তোবারক সাহেবের স্বপ্নযাপন

‘তোবারক সাহেব, আমরা বুঝতে পারছি, অফিসে আপনার একদম মন নেই। থাকার কথাও না। আর এমন দুরবস্থা মাথায় নিয়ে আপনার অফিসে আসাটাই তো আমার কাছে ভয়াবহ ও নির্মম বলে মনে হচ্ছে। আপনি এক সপ্তাহ, প্রয়োজনে পনেরো দিন ছুটি নিন। এটা স্পেশাল লিভ। সিএল বা মেডিকেল লিভ থেকে কাটা যাবে না। আপনি বিশ্রাম করুন। ঘুরে টুরে আসুন। দরখাস্ত দিয়ে বাড়ি চলে যান।’
তোবারক সাহেব ছুটির দরখাস্ত দিয়ে অফিসের এইচ আর বিভাগের প্রধানের রুম থেকে বের হলেন। তাঁর চেহারা বিধ্বস্ত। চোখ লাল। সারাক্ষণ কাঁদছেন। থেমে থেমে কান্না। তাঁর একমাত্র সন্তান গলায় রশি পেঁচিয়ে সুইসাইড করেছে পরশুদিন। লাশের ময়না তদন্ত ও পুলিশি ক্লিয়ারেন্স শেষে গতকাল রাতে এশার নামাজের পর কবর দেওয়া হয়েছে। এরপর আজ চলে এসেছেন অফিসে।
খাদিজার সঙ্গে ডিভোর্স হলো তাঁর দুমাস হতে চললো। জিসান ছোট থেকে তার এই তেরো বছর বয়স পর্যন্ত কেবল বাবা-মায়ের ঝগড়াই দেখেছে। কখনো কখনো সে ঝগড়া শেষ হতো হাতাহাতি-মারামারির মধ্য দিয়ে, অথবা তোবারক কিংবা খাদিজা—কোনো একজনের বাসা থেকে সাময়িক সময়ের জন্য বেরিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।
কখনো খাদিজা বাবার বাড়ি চলে যেতেন। জিসান থাকতো বাবার সঙ্গে।
কখনো তোবারক সাহেব চলে যেতেন ঘুরতে সুন্দরবনে বা বান্দরবনে। জিসান থাকতো মায়ের সঙ্গে।
তোবারক বা খাদিজা—কেউই জিসানের কথা ভাবতেন না। ঝগড়া বা লড়াইয়ে নিজের জয়-পরাজয় নিয়ে ভাবতেন।
এক পর্যায়ে তাঁদের শুভবুদ্ধির উদয় হলো। তাঁরা বুঝলেন যে, এভাবে ঘৃণার সঙ্গে বসবাসের কোনো অর্থ নেই। স্থায়ীভাবে আলাদা হয়ে যাওয়াই সমাধান। তাঁরা আলাদা হয়ে গেলেন। ডিভোর্স হলো। জিসানকে কেউই নিতে চাইলেন না। জিসান থেকে গেলো বাবার সঙ্গে।
পরশুদিন সকালে, তোবারক সাহেব যখন অফিসে যাবার জন্য টাইয়ের নট ঠিক করছিলেন, জিসান তখন স্কুলের শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো, ‘বাবা, আজ অভিভাবক সমাবেশ আছে। স্কুলে যেতে হবে তোমাকে।’
তোবারক সাহেব জিসানকে লক্ষ করলেন। মাথাভর্তি ঘন চুল। বড়ো বড়ো দুটো চোখ। খুব ইনোসেন্ট আর কিউট। কখনো নিজের ছেলের দিকে ভালো করে তাকান নি। খুব মমতা বোধ করলেন হঠাৎ জিসানের জন্য।
বললেন, ‘যেতাম। বন্ধের দিনও কাজ পড়ে গেলো অফিসে।’
আসলে মিথ্যা কথা। অভিভাবক সমাবেশে সুখী সব মা-বাবাদের মাঝে বসে তাঁর মধ্যে হতাশা আর বিষন্নতা কাজ করে। খানিকটা লজ্জাও। খাদিজা এই দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতেন। হতাশা, লজ্জা—এসব লুকিয়ে রাখতে পারতেন। তোবারক সাহেব পারেন না।
গত মাসের অভিভাবক সমাবেশেও জিসান বাবা-মা কোনো একজনকেও নিতে পারেনি। সে এজন্য খুব বিব্রত হয়। নিজেকে ছোট মনে হয়।
এই তেরো বছরে একবারও সে মা-বাবার সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যায়নি। যেতে পারেনি। ক্লাসের অন্য ছেলেরা যখন বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়াতে যাবার গল্প বলে জিসান চুপচাপ শোনে। ওদের বাবা-মা কত ভালো।
তোবারক সাহেব বেরিয়ে যেতেই জিসান খুব দ্রুত কাজগুলো করতে থাকে। রশি আগেই কেনা ছিলো। কীভাবে ফাঁস পড়তে হয় সে সম্পর্কে ইন্টারনেটে সে বহুবার পড়েছে, ভিডিয়ো দেখেছে।
সে তার ছোট বুকে পুষে রাখা বিরাট দুঃখের বোঝা নামিয়ে ফেললো।
|| দুই ||
অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় হাঁটলেন তোবারক সাহেব। জিসান যতদিন ছিলো ততদিন তিনি জিসানকে একদম মনে করতেন না। এখন সারাক্ষণ তাঁর কেবল জিসানের কথা মনে পড়ছে।
মদ খাওয়া তাঁর পুরোনো অভ্যাস। মদ খেয়ে বাসায় ফিরে খাদিজাকে গালিগালাজ, এমনকি মারধোরও করেছেন—এমন ঘটনা তাঁর পনেরো বছরের সংসার জীবনে একাধিকবার ঘটেছে। আজও ঢুকলেন এক বারে।
এভাবে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে, বারে গিয়ে কিংবা বাসায় ইজিচেয়ারে চুপচাপ বসে থেকে, কোনোভাবেই তিনি দুচোখ থেকে জিসানকে সরাতে পারছিলেন না।
বর্ষার আকাশের মতো গুমোট তাঁর মন।
থেমে থেমে বৃষ্টির মতো চলছে তাঁর থেমে থেমে কান্না।
কিছুদিন কেটে যাবার পর তাঁর চোখে পড়লো একটা বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের ভাষা অদ্ভুত: ‘আসুন স্বপ্ন দেখি’।
|| তিন ||
‘আমরা স্বপ্ন নিয়ে কাজ করি। আমরা একটা মেশিন বানিয়েছি। দেখতে সামান্য এয়ারবাডের মতো। কানের মধ্য দিয়ে সরাসরি মগজে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম। এই মেশিনকে স্বপ্নবর্ধক বলা যায়, যদি সহজ করে বলি।’
তোবারক সাহেব বললেন, ‘স্বপ্নবর্ধক?’
হালকা-পাতলা লোকটি, বসে আছে একটা কাঠের চেয়ারে, সামনে একটা ছোট টেবিল নিয়ে, সে টেবিলে একটা নেমপ্লেট, যেখানে লেখা: “আব্দুল কাইয়ুম, সিইও, ড্রিম ইয়োর কাস্টোমাইজড ড্রিম”—বললো, ‘অফিসের দরিদ্রতা দেখে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। আমরা যে মেশিনটি এনেছি সেটা বাজারে হৈচৈ ফেলে দেবার মতো। এটা আপনার স্বপ্নকে কাস্টোমাইজ করতে সক্ষম। আপনি সুখ-স্বপ্ন দেখতে দেখতে সারারাত পার করে দিতে পারবেন আর সকালে আপনার ঘুম ভাঙবে একজন পারফেক্ট সুখী মানুষের তৃপ্তি নিয়ে।’
তোবারক সাহেব বললেন, ‘আমার সমস্যা অন্য। আমি আসলে আমার হতাশা দূর করতে চাই। স্বপ্ন তো এমনিতেই দেখি। চোখ বন্ধ করলেই জিসানকে দেখি।’
ড্রিম ইয়োর কাস্টোমাইজ্ড ড্রিমের সিইও আব্দুল কাইয়ুম বললেন, ‘স্বপ্ন একটা অবাক করা ব্যাপার। আপনার ছেলে মারা গেছে। তাকে আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু স্বপ্নে তাকে ফিরে পাবার পথ খোলা। একমাত্র স্বপ্নই পৃথিবীর অসম্ভবতম এ কাজ—মৃতকে জীবিত করতে পারে। আর আপনি যখন স্বপ্নে আছেন, তখন কিস্তু আপনি জানেন না যে আপনি স্বপ্নে আছেন। আপনার কাছে তখন স্বপ্নই সত্য। তাই স্বপ্ন সত্য নাকি মিথ্যা- ব্যাপারটি আপেক্ষিক।’
হ্যাংলাপাতলা গাঁজাখোরের মতো চেহারার অল্পবয়সী সিইও-র কথা শুনতে বেশ নতুন নতুন লাগছে তোবারক সাহেবের।
‘আমাদের এই মেশিন স্বপ্ন-উদ্দীপক হিসেবে কাজ করবে। স্বপ্নকে অনেক বেশি জীবন্ত করে তুলবে। বাস্তবের মতো মনে হবে। ঘুম ভাঙার পর কিছুক্ষণ সময় লেগে যাবে বুঝতে কোনটা জাগ্রত অবস্থা আর কোনটা স্বপ্ন। আপনি আপনার মৃত সন্তানকেও দীর্ঘ সময় ধরে স্বপ্ন দেখতে পারবেন। তার সাথে আলাপ জমাতে পারবেন। ক্ষতি কী যদি সেটা স্বপ্নেই ঘটে?’
