যোগান্তে জ্যেঠিমা

অ+ অ-

 

আমার এক জ্যেঠিমা ছিলেন, নিজের না, পাড়াতুতো। পাড়ার লোকে বলতো মহিলার মাথায় ছিট আছে। হতে পারে। জ্ঞান হয়ে তো দেখছি জ্যেঠিমা বিড়বিড় করে নিজের মনে বকে চলেছেন।

একদিন জ্যেঠিমা বিড়বিড় করে বকতে বকতে আমাদের বাড়ি এলেন। মা-কে দেখে বলে উঠলেন, তোদের খবর নিতে এলাম। তোর বর তো বিদেশে থাকে। ভালো ভালো, সেটাই ভালো। আমাকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, এই শিবু, দেখি দেখি, তোর মাথায় তো বেশ চুল! নেড়ার মাথাতেও হয়েছে। নেড়া ওঁর ছোট ছেলে, আমার থেকে মাস ছয়েকের বড় হবে। জন্মাবার পরে ওর মাথায় নাকি চুল ছিল না, তাই নাম হয়ে গেলো ন্যাড়া।

জ্যেঠিমা খুব ভালো আঁকতে পারতেন, বিশেষ করে আলপনা জাতীয় নকশা। বায়না ধরলাম, একটা নকশা এঁকে দাও, ফুল লতা-পাতা দিয়ে।

জ্যেঠিমা জিজ্ঞাসা করলেন, কি করবি?

বললাম, সাজাবো। বন্ধুদের দেখাবো। নকল করবো।

জ্যেঠিমা ধমকে দিলেন, নকল করবি না। নিজের মনের মত আঁকবি। পারবি না?

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, হ্যাঁ।

—‘দে, খাতা-পেন্সিল দে। তাড়া আছে।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে খাতা ভরে নকশা এঁকে দিলেন। আমি তাকিয়ে রইলাম, যেন ম্যাজিক দেখছি।

বাড়িতে লক্ষ্মী পূজোআমার কাকিমা লক্ষ্মীর পা আঁকছেন। জ্যেঠিমা হঠাৎ উদয় হয়ে কাকিমাকে ঠেলা মেরে বলে উঠলেন, কি যে পায়ের ছিরি, অনেক হয়েছে। নে ওঠ, আমায় করতে দে। বলে, কাকিমার হাত থেকে বাটি-ন্যাকড়া কেড়ে নিয়ে বিড়বিড় করতে করতে ভীষণ সুন্দর আলপনা এঁকে দিলেন। আমাকে দেখে বললেন, আগে গান গাইতে পারতাম, এখন পারি না। গান গাইলে ভালো আলপনা হয়। কিন্তু কি করি বল! আলপনা শেষ করে উধাও।

সেবার পূজোর সময় বাবা বিদেশ থেকে বাড়ি এসেছেন। বিরাট যৌথ পরিবার। যৌথ পরিবারে বাড়ির মায়েদের বা বউদের ভীষণ জ্বালা, কিন্তু ছোটদের খুব মজা। মজা মানে দেখবার কেউ নেই, হৈ-হুল্লোড়ে দিন কেটে যায়, পড়াশুনা নিয়ে পিছনে পড়বার কেউ নেই। বাবা এসে বিপদে ফেললেন। আমার পড়া নিয়ে বসলেন, তাও আবার অঙ্ক।

বাবা: যোগ করতে পারিস?

আমি: (ঘাড় নেড়ে) হ্যাঁ।

বাবা: গুন করতে?

আমি: (অস্বস্তিতে) হ্যাঁ...

বাবা: বয়েস কত হলো?

আমি: ছয়।

বাবা: ছয়-কে ছয় দিয়ে গুন কর।

আমি ফ্যাসাদে পড়লাম। যোগ ঠিক আছে, বাকিগুলো বড্ডো খটমটে। কি করি...কি করি!চটপট ছয় বার ছয় লিখে যোগ করে দিলাম।

বাবা তো রেগে কাঁই। এই তোমার পড়াশুনা হচ্ছে? গুন করতে বললাম, যোগ করে দিলি?'

বিড়বিড়ে জ্যেঠিমা কখন চুপচাপ পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, কেউ খেয়াল করিনি। বলে উঠলেন, ও দেওর ঠাকুর, ও তো ঠিকই করেছে।

বাবা চেঁচিয়ে উঠলেন, দেখুন না বৌদি, গুন করতে বললাম...

জ্যেঠিমা বাবাকে চুপ করিয়ে বলে উঠলেন, সব কিছুই তো যোগ। বাকি সব আলাদা আলাদা উপায়ে যোগ করা। সেটা ওকে বুঝিয়ে দাও। বলেই জ্যেঠিমা বিড়বিড় করতে করতে উধাও।

একটু বড় হয়ে শুনেছিলাম জ্যেঠিমা নাকি পড়াশুনায় ভালো ছিলেন, বিশেষ করে অঙ্কে। কিন্তু কে তার মূল্য দেয়? গুনের তোয়াক্কা না করে অনেক মেয়েকেই সৎপাত্রে দান করা হয়। জ্যেঠিমার ভাগ্যেও হয়তো তাই হয়ে থাকবে। তা না হলে এত গুন থাকতেও এই অজ পাড়াগায়ে কেন বিয়ে হল!

আরো বড় হয়ে ভেবেছি, কেউ অঙ্কে ভালো হয়, কেউ ভালো ছবি আঁকে, কেউ গান করে, নাচে। আমার এক পিসতুতো দাদা দিনরাত পড়াশুনা করতো, জেলায় প্রথম হয়েছিল। শিল্প-টিলপোর ধারেকাছে ছিল না। কিন্তু জ্যেঠিমা!

জ্যেঠিমা আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। দেখা হলেই কাছে টেনে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। মা একবার বলেছিলেন, তোর এই জ্যেঠিমার অনেক গুন ছিল। দেখতে শুনতেও ভালো ছিল। কি যে হয়ে গেল!

আমার ঠাকুমা একদিন বলেছিলেন, পাগলী তোকে এতো ভালোবাসে কেন জানিস? তুই জন্মাবার পর তোর মা সূতীকায় ভুগলো, মরণ-বাঁচন অবস্থা। দিন-রাত সেবা করে তোর মা-কে সারিয়ে তুললো এই পাগলী। তোকে নিজের বুকের দুধ খাওয়ালো।

আমি আরো একটু বড় হয়েছি। বছর শেষে বাবা আবার এসেছেন। জ্যেঠিমা এসে বাবাকে বোঝালেন, ছেলেটার জন্য তোর খুব চিন্তা, না?আমারও। ছেলেটাকে মানুষ করতে চাও তো এখন থেকে নিয়ে যাও। গ্রামে কিচ্ছু নেই, অন্ধ কূপ এটা। নিয়ে যাও, নিয়ে যাও।

বলে, বিড়বিড় করতে করতে যেমন এসেছিলেন তেমনি চলে গেলেন। আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। অদ্ভুত!

বাবা আমাদের সত্যি সত্যি গ্রাম ছাড়া করলেন। ছাড়া গরু বড় শহরে এসে বাঁধা পড়লো। সে অন্য কথা।

স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে ঢুকবো, সেই ফাঁকে গ্রামে ছুটি কাটাতে এলাম। এসে জ্যেঠিমার খোঁজ করলাম। শুনলাম জ্যেঠিমা পাগল হয়ে গেছেন। শুধু পাগল নয়, উন্মাদ। ন্যাড়া আমার বন্ধু। দেখা করতে ওদের বাড়ি গিয়েছি, দেখি জ্যাঠামশাই জ্যেঠিমাকে পেটাচ্ছেন আর জ্যেঠিমা অকথ্য গালাগালি করে চলেছেন। জ্যেঠিমার মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ন্যাড়া দেখছে আর হাসছে। আমার খুব রাগ হলো।

চলে আসছিলাম, ন্যাড়া আমার হাত ধরে অসভ্য হেসে বললো, কি হয়েছে শুনবি? কীর্তন হচ্ছিল, মা গিয়ে উৎপাত শুরু করে দিল। শুধু তাই না, বোষ্টুমিকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলোএই, তোকে তো এই ব্যাটা রোজ ঠোকে, তবুও তোর বাচ্ছা হয়ে না কেন রে? তুই কি বাঁজা? শুনে বোষ্টুমি হাউ হাউ করে কাঁদলো আর বাবা মা-কে পেটাতে লাগল।

আমি এখন শহুরে, নেড়ার অসভ্য কথাবার্তা ভালো লাগলো না। চলে আসছিলাম, পিছন থেকে এসে জ্যেঠিমা আমার হাত ধরলেন।

—‘শোন, দুনিয়াটা ভক্ত আর ভক্তিই উপর টিকে আছে। ভক্তির টোটকা মার, ভক্ত গজিয়ে যাবে। এক গাদা অকাল-কুষ্মান্ড ভক্ত জুটে গেলেই হল, ভক্ত সমেত ভণ্ডামি করে যাও। সাত খুন মাফ। তোর জ্যাঠামশাইকেই দেখ নাকন্ঠী-তিলক লাগিয়ে ভক্তিতে ভাসছে। হারামজাদা আমাকে দিয়ে সাত সাতটা বাচ্ছা পয়দা করিয়ে এখন বোষ্টুমী নিয়ে মেতেছে। হারামজাদা আমাকে তো চেনেনি; কীর্তনের মাঝে কাপড় তুলে ধেই ধেই করে নেচে দিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে ভক্তি উধাও। কি মারটাই মারলো। এই দেখ না, পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। ভক্তরা তাই দেখে খুব খুশি। আমিও সব কটাকে গালি দিতে দিতে বেরিয়ে এলাম। তাই বলছি, পড়াশুনা করে কি হবে, ভক্ত তৈরি কর। অবশ্য ভক্ত তৈরি করতে গেলে টাকা লাগে! তাতে কি? বিষয়ী হ, লোক ঠকা। ভক্ত লোকেদের কি টাকার অভাব হয়? হয় না।

আরো কত কি বলে গেলেনচেঁচিয়ে চেঁচিয়ে, পাড়া মাত করে। বলতে বলতে খেত-খামার পেরিয়ে বাঁশ ঝাড়ের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।

কিছু দিন জ্যেঠিমার দেখা নেই। কোথায় ছিলেন কে জানে! আমার ফেরার সময় হয়ে এলো। একদিন আগে, সন্ধ্যার সময় দেখি ন্যাড়া কলাপাতায় করে কিছু নিয়ে যাচ্ছে। আমায় দেখে বলল, মা তোর কথা বলছিল। চল, দেখা করবি।

গ্রামের বাইরের দিকে খড়ের ছাউনি দেয়া এক পুজো মন্ডপ ছিল। আলো-অন্ধকারে দেখি জ্যেঠিমা বসে আছেন। ন্যাড়া, কলা পাতায় মোড়া ভাত-তরকারি ওঁর সামনে রাখলো। জ্যেঠিমার সেদিকে খেয়াল নেই। আমাদের দুজনকে কাছে ডাকলেন, দুই পাশে বসালেন।

—‘এই হল আমার ন্যাড়া, আর এই হল আমার শিবু। এই শিবু, ন্যাড়াটাকে নিয়ে যা না এখান থেকে। নরককুন্ড এটা; নিয়ে যা, নিয়ে যা।

ন্যাড়াকে নিয়ে যাবার আমি কে! বড় শহরে, বড় কলেজে পড়লাম। উড়ো খবর পেলাম যে ন্যাড়া নাকি বাপকে পিটিয়ে দেশান্তরী হয়েছে। জ্যাঠামশাই  শয্যাগত হয়ে গত হয়েছেন, আর বৈষ্ণবী এক ভক্ত বৈষ্ণবের সঙ্গে ভিন গ্রামে বসত করেছে। আর জ্যেঠিমা নাকি অন্ধ হয়ে গেছেন।

পাঁচ বছর পরে বিশ্ববিদ্যালয় ডিঙিয়ে চাকরিতে ঢোকার আগে গ্রামের বাড়িতে ফিরলাম। গ্রাম আমার কাছে নতুন ঠেকল। গ্রামের অনেকেই আমাকে চিনতে পারলো না। যারা চিনলো, তাদের কারো মুখে চেনার আনন্দ ফুটলো না। আগে গ্রাম সমাজ এক পরিবারের মত ছিল, মনে হল এখন আর তা নেই। আমার থেকে কম বয়েসিদের তো আমি চিনতেই পারলাম না। কেমন যেন ঠান্ডা মেরে গেলাম।

একদিন দেখি, গ্রামে ঢোকার মুখে, পুজো মণ্ডপের সামনের রাস্তায়, বেল গাছের তলায়, অন্ধ জ্যেঠিমা বসে আছেন। নোংরা জীর্ণ কাপড় গায়ে জড়ানো, মাথায় এক চাবড়া গোবর। দেখলাম, হাঁটু গেড়ে বসলাম, আস্তে করে ডাকলাম, জ্যেঠিমা!

মুহূর্তের মধ্যে বিড়বিড়ানি থেমে গেল।

—‘শিবু।

আমি অবাক। এতো বছর পরে শুধু গলা শুনে চিনে ফেললেন!

—‘আয়, বস। মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা, তাই গোবর দিয়েছি। তুই গেলি, ন্যাড়া গেল, হারামজাদাটা গেলভাল, ভাল।হ্যাঁ রে, যোগ করতে শিখেছিস, কত কায়দায় যে যোগ হয়, করতে করতে পাগল হয়ে যেতে হয়! কিছুটা শিখেছিস তো? তাতেই হবে। জীবনভর যোগ করে যেতে হয়, সে এক হ্যাপা বটে।

আমি থাকতেই জ্যেঠিমা মারা গেলেন। জ্যেঠিমার সাত সন্তানের মধ্যে চার মেয়ে বিয়ে করে অন্যের সংসারে, ন্যাড়া দেশান্তরি, আর ন্যাড়ার দুই দাদা সম্পত্তি নিয়ে খুনোখুনি করে সদর হাসপাতালে। পাড়ার এক বয়স্কা বললেন, শিবু, তোমাকে তো ছেলের মতোই ভালোবাসত। তুমিই মুখাগ্নিটা কর। তাই করলাম।

জ্যেঠিমাকে মনে পড়লেই প্রশ্নটা ফিরে ফিরে আসে, যোগ করতে শিখেছি কি? জানি না।

জ্যেঠিমার বিয়োগান্ত জীবন নিয়ে লিখলাম এই আশায় যে যত লোকে পড়বে ততই জীবনে জীবন যোগ হবে।