উপদ্রব

অ+ অ-

 

কাফনে দেহ মুড়িয়ে ঘুমাচ্ছে মানুষটা। বোঝা মুশকিল এ নারী নাকি পুরুষ। দেহের ভাঁজ দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে, সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতা হবে মানুষটার, গড়নও শক্তপোক্ত। হয়তো পুরুষই হবে। কিন্তু দেহের গড়ন দেখে কী আর এখন পুরুষকে আলাদা করে চেনা যায়। নারীও তো হতে পারে। কিন্তু কী চায় সে, কী উদ্দেশ্যে এই শহরে তার আগমন সেই বিষয়ে কিছু এখনও জানা যায়নি। শহরে কোনো আগন্তুক এলে সহসা সব জানার উপায় থাকে না। ব্যস্ত শহর। মানুষেরাও ব্যস্ত ভীষণ। তবু কেউ কেউ পাশ ফিরে, পেছন ফিরে দেখছে মানুষটাকে। মানুষটা কাউকে দেখছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। শহরে পা দিয়ে সবচেয়ে ব্যস্ততম সড়কের ফুটপাতে সে নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে ঢুকে দ ভঙ্গিতে শুয়ে পড়েছে। শোয়ার এই ভঙ্গিটাই নানাবিধ প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। মানুষটা টানটান হয়ে শুয়ে পড়লে না হয় তার উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার বোঝা যেত, কিছু খুচরো টাকা-পয়সা জমা পড়তে থাকতো কাফনের কাপড়ের ওপরে। এই শহরে এমন হর-হামেশাই হয়। হাভাতে মানুষের নাকি কান্না শুনে শহরের মানুষেরা সিকি-আধলি দান-খয়রাত করে বিস্তর সওয়াব কামানোর পথ খুঁজে নেয়। কিন্তু এবার তেমন কিছু হয়নি। বরং মানুষটার হাঁটু ভাঙা দ ভঙ্গিটাই সবাইকে উৎসুক করে তুলছে, কে এই মানুষ? কী চায় সে?

এখন পর্যন্ত মানুষটা অবশ্য কারও কাছে কিছু চায়নি। পড়ে পড়ে শুধু ঘুমাচ্ছে। মাঝখানে একটা টোকাই এসে মশকরা জুড়েছিল। টান দিয়ে কাফনের কাপড়টা সরানোর চেষ্টা করেছিল। শহরের মানুষেরা আশা করেছিল, মানুষটা এখনই ক্ষেপে উঠবে, তাড়া করবে ছেলেটাকে। কিন্তু সবাইকে হতাশ করে সে একবারের জন্য মাথাটা পর্যন্ত বের করেনি। কাফনের সাদা কাপড়টা টেনেটুনে পুনরায় নিজেকে দ ভঙ্গিতে গুটিয়ে নিয়েছে।

এভাবে সাতদিন সাতরাত কেটে যায়। কেউ মানুষটাকে উঠে এক গাল খাবারও খেতে দেখে না। কে জানে কী খেয়ে বেঁচে থাকে মানুষটা! কী খায় সে? চাঁদের আলো? সূর্যের ঝিলিক না তোড়া তোড়া অন্ধকার? নাহ্ একবারের জন্যও তো মুখ বের করে এসবের কিছুর সন্ধান করতে দেখা যায় না তাকে। রাত কুকুর, শেয়ালেরা এসে তার শরীরের গন্ধ নেয়, কাফনের কাপড়টা শোঁকে, কোনা ধরে টানাটানি করে, কিছুতেই টলে না সে। মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে একবার খ্যাক করে উঠে বলেও না, ভাগ!

কে যেন এসে খবর ছড়ায়, মানুষটার কাফনের কাপড়ে ফুটো আছে। ঐ ফুটো দিয়েই সে ফুলের ঘ্রাণ টেনে নেয়। তাই তো ফুলের ঘ্রাণ খেয়েও বেঁচে থাকতে পারে মানুষটা। এইদিকের প্রায় প্রতিটি বাড়ির প্রবেশদ্বারেই তো হাসনাহেনা, মধুমঞ্জুরির ঝোপ। টবে টবে বেলি আর তারাঝরাও আছে। নির্ঘাৎ বিনা পয়সায় ফুলের সৌরভ খেয়েই দিনরাত নির্বিকার পড়ে থাকে মানুষটা। আর ফটকা বাতাসও সাঁই সাঁই করে কাপড়ের ভেতরে ঢুকে অক্সিজেনের যোগান দেয়। সবাই পরিষ্কার বুঝে যায়, খুব ধূর্ত মানুষটা, ঘ্রাণেন্দ্রিয় সজাগ রেখেছে। পথে-ঘাটে, ঘরে-বাইরে এই নিয়ে পুরোদমে বিষোদ্গার শুরু হয়। এমন চললে তো শহরে তিষ্টানো মুশকিল। এমনিতেই তো সবাইকে ঘাড়, পিঠ গুঁজে বিষে বিষক্ষয় করে দিন গুজরান করতে হয়। আর এ তো বড় সুখে আছে দেখছি! এর জীবনে তো রাজনীতি, অর্থনীতির বালাই নেই। এমনকি এ-দল ও-দলের কোন্দলে জড়ানো নেই, বাজার-সদাইয়ের ঝুট ঝামেলা নেই, বস কিংবা স্বামী-স্ত্রীর ধাতানি নেই, প্রেসক্রিপশন ধরে ধরে খাওয়ার আগে তিনটা, খাওয়ার পরে সাতটা ওষুধ খাওয়ার মতো কোনো অসুখ নেই। পুরো শহরকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমানোর অবসর ঠিকই আছে।

এর মধ্যে পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র পেরিয়ে বৈশাখ আসে। বৈশাখি হাওয়া তেড়ে-ফুঁড়ে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টির দৌরাত্ম্য দেখে সবাই ঠোঁট বাঁকা করে হাসে। এবার যাবি কোথায়? পাত্তাড়ি গুটিয়ে পালাতেই হবে। পালা... পালা...। কীসের কী, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভিজে একাকার হয়ে দেখা যায়, ঝড়ো বৃষ্টির মাঝেও দিব্যি দ শেইপ টিকে আছে। এ কী! আত্মরক্ষার কোনো চেষ্টাই তো নেই মানুষটার মাঝে! এ কী মানুষ? না আর কিছু? বৃষ্টি স্নাত ফুটপাতে সাদা কাফনে ঢাকা প্রেতায়িত অবয়ব দেখে এবার সবাই ঘাবড়ে যায়।

এ হেন বেয়াদবি কাহাতক সহ্য করা যায়? আর নিত্যকার জীবনের ছন্দপতন ঘটিয়ে এমন বেয়াদবের মতো দিনের পর দিন শুয়ে থেকে সে কী বোঝাতে চায়? শহরবাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে কী দেখাতে চায়? বোঝাতে চায় কী, এই শহরের কেউই অমন বৈরাগ্য দেখাতে জানে না। আর অমন সন্ন্যাসী হলেই কি সবকিছু থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব?

ছয় ঋতুর ঘূর্ণিপাক শেষ হলে শহরের সবাই বুঝে যায়, এসব ভণ্ডামি। একে প্রশ্ন করে কোনো লাভ নেই। মানুষটাও কম যায় না, প্রশ্নের পর প্রশ্ন জাগিয়ে তুলে সে কাফনের আড়ালে সব উত্তর নিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে। তার ঔদ্ধত্যে শহরের মানুষগুলোর ভ্রুতে ক্রমশ ভাঁজ পড়ে। পায়ের গতি শ্লথ হয়। ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখতে থাকে, খাবার নেই, জৈবিক চাহিদা নেই, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই, ঋণের বোঝা নেই, অফিস আর বাসার পলিটিক্স নেই; দুনিয়াদারির সব নেইকে উপেক্ষা করে কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে মানুষটা। মাঝেমাঝে নিশ্বাস পড়ার শব্দ হয়। নিশ্বাসের ওমেই বোঝা যায়, দৈনন্দিন জীবনের হিসাবনিকাশের বালাই নেই বলেই সবরকম যান্ত্রিক হুলস্থূলের ভেতরেও প্রশান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে আছে মানুষটা।

সহ্য করতে না পেরে সবাই একদিন শহরপিতার কাছে যায়। নালিশের ফিরিস্তি দেখে-শুনে শহরপিতা প্রথমে বিষয়টা হেসেই উড়িয়ে দেন। জানান, দুই লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার তিনশত একত্রিশ রাত ধরে তিনি ঘুমান না। এইসব নির্ঘুম রাত শহরের রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা তার ব্যক্তিগত জীবনে কোনোপ্রকার প্রভাবই ফেলতে পারেনি। এ যে নির্জলা মিথ্যা তা শহরপিতার সামনে বসা অভিযোগকারীদের উসখুস ভাবই স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে কোনো তথ্যই লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকে না। শহরপিতার দুই সন্তানের বখাটেপনা, স্ত্রীর অবাধ দুর্নীতি, রক্ষিতার স্বেচ্ছাচারিতা-কিছুই তাই কারও কাছে আর গোপন নেই।

শহরবাসী মৃদু আওয়াজ তুলে সব প্রকাশের ইঙ্গিত দিতেই শহরপিতা হাত তুলে তাদের আশ্বস্ত করে বলেন, বিষয়টা তদন্ত করতে অবিলম্বে দশ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হবে। শহর রক্ষা বাহিনীকে সতর্ক থাকারও নির্দেশ দেওয়া হবে।

এরপর সপ্তাহ ধরে দশ সদস্যের বিশেষ তদন্ত কমিটি দফায় দফায় মিটিং করে লিটার লিটার চা, পানি আর টন টন স্ন্যাক্স খেয়ে একশ এক পৃষ্ঠার প্রতিবেদন শহরপিতার হাতে তুলে দেয়। প্রতিবেদনে কী আছে শহরবাসী তা তাৎক্ষণিক জানতে না পারলেও পরের দিন বিশেষ বুলেটিনের মাধ্যমে সকল প্রকার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ঐ প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ প্রকাশ করা হয়। জানানো হয়, যেহেতু ভাসমান মানুষটা উৎপাতহীনভাবে সড়কের ফুটপাতে ঘুমিয়ে আছে সেহেতু মানুষটাকে শহর থেকে উৎখাত করা হবে মানবাধিকার লংঘনের সামিল। তাই কাফনে জড়ানো মানুষটার প্রতি পূর্ণ সহনশীলতা বজিয়ে রাখার জন্য শহরবাসীকে নির্দেশ প্রদান করা হয়।

শহরপিতার নির্দেশনার খবরে শহরবাসী উত্তপ্ত না হয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়ে। এরপর সবাই মিলে একদিন গোপন মিটিং করে আপাত একটা সমাধানে পৌঁছায়। ঠিক করে মানুষটার খাদ্যের উৎস বন্ধ করতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাড়ির মালিকেরা তাদের প্রবেশদ্বার সংলগ্ন হাসনাহেনা আর মধুমঞ্জুরির গাছগুলো সমূলে তুলে ফেলে। তারাঝরা আর বেলির টবগুলোকেও সিটি কর্পোরেশনের গাড়িতে তুলে দেয়। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। খাবার বা সৌরভহীনভাবেও দিব্যি শুয়েই দিন কাটাতে থাকে মানুষটা। বরং মানুষটার নির্লিপ্তি ঘরে ঘরে যতটুকু স্বস্তি আর শান্তি ছিল ততটুকুও ছিনিয়ে নেয়। বিষণ্ন মানুষেরা ক্রমশ আরও বিষণ্ন হয়ে পড়ে। কেউ কেউ আড্ডা গরম করে ক্ষেপে ওঠে, এসব আর প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক না।

প্রশ্রয় দেয় না কেউ। শুধু চলতি পথে মানুষটাকে পাশ কাটাতে কাটাতে ভাবে, সুখী মানুষের জামার মতো মানুষটার কাফনের কাপড়টা কি চেয়ে নেবে? ওটা গায়ে জড়িয়ে কি একটু নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাবে? কিন্তু চাইতে গেলে বিনিময়ে যদি সে উলটা-পালটা কিছু চেয়ে নেয়? নাকি ছিনিয়ে নেবে? কিন্তু ছিনিয়ে নিতে গেলে যদি দেখা যায়, তুকতাক করে ওদেরকে ইতর কোনো প্রাণীতে পরিণত করে দেয়। কত বুজরুকি কাণ্ডকারখানাই তো ঘটে পৃথিবীতে। এসব ভেবে ভেবে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে শহরবাসীর রাত পার হয়।

মানুষটা নিরুপদ্রবে শুয়ে আছে, এটাই শহরের সবচেয়ে বড় উপদ্রব বলে মনে হয়। সুখ নেই মনে মনে, ঘরে ঘরে এই নিয়েই উৎপাত। তাই কাফন পরিহিত মানুষটার সুখও আর সহ্য হয় না। তাই শহরবাসী একদিন পুনরায় গোপন বৈঠক আহ্বান করে। তারপর বৈঠক শেষে সবাই একমত হয়ে রাতের আঁধারে মানুষটাকে চ্যাংদোলা করে ধরে শহরের বাইরে ফেলে দিয়ে আসে।