তোবারক সাহেব শুনছেন মনোযোগ দিয়ে, আনমনা হয়ে।
‘আপনার স্ত্রী চলে গেছে। আপনি কিন্তু চাইলে তাকেও আপনার স্বপ্নে নিয়ে আসতে পারেন। আপনি তাকে নিয়ে সুখের কোনো স্মৃতি ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ুন। হয়তো আপনার অবচেতন মন তাকে হাজির করবে স্বপ্নে। আর ঝকঝকে সুখস্বপ্ন দেখতে দেখতে পার করে দিন সারারাত। কিংবা,’ —আব্দুল কাইয়ুম চোখ টিপে ফাত্রা মার্কা হাসি দিয়ে বললো, ‘হুরপরি দেখতে চাইলে সে ব্যবস্থাও হতে পারে।’
অল্পবয়সী সিইও-র ঠাট্টায় প্রায় মুরুব্বি গোছের তোবারক সাহেব দমে গেলেন না। বললেন, ‘অর্থাৎ আপনার এই মেশিন আমি যা দেখতে চাইবো স্বপ্নে আমাকে তা-ই দেখাবে?’
সিইও বললো, ‘সরলীকরণ করলে ব্যাপারটা এমনি দাঁড়ায়। আসলে এই মেশিন কাজ করে উদ্দীপনা নিয়ে। আমরা যা ভাবি, যা চিন্তা করি তা-ই স্বপ্নে দেখি। প্রতিরাতেই আমরা স্বপ্ন দেখি। কিন্তু ঘুম ভাঙলে বেশিরভাগ স্বপ্নই বা স্বপ্নের বেশিরভাগ অংশই আমরা ভুলে যাই। এই মেশিন স্বপ্নকে ঝাপসা হতে দেবে না। জীবন্ত ও বাস্তবের ফিল দেবে। ঘুম ভেঙে গেলেও স্বপ্নের রেশ থেকে যাবে। আপনি আনন্দে থাকলে আনন্দের স্বপ্ন দেখবেন। কষ্টে থাকলে কষ্টকর কিছু দেখবেন। দুঃসময়ে মেশিন না পরে ঘুমানোর পরামর্শ দেই আমরা।’
|| চার ||
দুঃসময়ের সময়ই মানুষ সুস্বপ্নের স্বপ্ন দেখে।
তীব্র ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে তোবারক সাহেবের। কানে লাগানো এয়ারবাডের মতো ছোট মেশিন। ঘুমের দেশে পৌছে দ্রুতই তিনি প্রবেশ করলেন স্বপ্নের দেশে। স্বপ্নে দেখা দিলো জিসান। চমৎকার এক লেকের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। লেকের টলটলে পানিতে সাঁতার কাঁটছে জিসান। তার দুচোখে আনন্দ জ্বলজ্বল করছে। লেকে কিছু পানকৌড়ি উড়ছে। জিসান যে মারা গেছে এই তথ্য তাঁর মধ্যে স্বপ্নেও জাগরুক রইলো। মৃত জিসানকে সাঁতার কাটতে দেখে তিনি একটুও অবাক হলেন না। স্বপ্নের সৌন্দর্যই এটি। সব অসম্ভবকেই অনায়াসে যাপন করা যায় স্বপ্নে।
জিসানকে প্রশ্ন করলেন, ‘গলায় দড়ি দিলে কেন?’
