কামিনী রায়ের আলোচিত নিবন্ধ ‘বরপণ’

কথা সামান্য
উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের একজন প্রথিতযশা বাঙালি কবি, সমাজকর্মী এবং নারীবাদী লেখিকা কামিনী রায়। ভারতের প্রথম মহিলা অনার্স গ্র্যাজুয়েট [সংস্কৃত]। জন্ম বৃহত্তর বরিশালের অন্তর্গত ঝালকাঠি জেলার বাসণ্ডা গ্রামে ১৮৬৪ সালের ১২ অক্টোবর। পিতা চণ্ডীচরণ সেন একজন ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী, বিচারক ও ঐতিহাসিক লেখক। মাত্র ৮ বছর বয়স থেকে কামিনী রায় কবিতা লেখা শুরু করেন। রচিত কবিতাগুলোতে জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনার সহজ-সরল ও সাবলীল প্রকাশ ঘটেছে। মাত্র পনেরো বছর বয়সে, ১৮৮৯ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ আলো ও ছায়া প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু প্রথমে এতে গ্রন্থকর্ত্রী হিসেবে কামিনী রায়ের নাম প্রকাশিত হয় নাই। গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে তার কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
তার লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—আলো ও ছায়া [১৮৮৯], নির্মাল্য [১৮৯১], পৌরাণিকী [১৮৯৭] মাল্য ও নির্মাল্য [১৯১৩], অশোক সঙ্গীত [সনেট সংগ্রহ, ১৯১৪], অম্বা [নাট্যকাব্য, ১৯১৫], দীপ ও ধূপ [১৯২৯], জীবন পথে [১৯৩০] প্রভৃতি। অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত মহাশ্বেতা ও পুণ্ডরীক তার দুটি প্রসিদ্ধ দীর্ঘ কবিতা। এছাড়াও, ১৯০৫ সালে তিনি শিশুদের জন্য গুঞ্জন নামের কবিতা সংগ্রহ ও প্রবন্ধ গ্রন্থ বালিকা শিক্ষার আদর্শ রচনা করেন। ১৯৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়।
লক্ষণীয় বিষয়, কামিনী রায় যে সময় কাব্যচর্চা শুরু করেন সে সময় মেয়েরা ছিল অন্তঃপুরবাসিনী। গৃহস্থ কাজকর্মের মধ্য দিয়ে যেন তাদের জীবন অতিবাহিত হতো। কামিনী রায় সে সময়ের অবলা নারীর সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার ও তাদের অধিকারের কথা নানাভাবে উপস্থাপন করেছেন তাঁর লেখায়। বেগম রোকেয়ার মতো কামিনী রায়ও নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, তাঁদের অধিকারের কথা নানাভাবে প্রচার করেছেন। এসব লেখা আজও আমাদের সমাজ বাস্তবতায় যেন প্রাসঙ্গিক। এমন প্রশ্ন অমূলক নয়, সাতানব্বই বছরে আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র কতটুকু এগোলো? বর্তমান সময়ের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো কামিনী রায়ের তেমনই এক লেখা ‘বরপণ’। লেখাটি নেওয়া হয়েছে মিজান রহমান সম্পাদিত কামিনী রায় রচনা সংগ্রহ থেকে।
কেহ কেহ এই বলিয়া বরপণ সমর্থন করেন যে, এদেশের আইনে পিতার মৃত্যুর পর কন্যা তাঁহার সম্পত্তির অল্পাংশেরও উত্তরাধিকারিণী হয় না। সুতরাং পিতা যখন জীবিত এবং কন্যাকে পাত্রস্থ করিবার জন্য আগ্রহান্বিত, ঠিক সেই সময় কন্যার জন্য কিছু সংস্থান করিয়া লইবার একমাত্র পথ এই বরপণ।
বরপণ
বরপণ কি?—এই বাংলা দেশে কোন বালিকার পিতা বা অভিভাবক যে মূল্য দিয়া উহার জন্য বর ক্রয় করেন তাহারই নাম বরপণ। হিন্দু ধর্ম্মানুসারে বিবাহ একটা ধর্ম্মাত্মক পবিত্র অনুষ্ঠান, একটা অবশ্য কর্ত্তব্য সংস্কার; ইহা চুক্তির ব্যাপার নহে। বিবাহের বন্ধন অচ্ছেদ্য। পত্নী কেবল সহকর্ম্মিণী নহে, যে সহধর্ম্মিণী,পতির আধ্যাত্মিক জীবনের অংশীভাগিনী। কিন্তু আজ কাল প্রায় সর্ব্বত্র এই অংশীদারীর আরম্ভে টাকা কড়ি সংক্রান্ত একটা চুক্তি দেখা যায়। এ যেন একটা ক্রয় বিক্রয়ের ব্যাপার। এই ব্যাপারের মধ্যে একটা আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যে বাজারে দাসদাসী বিক্রয় হয় সেখানে মূল্যটি হয় দিতে হয় দাস কিংবা দাসীর জন্য; কিন্তু বিবাহের বাজারে মূল্য দিয়া কিনিতে হয় মনিব। যে সকল লোকের অর্থসম্পত্তি যথেষ্ট নাই কিন্তু কন্যা অনেকগুলি আছে, এই পণপ্রথা তাহাদের সর্ব্বস্বান্ত করে। কন্যাদের বিবাহ দিতে গিয়া তাহারা ঋণগ্রস্ত হয় এবং তাহাদের বাটিভিটা সব উত্তমর্ণের কাছে বাঁধা পড়ে। যাহারা প্রথমাবধিই দরিদ্র, আপনার উপার্জ্জন দিয়া বরপণ জোগাইতে পারে না, মহাজনের কাছেও যাহাদের ঋণ পাইবার সম্ভাবনা নাই, তাহাদের কন্যার বিবাহকালে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিয়া অর্থ সংগ্রহ করিতে হয়, অথবা কন্যাদের আজীবন অবিবাহিত রাখিতে হইবে; তাহাও আবার সমাজের পক্ষে বিশেষ লজ্জার কথা। দেখা গিয়াছে পিতা বা অভিভাবককে এই নিদারুণ লজ্জা হইতে রক্ষা করিবার জন্য কোমলপ্রাণা, অভিমানকাতরা কোন কোন বালিকা আত্মহত্যাও করিয়াছে। তথাপি যে গর্হিত প্রথ পণদাতা ও পণগ্রহীতা উভয়কেই অধোগত করিতেছে, তাহা দূরীকৃত হইতেছে না। এদিকে আমরা স্বরাজের কথা বলি, আমরা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা পাইবার দাবি করি; আমাদের এই ভারতবর্ষ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সাধনায় জগতের সকল দেশের শীর্ষস্থানীয় বলিয়া গর্ব্ব করি। একটা নিষ্ঠুর সামাজিক প্রথার যে দাসত্ব করা হইতেছে আত্মসম্মান ভুলিয়া, স্বদেশীয়া নারীর প্রতি সম্মান ভুলিয়া যে লোভের দাসত্ব স্বীকার করা হইতেছে, সে জন্য কিছুমাত্র লজ্জাবোধ নাই।
কেহ কেহ এই বলিয়া বরপণ সমর্থন করেন যে, এদেশের আইনে পিতার মৃত্যুর পর কন্যা তাঁহার সম্পত্তির অল্পাংশেরও উত্তরাধিকারিণী হয় না। সুতরাং পিতা যখন জীবিত এবং কন্যাকে পাত্রস্থ করিবার জন্য আগ্রহান্বিত, ঠিক সেই সময় কন্যার জন্য কিছু সংস্থান করিয়া লইবার একমাত্র পথ এই বরপণ। তাঁহারা বলেন যে, বরকে যখন আজীবন বধূর অন্নবস্ত্র জোগাইতে হইবে, তখন সেই ব্যয়ের কিয়দংশ বধূর পিতার নিকট আদায় করিবার চেষ্টা কিছু দোষের নহে। বরপণের উদ্দেশ্য যদি ইহাই হয়, তাহা হইলে অর্থের দাবীর পরিমাণ ও কন্যার পিতার দানের শক্তি-মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকা আবশ্যক। দাবীটা অতিরিক্ত হওয়া উচিত নহে এবং প্রদত্ত অর্থ রক্তশোষক শ্বশুর বা লোভপরায়ণ স্বামীর হস্তে ন্যস্ত না হইয়া যাহাতে কন্যার জন্যই গচ্ছিত থাকে, সেই রূপ ব্যবস্থা করাই বিধেয়।
লোভ বা প্রয়োজন যাহা হইতেই এই কু-প্রথা উদ্ভূত ও পরিপুষ্ট হইয়া থাকুক না কেন, এখন উহার উচ্ছেদ সাধনের সময় আসিয়াছে। এই সঙ্গে উত্তরাধিকার ঘটিত আইনেরও পরিবর্তন আবশ্যক হইয়াছে। পুত্রের মত কন্যাও পিতামাতার সন্তান ও পুত্রের জন্য জনক-জননীর যে দায়িত্ব, কন্যার জন্যও ঠিক সেই দায়িত্ব, গৃহস্থের কর্ত্তব্যের তালিকায় শাস্ত্রে দেখা যায়—
গৃহস্থ পালয়েৎ দারান্ বিদ্যামত্যাসয়েৎ সূতান্।
গোপয়েৎ স্বজনান্ বন্ধুন্ এষা ধর্ম্ম সনাতনঃ।।
কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতি যত্নতঃ
দেয়া বরায় বিদুষে ধনরত্ন সমন্বিতা।।
গৃহস্থ স্বীয় স্ত্রীকে পালন করিবেন; পুত্রদিগকে বিদ্যাভ্যাস করাইবেন; স্বজন ও বন্ধুবর্গকে রক্ষা করিবেন। কন্যাকেও এইরূপ পালন করিবেন, অতি যত্নের সহিত শিক্ষা দিবেন এবং ধনরত্ন সহিত বিদ্বান পাত্রে সম্প্রদান করিবেন।
ধনরত্ন দিবার কথা অবশ্যই এখানে আছে কিন্তু তাহার পরিমাণের তো নির্দ্দেশ নাই। যতদূর বুঝা যায়, পিতার অবস্থার অতীত দান হইবে, শাস্ত্রে এমন কথা বলে না। পিতার দান বা বিবাহদত্ত যৌতুক তাঁহার স্নেহের স্বাভাবিক প্রেরণায় স্বেচ্ছাকৃত, অপরের ইচ্ছাধীন নহে।
এই বরপণ প্রথার সহিত বাল্যবিবাহ ও একান্নবর্ত্তিতা এই দুইটা প্রথাও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত আছে। একান্নবর্ত্তিতার দোষগুণ যাহাই থাকুক, উহা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হইতেছে। বাল্যবিবাহের কুফলেরও ক্রমশঃ উপলব্ধি হইতেছে এবং দেশে একটা সুস্থ সবল জাতির অভ্যূত্থান কল্পে নারীশিক্ষার আবশ্যকতাও স্বীকৃত হইতেছে। যে বয়সে পত্নী ও মাতার কর্ত্তব্য এবং দায়িত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান জন্মে, সেই বয়স পর্য্যন্ত যদি বালিকারা শিক্ষাধীন থাকে, তাহা হইলে তাহারা অর্থ দ্বারা ক্রীত স্বামীকে বরণ করিতে অপমান বোধ করিবে। ইদানীং ম্যাট্রিকুলেশন পাশকে যত, ইন্টারমিডিয়েট পাশকে তদপেক্ষা অধিক, বিএ পাশকে আরও অনেক বেশি, এই দুই তিন করিয়া পরীক্ষার সংখ্যার সহিত বরপণও সেই অনুপাতে ক্রমশঃ বাড়িয়া চলিয়াছে। ইহা তাহাদের অসহ্য হইবে। ভাষাহীন অচেতন পদার্থের মত হস্ত হইতে হস্তান্তরে অর্পিত হইতে তাহাদের লজ্জাবোধ হইবে, আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ন হইবে। কিন্তু নিজের পরিশ্রমে জীবিকা অর্জ্জন করিতে তাহাদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগিবে না। অবস্থা যাহাদের স্বচ্ছল নহে, আজকালকার জীবন সংগ্রামের কঠোরতার দিনে সেই সকল পরিবারের কয়জন নারী না খাটিয়া পারে? পিতার বা পতির গৃহে কি তাহারা খাটে না? শিক্ষিতা নারীদের মধ্যে কন্যারূপে অর্থোপার্জ্জন করিয়াই অনেকে দরিদ্র পিতার সাহায্য করেন, ভগিনীগণ ভাইদের শিক্ষার ব্যয় বহন করেন। যদি আত্মসম্মান ও স্বাবলম্বন শিক্ষার ফল হয়, তবে আমাদের দেশের শিক্ষিত যুবকেরা নিশ্চয় অর্থের লোভে পড়িয়া বা উপার্জ্জনক্ষম হইবার পূর্ব্বে কখনই বিবাহ করিবে না। দেশের শিক্ষিত সমাজের অবস্থা যতদূর জানি তাহাতে আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, এদেশে শত শত উন্নতমনা যুবক আছেন, যাঁহারা অর্থের জন্য বিবাহ করা ঘৃণাকর কার্য্য বলিয়া অনুভব করেন; যাঁহারা সমাজ হইতে এই দূষিত রীতির উচ্ছেদ সাধনে উৎসুক। তাঁহাদের অনুরোধ করি, তাঁহারা একান্ত মনে এই শোধনকার্য্যে ব্রতী হউন। আমরা ভারতবাসীরা বিশেষ বাংলা দেশের লোকেরা অতিশয় ভাবপ্রবণ। আমরা মনে যাহা অনুভব করি, মুখে তাহার সম্বন্ধে অনেক কথা বলিতে ভালবাসি; কিন্তু এতটা ভাবের স্থিরতা ও প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তা নাই যাহাতে কর্ম্মের সাফল্য হয়। কেবল বক্তৃতায়, কেবল কোন স্নেহলতার শোচনীয় মৃত্যুতে গোটা কতক কবিতা লেখায় বা দুই চারি ফোঁটা অশ্রু ফেলায় অথবা এই সবগুলির সমবায়েও কোনো ফল নাই। সভা করিয়া বরপণের বিরুদ্ধে প্রস্তাব উত্থাপন ও সর্বসম্মতিক্রমে পরিগ্রহণেও কোন লাভ নাই, কার্য্যতঃ বরপণ গ্রহণ যদি না অসম্ভব করিয়া তুলিতে পারি। প্রতিজ্ঞা করিবে, বরপণ লইবে না, বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে বরপণ লইতে দেওয়া হইবে না। যাহারা কথা না শুনিবে তাহাদের একঘরে করিতে হইবে। এ দেশে অতি সামান্য কারণে প্রতিবেশী বা কুটুম্বকে লোকে একঘরে করিয়া থাকে। কাহারও সামাজিক আচারাদি বা আদব কায়দায় একটু ত্রুটি হইলে অমনি সে একঘরে; বাড়ির অন্য কেহ কোন দুষ্কর্ম্ম করিয়াছে, সে নিজে নির্দ্দোষ, তবু কর ওকে একঘরে। এই রকম তো কতই হয়। পণপ্রথা উঠাইবার জন্য যাঁহাদের বিশেষ আগ্রহ, আশা করি তাঁহারা পণগ্রাহী বরদিগকে এবং যাহারা তাহাদের পণ লইতে প্রলুব্ধ ও প্রবৃত্ত করায় তাহাদিগকে সমাজচ্যুত, একঘরের মতো ব্যবহার করিবেন। ইহার ফলে এই দূষিত প্রথা অনেকটা বাধাপ্রাপ্ত হইবে। উত্তরাধিকার বিষয়ে নূতন আইন প্রবর্ত্তন, বাল্যবিবাহ দূরীকরণ ও কন্যাশিক্ষার প্রচলন, এই বরপণ প্রথার উচ্ছেদে প্রধান সহায়।
বঙ্গলক্ষ্মী, বৈশাখ ১৩৩৩
নোট: কামিনী রায়ের আমল থেকে শতবর্ষ পর বাংলা বানানরীতির বহু সংস্কার হয়েছে। তবে পাঠকের সুবিধার্থে লেখাটি প্রকাশের ক্ষেত্রে আমরা কামিনী রায়ের বানানরীতি বহাল রেখেছি।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন