আগর আলীর প্রাতঃভ্রমণ

অ+ অ-

 

প্রতিদিন সকাল হতে না হতেই আগর আলীকে তার বড় ছেলে ধমকায়, আব্বা, এক্কনো হাটবার বের হোলা না? ধমকটা তার বুকে এসে জোরে বাড়ি খায়। ধমকে আগর আলীর ঘুম ভাঙে। আতঙ্কে তার দেহের কোষগুলোর মধ্যে একটা তাড়াহুড়া লাগে। তার দুর্বল হার্ট একটানা দ্রুতলয়ে ধুক ধুক করতে থাকে, যেন একটা মেশিন স্টার্ট নিয়েছে। সে নিশ্চল শুয়ে শুয়ে শোনে সে আওয়াজ। বহুদিনের পরিচিত এ আওয়াজ শুনলে আগর আলী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সে শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করে বোধহীন ভাবটা কেটে যাওয়ার।

আজ যখন পাশের ঘর থেকে বড় ছেলে ধমক ছাড়ে তখন সে ছিল গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। ধমকটা কানে ঢোকার পর থেকে তার দেহের মধ্যে হট্টগোলের উৎপত্তি।

এই হট্টগোলে আতঙ্কগ্রস্ত মেশিনটা জোরে জোরে ধুক ধুক করে চলে। মস্তিষ্ক তৎক্ষণাৎ তদন্তে নামে, ঘটনা কী? তেমন কিছুই নয় কয়েকটা উচ্চ শব্দের অনুপ্রবেশ মাত্র।

তারপর থেকেই আগর আলীর এই আলাফোলা নিশ্চল দশা। তবে এই দশা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। প্রথমে তার চোখের পাতা নড়ে ওঠে তারপর চোখের মনি দুটো ঘুরে ঘুরে স্থির হয় দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির ওপর। সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে।

তার মুখগহ্বর উন্মুক্ত হয়ে বড় বড় দুটো হাই ওঠে। মাথাটা ঘুরে যায় বালিশের ডান থেকে বামে। তারপর বাম হাতের আঙুলগুলো সচল হয়ে এগিয়ে গিয়ে একটানা পাছা চুলকায়। পাছার দাদের কোষগুলো আগর আলীর শরীরের সবচেয়ে সক্রিয় অংশ, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সারাক্ষণ তিড়বিড় তিড়বিড় করতেই থাকবে। হাতের আঙুলগুলোর তৎপরতা বাড়লে চুলকানির অসহনীয় বিরক্তিভাব কেটে গিয়ে একধরনের প্রশান্তির আবেশ ঘিরে ধরে তাকে। শুয়ে শুয়ে আগর আলী আরামে পা দুটো নাচায়।

মেশিনের ধুক ধুক আওয়াজ কমে গেলে শরীরের কোষগুলোর মধ্যে খানিকটা শৃঙ্খলা ফেরে।  ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে উঠে বসে আগর আলী। প্রতিদিনের মতো এভাবে আরও কিছুক্ষণ বসে থাকবে সে।

শালা, ঘড়ির কাঁটাডাও ক্যাম্বা ঘোরেছে ভন ভন কর‌্যা। আগর আলী একদেহ অলসতা নিয়ে বিড়বিড় করে। এর মধ্যে পরবর্তী ধমকের আশংকা দেখা দিলে তার অঙ্গ-প্রতঙ্গের মধ্যে তৎপরতা বাড়ে। তাই ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে কিছু কাজ দ্রুত সেরে ফেলার উদ্যোগ নেয়। মেজাজ বিগড়ে যেতে শুরু করে। মেঝেতে পা দুটো নামিয়ে দ্রুত এগিয়ে যায় বাথরুমের দিকে।

আগর আলীর খারাপ মেজাজের কবলে প্রথম পড়ে বাথরুমের সুইচটা। এক্কেরে সারাডা রাত গোয়াডা উঁচু কর‌্যা আছু তুই। চাপ দিয়ে সুইচের উর্দ্ধত পাছাটা নামিয়ে দেয় সে। বাথরুমের লাইট জ্বলে ওঠে।

বাঁকা শরীর নিয়ে আগর আলী একটা আলোকিত জগতের মধ্যে ঢোকে। লাইটের চকচকে আলোর নিচে দাঁড়িয়ে লুঙ্গি তুলে অর্থব শিশ্ন হাতে ধরে চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে সে। কিন্তু তেমন কোনো সুখবর আসে না। সুখবর যে চাইলেই পাওয়া যায় না আগর আলী তা ভাল করেই জানে। সেই প্রাপ্তির জন্য যে মনোসংযোগ, একাগ্রতা ও ধৈর্য দরকার তাতে তার কোনো ঘাটতি নেই। বরং বিশেষ করে এই সময়টায় এই ধ্যানমগ্নতা তার ভালোই লাগে।

সে ধ্যান ধরে দাঁড়িয়ে মনোসংযোগ দেয় তলপেটে। তারপর ধৈর্য ধরে একটানা একটা চাপ ধরে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু আজ তার মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটে।

কারণ ঘড়ির কাঁটা ভনভন করে ঘুরে সময় খেয়ে ফেলছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর যাইহোক ধ্যান হয় না।

আগর আলী তাড়াতাড়ি জোরে জোরে চাপ দেয় তলপেটে। গলা দিয়ে একটানা বাধাপ্রাপ্ত কম্পিত আওয়াজ বের হয়। কিন্তু আজ সে আওয়াজ কোনো ধ্যানীর গলার আওয়াজ নয়, এতে নেই কোনো শান্তি কিংবা মুক্তির ইঙ্গিত। এ আওয়াজ শুনতে বিশ্রী, বিষণ্ন আর আর্তনাদে ভরা।

ঘড়ির ঘূর্ণায়মান কাঁটা ধমকের আশংকাকে আরও স্পষ্ট করে তুলছে কিন্তু আগর আলীর পেশাব হচ্ছে না।

একন ঘড়ির কাঁটার সাতে তাল দিয়া হামাক মোতা লাগবে। শেষমেষ সামান্য গাঢ় হলুদ পেশাব তার নেতানো শিশ্ন বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। তার খানিকটা লেগে যায় হাতে।

বেশ দ্রুততার সঙ্গে আগর আলী কমোড ফ্লাশ করে। বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে নেয়। কিন্তু ব্রাশে পেস্ট লাগাতে গিয়ে ভাঁটা পড়ে সেই দ্রুততায়।

ইদানিং ব্রাশ করতে ইচ্ছা করে না। ব্রাশ করতে গেলেই চোখের সামনে দুনিয়াটা ওলট-পলট লাগে। মাথা ঘুরতে থাকে ঝাঁকুনিতে। তাছাড়া ব্রাশ করতে গেলে হাতের সঙ্গে মুখের যে একটা ছন্দ দরকার সেটা সে এখন ধরে রাখতে পারে না। ফলে ব্রাশ প্রায়শ সরাসরি ক্ষমাহীনভাবে আঘাত হানে তার মাড়িতে, তখন কয়েকদিন বন্ধ হয়ে যায় খাওয়া-দাওয়া। তাই এই ঝুঁকিটা সে আজ নেয় না।

ব্রাশ না করেই হাতে মুখে পানি দিয়ে সে বেরিয়ে আসে। এতে অন্তত সময় কিছুটা বাঁচে কিন্তু লাইটের সুইচের মুক্তি ঘটে না। ইংকা কর‌্যা কান ধর‌্যা গোয়ার উপুর সারাদিন বোস্ থাক তুই।

মন মেজাজ খারাপ থাকলে আগর আলী এভাবেই শাস্তি দেয় ফ্যান, লাইটের সুইচগুলোকে। হয়ত কনকনে শীতের মধ্যেই রাগ উঠল তো ফ্যানের সুইচটাকে পাছার ওপর কান ধরে বসিয়ে দেবে। শীতের মধ্যে ফ্যানের বাতাসের মধ্যে ঠকঠক কাঁপবে রাগ না কমা পর্যন্ত।

তার এই কান ধরে বসানোর মনস্তাত্ত্বিক উৎস বুঝতে বেশি পরিশ্রমের দরকার নেই। সেই যে এক তরুণ শিক্ষকের মনে ছাত্রদের শাস্তি দেওয়ার আইডিয়াটা প্রবেশ করেছিল তা এখনো রয়ে গেছে। তাই আগর আলী সবকিছুকে শাস্তিদানের উদ্দেশে কান ধরে পাছার ওপর বসাবে তাতে অবাক হওয়ার  কিছু নেই।

আগর আলী এক গ্লাস পানি খেয়ে তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবিটা গায়ে চাপিয়ে হাঁটতে বের হতে হতে দেখতে পায় বড় ছেলে ল্যাংটা হয়ে বউয়ের ওপর নেতিয়ে আছে।

রাস্তা এখন একেবারে ফাঁকা। ফুটপাতের ওপর ভাসমান মানুষগুলো এখনও নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। হাঁটার পার্কটা কাছেই, রাস্তাটা পেরোলেই।

আগর আলী সাবধানে রাস্তাটা পার হয়। ফুটপাতের ওপর মানুষগুলোকে ঘুমোতে দেখে তার আফসোস বাড়ে। পার্কের গেটের সামনে আসার পর সে একটা মারাত্বক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। দুটো কুকুর সঙ্গম থেকে মুক্তির আশায় গেটের সামনে টানটানি করতে থাকে। সামনে আরও দু-চারটে কুকুর আগর আলীর সঙ্গে দেখতে থাকে সে দৃশ্য। আগর আলীর মেজাজ আর ঠিক থাকে না। তোরা শালা সব সুখ লিচ্চু আর হামি খালি এই ভোর বেলা হাটবা লাগছি।

সবকটাকে পাছার ওপর কান ধরে শাস্তি দিতে মন চায় তার। এখন যদি বড় ছেলে, ফুটপাতের ঘুমন্ত মানুষগুলো আর কুকুর দুটোকে পাছার ওপর কান ধরে বসাতে পারত তাহলে মেজাজ খানিকটা ঠান্ডা হত তার।

আগর আলী খারাপ মেজাজের ঘোরের মধ্যে দেখতে থাকে সামনে পাছার ওপর কান ধরে বসে আছে তার নেতানো ল্যাংটা বড় ছেলে, ঘুমঘুম চোখের মানুষগুলো আর কুকুর দুটো। সে যেন ফিরে যায় তার শ্রেণিকক্ষে। হাতে লম্বা বেত নিয়ে তীক্ষè চোখে পায়চারি করে। ঘুমঘুম চোখের মানুষগুলোকে বেতের গুতো দিয়ে শাস্তির সঠিক পদ্ধতির আওতায় আনে। বেতের ভয়ে কান টেনে ধরে থাকে কুকুর দুটো। সপাং করে একটা বেতের বাড়ি পড়ে বড় ছেলে উন্মুক্ত পাছার ওপর। কিছু হলেই ইংকা নেতায়া যাস ক্যারে!

আগর আলী বাস্তবে ফেরে যখন একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী এসে কুকুর দুটোকে পার্কের গেট থেকে তাড়িয়ে দেয়।

এখন বেশ ফুরফুরে মেজাজ তার। শান্ত সকালের বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে পার্কে ঢোকে সে।

এখন আগর আলী সোজা কাঠবাদাম গাছটার নিচে পাতা বেঞ্চে প্রতিদিনের মতো পা দুটো টানটান করে শুয়ে একটা ঘুম দেবে। সেই ঘুম ভাঙবে না নয়টার আগে।

স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে পার্কে। কেউ হাঁটে, দৌড়ায়। আবার কেউ কেউ এ দুটোর কোনটায় করে না। মস্তিষ্কে সৃষ্ট অদৃশ্য স্বাস্থ্যবিষয়ক ভাবনাগুলোকে বাস্তবে রুপ দেওয়ার চেষ্টা করে। এদের মস্তিষ্কের সদ্য কল্পনা থেকে উৎপাদিত অঙ্গসঞ্চালন নতুন নতুন কিম্ভুত ব্যায়ামের জন্ম দেয়। কিংবা এখানে এলে হয়ত এদের মধ্য সক্রিয় হয়ে ওঠে ঘাপটি মেরে থাকা আদিম জিনেরা। বন্য জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যায় এদের। তাই খালি চোখে যেটাকে হাস্যকর লাগে সেটা হয়ত বন্য জীবনে ফিরে যাওয়ার তীব্র আকুতি। এতো বিবর্তনের পরও মস্তিষ্ক আর শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য যা জরুরি। তাই প্রতিদিন সকালে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষে ভরে ওঠা পার্কটা হয়ে ওঠে একটা নৃতাত্ত্বিক গবেষণাক্ষেত্র।

এই নৃতাত্ত্বিক গবেষণাক্ষেত্রের বেঞ্চে শুয়ে আগর আলীর আজ আর চোখে ঘুম আসে না। সকাল থেকেই তার মনোসংযোগ, একাগ্রতা ও ধৈর্যের মধ্যে হট্টগোল লেগেই আছে। চোখে ঘুম আনতে ব্যর্থ হয়ে সে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে কাঠবাদাম গাছের দিকে। আর আগর আলীর অগোচরে মানুষের বিবর্তন ও জীবন প্রণালির ইতিহাস মঞ্চস্থ হতে থাকে চারপাশে।

তার নিঃশ্বাস দূরত্বে কিছু মানুষ যারা অর্থহীন উপর-নিচে, ডানে-বামে, শূন্যে-মহাশূন্যে বিশৃঙ্খল হাত-পা ছুড়ছে তারা বিবর্তনে সবচেয়ে পিছিয়ে যেন। এখনো এদের মধ্যে চারপেয়ে জিন সক্রিয়। আর যারা হাঁটছে বা দৌড়াচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছে শিকারী জীবনের প্রভাব। কিন্তু যারা আগর আলীর মাথার ঠিক পিছনে হা হা হা করে কৃত্রিম হাসি হাসছে এবং ধোকা দিচ্ছে এদের মস্তিষ্ককে এরা বিবর্তনে এগিয়ে সবচেয়ে। এদের বুদ্ধিমান মস্তিষ্ক বলে সুস্থ থাকতে চাইলে হাসো, হোক সে নকল। এবং এমনভাবে হাসো যেন তা আমি বুঝতে না পারি সেটা নকল।

আগর আলী এগুলোর কোনোটায় করে না। তার মস্তিষ্ক বড় ছেলেকে ফাঁকি দিয়ে পার্কের বেঞ্চে শুয়ে সুখের ঘুম দেয়। কিন্তু আজ কাঠবাদাম গাছ তাকে স্মৃতির স্রোতে টানে। সে হাল বায় স্রোতের বিপরীতে। ঘুম আনার চেষ্টা করে।

চোখ বন্ধ করে বুকের ওঠানামার দিকে মনোযোগ দেয় সে। কিন্তু মেশিনের মধ্য এখন হাহাকার শুধু। আগর আলী হাল ছেড়ে দেয়। কিসের হাহাকার? স্রোত তাকে টেনে নিয়ে যায় সায়েরা বানুর কাছে।

দেখতে দেখতে দুবছর হয়ে গেল। সময়ের এতো কিসের তাড়াহুড়ো আগর আলী বোঝে না। সময়ও কি তার মতো ধমক খায়? না হলে এত দ্রুত যায় কীভাবে!

একটা কাঠবাদাম এসে পড়ে তার প্রায় নিস্তেজ ধীরলয়ের বুকের ওপর।

স্মৃতির গহ্বরে ডুবে যেতে যেতে ডালে বসে কাঠবাদাম ঠোকরাতে থাকা কাক দেখে তার আফসোস জাগে, তুইও সুখ লিচ্চু! আফসোসের সঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস মুখ দিয়ে বের হলে তার বুক খানিকটা দেবে যায় এবং কাঠবাদামটা নিচে গড়িয়ে পড়ে।

বছর তিনেক আগে হলেও কাঠবাদামটার এভাবে গড়িয়ে পড়ার সাহস হত না। ঘটনাটার শুরু একটা বাসের মধ্যে তবে কবে, কখন এবং কোথায় তা সে মনে করতে পারে না। তবে স্পষ্ট মনে আছে, এটা এমন একটা সময় যখন সে মনে করত তার শরীরের জন্য কাঠবাদাম অত্যন্ত জরুরি কিছু।

কাঠবাদামের উপকার সম্পর্কিত ক্যানভ্যাসের দীর্ঘ বয়ানের পরও সে খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। কিন্তু যখন ক্যানভ্যাসার কানের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে চাপা স্বরে বলেছিল তবে ভাইজান এর আসল কাম হলো লিঙ্গের শক্তি ও মালের দম বাড়ানো।

ক্যানভ্যাসারের এই গোপনীয়তা সাহস জুগিয়েছিল তাকে। ক্যানভ্যাসারের আরও ঘনিষ্ট হয়ে সে বলেছিল, হামাক এডা প্যাকেট দ্যান দিনি।

পাশের সিটে বসে সায়েরাবানু একাধারে ফিসফিস করে যাচ্ছিল, শুনো, এডা কিসক লিব্যা!

সারারাস্তা আগর আলী সায়েরাবানুর দিকে ফিরে মিটমিট করে হেসেছিল। এর কিছুদিনের মধ্যে তারা পার্কে হাঁটার সময় আবিষ্কার করেছিল এই কাঠবাদাম গাছ।

সে সময় প্রতিদিন সবার আগে পার্কে আগর আলীর পদচারণ ঘটত। কুড়িয়ে নিয়ে যেত পড়ে থাকা কাঠবাদাম। তখন কাকগুলোকে খুব আপন লাগতো তার। কারণ কাকের ঠোঁটের কারসাজিই মধ্যেই লুকিয়ে ছিল আগর আলীর দাম্পত্য সমস্যার সমাধান। তখন কাক ও আগর আলী উভয়ই সুখ খেত। কিন্তু এখন সেই সাম্যবস্থা নেই।

আগর আলী সারাদিন বসে বসে কাঠবাদাম কুড়োতো। সেগুলোকে যত্ন করে শুকোতো রোদে। একবার ওপরের শক্ত খোসাটা পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে একটা দা কিংবা হাতুড়ি দিয়ে খোলসের জয়েন্ট বরাবর বাড়ি মারলেই হলো। শক্ত খোসা কী চমৎকার দুপাশে ভেঙে এলিয়ে পড়ে আর হঠাৎ বেরিয়ে আসে একটা আস্ত মনোরম কাঠবাদাম।

মাঝে মাঝে সায়েরা বানু পাশে থাকলে দুই আঙুলের ফাঁকে কাঠবাদাম ধরে সায়েরা বানুর মুখের সামনে তুলে ধরে বলত, কী ফাইন লাগিচ্চে, এক্কেরে তুমার লাকান, দেকিচো!

কিন্তু বেদনার বিষয়, কিছুদিনের মধ্যে সে সায়েরা বানুকে হারায়।

এখন পার্কের বেঞ্চে শুয়ে শুয়ে কাকগুলোকে অসহ্য লাগে আগর আলীর। সবকটাকে কান ধরে পাছার ওপর বসাতে পারলে মেজাজটা ঠান্ডা হত। কিন্তু যে কাঠবাদামটা এইমাত্র বুক থেকে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে সেদিকে আগর আলী নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক থেকে।

কাঠবাদামটা গড়িয়ে চলে পার্কের দুপেয়ে প্রাণিদের পায়ে পায়ে তাদের নৃতাত্তি¡ক ইতিহাসের মধ্যে। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আগর আলীর ক্ষণিকের সুখ আর আর সায়েরা বানুকে হারানোর বেদনা।

আগর আলী একটা কাঠবাদাম কুড়িয়ে পাঞ্জাবির পকেটে ভরে নেয়। বেরিয়ে আসে পার্ক থেকে। একটা রিকসা নেয় কবরস্তানের উদ্দেশে।

যতক্ষণে সে পৌঁছায় ততক্ষণে সূর্য তার কুসুমরুপ ত্যাগ করে ঝকঝকে তাপ ছাড়তে শুরু করেছে। কবরস্তানের গেট দিয়ে সে সোজা চলে যায় উত্তর পাশে। যেখানে শায়িত সায়রা বানু। একটা কাঠবাদামের হৃদয় বয়ে নিয়ে ছুটে চলে আগর আলীর পা দুটো। তাকে পৌঁছে দেয় সায়েরা বানুর কবরের সামনে।

হঠাৎ তার মেশিনটা ধুক ধুক করতে থাকে জোরে জোরে। ফলে অবস্থা বেগতিক বুঝে মস্তিষ্ককে আবার তদন্তে নেমে পড়তে হয়। তবে এবার পরিস্থিতিটা বেশ জটিল। সায়েরা বানুর কবরের দুইপাশে দুটো নতুন কবরÑমরহুম আ্যাডভোকেট আবেদ চৌধুরী আর মরহুম প্রফেসর বেলাল উদ্দিনের।

আগর আলী এখন জগতের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ মানুষ। হাত-পা অবশ লাগে তার। মাথাটা একনাগারে ঘুরতে থাকে। একটু বসতে পারলে ভালো লাগত বোধহয়। ঝিমঝিম ভাবটা কাটত। কিন্তু কোথায় বসবে সে? এখানে? সায়েরা বানুর সামনে? যে গুছিয়ে নিয়েছে তার পারত্রিক জীবন! অজান্তেই অবশ লাগা হাত থেকে কাঠ বাদামটা গড়িয়ে পড়ে। আগর আলীর কণ্ঠনালী থেকে শুধু একটা অসম্পূর্ণ বাক্য বাতাসকে মৃদু কম্পিত করে, বানু তুমিও...