অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের ‘লালন ফকির’

অ+ অ-

 

|| ভূমিকার বদলে ||

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় [১৮৬১-১৯৩০] একজন ঐতিহাসিক ও সমাজকর্মী। জন্ম ১৮৬১ সালের ১ মার্চ নদীয়া জেলার নওয়াপাড়া থানার সিমুলিয়ায়। ১৮৮৫ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে বি.এল পাস করার পর তিনি রাজশাহীতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। গবেষণা ও ইতিহাস চর্চায় তিনি সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস, শিল্পকলা ও পটশিল্প সম্পর্কে গভীর ও প্রামাণিক জ্ঞান অর্জন করেন। ঐতিহাসিক চিত্র [১৮৯৯] শিরোনামে  সিরাজউদ্দৌলা,  মীর কাসিম,  রানী ভবানী, সীতারাম, ফিরিঙ্গি বণিক প্রমুখ ব্যক্তিকে নিয়ে ইতিহাস বিষয়ক প্রথম বাংলা সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান, শিল্পকলা ও পটশিল্প সম্পর্কে তথ্যমূলক নিবন্ধও প্রকাশ করেন। তিনি ১৯১২ সালে প্রকাশিত গৌড়লেখমালায় কয়েকটি পাল তাম্রশাসন ও শিলালিপি বাংলা অনুবাদসহ সম্পাদনা করেন। যার ফলে বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিক গবেষণার নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হয়। তার উল্লেখযোগ্যগ্রন্থ—সমরসিংহ [১৮৮৩], সিরাজদ্দৌলা [১৮৯৮], সীতারাম রায় [১৮৯৮], মীরকাসিম [১৯০৬], গৌড়লেখমালা [১৯১২], ফিরিঙ্গি বণিক [১৯২২] ও অজ্ঞেয়বাদ [১৯২৮]। ১৯১০ সালের এপ্রিলে রাজশাহী জাদুঘরও [বর্তমান বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম] প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা অনন্য। সংস্কৃত নাটকের সঙ্গেও তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। ছিলেন একজন ভাল ক্রিকেট খেলোয়াড় ও চিত্রকর। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ১৯৩০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। প্রতিধ্বনি তার আলোচিত ‘লালন ফকির’ শিরোনামের রচনাটি প্রকাশ করছে। তথ্যগত দিক থেকে এ রচনার দুয়েক ক্ষেত্রে সমালোচনা বাহ্য নয়, কিন্তু রচনাটির ঐতিহাসিক মূল্য বিস্তর। রচনাটি ছোট হলেও পাঠক এতে চিন্তার খোরাক পাবেন।  

 

লালন ফকির || অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়

লালন ফকিরের সকল কথা ভাল করিয়া জানি না, যাহা জানি তাহাও কিম্বদন্তীমূলক। লালন নিজে অতি অল্প লোককেই আত্মকাহিনী বলিতেন, তাঁহার শিষ্যেরাও বেশী কিছু সন্ধান বলিতে পারেন না। লালন জাতিতে কায়স্থ, কুষ্টীয়ার নিকটবর্তী চাপড়াগ্রামের ভৌমিকেরা তাঁহার স্বজাতীয়। ১০/১২ বৎসর বয়সে বারুণী গঙ্গাস্নান উপলক্ষে মুর্শিদাবাদে যান, তথায় উকট বসন্তরোগে আক্রান্ত হইয়া মুমূর্ষ দশায় পিতা-মাতা কর্তৃক গঙ্গাতীরে পরিত্যক্ত হন। লালনের মুখে বসন্তচিহ্ন বৰ্ত্তমান ছিল বলিয়া অনেকে এই কাহিনী বিশ্বাস করিয়া থাকেন। শ্মশানশায়ী লালনকে একজন মুসলমান ফকীর সেবাশুশ্রূষায় আরোগ্য করিয়া লালনপালন করেন ও ধর্মশিক্ষা প্রদান করেন। এই ফকিরের নাম সিরাজ সা, জাতিতে মুসলমান। লালনের প্রণীত অনেক গানে এই সিরাজ সা দীক্ষাগুরুর উল্লেখ আছে।

লালনের ধর্মমত অতি সরল ও উদার ছিল। তিনি জাতিভেদ মানিতেন না, হিন্দু মুসলমানকে সমভাবে দেখিতেন ও শিষ্যদিগের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সকল জাতিকেই গ্রহণ করিতেন। লালন হিন্দু নাম, সা উপাধি মুসলমান জাতীয় সুতরাং অনেকেই তাঁহাকে জাতির কথা জিজ্ঞাসা করিত। তিনি কোনো উত্তর না দিয়া কেবল স্বপ্রণীত নিম্নলিখিত গানটি শুনাইতেন:

১ | সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে?
লালন ভাবে–জাতির কি রূপ দেখলাম না এই নজরে।
কেউ মালা কেউ তজবী গলায়,
তাইতে ত জাত ভিন্ন বলায়,
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়
জাতের চিহ্ন রয় কার রে?

২ | যদি সুন্নত দিলে হয় মোসলমান।
নারীর তবে কি হয় বিধান।
বামন চিনি–পৈতা প্রমাণ,
বামনী চিনি কিসে রে?

৩ | জগৎ বেড়ে জেতের কথা,
লোকে গৌরব করে যথা তথা,
লালন সে জেতের কাতা,
ঘুচিয়েছে সাধ-বাজারে।

একটা কথা বলিয়া রাখিলালন নিরক্ষর ছিলেন। তাঁর সুদীর্ঘ দেহ, উন্নত ললাট, উজ্জ্বল চক্ষু, গৌরবর্ণ মুখশ্রী এবং প্রশান্তভাব দেখিয়া তাঁহাকে হিন্দু বলিয়া চিনিতে পারা যাইত এবং স্বাভবিক তীক্ষ্ণবুদ্ধির সঙ্গে ধৰ্ম্মজীবনের প্রেমোন্নত্ততা মিলিত হইয়া তিনি যে নিরক্ষর তাহা যেন সহজে বুঝিতে পারা যাইত না।

লালনের ধর্মমতের নিকট হিন্দু মুসলমানের ভেদাভেদ ছিল না, স্ত্রী পুরুষেরও সমান অধিকার ছিলঅনেক রমণী ইহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়েছেন। সত্য কথন সত্য ব্যবহার লালনের সাধন ও তাঁহার স্বরচিত সঙ্গীত তাঁহার ভজনইহা ভিন্ন অন্য কোনো কথা বাহিরের লোকে জানে না, তিনিও জিজ্ঞাসা করিলে বাহিরের লোককে ইহার অধিক কিছু বলিতেন না।

বৈষ্ণবদিগের ধর্মমতের প্রতি ইহার স্বাভাবিক অনুরাগ ছিল এবং শ্রীকৃষ্ণকে কখন কখন অবতার বলিয়া স্বীকার করিতে শুনা গিয়াছে।

কুষ্টীয়ার নিকটবর্তী সেওরিয়া গ্রামে লালনের আস্তানা বা আখড়া ছিল। তিনি তথায় প্রতি বৎসর ৫/৬ শত টাকা ব্যয় করিয়া শীতকালে একটি উৎসব করিতেন। তাহাতে সকল দেশের শিষ্য সম্মিলিত হইত। ইহার শিষ্য সংখ্যা প্রায় দশ হাজারপ্রায়ই নিরক্ষর কৃষক। ইনি সংসারী ছিলেন, স্ত্রী এখনও বৰ্ত্তমান, তিনিই গদীর অধিকারিণী ও শিষ্যদিগের গুরুমা।

লালন অশ্বারোহণে দেশবিদেশ ভ্রমণ করিতেন। এদানীক বৃদ্ধাবস্থায় প্রায় চলচ্ছক্তিহীন হইয়া পড়িয়াছিলেন। ১৮৯১ সালের ১৭ অক্টোবর শুক্রবার প্রাতে ১১৬ বৎসর বয়সে লালনের মৃত্যু হয়। পূৰ্ব্ব রাত্রে শিষ্য সঙ্গে গান গাহিয়া প্রভাতে বলিলেন আমি চলিলাম এবং তার পর হইতেই মৃত্যু আসিয়া উপস্থিত হইল। তাঁহার আদেশানুসারে আস্তানার একটি গৃহমধ্যে মৃতদেহ সমাধিস্থ হইয়াছে। তাঁহার সম্মত্তি জোত জমা ও নগদ কয়েক সহস্র টাকা ছিল তাহা কতক স্ত্রীকে কতক এক ধৰ্ম্মকন্যাকে ও কতক প্রধান শিষ্য শীতল সাকে ও কতক সকাৰ্য্যে দান করিয়া গিয়াছেন।

লালনের জীবনী লিখিবার উপকরণ সংগ্রহ করিবার কখনও চেষ্টা করি নাই; তাঁহার রচিত গানগুলিও লিখিয়া রাখি নাই। সেগুলি সংগ্রহ করিতে পারিলে কতক পরিচয় দিতে পারিতাম।

লালনের শিষ্যেরা প্রায়ই নিরক্ষর ও দরিদ্র, কিন্তু তাহাদের সত্যনিষ্ঠা খুব প্রশংসনীয়। ইহারা স্ত্রী-পুরুষে মিলিয়া গান গাহিয়া ভজন করে এবং লালনকে গুরু বলিয়া মানে। লালন নিজেও গুরুবাদী ছিলেন।

লালনের ধর্মমত কোনো পুস্তকে লিখিত নাই, তিনিও কোনো পুস্তক মানিতেন না; তবে বৈষ্ণব কবিদিগের করচাগ্রন্থ আদরের সঙ্গে শ্রবণ করিতেন এরূপ দেখা গিয়াছে।

শ্রীযুক্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের চিত্র পুস্তকে ইহার একটি প্রতিকৃতি দেখিয়াছি তাহাই লালনের পার্থিবদেহের একমাত্র ছায়াঅসম্পূর্ণ হইলেও তাহাই একমাত্র আদর্শ।

কুষ্টীয়ার উকীল বাবু রাইচরণ বিশ্বাস, কুমারখালীর খ্যাতনামা হরিনাথ মজুমদার ও তাঁহার ফিকিরচাঁদের দলস্থ লোকেরা লালনের অনেক গান ও জীবনের অনেক ঘটনা জানেন এবং লালনের মৃত্যুর পরই কুষ্টীয়া হইতে প্রকাশিত হিতকরী নামক সংবাদপত্রে তাঁহার একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশিত হইয়াছিল। আমি কুমারখালীতে অনুসন্ধান করিয়া যতদূর জানিয়াছি তাহা লিখিলাম।

ভারতী, ভাদ্র, ১৩০২ 

নোট: লেখার ভাষা ও বানানরীতি লেখকের অনুরূপ রাখা হলো।