জিসান লেক থেকে উঠে এলো। তোবারক সাহেবের হাত ধরে বললো, ‘তোমরা, তুমি আর মা আমাকে ভালোবাসো না বলে।’ তোবারক সাহেব জিসানকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি কাঁদছেন। সেই কান্না নিয়ে তাঁর ঘুম ভাঙলো। ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর যখন আবিষ্কার করলেন জিসান নেই, মারা গেছে গলায় ফাঁস দিয়ে।
তোবারক সাহেবের চোখ ভিজে যেতে লাগলো স্বপ্নের চেয়ে দ্রুত।
এরপর প্রতিরাতে তোবারক সাহেব স্বপ্ন দেখার মেশিন কানে লাগিয়ে ঘুমাতে যান। নিজের জীবনের সমস্ত অতৃপ্তি মুছে জীবনটাকে স্বপ্নে নিজের মতো করে রাঙিয়ে তোলেন। সেই স্বপ্নে সারাক্ষণ সঙ্গী হয়ে থাকে জিসান। কলহপূর্ণ দাম্পত্য জীবনকেও রাঙিয়ে তোলেন, পরিপূর্ণ করে তোলেন পারফেক্শনে। তিনি স্বপ্ন দেখেন সুন্দর এক গৃহের, যেখানে খাদিজার সঙ্গে তাঁর দাম্পত্য কলহ নেই। খাদিজাকে নিয়ে তিনি সুখে আছেন। জিসান পড়ে খ্যাতনামা কোনো স্কুলে। অবসরে তিনি জিসানকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান স্বর্গরাজ্যে। মজার মজার সব খাবার খান। ঘুম ভেঙে গেলে স্বপ্নও ভেঙে যায়। স্বপ্ন ভেঙে গেলে তোবারক সাহেব খুব মুষড়ে পড়েন।
অফিসের ছুটি শেষ হয়ে এলো। তোবারক সাহেব আরও এক সপ্তাহ ছুটি নিলেন ফোন করে।
|| পাঁচ ||
তোবারক সাহেব এখন সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাতে চান। ঘুম ভাঙলে চুপচাপ সিলিঙের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকেন। শরীর স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল না করে বেশি বেশি খান, যাতে ভরা পেটে দ্রুত ঘুম নেমে আসে। আর সারাক্ষণ ভাবেন জিসানের কথা যাতে স্বপ্নে জিসান দেখা দেয়।
একদিন তোবারক সাহেবের ঘুম ভাঙালো সিইও আব্দুল কাইয়ুম। সে বাসায় এসেছে কীভাবে এসব ভাবার আগেই তোবারক সাহেবকে শুনতে হলো, ‘আপনি এভাবে আত্মহত্যা করতে পারেন না।’
তোবারক সাহেবের ঘুমের ঘোর এখনো কাটেনি।
‘আপনি এখন হাত-মুখ ধুয়ে অফিসে যাবেন। দেরি হয়ে গেছে অফিসের, তারপরও যাবেন। স্বপ্ন-জগতে হারিয়ে যাবার জন্য আপনি ঘুমের বড়ি খাচ্ছেন। বেশি বেশি ঘুমাতে চাচ্ছেন। হয়তোবা সারাদিনই ঘুমাতে চাচ্ছেন। আমি ঘুমের ওষুধগুলো নিয়ে যাচ্ছি। একটা জগতের জন্য আরেকটা জগৎ নষ্ট করবার অর্থ কী? ঘুমিয়ে গেলে আপনি তো জিসানের সঙ্গেই থাকছেন। আবার জাগ্রত অবস্থায় বাস করছেন মর্তের মানুষ হয়ে। আপনি কিছু হারাননি। কিন্তু বেশি বেশি ঘুমের বড়ি খেয়ে সারাক্ষণ ঘুমাবার চেষ্টা করে যদি আপনি মারা যান তবে তো জিসানকেও হারাবেন, নিজেকেও হারাবেন। তারচেয়ে বরং নিজেও বাঁচুন, জিসানকেও বাঁচিয়ে রাখুন।’
তোবারক সাহেব হাত-মুখ ধুয়ে তৈরি হচ্ছেন। এখন দুপুর একটা। তিনি পথের দুধারে জাগ্রত জীবন দেখতে দেখতে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।
তাঁর মন প্রফুল্ল। তিনি একজন ঈহাবান মানুষ।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন