স্টিগ দাগেরমানের ‘রাতের খেলাগুলো’
ভূমিকার বদলে
স্টিগ দাগেরমান [১৯২৩-১৯৫৪] একজন ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক। তাকে চল্লিশ দশকের সুইডিশ সাহিত্যে সবচেয়ে প্রতিভাশালী লেখক। প্রথম উপন্যাস ‘ওরমেন’ [সাপ] প্রকাশিত হওয়ার পর বিপুল সাড়া জাগায়। এরপর তিনি নাটক এবং আরো তিনটি উপন্যাস লেখেন যা এখনো সমান জনপ্রিয়। ঔপন্যাসিক হিসাবে তিনি অনেক পুরস্কারও অর্জন করেছেন। সাংবাদিকতা করেছেন বিভিন্ পত্রপত্রিকায়। সুইডিস এই প্রতিভাশালী লেখক দুঃখজনকভাবে মাত্র ৩১ বছর বয়সে আত্মহত্যা করে তার সম্ভাবনাময় জীবনের ইতি টানেন। প্রতিধ্বনির জন্য তার নিম্নোক্ত অনুবাদ করেছেন মাহবুব কাদেরী।
স্টিগ দাগেরমান © মারিয়া হাকসিনের সৌজন্যে
রাতের খেলাগুলো || স্টিগ দাগেরমান
কখনো সন্ধ্যাগুলোতে মা যখন রুমে বসে কাঁদে আর অপরিচিত পদক্ষেপ সিঁড়িতে ধুপধাপ শব্দ করে তখন অকে কান্নার বদলে একটা খেলা খেলতে থাকে। সে খেলাচ্ছলে ভাবে, সে অদৃশ্য আর চাইলেই ইচ্ছেমতো যেখানে খুশি যেতে পারে। ওই সন্ধ্যাগুলোতে সে যেতে চায় শুধু একটা জায়গাতেই আর সেখানেই সে হঠাৎ নিজেকে দেখতে পায়। সে জানে না কেমন করে সে সেখানে এলো, শুধু জানে সে একটা রুমের মধ্যে দাঁড়িয়ে। জায়গাটা কেমন তা সে জানে না কেননা তা দেখার চোখ নেই তার, কিন্তু তা সিগারেট ও পাইপের ধোঁয়ায় পূর্ণ এবং সেখানে পুরুষরা হঠাৎই বিনাকারণে ও ভীতিকরভাবে হেসে ওঠে আর মহিলারা যাদের কথা বোধগম্য নয়, একটা টেবিলে ঝুকে পড়ে বিশ্রীভাবে হাসাহাসি করে। তাদের হাসি অকের গায়ে ছুরির মতো লাগে, কিন্তু তবুও সে খুশি যে সে সেখানে গিয়েছে। টেবিলটায়, যার চারপাশে সবাই বসা, অনেকগুলো বোতল আর যখনই কোনো গ্লাস খালি হয় তখনই একটা হাত বোতলের কর্ক খুলে তা ভরিয়ে দেয়। অদৃশ্য অকে মেঝেতে শুয়ে পড়ে ও হামাগুড়ি দিয়ে টেবিলের নিচে ঢুকে যায়, টেবিলে বসা লোকেরা তা খেয়াল করে না। তার হাতে এক অদৃশ্য বোরমেশিন এবং এক মুহূর্তের দ্বিধা ছাড়াই সে বোরমেশিনটা দিয়ে নিচ থেকে টেবিল ফুটো করতে শুরু করে। শিগগিরই সে উপরের কাঠ ভেদ করে ফেলে তবে সেখানেই সে থামে না। সে ফুটো করতে থাকে গ্লাসগুলো এবং হঠাৎই, যখন সে বোতলগুলোও ফুটো করে ফেলেছে, তখন বোতল থেকে মদ চুয়ে পড়তে শুরু করে টেবিলের ফুটো করা ছিদ্র দিয়ে সমান ধারায়। সে টেবিলের নিচে বাবার জুতো দুটো চিনতে পারে আর তার সাহস হয় না ভাবতে কি ঘটতে পারে যদি সে হঠাৎ দৃশ্যমান হয়। কিন্তু তখনই অকে শরীরে আনন্দের স্পন্দন নিয়ে বাবাকে বলতে শোনে: ‘মদ গেলা শেষ,’ আর অন্য কেউও সায় দেয়: ‘এক্কেবারে’ এবং রুমের সবাই একযোগে উঠে পরে।
অকে বাবার সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নামে এবং যখন তারা রাস্তায় পৌঁছায় সে বাবাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়, যদিও বাবা তা খেয়াল করে না। অকে বাবাকে নিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ির কাছে আসে এবং কোচোয়ানকে ফিসফিস করে বলে তাদের সঠিক ঠিকানা, তারপর পা রাখার জায়গায় বসে লক্ষ্য করে তারা ঠিক পথে যাচ্ছে কিনা। যখন বাড়ি আসতে আর শুধু কয়েকটি ব্লক বাকি অকে আবার তার কল্পনার খেলায় বাড়ি ফিরতে চায়—আর সে নিজেকে দেখতে পায় রান্নাঘরের সোফার নিচে আর শোনে নিচে রাস্তায় গাড়িটির থামার শব্দ এবং যখন সেটি নুতন করে চলতে শুরু করে সে বুঝতে পারে এটি সেই গাড়ি নয়, এটি থেমেছিল পাশের বাসার সামনে। তার মানে আসল গাড়িটি এখনো রাস্তায়, হয়তো সেটি কাছের কোনো ক্রসিং-এ ট্রাফিক জ্যামে আটক পড়েছে, হয়তো সেটি ব্রেক কষেছে কোনো পরে যাওয়া সাইকেল চালকের সামনে। হ্যাঁ, অনেক কিছুই ঘটতে পারে একটা গাড়ির সঙ্গে।
শেষমেশ একটা গাড়ি আসে যাকে মনে হয় আসলটা। অকেদের বাড়ির কয়েক ব্লক আগে থেকে তার গতি কমে, ধীরে ধীরে অকেদের প্রতিবেশির বাড়ি পেরিয়ে সেটি এসে থামে ঠিক গেটের সামনে। একটা দরজা খোলা হয়, একটা দরজা বন্ধ হয় আবার, কারো শিস দেওয়ার শব্দ আর টাকার ঝনঝনি শোনা যায়। বাবা তো কখনো শিস দেয় না তবে নিশ্চিত কেউ কখনো বলতে পারে না। কেন সে হঠাৎই শিস দেওয়া শুরু করতে পারবে না? গাড়িটি চালু হয় ও রাস্তার কোণে মিলিয়ে যায় আর তখন রাস্তাটি নীরব হয়ে পরে।
অকে কান খাড়া করে সিঁড়ির নিচের শব্দ শোনার চেষ্টা করে কিন্তু কেউ ভেতরে ঢোকার পরে গেট বন্ধ হওয়ার যে শব্দ তা আর শোনা যায় না। সিঁড়িতে কেউ বাতি জ্বালালে খুট করে যে শব্দ হয় তাও হয় না। সিঁড়ি বেয়ে কারো ওপরে ওঠার যে ভোতা শব্দ তাও নেই।
কেন আমি তার কাছ থেকে অত আগে আসতে গেলাম, অকে ভাবে, আমি তো সাথে সাথেই আসতে পারতাম গেট পর্যন্ত, যখন আমরা এত কাছেই এসে গিয়েছিলাম। এখন বাবা নিশ্চয়ই নিচে দাঁড়িয়ে আছে আর চাবি হারিয়েছে তাই ঢুকতে পারছে না। এখন হয়তো সে রেগে চলে যাবে কোথাও এবং কাল সকালে গেট খোলার আগে আর ফিরবে না। আর সে তো শিস দিতে পারে না, নইলে সে নিশ্চয়ই শিস দিয়ে আমাকে বা মাকে বলতো চাবিটা নিচে ছুঁড়তে।
যত নিঃশব্দে সম্ভব সেভাবেই অকে সবসময় ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করা সোফাটি ডিঙিয়ে অন্ধকারে রান্নাঘরের টেবিলের দিকে চললো। রান্নাঘরের ঠান্ডা কার্পেটে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পরে, মা কাঁদছে জোরে ও একনাগাড়ে, ঘুমন্ত মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দের মতো, তার অর্থ সেও কিছু শোনেনি। অকে জানালার দিকে এগোয় আর সেখানে পৌঁছে ধীরে ধীরে পর্দাটা একপাশে সরিয়ে বাইরে তাকায়। রাস্তায় কোনো প্রাণী নেই কিন্তু উল্টো দিকের গেটের উপর বাতি জ্বলছে। সেটি জ্বলে সিঁড়ির বাতির সাথে একই সময়ে, অকেদের গেটের বাতির মতোই।
একটু পরে অকের শীত করে ও সে পা টিপে টিপে সোফায় ফিরে চলে। রান্নাঘরের টেবিলে যাতে ধাক্কা না লাগে যার জন্য সে চুলা ও বাসন ধোয়াধুয়ির বেসিনের ধারে হাত রেখে এগুতে থাকে। হঠাৎ তার আঙুল স্পর্শ করে কোনো ঠান্ডা ও ধারালো কিছু। তার আঙুলের ডগা দিয়ে একমুহূর্ত খুঁজলে তার হাতে আসে একটি ছুরির হাতল। যখন সে সোফায় ফেরে তখন ছুরিটি তার হাতে। সে সেটা কম্বলের নিচে রাখে আর আবারো নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলে। আবারো সে ফিরে যায় একই রুমে যেখানে সে আগে গিয়েছিলো, তার দরোজায় দাঁড়ায় আর পুরুষ ও মহিলাদেরকে দেখে যারা বাবাকে বন্দি করে রেখেছে। সে বুঝতে পারে বাবাকে যদি মুক্ত করতে হয় তাহলে তাকে তা করতে হবে একইভাবে যেভাবে ভাইকিং মিশনারিকে করেছিল যখন তাকে আগুনে পোড়ানোর জন্য বেঁধে রেখেছিলো ক্যানিবালরা।
অকে চুপিচুপি এগিয়ে যায়, তার অদৃশ্য ছুরি তুলে ধরে আর তা দিয়ে বাবার পাশে বসা মটকুর পিঠে ঢুকিয়ে দেয়। মটকু মরে যায় ও অকে টেবিলের চারপাশে ঘুরে ঘুরে একই কাজ করে। লোকজন একের পর এক চেয়ার থেকে নিচে পড়তে থাকে আসলে কি ঘটেছে তা না বুঝেই। এইভাবে বাবা মুক্ত হলে অকে তার বাবাকে নিয়ে অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামে এবং যেহেতু রাস্তায় কোনো গাড়ির শব্দ শোনা যায় না তাই তারা সিঁড়ি থেকে নেমে রাস্তা পেরোয় আর একটা ট্রামে উঠে পড়ে। অকে ব্যবস্থা করে যাতে বাবা ভেতরে বসতে পারে আর আশা করে যে কন্ডাক্টর খেয়াল করবে না যে বাবা একটু মাতাল। সে এও আশা করে যে বাবা কন্ডাক্টরকে আজেবাজে কিছু বলবে না বা এমনি এমনি হাসবে না, হাসার কারণ না থাকলেও।
দূরে পথের বাঁকে রাতের ট্রামের শব্দ ক্রমাগত রান্নাঘরে ঢুকে পরতে থাকে আর অকে যে কিনা ইতিমধ্যেই ট্রাম ছেড়ে এসেছে আবারো সোফায় শুয়ে লক্ষ্য করে মার কান্না থেমেছে এই অল্প সময়ের মধ্যে যখন সে বাইরে ছিল। জানালার ঝোলানো পর্দাটি বিকট শব্দ করে ছাদের দিকে উঠে যায় আর শব্দটির প্রতিধ্বনি থেমে গেলে মা জানালা খোলে। অকের ইচ্ছে করে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে দৌড়ে রুমের ভেতর যেতে আর মাকে ডেকে বলতে যে—সে আবার জানালা বন্ধ করতে পারে ও পর্দা নামিয়ে শান্তিতে ও নির্বিঘ্নে আবার ঘুমাতে পারে কারণ বাবা এখন আসবেই। ‘এই ট্রামটিতে সে আসবেই কেননা আমি নিজে তাকে এটাতে তুলে দিয়েছি।’ কিন্তু অকে বোঝে এটা বলে কোনো লাভ হবে না, কারণ মা তাকে বিশ্বাস করবে না। মা জানেনা অকে তার জন্য কি করে যখন রাত্রিবেলা তারা শুধু দুজন বাসায় আর মা ভাবে অকে ঘুমায়। মা জানেনা কতবার অকে বাইরে যায় আর কত রকমের অভিযানে সে ঝাঁপিয়ে পরে শুধু তার জন্য।
এরপর ট্রামটি যখন রাস্তার কোণার বাসস্টপে দাঁড়ায় তখন সেও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পর্দার ফাক দিয়ে বাইরে তাকায়। রাস্তার কোনায় প্রথম দেখা যায় দুই কিশোরকে যারা সম্ভবত ট্রাম থামার আগেই নেমে গিয়েছিলো। তারা দুজনে মজা করে একে অন্যের সঙ্গে বক্সিং করে আর তারা থাকে উল্টো দিকে কোনার বাড়িটাতে। ট্রাম থেকে নেমে পরা যাত্রীদের গলার শব্দ শোনা যায় রাস্তার কোনায় আর বাতিজ্বালা ট্রামটি অকেদের রাস্তা দিয়ে সশব্দে চলে যায় ও নেমে পরা লোকজন সামনে এসে নানা দিকে চলে যায়। ভিখারিদের মতো টুপি মাথায় একজন অস্থির পায়ে তাদের গেটের দিকে এগোয়, কিন্তু সে তার বাবা নয় বরং তাদের বাসার দারোয়ান।
যাহোক অকে দাঁড়িয়ে থাকে এবং অপেক্ষা করে। সে তো জানে যে অনেক কিছুই আছে যা একজন যাত্রীকে আটকে রাখতে পারে রাস্তার কোণটিতে। সেখানে দেয়ালে অনেক বিজ্ঞাপন যার একটা জুতোর দোকানের, যেখানে বাবা দাঁড়িয়ে নিজের জন্য একজোড়া জুতো পছন্দ করতে পারে বাড়ি ফেরার আগে আর ফলের দোকানেরও হাতে আঁকা একটা প্ল্যাকার্ড আছে, যার সামনে অনেকেই দেখার জন্য দাঁড়ায়, কেননা তাতে মানুষের মজার মজার ছবি। তবে ফলের দোকানে আবার একটা অটোমেটিক মেশিনও আছে যেটা মাঝে মাঝে নষ্ট হয় এবং এমন হতে পারে বাবা সেই মেশিনে পঁচিশ পয়সা ঢুকিয়েছে অকের জন্য এক প্যাকেট ল্যাকেরোল কিনতে আর এখন মেশিনটা কাজ করছে না।
যখন অকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে বাবা কখন মেশিনের ঝামেলা থেকে ছাড়া পাবে তখন হঠাৎই মা রুম থেকে বের হয় ও রান্নাঘর পার হয়ে চলে যায়। যেহেতু মা খালি পায়ে তাই অকে কিছু শুনতে পায়নি কিন্তু মাও কিছু খেয়াল করেনি, কেননা সে হলের দিকে যেতে থাকে। অকে জানালার ঝুলপর্দাটি হাত দিয়ে নামিয়ে নেয়, তারপর নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে একেবারে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর মা বাইরের কাপড়চোপড়ের মধ্যে কী যেন খুঁজতে থাকে। তা নিশ্চয়ই নাক মোছার রুমাল কারণ একটু পরেই তার নাক ঝাড়ার শব্দ শোনা যায় আর সে তার রুমে ফেরত যায়। যদিও তার খালি পা তবু অকে লক্ষ্য করে মা খুবই নিঃশব্দে হাঁটে যাতে অকে জেগে না যায়। রুমে ঢোকার পরপরই মা জানালা বন্ধ করে আর সশব্দে ঝুলপর্দাটি নামিয়ে নেয়। তারপর সে তাড়াতাড়ি বিছানায় শুয়ে পড়ে যেন সে কাঁদতে পারে না বিছানায় শোয়া ছাড়া অথবা বিছানায় শুয়ে পড়ার সাথে সাথেই তাকে অবশ্যই কাঁদতে হবে।
যখন অকে আরেকবার রাস্তার দিকে তাকায় আর দেখতে পায় তা একেবারে ফাঁকা তখন সে তাদের উল্টা দিকের গেটে এক তরুণী যেমন গোপনে এক নাবিকের আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়, তেমনি চুপিচুপি তার সোফায় ফিরে আসে। মনে হয় তার পায়ের নিচে কার্পেটে হঠাৎই শব্দ হলো যেন সে কিছু ফেলে দিয়েছে। সে এখন দারুণ ক্লান্ত, রাজ্যের ঘুম কুয়াশার মতো ঢেকে ফেলে তাকে যখন সে হাঁটে আর সেই কুয়াশার মাঝে সে উপলব্ধি করে সিঁড়িতে ধুপধাপ শব্দ, কিন্তু উল্টা দিকে: উপর থেকে নিচে। যখনি সে লেপের নিচে ঢোকে, অনিচ্ছাসত্ত্বে কিন্তু দ্রুত সে তলিয়ে যায় ঘুমের অতলে আর তার উপরে আছড়ে পড়ে শেষ ঢেউগুলো, তারা কান্নার মতো নরম। কিন্তু ঘুম এত ভঙ্গুর যে তা তাকে দূরে রাখতে পারে না যা তাকে ব্যস্ত রাখে যখন সে জেগে থাকে। এটা ঠিক যে সে কোনো গাড়িকে গেটের সামনে ব্রেক করতে শোনেনি, শোনেনি সিঁড়ির বাতি জ্বালানোর বা সিঁড়ি বেয়ে কারো উপরে ওঠার শব্দ কিন্তু যে চাবি তালার মধ্যে প্রবেশ করে তা প্রবেশ করে তার ঘুমের মধ্যেও আর নিমেষেই সে জেগে যায়। আনন্দ তার উপর নেমে আসে হঠাৎ চমকানো বিদ্যুতের মতো, তাকে উষ্ণ করে তোলে পা থেকে কপাল পর্যন্ত। কিন্তু তারপর আনন্দ তেমনই দ্রুত উধাও হয়, একগাদা প্রশ্নের ধুম্রজালের মধ্যে। এমন পরিস্থিতির জন্য অকের একটি খেলা আছে, যা সে খেলে থাকে যখনই সে এভাবে জেগে যায়। সে কল্পনা করে, বাবা তখনই হল দিয়ে দ্রুত হেঁটে আসে আর রান্নাঘর ও রুমের মাঝামাঝি এমনভাবে দাঁড়ায়, যাতে তারা দুজনই শুনতে পারে যখন সে উঁচু গলায় বলে: কাজের সময় একজন উপর থেকে নিচে পরে গিয়েছিলো এবং আমাকে তার সঙ্গে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল আর তার সঙ্গেই আমি ছিলাম সারারাত, কিন্তু ফোন করতে পারিনি। কেননা কোনো ফোন ছিল না সেখানে, অথবা: ভাবতে পারো বসের কাছ থেকে আমি আজ একটা মোটরবোট পেয়েছি যা নিয়ে ঘুরেছি ও চালিয়ে দেখেছি কেমন লাগে। কাল সকালে আমরা তিনজন যাচ্ছি ওতে ঘুরতে। কি বলো তোমরা?
কিন্তু বাস্তব আরো ধীরগতির এবং তারও চেয়ে বড় কথা, আরো কম আশ্চর্যের। বাবা হলঘরের সুইচ খুঁজে পায় না। শেষে চেষ্টা ছেড়ে দেয় আর একটা কাপড় ঝোলানোর হ্যাঙ্গারের সাথে তার ধাক্কা লাগলে সেটা মেঝেতে পরে যায়। সে হ্যাঙ্গারটাকে গালি দেয় আর সেটা তুলতে চেষ্টা করে, কিন্তু তা করতে গিয়ে সে দেয়ালের পাশে রাখা একটা ব্যাগকে উল্টে ফেলে। তখন সেই চেষ্টা বাদ দিয়ে সে ওভারকোট রাখার জন্য একটা হুক খোঁজে আর শেষে যখন সে তা খুঁজে পায়, তখন ওভারকোটটি তার হাত থেকে পড়ে যায় মেঝেতে একটা নরম শব্দ করে। দেয়ালে ভর দিয়ে বাবা তারপর কয়েক পা এগিয়ে পৌঁছে যায় টয়লেটে, দরজাটি খোলে এবং সেটা খুলেই রাখে, তারপর বাতি জ্বালায় আর আগের অনেকবারের মতো অকে শক্ত হয়ে শুয়ে থাকে ও শোনে মেঝেতে প্রস্রাবের শব্দ। তারপর বাবা বাতি নেভায়, দরজার সাথে ধাক্কা খায় আর গালি দেয় আর রুমে ঢোকে পর্দাটি সরিয়ে যেটা হিসহিস শব্দ করে যেন কামড়াতে চায়।
তারপর একেবারে নীরব। বাবা ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু কোনো কথা বলে না, জুতোর অস্পষ্ট শব্দ আর তার ভারী ও অনিয়মিত নিঃশ্বাস শোনা যায়—শুধু এই দুটি জিনিসই সবকিছুকে আরো ভয়ঙ্কর নীরব করে তোলে এবং সেই নীরবতার মধ্যে অকের ওপর যেন এক বজ্রপাত হয়। ঘৃণা তাকে উত্তপ্ত করে এবং সে ছুরির হাতলটা এমন জোরে আঁকড়ে ধরে যে তার হাতের তালুতে লাগে, কিন্তু সে কোনো ব্যথা অনুভব করে না। নীরবতা শুধু এক মুহূর্তই স্থায়ী হয়। বাবা কাপড় খুলতে শুরু করে। কোট, ভেস্ট। কাপড়গুলো সে ছুড়ে মারে একটা চেয়ারে। সে একটা আলমারিতে হেলান দেয় ও তার জুতোগুলো পা থেকে খুলে পরে। টাইটি গলা থেকে উড়ে যায়। তারপর সে রুমের আরো ভিতরে কয়েক পা এগিয়ে যায় ও খুব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ঘড়িতে দম দিতে শুরু করে। তখন সবকিছু আবার নীরব হয়, আগের মতোই ভয়ঙ্কর নীরব। শুধু ঘড়িটা নীরবতাকে কুটে কুটে খায় ইঁদুরের মতো—মাতালের দাঁতালো ঘড়ি।
তখন ঘটে তাই যার জন্য নীরবতা অপেক্ষা করছিলো। অকের মা অসহ্য রাগে নিজেকে বিছানায় নিক্ষেপ করে আর তার রক্তের মতো মুখ থেকে চিৎকার বেরিয়ে আসে।
—তুমি শয়তান, শয়তান, শয়তান, শয়তান শয়তান শয়তান, সে চিৎকার করতে থাকে যতক্ষণ না তার স্বর দুর্বল হয়ে মিলিয়ে যায় আর সব নীরব হয় আবার। শুধু ঘড়িটি টিকটিক করে আর ছুরি ধরা হাতটা ঘামে একেবারে ভিজে যায়। দুশ্চিন্তা এমনই প্রবল ছিল যে অস্ত্র ছাড়া তা সহ্য করা সম্ভব ছিল না, কিন্তু অকে এরকম ভীষণ ভীত হয়ে শেষে এতই ক্লান্ত হয়ে পরে যে বিনা প্রতিরোধে মাথাটা এলিয়ে ঘুমে ভেঙে পরে। গভীর রাতে সে আবার একটু সময়ের জন্য জেগে ওঠে আর শোনে রুমের খাটটি থেকে কেমন ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হয় এবং একটি মৃদু গুঞ্জনে রুমটি ভরে যায়। সে ঠিক জানে না সেই শব্দের কি মানে তবে সেই দুটি শব্দ তাকে আশ্বস্ত করে যে আজ রাতের মতো দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে। নিজের প্রতি জ্বলন্ত ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে এখনো সে যে ছুরিটি ধরে ছিল তা ছেড়ে দেয় ও দূরে ঠেলে দেয় আর ঘুমিয়ে পরার মুহূর্তে সে রাতের শেষ খেলাটি খেলে যা দেয় তাকে চূড়ান্ত শান্তি।
চূড়ান্ত—এখানে চূড়ান্ত বলে কিছু নেই। যখন ঘড়িতে প্রায় সন্ধ্যা ছয়টা তখন রান্নাঘরে যেখানে টেবিলে বসে সে অংকের হিসাবনিকাশ করছিলো, মা সেখানে ঢোকে। সে তার হাত থেকে অংকের খাতাটা নিয়ে নেয় আর এক হাতে তাকে সোফা থেকে টেনে তোলে।
—‘বাবার কাছে যা,’ মা বলে আর তাকে সাথে নিয়ে হলে যায় এবং অকের পেছনে দাঁড়ায় যাতে সে পিছু হটতে না পারে, ‘বাবার কাছে যা আর বল যে তোকে টাকাগুলো দিতে বলেছি।’
দিনগুলো রাতের চেয়ে খারাপ। রাতের খেলাগুলো দিনের চেয়ে অনেক ভালো। রাতে মানুষ অদৃশ্য থাকতে পারে আর ছাদের উপর দিয়ে যেখানে দরকার চলে যেতে পারে। দিনের বেলায় মানুষ অদৃশ্য নয়। দিনের বেলা সব তাড়াতাড়ি হয় না, দিনে খেলতে এত মজা নেই। অকে গেটের বাইরে আজ এবং সে মোটেও অদৃশ্য নয়। দারোয়ানের ছেলে তার জামা ধরে টানে ও মার্বেল খেলতে চায় কিন্তু অকে জানে মা জানালায় দাঁড়িয়ে আর তার চোখ তাকে অনুসরণ করবে মোড়ে সে হারিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তাই সে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় আর দৌড় দেয় যেন কেউ তার পিছনে লেগেছে। কিন্তু যে মুহূর্তে সে মোড়টি পার হয়, সে যত আস্তে সম্ভব হাঁটা শুরু করে আর ফুটপাথের টাইলস আর তাতে থুতুর দাগ গোনা শুরু করে। দারোয়ানের ছেলেটি দৌড়ে তাকে ধরে ফেলে কিন্তু অকে তার কথায় সাড়া দেয় না, কারণ মানুষ কাউকে বলতে পারে না যে সে বের হয়েছে বাবাকে খুঁজতে, যে এখনো বেতনের টাকা নিয়ে ঘরে ফেরেনি। শেষমেশ দারোয়ানের ছেলে ক্লান্ত হয়ে সরে পড়ে আর অকে ক্রমেই সেই জায়গার নিকটবর্তী হয় যে জায়গায় সে আসলে যেতে চায় না। সে কল্পনা করে যে সে ওই জায়গাটি থেকে দূরে আরো দূরে চলে যাচ্ছে কিন্তু তা মোটেও সত্যি নয়।
তবে সে এই প্রথম ক্যাফেটি পেরিয়ে যায়। সে দারোয়ানের এতো গা ঘেঁষে যায় যে দারোয়ান চমকে গিয়ে তার পেছনে কিছু বলে। সে ঢুকে পরে পাশের একটা গলিতে ও সেই বাড়িটির সামনে গিয়ে থামে যেখানে বাবার কারখানা। একটু পরে সে গেইট দিয়ে ঢুকে পরে ও ভিতরের চত্বরে গিয়ে দাঁড়ায়। সে কল্পনা করে যে বাবা সেখানে আছে আর বস্তা ও ব্যারেলগুলোর আড়ালে কোথাও লুকিয়েছে এজন্য যে অকে সেখানে আসবে এবং তাকে খুঁজে বের করবে। অকে ব্যারেলগুলোর ঢাকনা তুলে ধরে ও প্রতিবার একইরকম অবাক হয় দেখে যে বাবা গুটিসুটি হয়ে বসে নেই ওরকম একটা ব্যারেলের মধ্যে। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে খোঁজাখুঁজি করার পর সে শেষে বুঝতে পারে যে বাবা সেখানে লুকিয়ে থাকতে পারে না এবং সে ফিরে চলে।
ক্যাফের পাশেই একটা চিনামাটির তৈরি জিনিসপত্রের দোকান ও একটা ঘড়ির দোকান। অকে প্রথম দোকানটির সামনে দাঁড়ায় ও কাঁচের শোকেসে তাকায়। সে গুনতে চেষ্টা করে কুকুরগুলোকে, প্রথমে জানালায় রাখা সিরামিকের গুলো, তারপর অন্য কুকুর যেগুলো দেখা যায় বিভিন্ন তাকে ও ডেস্কে। ঘড়ির দোকানদার ওই সময় দোকান থেকে বেরিয়ে আসে ও জানালার গ্রিলটি নামিয়ে দেয় কিন্তু ফাঁক দিয়ে অকে তবুও দেখতে পায় ভিতরে থাকা ও টিকটিক শব্দ করা হাতঘড়িগুলো। সে আরো দেখে ‘ঠিক’ সময় দেয়া ঘড়িটি আর ভাবে সে ভিতরে যাওয়ার আগে মিনিটের কাটাটি আরো দশবার ঘুরুক।
ক্যাফের দারোয়ান যখন একটা লোককে বকছে তাকে খবরের কাগজে কিছু একটা দেখানোর জন্য, তখন অকে চুপিসারে ক্যাফেতে ঢুকে পরে আর দৌড়ে সোজা ঠিক টেবিলের সামনে যায় যাতে বেশি কেউ তাকে দেখতে না পারে। বাবা তাকে দেখে না প্রথমে কিন্তু রংমিস্ত্রিদের একজন অকের দিকে মাথা ঝোঁকায় ও বলে: তোমার ছেলে তো এখানে।
বাবা ছেলেকে তার কোলে তুলে নেয় আর তার দাড়ি ঘষে ছেলের গালে। অকে চেষ্টা করে বাবার চোখের দিকে না তাকাতে কিন্তু মাঝে মাঝে বাবার চোখের সাদা অংশে লাল দাগগুলো তবু তাকে কৌতূহলী করে তোলে।
—‘কি চাস তুই, বাপজান,’ বাবা বলে নরম ও জড়ানো জিহ্ববায়। একই কথা অন্তত দুইবার বলতে হয় তাকে, নিজের কাছেও বোধগম্য হওয়ার জন্য।
—আমার টাকা লাগবে।
তখন বাবা তাকে আস্তে করে মেঝেতে নামিয়ে দেয় আর পেছনে হেলান দিয়ে এত জোরে হেসে ওঠে যে তার সঙ্গীদেরকে তাকে থামাতে হয়। হাসতে হাসতে বাবা পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ও কাঁপা হাতে রাবারের ফিতা টেনে ভিতরে খুঁজতে থাকে যতক্ষণ না সে খুঁজে পায় সবচেয়ে চকচকে এক ক্রোনাটি।
—এই যে অকে, নে, বাবা বলে। এখন যা আর ভালোমন্দ কিছু কিনে খা, বাবা।
অন্য রংমিস্ত্রিরাও কম যায় না, অকে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে এক ক্রোনা করে পায়। সে টাকাগুলো তার মুঠিতে ধরে রাখে আর একই সঙ্গে লজ্জা ও বিভ্রান্তিতে অভিভূত হয়ে টেবিলগুলোর মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে যায়। সে খুবই ভীত হয়ে ভাবে যে যখন সে দারোয়ানকে পার হয়ে বের হবে তখন কেউ তাকে দেখে ফেলবে আর পরে স্কুলে বলাবলি করবে যে গতকাল সন্ধ্যায় আমি অকেকে দেখেছি একটা বিয়ারের ক্যাফে থেকে বের হতে। কিন্তু সে তবু ঘড়ির দোকানের জানালার সামনে দাঁড়ায় আর যখন ঘড়ির কাঁটা দশবার তার কেন্দ্রকে পর্যবেক্ষণ করে তখন সে দোকানের গ্রিলে গা লাগিয়ে দাঁড়ানো। সে জানে যে আজ রাতেও তাকে খেলতে হবে তবে জানে না যে দুজনের জন্য তার এই খেলা তাদের মধ্যে কাকে সে বেশি ঘৃণা করে।
যখন সে ধীরে ধীরে রাস্তার মোড়ে আসে তখন সে দশ মিটার ওপর থেকে তাকিয়ে থাকা মাকে দেখতে পায় আর যত ধীরে সম্ভব গেটের দিকে এগিয়ে যায়। গেটের পাশে একটি কাঠকয়লার দোকান আর সে হাঁটু গেড়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে পায় এক বুড়োকে যে কালো একটা ঝুড়িতে কয়লা তুলছে। বুড়োর কয়লা তোলা সারা আর মাও তখুনি তার পেছনে দাঁড়িয়ে। সে তাকে টেনে তোলে ও তার চিবুক ধরে মুখটি উপরে ওঠায় যাতে তার চোখ দেখতে পারে।
—কি বললো সে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে মা। নাকি তুই আবার ভয় পেয়েছিলি?
—বাবা বললো যে সে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবে, অকেও ফিসফিস করে উত্তর দেয়।
—আর টাকা?
—চোখ বন্ধ করো মা, অকে বলে আর দিনের শেষ খেলাটি শুরু করে।
মা যখন চোখ বন্ধ করে তখন অকে চুপিচুপি মার বাড়ানো হাতে চারটি এক ক্রোনারের মুদ্রা রাখে আর তারপর রাস্তার দিকে দৌড় দেয়, ভীষণ ভয়ে পাথরে পিছলে যাওয়া পা দুটি টেনে টেনে। একটা ক্রমবর্ধমান চিৎকার বাসার দেয়ালগুলো পেরিয়ে তাকে ধাওয়া করে, কিন্তু তা তাকে থামাতে পারে না বরং আরো জোরে দৌড়াতে বাধ্য করে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন