশালবপু সভাপতি ইঞ্জিন মশাই এলেন। তাঁর লেট হয়ে গেছে। লম্বা চেহারার সিগন্যাল সাহেব এলেন হাত দুটো লট্পট্ করতে করতে, তিনি কখনো নীল চোখে, কখনো লাল চোখে তাকান। বন্দুক উঁচোনো সিপাইদের মতো সারি বেঁধে এলেন লাইন-ক্লিয়ার করা যন্ত্রের হাতলেরা। ঠকাঠক ঠকঠক করতে করতে রোগা রোগা লাইন আর টেলিগেরাফের খুঁটিরা মিছিল করে সভা ভরিয়ে দিল। ফাজলামি করতে করতে ইসটিশানের ঘণ্টা আর গার্ড সাহেবের লাল-সবুজ নিশানেরাও হাজির। সভা জমজমাট। সভাপতি শুরু করলেন:
“ভাইসব, তোমরা শুনেছ মানুষ মজুরের হরতাল করছে। কিন্তু মানুষ মজুরেরা কি জানে যে তাদের চেয়েও বেশী কষ্ট করতে হয় আমাদের, এইসব ইঞ্জিন-লাইন-সিগন্যাল-ঘণ্টাদের? জানলে তারা আমাদের দাবিগুলিও কর্তাদের জানাতে ভুলত না। বন্ধুগণ, তোমরা জানো আমার এই বিরাট গতরটার জন্যে আমি একটু বেশী খাই, কিন্তু যুদ্ধের আগে যতটা কয়লা খেতে পেতুম এখন আর ততটা পাই না, অনেক কম পাই। অথচ অনেক বেশী মানুষ আর মাল আমাদের টানতে হচ্ছে যুদ্ধের পর থেকে। তাই বন্ধুগণ, আমরা এই ধর্মঘটে সাহায্য করব। আর কিছু না হোক, বছরের পর বছর একটানা খাটুনির হাত থেকে কয়েক দিনের জন্যে আমরা রেহাই পাব। সেইটাই আমাদের লাভ হবে। তাতে শরীর একটু ভাল হতে পারে।”
প্রস্তাব সমর্থন করে ইঞ্জিনের চাকারা বলল: ধর্মঘট হলে আমরা এক-পাও নড়ছি না, দাঁতে দাঁত দিয়ে পড়ে থাকব সকলে।
সিগন্যাল সাহেব বলল: মানুষ-মজুর আর আমাদের বড়বাবু ইঞ্জিন মশাইরা তবু কিছু খেতে পান। আমরা কিছুই পাই না, আমরা খাঁটি মজুর। হরতাল হলে আমি আর রাস্তার পুলিশের মতো হাত ওঠান-নামান মানবো না; চোখ বন্ধ করে হাত গুটিয়ে পড়ে থাকব।
লাইন ক্লিয়ার করা যন্ত্রের হাতল বলল: আমরাও হরতাল করব। হরতালের সময় হাজার ঠেলাঠেলিতেও অমিরা নড়ছি না। দেখি কি করে লাইন ক্লিয়ার হয়।
লাইনেরা বলল: ঠিক্ ঠিক্, আমরাও নট নড়ন-চড়ন, দাদা।
ইসটিশানের ঘণ্টা বলল: সে সময় আমায় খুঁজেই পাবে না কেউ। ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াব। লাল-সবুজ নিশান বন্ধুরাও আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। ট্রেন ছাড়বে কি করে?
সভাপতি ইঞ্জিন মশাই বললেন: আমাকে বড়বাবু ইঞ্জিন মশাই বলে অরি সম্মান করতে হবে না। আমি তোমাদের, বিশেষ করে আমার অধীনস্থ কর্মচারী চাকাদের কথা শুনে এতই উৎসাহিত হয়েছি যে আমি ঠিক করেছি অনশন ধর্মঘট করব। এক টুকরো কয়লাও আমি খাব না, তাহলেই সব অচল হয়ে পড়বে।
এদিকে কতকগুলো ইসটিশানের ঘড়ি আর বাঁশি এসেছিল কর্তাদের দালাল হয়ে সভা ভাঙবার জন্যে। সভায় কাজ ঠিক মতো হচ্ছে দেখে বাঁশিগুলো টিক্ টিক্ করে টিট্কারী মেয়ে হট্টগোল করতে লাগল। অমনি সবাই হৈ হৈ করে তেড়ে মেড়ে মারতে গেল ঘড়ি আর বাঁশিদের। ঘড়িরা আর কী করে, প্রাণের ভয়ে তাড়াতাড়ি ছ'টা বাজিয়ে দিল। অমনি সূর্য উঠে পড়ল। দিন হতেই সকলে ছুটে চলে গেল যে যার জায়গায়। সভা আর সেদিন হল না।
নোট: প্রচ্ছদে ব্যবহৃত সুকান্ত ভট্টাচার্যের পোর্ট্রেটটি এঁকেছেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় চিত্রশিল্পী মাসুক হেলাল। প্রতিধ্বনি সংশ্লিষ্ট শিল্পীর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন