শেষ ইচ্ছা ও অন্যান্য গল্প

অ+ অ-

 

শেষ ইচ্ছা

সেই শুরু থেকেই মানুষটাকে পছন্দ হয়নি আমার। একটু বেশি গা ঘেঁষা টাইপের। ‘আরে বাবা! আমার গায়ে গন্ধ হোক, পোকা পড়ুক, মাছি বসে থাক, তাতে তোমার কী আসে যায়? তুমি মিয়া এই সাতসকালে কেন এত কষ্ট করে আমাকে গোসল করাতে এসেছ? মেয়ে মানুষের শরীরের ছোঁয়া পেতে মন চায়, তাই না? তো সামনে তো কালী, লালী, এরকম অনেকেই আছে। তাদের ফেলে এই ধলীর দিকে নজর কেন তোমার?’
আমার ভাবনা শেষ না হতেই চামড়ার ওপর জোরে ঘষা দিয়ে বলে ওঠে, ‘তুমি কী জানো, এই চামড়া দিয়ে মানুষ জুতা বানায়। এই যে আমার পায়ে যে রকম জুতা আছে, এরকম দেখতে। তুমি শুঁকে দেখতে পারো।’
আমি ভাবি, ‘গায়ে হাত দেওয়ার শখ হয়েছে, দাও। এত কাহিনি শোনাতে হবে না। আর এত দরদও দেখাতে হবে না।’ পরে কী ভেবে নাকটা তার পায়ের কাছে নিয়ে যাই। গন্ধে বমি আসতে চায়। ‘আমার চামড়ার গন্ধ মোটেও এমন নয়। মিথ্যাবাদী কোথাকার!’
সে এবার আমার শিং দুটো নাড়তে নাড়তে বলে, ‘আমার শার্টে এই যে বোতাম দেখছ, এগুলো কিন্তু তোমার মতো একজনের শিং থেকে তৈরি।’
আমি ভাবি, ‘এইটাও কি বিশ্বাস করতে আমাকে? মিথ্যাবাদী কোথাকার!’
সে আবার বলে, ‘তুমি কি জানো তোমার চামড়ার নিচে যে মাংস আছে, সেটা আমরা খাই। তোমার নাড়ি-ভুঁড়ি খাই। তোমার হৃৎপিণ্ড খাই। তোমার যকৃত খাই। তোমার মাথার ভেতরের মগজ খাই। তোমার অস্থিমজ্জা খাই। তোমার হাড়গুলো প্রেশার কুকারে দিয়ে নরম বানিয়ে খাই।’
তার মিথ্যা কথাগুলো শুনতে শুনতে আমি অধৈর্য হয়ে উঠি। বানিয়ে বানিয়ে সে আর কত মিথ্যা কাহিনি শোনাবে আমাকে।
আমার চোখে অবিশ্বাস দেখে সে তার মোবাইল ফোনে একটা ভিডিও দেখায় আমাকে। একটা গরুকে বেঁধে তার গলা কাটা থেকে শুরু করে পুরো শরীর টুকরো টুকরো করা পর্যন্ত। ভিডিও দেখা শেষ হলে সে আমাকে বলে, ‘এখন বুঝতে পেরেছ, তোমাকে কেন এই সাতসকালে গোসল করাতে এসেছি।’
আমাকে নিরুত্তর দেখে সে আবার বলে, ‘তোমার কিছু চাওয়ার আছে? শেষ ইচ্ছা জাতীয় কিছু?’
প্রথমে মনে হলো কিছুই বলব না। তারপর একসময় বলেই ফেললাম, ‘যদি একটা মানুষকে ঘাস বানিয়ে চিবিয়ে খেতে পারতাম!’

 

বাংলা কী মাস?

এসি চলছে গাড়িতে। ড্রাইভারের পাশের ছোট্ট স্ক্রিনে তাপমাত্রা দেখাচ্ছে বিশ ডিগ্রি। জানালার কালো কাঁচের ভিতর দিয়ে আকাশটাকে মেঘলা মনে হয়। মজিদ সাহেব বলেন, ‘আজ খুব ঠাণ্ডা পড়েছে রে!’
‘জী স্যার!’ ড্রাইভারের ত্বরিত উত্তর।
‘শীতকাল এবার যেতেই চাচ্ছে না!’
‘জী স্যার!’ ড্রাইভারের গদগদ কণ্ঠ।
বিজয় সরণীর একটু আগে হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় গাড়ি। সামনের অংশ সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। ‘স্যার, দ্রুত নেমে পড়েন। আমি দেখছি।’
মজিদ সাহেব গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়ালেন। গাড়ির আশেপাশে উৎসুক জনতার ভিড়। ধোঁয়া কমে গিয়েছে। ড্রাইভারের গবেষণা চলল প্রায় মিনিট দশেক। তারপর বলল, ‘বুঝতে পারছি না স্যার। মেকানিক দেখাতে হবে। এখানে সিএনজি পেতে দেরি হবে। তার চেয়ে আপনি সামনে দাঁড়ানো বাসে উঠে বসুন। সোজা মতিঝিল নিয়ে যাবে।’
মজিদ সাহেব ঘড়ির দিকে তাকান। অফিসে যথাসময়ে পৌঁছতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে। তাই আর দেরি না করে উঠে পড়েন বাসে।
অস্বস্তি লাগছে। বাসে তিনি একাই স্যুট পরে আছেন।
পাশের সিটে বসা যাত্রী বলে, ‘ভাই কি সবসময় এভাবে স্যুট পরে অফিসে যান?’
‘না ভাই। সারারাত কম্বল মুড়ি দিয়ে ছিলাম। প্রচণ্ড জ্বর। খালি ঠাণ্ডা লাগে।’
সারারাত কম্বল মুড়ি দিয়ে থাকার বিষয়টা সত্য হলেও জ্বরের ইস্যুটা ডাহা মিথ্যা। কারণ তিনি এসি চালিয়ে ঘুমিয়েছেন।
‘তাই বলেন! আমি আরও ভাবছিলাম এই গরমে আপনার এই বেশ কেন?’
বাস বাংলামোটরের জ্যামে আটকে আছে। গরম আর অস্বস্তিতে মজিদ সাহেব ঘামতে শুরু করেন। দিব্যি টের পাচ্ছেন ভিতরে সব ঘেমে একাকার। ঘাড় আর কপোলের ঘাম মুছে শেষ করতে পারছেন না। সাথে থাকা কয়েকটা টিস্যু নিমিষেই শেষ।
পাশের ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, ‘ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ছে। প্যারাসিটামল খেয়েছিলেন নিশ্চয়?’
‘জী ভাই, ঠিক ধরেছেন। এটা বাংলা কোন মাস যেন ভাই?’
‘চৈত্র। গরম দেখেও টের পাননি? সরি, ভুলেই গিয়েছিলাম যে আপনার জ্বর।’

 

ফিলাশ

হারেস মিয়া কমোড থেকে সোজা দাঁড়িয়ে ফ্ল্যাশের ছোট্ট বোতামটায় চাপ দিতেই জাদুর মতো কোত্থেকে যেন ঘড় ঘড় শব্দ করে পানি বের হয়ে ময়লাগুলোকে সরিয়ে দিয়ে পরিষ্কার পানি দিয়ে ভরিয়ে দেয়। চোখ সরে না তার। আহ! কী সুন্দর বুদ্ধি মানুষের! তার মনে হয় এখনি আবার বসে পেট থেকে আরও কিছু আইটেম বের করে আবার ফ্ল্যাশ করে এই কারুকাজ দেখে। আহা! সকালবেলা ঝোপের ভেতর যাওয়ার দরকার নাই! আশপাশে কেউ এলো কি না তা দেখার জন্য চারদিকে সারাক্ষণ নজর রাখা লাগে না।

নিশ্চিন্তে, আরামে কাজ সেরে নাও। কত শান্তি!

হারেস মিয়া তার দূর সম্পর্কের খালাতো ভাইয়ের ঢাকার বাসায় এসেছেন গত সপ্তাহে। তার পর থেকেই আজব আজব সব জিনিস দেখছেন। আজও শুনেছেন। অতি গোপন এক কথা!
বাসার কাজের মেয়ে সকালবেলা গেস্ট রুম পরিষ্কার করতে ফিসফিস করে বলে, ‘হারেস মামা, মীরা আপার কাহিনি শুনছেন?’
‘কী কাহিনি?’
‘আপা ফিলাশ করছে!’
‘মানে?’
‘পেটে বাচ্চা আসছিল! তারে ফিলাশ করছে!’
‘বাচ্চাও কি ফিলাশ করা যায় নাকি?’
‘যায়! ক্লিনিকে গেলেই হয়!’
হারেস মিয়া স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। বছর বিশেক আগে গ্রামে একটা বড় লজ্জায় পড়েছিলেন। একটা অবিবাহিত মেয়ের পেটে বাচ্চা চলে আসে।
বাড়ির লোকজনের চাপাচপিতে সে হারেস মিয়ার নাম বলে দেয়। এই ঘটনা নিয়ে পরে কত বিচার-আচার। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তার মেয়ের বয়সী মেয়েটাকে তার বিয়েই করতে হয়। আহ! যদি এই ফিলাশের কথা জানতেন!
জীবনটাকে আরও উপভোগ করতে পারতেন! কত সুযোগ যে তার হাতছাড়া হয়ে গেছে পেটে বাচ্চা আসার ভয়ে!

 

ফটোগ্রাফ

একটা অটোগ্রাফ দেবেন প্লিজ!’ ক্রেতার কথায় পাশ ফিরে তাকান লেখিকা। আজ বিকেল থেকেই এই শব্দমালা শুনছেন তিনি। ভালোই লাগছে তার। পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলা যায়। পাঠকদের আকৃষ্ট করার বিশেষ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দামি একটা পারফিউম ব্যবহার করেছেন। এই পারফিউম তার গন্ধ দিয়ে অনেক দূর থেকে মানুষদের টেনে আনবে তার কাছে। তিনি উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পড়েছেন। শাড়িটার রং তাকে তার আশপাশের মানুষ হতে আলাদা করবে। খুব পরিপাটি করে মেকাপ করেছেন যাতে কেউ একবার তার দিকে তাকালে আর চোখ ফেরাতে না পারে। লেখিকা নিশ্চিত তার এই ক্রেতাও তার টানেই এখানে এসেছেন।
ক্রেতার কাছ থেকে বইটা নিয়ে নাম জিজ্ঞেস করেন, ‘কী নাম লিখব?’
‘কোনো নাম লিখতে হবে না!’ উত্তর ভেসে আসে।
লেখিকা অটোগ্রাফ দিয়ে বইটা হাতে তুলে দিতেই আরেক আবদার, ‘আপনার সাথে একটা ফটোগ্রাফ নিতে পারি।’
‘না, পারেন না!’ বলেই তার ক্রেতার অভিব্যক্তি দেখার জন্য অপেক্ষা করেন। মুখটার করুণ অবস্থা দেখে মায়া হয়। ‘ফটোগ্রাফ নিতেই হবে?’
‘হ্যাঁ!’
‘কিন্তু একটা সমস্যা আছে যে।’
‘খুব বড় কিছু?’
‘হ্যাঁ, খুব বড় ধরনের।’
‘জানতে পারি?’
‘না, পারেন না,’ বলেই তার ক্রেতার অভিব্যক্তি দেখার জন্য অপেক্ষা করেন। এবার তার চেহারা দেখে আরও বেশি মায়া হয় লেখিকার।
‘ঠিক আছে বলছি। আরও একটু কাছে আসুন।’ লেখিকা তার মুখ তার ক্রেতার একদম কানের কাছে নিয়ে বলেন, ‘আমার সাথে গত সপ্তাহ পর্যন্ত যারাই ফটোগ্রাফ তুলেছে, তাদের কেউ বেঁচে নেই। সবার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।’