মেসিডোনিয়ায় রোমা গোত্রের নৃত্যগীতের জলসায়

অ+ অ-

 

 সবুজ ঘাসে পার্ক করা দুটি জিপসি-ওয়াগন

আজ ছুটির দিন, এ দিনে আমি মেসিডোনিয়ায় বসবাসরত রোমা বা জিপসি সম্প্রদায়ের আবাসিক এলাকায় বেড়াতে যাচ্ছি। রোমা সম্প্রদায়ের মানুষজন অনেকটা আমাদের দেশের বেদেদের মতো, শত শত বৎসর ধরে ইউরোপের হরেক দেশে ভ্রাম্যমান হালতে দিনযাপন করছে। এদের কারো কারো গাত্রবর্ণ কালচে-বাদামি বা উজ্জ্বল কিংবা অনুজ্জ্বল শ্যাম, চেহারাসুরত দেখতে অনেকটা আমারই মতো। যে সব গবেষক জিপসিদের ভাষা বিশ্লেষণ করেছেন, তাদের ধারণা, হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেনানা দেশ ঘুরেঅবশেষে রোমারা ইউরোপে এসে পৌঁছে।

হোটেলের লাউঞ্জে বসে আমি রোমাদের আবাসিক এলাকায় যাওয়ার জন্য ট্যুর-গাইডের অপেক্ষা করছিলাম। দেখি, ঘোড়ার নালের কায়দায় খটাখট শব্দ তুলে এগিয়ে আসছে কাউগার্লদের মতো লেদার ভেস্ট ও স্কীনটাইট জিন্স পরা একটি মেয়ে। খুব সাবলীলভাবে সে হ্যালো এগেইন ডক্টর সুলতান, বলে দাঁড়িয়ে পড়ে। গজদাঁতে মৃদুহাসি দেখে রোমা গ্রোত্রের সোমত্থ কন্যাটিকে তৎক্ষণাৎ শনাক্ত করি। নিকোলেতা বিথুন নামে এ মেয়েটির সঙ্গে দিন কয়েক আগে এখানকার একটি ইউনিভারসিটির ছাত্র-শিক্ষকদের দেয়া রিসেপশনে দেখা হয়েছিল। মেয়েটি আমাকে সে প্রসঙ্গ স্মরণ করিয়ে দিয়ে সামনের সোফাটিতে বসে পড়ে।

আমি হেঁটে যাওয়া একজন ওয়েটারকে ইশারায় কফি দিতে বলি। মেয়েটি খানিক বাঁকা হয়ে পিটের দিকে ঠেলে দেয় তুলতুলে একটি কুশন, আর আমি খেয়াল করি, বিথুন নামে রোমা মেয়েটি আজ ভারি বিচিত্রভাবে সেজেগুজে এসেছে। তার বুটজুতা ও লেদার ভেস্ট থেকে ঝুলছে সুতলি দিয়ে বাঁধা ঝিনুক। চূড়ো করে সাজানো চুলের স্তূপকে ঘিরে প্যাচানো একটি কড়ির মালা। আমার সঙ্গে চোখাচুখি হতেই সে বলে, আজ সুটো ওরিজারিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে রোমা সম্প্রদায়ের উৎসব এদারলোজি। প্রচুর বাদ্যবাজনা হবে। আমি আপনাকে ওখানে নিয়ে যেতে চাই।

রোমাদের এদারলোজি উৎসবে সং এন্ড ড্যান্স হয় অঢেল। বিকিকিনিও হয় কুটিরশিল্পজাত পণ্য। এক পাক ঘুরতে যেতে আমার আপত্তি কিছু নেই। তবে রোমাদের মধ্যে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজনও যে আছেন, এ তথ্যটি আনকোরা। আমি যেহেতু ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বিষয়ে কাজ করছি, তাই ওই গোত্রের নেতৃস্থানীয় কারো সঙ্গে যোগাযোগ করাটা পেশাদারি দিক থেকে জরুরি। জানতে চাই, বিথুন, আমাকে মসজিদে নিয়ে যাবে না?

আশ্বস্ত করে সে জানায়, অফকোর্স, আমি আপনাকে মসজিদে নিয়ে যাবো, ইমামের সঙ্গে এপোয়েন্টমেন্ট করে রেখেছি, আপনি রেডি হলে এখনই যাওয়া যায়। তারপর ইফ ইউ ওয়ান্ট আই উইল টেক ইউ টু এদারলোজি ফেস্টিভ্যাল।

আমি প্রস্তুত হয়েই লাউঞ্জে এসেছি। সুতরাং পার্কিলটে রাখা গাড়ির দিকে আগাই। গাড়িতে এসে বিথুন লাজুক মুখে উঠে বসে ড্রাইভারের পাশের সিটে। মিনিট পনেরো ড্রাইভের পর ড্রাইভার রোডসাইডে আমাদের ড্রপ করে দিলে, আমরা সাবধানে সড়ক পাড়ি দিয়ে এপারে মসজিদটির দিকে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। জানতে পারি যেএখানে জুম্মার নামাজ আদায় করতে রোমা ছাড়া অন্যান্য গোত্রের বিশেষ করে আলবেনীয় সম্প্রদায়ের মুসলিমরাও আসেন।

জিন্সের সাথে কর্ডরয়ের জ্যাকেট পরা এক যুবক বিব্রতমুখে সালাম-আলেক বলে হাত মেলান। বিথুন পরিচয় করিয়ে দেয়, ইমাম আজবিজা মেমেদোভার সঙ্গে। কোন একটি ফার্মে ইনি আইটি-জাতীয় কাজ করেন। ইমাম-সাহেব শুক্রবারের জুম্মা পড়ান। তবে ডেপুটি ইমাম ও মুয়াজ্জিন যার হাতে মসজিদের চাবিটি থাকে, তাঁকে নাকি কিছুতেই মোবাইলে ধরা যাচ্ছে না। মুয়াজ্জিন সাহেব পেশায় জাগলার, সার্কাসে বল লোফালুফির খেলা দেখান। হয়তো এদালোজির পরবে এখন খেলা দেখাচ্ছেন। তাই মেমেদোভা-সাহেব আমাকে মসজিদটি দেখাতে পারছেন না। তিনি রোমানি কাফেনোভা বা রোমা-ক্যাফেতে বসে কথাবার্তা বলার প্রস্তাব করেন।

ক্যাফেটির পরিসরকে বিশেষ প্রশস্ত বলা যায় না। তবে দেয়ালে ঝুলানো রোমা-হস্তশিল্পের নিদর্শনে পরিবেশে একটু যেন ভিন্ন রকমের আবহ ফুটেছে। আমাদের একটি টেবিলে বসিয়ে দিয়ে ইমাম মেমেদোভা ব্যাকপ্যাক-কাঁধে চলে যান কাউন্টারের পেছন দিকে। একজন ওয়েটার গ্লাসে করে নিয়ে আসেন তপ্ত চা, পানীয়টি স্বাদেগন্ধে টার্কিশ-টির মতো, তবে রোমাদের জবানে বলা হয় চাও

তো চাও পান করতে করতে বিথুনের সঙ্গে সামান্য কথা হয়। সিঙ্গোল মাদার সে, ছেলে-সন্তানটির বয়স মাত্র সাড়ে-তিন। তার নির্দ্দিষ্ট কোন পেশা আছে কি না, ঠিক বুঝতে পারি না, তবে জিপসি মেনিকিওর, পেডিকিওর এন্ড হেনা স্প্যাশিয়েলিস্ট লেখা একটি ভিজিটিং কার্ড আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ব্যাখ্যা করে, টুরিষ্ট-নারীরা চাইলে তাকে রিং করতে পারেন, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সে তাদের নখে ফুলপাতা অথবা শঙ্খ-ঝিনুক এঁকে দিতে পারবে। শরীরের ভিন্ন কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেনা দিয়ে উল্কি করার প্রয়োজন পড়লেও তাকে স্মরণ করা যায়। আমি সুযোগ পেলে চেনা-আধচেনা পর্যটক কোন মহিলাকে তথ্যটি দেবো, এ আশ্বাস দিয়ে পুকেটে পুরি গোটা তিনেক কার্ড।

ইমাম মেমেদোভা-সাহেব আবডাল থেকে বেরিয়ে আসতে প্রচুর সময় নিচ্ছেন। আমি একটু উসখুস করি। বিথুন আমার দৃষ্টিআকর্ষণ করে বলে, লিসেন, আই হ্যাভ সাম ইনফরমেশন ফর ইউ। সে পকেটবুক খুলে পড়ে শোনায়, ২০০২ সালের জরিপানুযায়ী সমগ্র মেসিডোনিয়ায় বাস করছে মোট ৫৩,৮৭৯ জন রোমা মানুষ, এদের অনেকেই ধর্ম-বিশ্বাসে মুসলমান।

রোমা সম্প্রদায়ের মসজিদ

রোমা জনগোষ্ঠিকে ঈজিপ্শিয়ান বলে জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে জানতে পেরে একটু অবাক হই! বিথুন গজদাঁতে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে হেসে বলে, ইউ নো হোয়াট... ঈজিপ্শিয়ান শব্দটি থেকে আমাদের নাম পড়ে গেছে জিপসি। তবে আমাদের শিকড় আসলে উত্তর-ভারতের কোন জায়গায়, কারণ আমাদের ভাষায় আছে প্রচুর ভারতীয় শব্দ।

আমি প্রশ্ন করি, তবে কী হাজার বছর আগে রোমা সম্প্রদায় ঈজিপ্ট হয়ে ইউরোপে এসে পৌঁছেছিল? মাথা ঝাঁকিয়ে আমার ধারনাটি বাতিল করে দেয় বিথুন, নো, দে ডিডিন্ট অ্যারাইভ থ্রু ঈজিপ্ট, মধ্যে আছে বিরাট দরিয়া, রোমারা জাহাজ ভাসাতে জানতো না।

ওয়েটার আমাদের সামনে থালায় গ্রিল করা ক্যাপসিকাম, পেঁয়াজ ও চিজ দেয়া বগাচা-ব্রেড রেখে যান। পকেটবুকটিতে চোখ রেখে নতমুখি হয়ে আছে বিথুন। আমি তার দিকে তাকাই; না, এর দেহসৌষ্ঠবের সঙ্গে ঈজিপ্শিয়ান নারীদের ঠিক যেন মেলাতে পারি না। তাকে উত্তর-ভারতীয় রমণীদের মতোও দেখায় না। বরং মনে হয়, মাথায় গন্ধতেল মাখিয়ে, এলোখোঁপা বেঁধে ডুরেশাড়িটি পরিয়ে দিলে বিথুনকে বাঁকুড়া বা মেদিনীপুরের নারী বলে চালিয়ে দেয়া যায়।

কী যেন এক আইডিয়ায় চোখমুখ উদ্ভাসিত করে তুলে সে বলে, আমাদের শিকড়ের সন্ধান করতে গিয়ে আমি একজন নৃতাত্ত্বিকের লেখা রচনাও পাঠ করেছি। রোমা সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষরা হয়তো ঈজিপ্ট থেকে ট্র্যাক করে চলে গিয়েছিলেন মরক্কোয়, টানজিয়ারের বন্দর থেকে জিব্রাল্টার হয়ে ইউরোপের মুল ভূখণ্ড তো সামান্য কয়েক মাইলের ব্যবধানে, ফেরি-বোটে স্পেনের আন্দুলেশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগও চলছিল নিয়মিত। হয়তো তারা বাণিজ্যিক কোন ফেরি-বোটে চেপে এসে পড়েন আন্দুলেশিয়ায়।

জানতে চাইনৃতাত্ত্বিক মশাই এ ধারণার সমর্থনে কোন প্রমাণ হাজির করেছেন কী? আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সে জবাব দেয়, রোমারা আন্দুলেশিয়ায় ফ্লেমিংগো ড্যান্স-এর প্রচলন করেছিল, এ নৃত্য প্রকরণের সুর-ছন্দে প্রবাহিত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের রিদম, ফ্লেমিংগোতে ভারতবর্ষীয় তেমন কিছু নেই। আমাদের পুর্বপুরুষরা এ নৃত্যকলা হয়তো শিখেছিলেন ঈজিপ্টে বসবাসের দিনগুলোতে।

গ্রিনরুম থেকে স্টেজে বেরিয়ে আসা অভিনেতার মতো মাথায় ট্যাসেল ঝুলানো ফেজ টুপি পরে, হাঁটু-জোকা আলখাল্লায় জিন্স-জ্যাকেট ঢেকে বেরিয়ে আসেন ইমাম মেমেদোভা। তিনি তসবির দানা টিপতে টিপতে ওয়োটারকে কাফা বা কফি দিতে ইশারা করেন। তাঁর লেবাসে স্পষ্টত প্রতিফলিত হচ্ছে তুর্কি ড্রেস-কোড, এতে তথাকথিত রোমা সংস্কৃতির কোন ছাপ আছে কি না, তা ভাবার কোন অবকাশ পাই না। ইমাম সাহেব রাব্বি জিদনি ইলমা.. বলে বাতচিতের সূত্রপাত করেন। তথ্যের গুরুত্ব বিবেচনা করে আমি ছাত্রের নিষ্ঠায় নোট নেই।

জানতে পারি, পূর্ব ইউরোপে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জিপসি-বিদ্বেষ প্রবল হয়ে উঠলে, রোমা মুসলিমদের মধ্যে অনেক পরিবারতৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে মেসিডোনিয়ায় এসে অভিবাসী হন। কারণ, সে যুগের যুগোস্লাভিয়ার সমাজতান্ত্রিক শাসনে জিপসি বা রোমাদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক আক্রমণের সম্ভাবনা ছিলো তুলনামূলকভাবে কম।

ইমাম-সাহেবের তথ্য মোতাবেক, ১৯৫৮ সালে তৎকালীন চোকোস্লাভাকিয়ায় রোমাদের যাযাবর-বৃত্তিকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৪ সালের দিকে পোলান্ডের গ্রামগঞ্জ ও বন্দরের মেলাগুলোতে ঘুরে ঘুরে পণ্য বিক্রি ও তাঁবু খাঁটিয়ে ভ্রাম্যমান জীবনযাপন নিষিদ্ধ করা হয়। এদিক থেকে বুলগেরিয়ার প্রশাসন ছিলো আরেক কাঠি সরেস, তারা কাগজকলমে রোমা সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব অস্বীকার করে। সরকারি দলিলপত্রে রোমা-মুসলিদের নাম বাদলিয়ে স্লাভিক নামধারন করতে বাধ্য করা হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় মসজিদ ও খতনা করার কৌমি রেওয়াজ। এমন কী মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত শালবারি নামে তুর্কি কেতার ঢোলা পায়জামা-জাতীয় প্যান্ট পরিধানও নিসিদ্ধ করা হয়।

আলোচনা জমে ওঠেছিল, ইমাম-সাহেবের ব্যাকপ্যাকে রাখা মোবাইলটিতে এ্যালার্ম বেজে উঠলে, তিনি ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে তা টার্নড-অফ করেন। বুঝতে পারি, দুপুরবেলা কাজ থেকে সামান্য বিরতি নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন, এখনই তাঁকে ফিরতে হচ্ছে কর্মস্থলে। তো তিনি দু-হাত তুলে তুর্কি ভাষায় আল্লাহু রাহমেত এলিসিন…’, উচ্চারণে মোনাজাত করে কাউন্টারের পেছন দিকে ছুটেন। একটু পর জোব্বা ও ফেজ-টুপি বদলে বেরিয়ে আসেন জিন্স ও কর্ডরয়ের জ্যাকেটটি গায়ে চড়িয়ে।

ইমাম আজবিজা মেমেদোভার সঙ্গে আমরা বেরিয়ে আসি রোমানি কাফেনোভা থেকে। মসজিদের পার্কিংলটে দাঁড় করানো মোটরবাইকে চেপে ইমাম-সাহেব আল্লাহু খরসুন বলে বহনটি স্টার্ট করেন। আমরা ট্র্যাফিক সামলে-সুমলে সাবধানে সড়ক অতিক্রম করি। কাছেই পাওয়া যায় বাসস্টপ। মিনিট সাতেকের ভেতর একটি বাস আমাদের পিক করে নেয়।

সুটো ওরিজারির প্রান্তিকেছোট্ট একটি পার্কের গেটে আমরা বাস থেকে নামি। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কানে আসে বাদ্য-বাজনার হৃদয়মন তোলপাড় করা আওয়াজ। তীব্র সবুজ ঘাসে পার্ক করে রাখা হয়েছে দুটি জিপসি-ওয়াগন। শত শত বছর ধরে ঘোড়ায় টানা এ ওয়াগনগুলো চড়ে রোমা বা জিপসিরা পূর্ব ইউরোপের নানা জায়গায় অনুষ্ঠিত মেলাগুলোতে হাজির হয়ে খাটাতো তাবু, কারুপণ্যের পশরা দিয়ে সাজাতো দোকান, দেখাতো সার্কাসসুলভ এক্রোব্যাটিক্স, ক্রিস্টাল বল বা চিত্রিত-তাসের মাধ্যমে গণনা করে দিতো মানুষের ভাগ্য, হেনা-টাটুর তাবুতে ঢুকে নারীরা নানাবিধ অঙ্গে আঁকিয়ে নিতেন আকর্ষণীয় নকশা। নৃত্যগীতের পরিসর বিস্তৃত ছিলো, বেলি ড্যান্স থেকে স্ট্রিপটিজের পদ্ধতিতে জিপসি-যুবতীদের বিবসনা হয়ে শরীর প্রদর্শনীর পালা আব্দি।

সমাজতান্ত্রিক শাসনামলে এই মেলা-ভিত্তিক ঘুরাফেরার হামেশা ভ্রাম্যমান রেওয়াজটি কোন কোন দেশে রীতিমতো আইন করে বন্ধ করে দেয়া হয়। রোমাদের নির্দ্দিষ্ট আবাসিক এলাকায় থিতু হয়ে চাকুরি-বাকরির তালাশ করতে উৎসাহিত করা হয়। তবে সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় সমাজতান্ত্রিক শাসনের শেষ দিকে অনুমতির বিনিময়ে রোমা বা জিপসিরা ফের মেলাগুলোতে দোকানপাট খোলার অধিকার ফিরে পায়। ততদিনে অশ্বভিত্তিক যানবাহনের বিকল্প হিসাবে চালু হয়েছে যান্ত্রিক ট্রেইলার-ভ্যানের। রোমারা হালফিল মেলায় যাতায়ত ও পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহার করছে ট্রেইলার-ভ্যান। তবে দু-তিনটি সংরক্ষিত জিপসি-ওয়াগন এখনো মেলাতে প্রদর্শনী আইটেম হিসাবে ডিসপ্লে করা হয়।

জানতে পারি যে, কিছুক্ষণ পর ওয়াগনওয়ালা ঘোড়া নিয়ে আসবেন। কপাটও খোলা হবে, তখন দর্শনীর বিনিময়ে ছাউনির ভেতরে ঢুকেএক জামানায় প্রচলিত জিপসিদের ভ্রাম্যমান সংসারেরও একটি আন্দাজ পাওয়া যাবে। আমরা সামনে বাড়ি। এসে পড়ি, অনেক বছর আগে তৈরি একটি নোনাধরার গির্জা-সংলগ্ন চত্তরে।

এখানে দোকানপাটে পণ্য সাজিয়ে বসেছে জমজমাট মেলা। একজন রোমা ফটোগ্রাফারও ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাকে পরিতোষিক দিলে তিনি তুলে দেবেন ফটোগ্রাফস্। আমি একটি দোকানে দাঁড়িয়ে গ্লাসবিডের গলার হার, ঝুকমোপাশা ও টিকলিগুলো দেখতে শুরু করি। গ্রাম্য মক্তবের কড়া-ধাচের মিয়াসাহেবের মতো তসবি হাতে এক বৃদ্ধ এসে আমার হাতটি মুঠো করে তুলে ধরেন। বোধ করি আলোয় দুটি আংটির পাথরে ঝকমকে বিচ্ছুরণ দেখে সন্তুষ্ট হয়ে কী যেন বলে নিবিড়ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন! তারপর কোমরবন্ধে ঝোলানো খুঁতি থেকে বের করেন, বেশ কতগুলো রঙিন পাথর। আমি যাচাই বাছাই করে অতঃপর অ্যম্বার ও জেসপার পাথরের দুটি খণ্ড খরিদ করি।

হাত নাড়তে নাড়তে পরিবারটি সড়ক ক্রস করছে

কেনাকাটা শেষ হলে পর বিথুনের সঙ্গে ফের মেলা দেখতে সামনে আগাই। এবারমা, ছোট্ট মেয়ে, কিশোরী ও যুবতী কন্যাসহ পুরো একটি জিপসি-পরিবার আমাকে অ্যামবুশ করে। কাপড়-চোপড় ও চেহারাসুরতে মনে হয় এরা মুসলমান। সালাম-আলেক দিতেই মারহাবা আওয়াজের উষ্ণতায় মা শেইকহ্যান্ডের জন্য হাতটি বাড়িয়ে দেন। দুটি বড় মেয়ে একসাথে কথা বলে এক্সাইটমেন্ট ছড়াচ্ছে। এদের বক্তব্য, আমার মতো কাউকে নাকি দু-বোন হিন্দি মুভিতে দেখেছে। আমি মজাক করে বলি, সময়ের অভাবে আমি বলিউডে অভিনয় করতে পারিনি, তবে তোমরা দেখতে অবিকল আমার আত্মীয়স্বজনদের মতো। মেয়েগুলো তাদের ছবি দেখতে চায়। আমি সেলফোনে পারিবারিক অ্যালবাম নিয়ে ঘোরাফেরা করি না। বলি, আমি কিছু ছবি নিয়ে তোমাদের বাড়িতে আসবো, তোমরা চাও বা কাফা কিছু খাওয়াবে না?

পরিবারটি বিথুনের চেনা, বেশ খানিকক্ষণ কথাবার্তার পর ঠিক হয়, তারা অবসর মতো বিথুনের মাধ্যমে আমাকে রিং করে দাওয়াত দেবেন। একটি পরিবারের সঙ্গে তাদের বাড়িতে সামান্য সময় কাটতে পারবো, এ সম্ভাবনায় খুশি হয়ে তাদের বলি, মিরুপাশিম বা গুডবাই

সিমেন্টের রোয়া-ওঠা চাতালটি ঘিরে জমেছে বৃত্তাকারে জাটলা। প্রচুর পর্যটকও শামিল হয়েছেন ভীড়ে, তাই ভেতরে কী ঘটছে ভালো করে দেখা যায় না, তবে চমৎকার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের প্রবাহমান ছন্দে পেল্লায় কড়াইটিতে ডোবা-তেলে ভাজাপোড়ার মতো চিড়বিড় শব্দ ওঠছে। উঁকি দিতেই দেখি, একটি যুবতী আধবোজা চোখে মাথাটি পেছন দিকে হেলিয়েক্যামন যেন আকাশমুখি হয়ে বেলি-ড্যান্স করছে, আর সিল্কের কাঁচুলিবন্ধনে ছটফট করে বার বার উথলে ওঠছে তার স্তনযুগল।

মেয়েটির কোমরের কাজ অসামান্য, নিম্ননাভির তুমুল ঊর্মিতে তলপেটে হেনা দিয়ে আঁকা ম্যান্ডেলার প্রতীকটি ক্রমাগত সংকোচিত ও প্রসারিত হচ্ছে;  এবং নৃত্যগীতের নিদারুণ ইমপ্যাক্টে দর্শকরা এমনভাবে শরীর-গতর দোলাচ্ছেন যে, মনে হয়, এনাদের বাহুতে গজিয়েছে অদৃশ্য ডানা। নৃত্যশিল্পী এবার ঘুরে যেতেই অনেকগুলো মুদ্রা গেঁথে তৈরি নিতম্ব জড়ানো অলংকারটি ঝলমল করে ওঠে। মেয়েটি খেমটা নাচিয়েদের মতো কোমর হেলিয়ে ঢিমে-তালে দোল তুলতে শুরু করলে, সক্রিয় হয়ে ওঠে আরেকটি বিচিত্র বাদ্যযন্ত্র। দেহভঙ্গির প্রবল প্রভোকেশনের সঙ্গে সুর-তাল বহাল রেখে তাতে তারাবাতি বিষ্ফোরণের মতো আওয়াজ ওঠে।

নারীটির শিরোদেশে তার এক সেহেলি এবার স্থাপন করে ছোট্ট একটি ফ্লাওয়ার বাস্কেট। অশেষ দক্ষতার সে শরীর বাঁকিয়ে বার বার চলে আসছে দর্শকদের ক্লোজরেঞ্জে। তাতে উদ্দীপ্ত হয়ে কোন কোন তামেশগীর ফুল-ভরা ঝুড়িটিতে আলতো করে রাখছেন ইউরোর কড়কড়ে নোট। স্রেফ সৌজন্যবশত কিছু কড়িপাতি গচ্ছা দিয়ে জটলা থেকে রিট্রিট করি।

বিথুন পথ দেখিয়ে দিয়ে মেলার অন্য দিকে আগুয়ান হয়। তার পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে একটা বিষয়ে আমি সচেতন হয়ে উঠি, বেলিড্যান্স করনেওয়ালী নারীটির কোমরের রূপালি কয়েন-গাঁথা জেওরটির সঙ্গে যেমন নেই ভারতবর্ষে প্রচলিত কেয়ূর বা মেখলা জাতীয় অলংকারের সাযুজ্য, তেমনি এ নৃত্যপ্রকরণও সম্পূর্ণ অভারতীয়। থট-রিডারের দক্ষতায় বিথুন যেন আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে মন্তব্য করে, আমাদের পূর্বপুরুষরা যাত্রাপথে যখন মিশরে বেশ কিছুদিনের জন্য থিতু হয়েছিলেন, তখন হয়তো জিপসি যুবতীরা শিখে নিয়েছিল বেলিড্যান্সের কলাকৌশল।

যুক্তিটা ডিসকার্ড না করে আমার পর্যবেক্ষণজনিত কৌতূহলকে ফ্র্যাংকলি আমি তার সঙ্গে শেয়ার করি, বলি,ইয়েস, ইট লুকস্ ভেরি সিমিলার টু দি বেলিড্যান্স অব মিডিলইস্ট, কিন্তু কায়রো কিংবা ক্লাসাবাংকায় মেয়েরা ফুলভরা ঝুড়ি মাথায় দিয়ে শরীর দোলায় না। দ্যা হৌল ফ্লাওয়ার বাস্কেট বিজনেস লুকস্ ইনোভেটিভ, তবে দোলনের ভঙ্গিতে আফ্রিকার লোকনৃত্যের একটি বিশেষ মুদ্রার কথা মনে পড়ে গেলো।

বিথুন মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে বলে, প্রবন্ধটির বেশ কয়েকটি প্যারাগ্রাফ জুড়ে লেখা হয়েছেকীভাবে যাত্রাপথে আফ্রিকান সংস্কৃতির সঙ্গে জিপসি সংস্কৃতির মিশ্রণ হয়েছে। জানতে চাই, লেখাটির লিংক দিতে পারবে, বিথুন? জবাবে সে জানায় যে, রোমা সেন্টার ফর স্কোপিয়ার লাইব্রেরীতে প্রবন্ধটি সংরক্ষিত আছে। অতঃপর আমার অনুরোধে বিথুন রাজি হয় রচনাটির একটি ফটোকপি জোগাড় করে দিতে।

আমরা চলে আসি, ছোট্ট ছোট্ট শামিয়ানা খাটিয়ে একটি-দুটি টেবিল সম্বল করে সাজানো দোকানপাটের কাছে। একটি দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা হেনা পার্লার, টেবিলে রাখা মেহদীপাতার মণ্ডের বেশ কতগুলো কৌটা ও নক্শার রেখাচিত্রওয়ালা কাগজপত্র। কিন্তু দোকানটিতে খদ্দের বা বিক্রেতা কেউ নেই।

জিপসি-ওয়াগনে নানাবিধ বাদ্যযন্ত্রের পশরা 

মেজাজ খারাপ করে বিথুন জানায়, দোকানটি তার নিজের, ছোটবোন সয়তুনকে অনুপস্থিতিতে টেবিল সামলানোর অনুরোধ সে করেছিল, কিন্তু অপদার্থটা গেলো কোথায়?  মোবাইলে সে ডায়াল করে। কাছেই একটি অকেজো জিপসি-ওয়াগন বা ঘোড়ার গাড়ির বাগিতে ডিসপ্লে করা হচ্ছে নানাবিধ বাদ্যযন্ত্রের পশরা। দু-বোনের ঝগড়া-কাজিয়ার মধ্যে আমি জড়াতে চাই না। তাই মোবাইলে কথা বলা বিথুনের দিকে ইশারা দিয়ে দোকান ছেড়ে সামনের দিকে আগাই।

চলে আসি রকমারি পণ্যে সজ্জিত কয়েকটি স্টলের সামনে। একটি দোকানেআগে কখনো চোখে পড়েনি, এ রকমের তিন-চারটি বাদ্যযন্ত্র। সাতপাঁচ ভেবেদামদর করে কিনি ফেলি একটি যন্তর। আমি গায়ক কিংবা বাদক নই, তারপরও যখন নানাদেশে আওয়ারা ঘুরে বেড়াই, তখন মওকা পেলে কিনি একটি দুটি বাদ্যযন্ত্র। মাঝেমধ্যে তা দেয়ালে ঝোলাই, হালফিল ওয়াল-স্পেসে ঘাটতি পড়েছে, তাই কোন কোন বাদ্যযন্ত্র পড়ে থাকে টেবিলের তলায়, কখনো এগুলো আমি বাজানোর চেষ্টাও করিনি, আমার এ আচরণের কোন ব্যাখ্যা আছে কি না, নিজেও ঠিক বুঝতে পারি না।

কাছ থেকে দু-তিনটি কন্ঠে এক সঙ্গে আওয়াজ আসে,পরসনডাজিয়ে বা হ্যালো। চোখ তুলতেই দেখি, যে পরিবারটির সঙ্গে একটু আগে কথা হয়েছে, তারা সকলেমা, বড়সড় মেয়ে দুটি ও ছোট্ট বালিকা আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে সড়ক ক্রস করছে। জবাবে আমিও হাত নেড়ে ওয়েভ করি, একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলে, গাজোহেম কে জু তাকজ,  বা নাইস টু মিট ইউ। তাদের আবার দেখতে পেয়ে প্রফুল্ল হয়ে ওঠে মন।

বিথুনকে ভারি স্ট্রেসড্ দেখায়। ততক্ষণে আমরা চলে এসেছি এক্রোবেটিক্স-এর নানাবিধ কসরত দেখানো বড়সড় একটি প্যান্ডেলের কাছে। মনে পড়ে মসজিদের মোয়াজ্জিন-সাহেব পেশায় জাগলার, আন্দাজ করি, হয়তো প্যান্ডেলের তলায় তিনি বল লোফালুফির খেলা দেখাচ্ছেন। ভাবি, ভেতরে ঢুকে যদি মোয়াজ্জিন-সাহেব অবসর হন, তাহলে তাঁকে সালাম-আলেক করে স্থাপন করা যাবে যোগসূত্র। কিন্তু বিথুন তুমুল আপত্তি তোলে। সে কিছুতেই ওই দিকে যাবে না।

জানতে চাই, হোয়াট ইজ দ্যা ম্যাটার, বিথুন? মোয়াজ্জিন-সাহেবকে কেন হ্যালো বলা যাবে না? অপ্রত্যাশিত ক্রোধে রীতিমতো বিষ্ফোরিত হয়ে সে জবাব দেয়, হি ইজ অ্যা পিওর ফাকার, অসভ্য... অমানুষ...। বিশেষ একটা চাপাচাপি করতে হয় না, নিজে থেকেই সে বলে, আমার ছোট্ট ছেলেটির বাবা সে, কিন্তু খরপোষ দিতে রাজি হচ্ছে না, আমি তাকে কোর্টে তুলবো।

প্যান্ডেলে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আমি তার দিকে খেয়াল করে তাকাই। প্রচণ্ড ক্রোধের সঙ্গে বিথুনের মুখমণ্ডলে ফুটে উঠেছে অসহায় এক আকুতি। জানতে চাই, সুইট পার্সন, ডু ইউ মাইন্ড টেলিং মি আবাউট ইয়োর সান, সে এখন কোথায়, কে দেখাশোনা করছে?

জবাব থেকে জানতে পারি, এক বৃদ্ধা বেবিসিটারের কাছে রেখে এসেছিল, কিন্তু ছেলেটির টেম্পার টেনট্রম হয়েছে, চোঁচামেচি কান্নাকাটি করছিল, সে আমার সাথে এস্কট হিসাবে কাজ করছে, তাই বেবিসিটারকে বোন সয়তুনের নাম্বার দিয়েছিল। তো বোন হেনা-পার্লার খালি রেখে ছুটে গেছে ছেলেটিকে শান্ত করতে।

আমি বিথুনকে বাচ্চাটির কাছে চলে যাওয়ার অনুরোধ করে বলি, এদারলোজি পরবের মেলার অনেক কিছু তো অলরেডি দেখা হয়ে গেছে। বাকিটুকু ঘুরেফিরে আমি নিজেই দেখে নিতে পারবো। তারপর সড়ক থেকে ট্যাক্সি-ক্যাব ধরে হোটেলে ফিরতেও কোন অসুবিধা হবে না।

বিথুন চলে যাওয়ার পর হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি, প্লাস্টিকের ফেন্স দিয়ে তৈরি একটি গড়ের কাছে। ভেতরের সিমেন্টের চাতালে আয়োজিত হয়েছে এদারলোজি পরবের স্প্যাশিয়েল সং এন্ড ড্যান্স প্রোগ্রামের। গেটে সাত ইউরো দিয়ে ঢুকে পড়ি।  ভেতরে নৃত্যগীতের পরিপাটি আয়োজন। গির্জার দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভায়োলিন, গিটার, একোর্ডিয়ান ও মারাকাসে পুরোদস্তুর একটি জিপসি-ব্যান্ড। আমি তাদের খানিক স্টাডি করি, চেহারা-সুরতে মনে হয় এদের টার্কিশ কিংবা স্লাভিক কোন নৃগোষ্ঠীর মানুষ। আন্দাজ করি, হাজার বছর ধরে জিপসি কিংবা রোমারা বসবাস করছে পূর্ব-ইউরোপে, সুতরাং তুর্কি কিংবা স্লাভিকদের সঙ্গে সংমিশ্রন অসম্ভব কিছু না।

জিপসি ব্যান্ড

পান্ডা গোছের একজন নাদুস নুদুস রোমা-পুরুষ এসে আমাকে এপ্রোচ করেন। তিনি ক্যামেরাটি দেখিয়ে বলেন, সমবেত ড্যান্স শুরু হতে যাচ্ছে, তুমি নিশ্চয়ই তাতে শরীক হচ্ছো, নো প্রবলেম, ড্যান্স ফ্রি, আমি তোমার ছবি তুলে দেবো, গায়ক-বাদকদের ছবি চাইলেও তাও এ্যাড করে দেবো, ফি মাত্র টেন ইউরো। বাজনারত ব্যান্ডের ছবি পেলে খারাপ হয় না, বলি, অল রাইট, আমি ড্যান্স করতে চাই না, তবে টেন ইউরো দিচ্ছি, ব্যান্ডের একটি ছবি আমার চাই। আরেকটি কথা..., তুমি তো মশাই চমৎকার ইংরেজি বলছো, গানের কথাগুলোর তর্জমা লিখে দিলে আমি আরো পাঁচ ইউরো অফার করতে পারি।

ভারি সুন্দর করে হেসে আমার বাড়িয়ে দেয়া পনেরো ইউরো থেকে মাত্র দশ ইউরো তুলে নিয়ে থ্যাংক ইউ সো মাচ ফর ইয়োর ইন্টারেস্ট ইন জিপসি-মিউজিক, বলে সে জানায়, লিরিকের ইংরেজি তর্জমার জন্য আলাদা কিছু দিতে হচ্ছে না। ওই সার্ভিসটা ফ্রি। তরুণটি পর্যটকদের জন্য তৈরি একটি লিফলেট আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। দেখি, কাগজটির একদিকে ইংরেজিতে জিপসি-মিউজিকের ব্যাকগ্রাউন্ড বিষয়ক কয়েকটি প্যারাগ্রাফের নিচেব্যান্ড যে গানগুলো গাইতে যাচ্ছে, তার লিরিকের কয়েকটি ছত্র ইংরেজি অনুবাদে দেওয়া আছে, উল্টোপিটে দেওয়া হয়েছে ফরাসি। লিফলেটটি পেয়ে এত খুশি হই যে, প্রায় জোর করে তার হাতে দশ ইউরো তুলে দিয়ে বলি, প্লিজ বাই অ্যা কোল্ড ড্রিংক। পান্ডা গোছের তরুণ পোকায় কাঁটা দাঁতগুলো বের করেতলপেটের থলথলে ভূড়িটি কাঁপিয়ে হেসে বলে, আই থিংক দিস লিফলেট মেড ইউ ভেরি হ্যাপি।

লিফলেটের দিকে তাকিয়ে দেখি, ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্যবহার করা হয়েছে জিপসি-মিউজিক শব্দটি, আমি সচেতন যে, রোমা সম্প্রদায়ের মানুষজন নিজেদের জিপসি বলা পছন্দ করেন না, তাই একটু কনফিউজ লাগে। ভাবি, পর্যটকরা এ কৌমের মানুষজনকে চেনে জিপসি হিসাবে, তাই হয়তো লিফলেটে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ভাবি, এক সুযোগে বিথুনকে জিজ্ঞেস করে দেখবো, জিপসি কিংবা রোমা শব্দ ব্যবহার নিয়ে তার মতামত কী?

টিনের চালে অসময়ে বর্ষিত বৃষ্টির মতো বেজে ওঠে মারাকাস। সাথে সাথে যুক্ত হয় ভায়োলিন ও একোর্ডিয়ানের ঢিমেতালা বাদন। ড্যান্স করনেওয়ালাদের মধ্যে চাপাস্বরে ওঠে সাজ সাজ রব। সকলে পজিশন নিয়ে জেগে ওঠা সজারুর কাঁটাটির মতো উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে ব্যান্ডের দিকে। ড্রামে ঠোকা পড়ে আস্তে-ধীরে, আর ধাতব কয়েন গেঁথে তৈরি বিছে হারে রিনিঠিনি বোল বাজিয়ে, ভারি প্রফুল্লমুখে কটিদেশ দোলাতে শুরু করে একটি যুবতী। ড্রামের বাদন দ্রুত হওয়ামাত্র তাতে সংযুক্ত হয় গিটার। যুগলকণ্ঠে উচ্চকিত হয় ভ্যোকাল।

আমি লিফলেটে চোখ রাখি, ফেন্স দেয়া গড়ের মধ্যিখানে ঢিলেঢালাভাবে শুরুয়াত হয় সমবেত নৃত্যের। গায়কদের গলার স্বর চড়তে থাকে: সে মে আরমা অরো খেলেনা/ অরো খেলেনা ডিবে কেরেনা লিরিকের এ ছত্র দুটির সাথে মিলিয়ে আমি লিফলেটের তর্জমায় নজর দেই: আমার স্বজন বান্ধব সবাই নৃত্য করছে অরো/ নৃত্য করছে অরো, আর উদযাপন করছে উৎসব...।

নৃত্যে উৎসবে উদ্দীপনা উথলে ওঠছে, এটা বুঝতে বিশেষ কোন অসুবিধা হয় না, কিন্তু বার বার অরো অরো জপছে কেন, অরো বস্তুটি কী? সামান্য বিরতিতে তালাশ করি নাদুস-নুদুস ক্যামেরাওয়ালার। দেখি, ভদ্রসন্তান শরীর বাঁকিয়ে গড়ের ফেন্সের ওপর তার স্থূলকায় পেট পাকস্থলি-সমেত স্থাপন করে, হাত বাড়িয়ে ফেরিওয়ালা কাছ থেকে খরিদ করছে তেলেভাজা ও কোক। হাঁসফাস করে ফিরে এসে সে আমার হাতে তুলে দেয়, কাগজের ঠোঙ্গাভর্তি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বা মুচমুচে করে ভাজা আলু। খাদ্যটি এমনই তেলতেলে যে ঠোঙ্গার কাগজ ভিজে চুবচুবে হতে আছে। কোকের ক্যানটি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে যুবকটি রুদ্ধশ্বাসে বলে, এই লিরিকটি ব্যান্ড গাইছে তোমার মতো পর্যটককে নিশানা করে। আই অ্যাম গোনা ড্যান্স নাউ, বলেই সে স্বেচ্ছায় নৃত্য করা বৃত্তটিতে গিয়ে শামিল হয়।

ড্রামে চাটি পড়ে। ভায়েলিন ও একোর্ডিয়ানের সাথে গীত হয় শ্রুতিমধুর আরেকটি লিরিক, ডু মোবি আদসো আ জা আ সা তা/ নে মা ঝিভিজেদে ডানিসে মো জে সা পুত নিচে  আমি লিফলেটের তর্জমায় নজর দেই, সড়ক ধরে চলে গেছে কাফেলা/ কিন্তু আমি থেকে গেছি পেছনে... বুঝলে হে আমার পথসঙ্গী পর্যটক/ প্রভাতী তারকাটির ফুটে ওঠার কোন সম্ভাবনা নেই আন্দাজ করি, আমাদের মতো কপালপোড়া গোছের পর্যটকদের নিশি সহজে ফুরাবে না।

সুরুজের তেজ ক্রমশ চড়া হচ্ছে, তো বেরিয়ে আসি ব্যান্ড সংগীতের গড় থেকে। দেখি, বিথুন ফুটফুটে শিশুপুত্রটির হাত ধরে আমাকে খুঁজছে। আমি মোবাইল অফ করে রেখেছি, তাই মনে হয় সে বিরক্তও হয়েছে। ট্রলিতে করে বিক্রি হচ্ছে, ঝারিসতা বা কর্ন-বেডের সঙ্গে ঝাইমোকা বলে পরিচিত হামানদিস্তায় থেতলানো খরগোসের মাংশের কিমা। বিথুন আমাকে তা খেতে উৎসাহিত করে জানায়, আহার্যটিকে বিবেচনা করা হয় জিপসি-খাদ্যের একটি মুখরোচক ডেলিকেসি হিসাবে। কিন্তু আমি নিজের অর্থনৈতিক সামর্থের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আমলে না এনে মেলায় যে হারে রাজ্যের ধকড়-মকড় কিনে পয়সা খরচ করছি, খরগোসের কিমা খেলে পরবর্তীতে না সিয়াম সাধনা করে ব্যয়বাহুল্যে ভারসাম্য আনতে হয়। তো বলি, স্যারি বিথুন, আই অ্যাম নট হ্যাংরি।

উসখুস করা ছোট্ট ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মনে হয়, তরুণী মা-টিকে সৌজন্য দেখানো উচিত। বলি, বিথুন, আমার খিদা নেই, তবে তোমাদের ঝাইমোকা স্যান্ডুইচ কিনে দিচ্ছি, তোমার বাচ্চাটি মনে হয় স্যান্ডুইচ পছন্দ করবে। সে লাজুকমুখে আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে জানায়, ছেলে কান্নাকাটি করছিল বাপের কাছে যাওয়ার জন্য। তো বাবার কাছে নিয়ে যাচ্ছি, সে তাকে বার্গার কিনে দেবে। আপনিও চলুন আমার সঙ্গে, ওর বাবা মোয়াজ্জিনের এখন টাইম অফ চলছে, আপনি কথা বলতে পারবেন। 

পরিবারটিকে প্রাইভেসি দেয়ার কথা বিবেচনা করে বলি, না, বিথুনআমার ভারি ক্লান্ত লাগছে, আজকে থাক, অন্য একদিন কথা বলবো। তো সড়কে খানিক হেঁটে এগিয়ে এসে বিথুন হাত তুলে একটি ট্যাক্সি-ক্যাব দাঁড় করায়। আমি তাকে গুডবাই বলে তাতে সওয়ার হই।

প্রচ্ছদ ও লেখায় ব্যবহৃত ছবি © মঈনুস সুলতান