হন্তারক

অ+ অ-

 

কে আমার শত্রু? ঈশ্বর? মানুষ? সময়? প্রকৃতি? সবকিছু? হ্যাঁ, সবকিছুই আমার শত্রু। কিন্তু আজ এই ভয়াবহ রাতে, এই প্রত্যাখ্যানের রাতে, আমার কী করণীয়? কে আমার অসুখের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী? অনেকক্ষণ ভাববার পর মনে হলো, সময়, হ্যাঁ, সময়ই আমার সবচেয়ে বড়ো শত্রু। আমি যদি সুখী হতে চাই, তো সময়কে থামাতে হবে সবার আগে; আর তাকে থামানোর আগে তাকে খুঁজে বের করতে হবে। এখন রাত অনেক। কিন্তু নিজের ভেতরে আমি এমন এক নিশ্চয়তা অনুভব করলাম যে, মনে হলো, আজ রাতে আমি সময়কে খুঁজে পাবোইসুতরাং সময়ের সঙ্গে একটা মীমাংসা, একটা হেস্তনেস্ত করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম। একটা গর্জন শুনলাম নিজের ভেতরে, সময়কে আজ থামিয়ে দেবো, দরকার হলে তাকে হত্যা করবো!

সিঁড়ি ভেঙে নামতে হবে। সাবানের মতো শাদা শাদা সিঁড়ি। অজস্র। যেনো অজস্র সাবান আমার সামনে চকচক করে উঠলো। প্রথম সিঁড়ি পেরিয়ে দ্বিতীয় সিঁড়িতে নামতেই আমার ইচ্ছে হলো, না, থাক, ফিরে যাই। ঘরে ফিরে যাই, কিংবা ফিরে যাই অন্তত প্রথম সিঁড়িতে। কোনো কোনো ইচ্ছের কাছে আমরা কোনো কারণ ছাড়াই অসহায়; আমি পিছিয়ে এসে প্রথম সিঁড়িতেই দাঁড়ালাম। কিন্তু স্থির হয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো আমার প্রতিজ্ঞার কথা; মনে হলো, আজই সময়। আজই! তাই অন্তত দুশো সিঁড়ি ভেঙে তড়িঘড়ি রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। বেরোনোর সময় বাসার দারোয়ান আমার দিকে এক নজরে তাকিয়ে ছিলো। সে আমাকে সন্দেহ করছে কি? করলে করুক। কিছু করার নেই। দারোয়ানের চোখ দেখে শিকারে ব্যাপৃত ক্ষুধার্ত সিংহের কথা মনে পড়লো আমার, যে একটা আধ-খাওয়া, মরা হরিণ দেখে একই সাথে হতাশ, আবার উল্লসিত।

কোথায় যাবো? কোথায় খুঁজবো সময়কে? সাথে কিছু আনতেও ভুলে গেছি; তার মানে, আমি শেষ পর্যন্ত সময়কে খুঁজে পেলেও তাকে তেমন কিছু করতে পারবো না। হাঁটতে লাগলাম। রাস্তায় দু-একটা মানুষ; অজস্র ল্যাম্পপোস্ট, যাদের অনেকগুলোই আবার নষ্ট। কী করবো এখন? হাঁটতে হাঁটতে জনাকীর্ণ এলাকা পেরিয়ে পরিত্যক্ত পুরাতন বিমানবন্দরের কাছে এসে থামলাম আমি। দু-একটা গাড়ি চলে যাচ্ছে কোথাও... নাকি তারা ফিরে আসছে? রাতের রাস্তায় শূন্যতাই শোভনীয়, গাড়িগুলো বোধ হয় তা জানে না।

এবার কোথায় যাবো? চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম কোথাও কিছু পাই কিনা। না। কিছু নেই। আচ্ছা, সময় দেখতে কেমন? তার কি দেহ আছে আদৌ। আমি কি তার মুখ দেখতে পাবো? বা আলখাল্লা? তাকে যদি খুন করি, মৃত্যুর আগে কি সে চিৎকার করে উঠবে না? অবশ্য খুন করার কথাই বা কেনো ভাবছি? আমি তো সময়ের হাত-পা কেটে ফেলে তাকে অচল করে দিতে পারি, জিহ্বা কেটে বোবা করে দিতে পারি। তাকে মেরে ফেলার তো কোনো প্রয়োজন নেই। তাছাড়া এসব ভেবে লাভ কী, যখন আমার জানাই নেই, সময়ের আদৌ হাত-পা আছে কিনা (এই জানাটাই বা এত জরুরি কেনো?)। আমি জানি, সে আছে। এই শহরেই। আমার কাজ হলো তাকে খুঁজে বের করা।

একটা আলো জ্বলছে, টকটকে লাল; অনেক দূরে, বিমানবন্দরের ঠিক মাঝখানে। আমাদের মনে ঠিক এইভাবেই স্মৃতি ও শৈশব জ্বলতে থাকে, সারাটা জীবন, অন্ধকারের বুকে শাশ্বত সূর্যাস্তের ফুলের মতন। এইভাবেই জেগে থাকে ব্যর্থ প্রেমের সাবেকী যন্ত্রণা! ইতিমধ্যেই বহু দূর এসে পড়েছি, অথচ কোথাও সময়কে পাইনি, সুতরাং দিক বদলিয়ে লাল আলোর দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আলোটা জ্বলছে বাতাসে সৌন্দর্যের ফেনা ছড়িয়ে, যাকে দেখলে এমনকি মানুষও পতঙ্গের মতো আচরণ করতে বাধ্য। কিন্তু আলো পর্যন্ত যাবো কিভাবে? দেয়াল যদিবা টপকাই, প্রহরীদের চোখ কিভাবে এড়াবো আমি? তবু, যেতে তো হবেই। এগিয়ে গেলাম। মেইন গেটের দিকে। প্রহরীর সাথে কথা বলতে হবে।

কিন্তু এই প্রহরী তো দেখি মৃত! মাটিতে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে আছে সে, তার কপালের কাছে দুটো ছিদ্র, রক্ত বেরোচ্ছে দরদর করে; আর হাতের বন্দুকটা এমনভাবে ধরে রাখা যে, মনে হয় মৃত্যুর আগে সে গুলি চালাতে চেয়েছিলো কারো দিকে। নাকি চালিয়েছিলো? নিজের কপালেই? আত্মহত্যা! আমার বুকে দুপ করে একটা কাঠের গুড়ি পড়ার শব্দ হলো। এখানে থাকা কোনোভাবেই উচিত হচ্ছে না। মনে পড়লো আমার প্রতিজ্ঞার কথা, আর সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলাম মানুষের ছুটে আসার দুদ্দাড় শব্দ। এখন কী করবো? পালাবো? কিন্তু কেনো? এই রক্ত দেখে আমার ভয় কিসের, যখন খুনটা আমি করিনি? হয়তো এই ভাবনাতেই সন্তুষ্ট থাকতাম আরো কিছুক্ষণ, কিন্তু আমার অস্তিত্ব যেনো আহত সাপের মতো মোচড় দিয়ে উঠলো হঠাৎ। ভাবলাম, হ্যাঁ, পালাতে হবে, কারণ ওরা আমাকে খুনী ভেবে সন্দেহ করতে পারে, এবং তাদের সন্দেহের ফল হবে অতি মারাত্মক। যে খুন আমি আসলেই করিনি, তার জন্য কোনো প্রকার হয়রানি সহ্য করার কোনো মানেই হয় না।

কিন্তু এই প্রহরীকে খুন না করি, নিজেকেই কি আমি খুন করিনি? কাল রাতে? আমি কি প্রেতাত্মা মাত্র নই? প্রতিটি মানুষই কি নিজেকে বারবার মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় না? হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমি খুনী। কিন্তু ওই তো লাল আলোটা আবার জ্বলছে। আমাকে যেতে হবে। আমি ধীরে ধীরে সরে পড়লাম। শব্দ শুনে মনে হলো ছুটে আসা মানুষগুলো প্রহরীর মৃত লাশের দখল নিয়েছে। ওরা কি দেখতে পেয়েছে আমাকে?

এগিয়ে গেলাম আলোর দিকে। কাছে আসতে মনে হলো, যতক্ষণ লাগবে ভেবেছিলাম, তার চেয়ে সময় লেগেছে অনেক বেশি। আলোর দিকে তাকালাম। কত শান্তভাবে সে জ্বলছে! কিন্তু কই? আমি যাকে খুঁজছিলাম, সে তো এখানে নেই। আশেপাশে তাকালাম, খুঁজে দেখলাম চারিদিক; কিন্তু যা পেলাম, তা হলো সেইসব মামুলি জিনিস, যা সব জায়গাতেই পড়ে থাকে। হতাশ হয়ে আবার উপরে তাকালাম, কিন্তু এ কী? আলোটা যে নিভে গেলো! কেনো গেলো? অবাক হলাম, চারদিকে কোথাও কেউ নেই, তাহলে আলোটা কেনো নিভে গেলো? ফিরসে হাঁটা শুরু করলাম। আর কিছু না পারি, ওই লাশটার থেকে দূরে সরে যেতেই হবে আমাকে। কিছুতেই ধরা পড়া যাবে না। এইসব সাত-সতেরো ভাবতে ভাবতে আরো এক ঘণ্টা ফুরিয়ে গেলো হয়তোবা।

হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যাচ্ছি জানি না। কখনো গেলাম সোজা পথে, কখনো বাঁক নিলাম; কখনো ঢুকে পড়লাম গলিতে। কোনো কোনো গলিতে ইচ্ছে হলো সারা জীবন থেকে যেতে; অথচ সব গলি ছাড়িয়ে সোজা রাস্তায় এসে দাঁড়াতেও একটুও দ্বিধা করলাম না। রাতের প্রতিটা কণা আমার শরীরে এসে বিঁধতে লাগলো; এবং প্রতিটা নতুন আঘাত আমাকে মনে করিয়ে দিলো জোসেফিনের কথা। কিন্তু আমি দাঁড়ালাম না। পথের পর পথ ধরে হেঁটে যেতে লাগলাম, যেনো আমি নির্ভীক! আমি ঈশ্বর! আমি পেরিয়ে যাচ্ছি মহাবিশ্বের হাজারো ঝঞ্ছা! হঠাৎ একটা রাস্তার রুপালি মোড়ে এসে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম লাল আলো! ঠিক আগেরটার মতো! দূর থেকে একটা লজেন্সের মতো লাগছে। সূর্যাস্তের লজেন্স! যাই হোক, আবারও উৎসাহী হলাম, মনে হলো, ওখানেই খুঁজে পাবো সময়ের পায়ের চিহ্ন, আর ওখানে গিয়ে ভালো করে খোঁজাখুঁজি না করলে আমার এই সমস্ত সন্ধানই বৃথা হয়ে দাঁড়াবে।

যেতে যেতে পথে পড়লো অনেক ঝোপঝাড়, মাঝেমাঝে কাঁদায় আটকে গেলো জুতো। একটা কথা মনে পড়তে খুব অবাক হলাম। এই শহরকে আমি যতটুকু দেখেছি, তাতে কখনোই মনে হয়নি, এখানে এমন কোনো ঝোপ-জঙ্গল থাকতে পারে! অথচ আমি স্বপ্নও দেখছি না। আমি ব্যথা পাচ্ছি, আমি দেখতে পাচ্ছি লাল আর সবুজ রং; যে অন্ধকার নিতান্তই কালো, কখনো কখনো তাকেও মনে হচ্ছে অপরূপ রঙে রঙিন বহতা নদীর মতো। যাই হোক, অবশেষে পৌঁছলাম লাল আলোর কাছে, বুকে হাত দিয়ে চেষ্টা করলাম দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিতে। বুকটা শান্ত, ঠাণ্ডা।

কোমর থেকে টর্চ বের করলাম চারপাশ খুঁজে দেখবার জন্যে। কিন্তু টর্চের আলোয় যা দেখলাম, তা এমন কিছু বিস্ময়কর না হলেও জীবনে এই প্রথম আমি যেনো সত্যি সত্যি আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। কেননা, এটা সেই জায়গাই, যেখানে কিছুক্ষণ, বা অনেকক্ষণ, আগে আমি ছিলাম। কোনো সন্দেহ নেই। এটা সেই জায়গাই। সেই একইভাবে ছড়িয়ে পড়ে আছে মামুলি জিনিসগুলো, যা দেখে আমার হাসি পেয়েছিলো, আমি হতাশ হয়েছিলাম।

কিন্তু এমনও তো হতে পারে পৃথিবীতে ঠিক একই কায়দায় সাজানো দুটো জায়গা আছে, আর ভাগ্যক্রমে দুটো জায়গাই আছে আমার শহরে। সত্যি তো! কোনো পার্থক্যই নেই! টর্চের আলোয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম জায়গাটা; হ্যাঁ, একই রকম; দুটো জায়গা যেনো ঈশ্বরের দুই জমজ সন্তান; হুবহু একই রকম দেখতে। এই উপসংহার টানতে টানতেই উপর দিকে তাকালাম, আর আবারও, ঠিক আগের মতোই আলোটা নিভে গেলো। লাল সূর্যের বদলে স্তম্ভের উপরে এখন দেখা যাচ্ছে এক নিদারুণ শূন্যতা। বুঝতে পারলাম যে, ওসব যমজ-ফমজ কিছু না আসলে, আমি সেখানেই এসে থেমেছি, যেখান থেকে আমার শুরু হয়েছিলো। কিন্তু সেই মানুষ, অর্থাৎ সেই লাশ? সেসব কি এখনো আছে? যদি থাকে, তাহলে তো আমি এখনো সন্দেহের আওতায় আছি। তাহলে! বিপদের সমস্ত আশঙ্কা ছেড়ে দিয়ে ছুটতে লাগলাম স্মৃতির উপর নির্ভর করে, কারণ ইতিমধ্যেই ভুলে গিয়েছিলাম কোন পথ দিয়ে আমি এখানে প্রথম এসেছিলাম, আর কোন পথেই বা এসেছিলাম একটু আগে, দ্বিতীয়বার, লাল আলো দেখে।

না। কোথাও না পেলাম সেই লাশ, না পেলাম রক্ত, যদিও আগের মতোই শুনতে পেলাম সেই দুদ্দাড় শব্দ। মানুষ আমাকে ডাকছে, আমাকে ধরতে চাইছে; আমি জানি, কোনো কিছুই ভুল করে ঘটছে না; কোনো স্বপ্নও আমি দেখছি না। এমনই নেশাগ্রস্ততা আমাকে পেয়ে বসলো, যে, মনে হলো, যদি এই রাত অনন্তে প্রলম্বিতও হয়ে যায়, তবু আমি থামবো না। হাঁটতে লাগলাম টর্চ নিভিয়ে দিয়ে, কারণ ইতিমধ্যেই তার আলো মিইয়ে আসতে শুরু করেছিলো। হাঁটতে হাঁটতে টের পেলাম গোলাপের কাঁটার স্পর্শ; কখনো পা দিলাম নর্দমায়; কখনো তো গড়িয়ে পড়ে গেলাম খাদে। এরপরও আমি আশ্চর্য ও আনন্দিত, কেননা, এই সবকিছু যত বিপজ্জনকই হোক, আমি এখনো মরিনি; এবং আশা করি, মরবোও না। এইভাবে অনন্তকাল আমি হেঁটে যাবো... আর... কিন্তু ওই কি সেই লাল আলো? চোখ কচলে ভালোভাবে দেখলাম; হ্যাঁ, ওই তো... আবার সে জ্বলে উঠেছে... আবার আমি ছুটে গেলাম, খুঁজে পেলাম সেই একই মামুলি অবস্হা... আবার নিভে গেলো আলো... আবার হাঁটলাম... ছুটলাম... আরে, ওই তো সেই লাল আলো... নিভে গেলো... হতাশ... ওই তো... এবং আবারও ছুটলাম...

এইভাবে আরো সাতবার সাত রকম পথ ঘুরে লাল আলোর কাছে পৌঁছলাম আমি; সবকিছু মিলিয়ে দেখলাম; এবং প্রত্যেক বারই আবিষ্কার করলাম, আমি একই জায়গায় বারবার পৌঁছচ্ছি। প্রত্যেক বারই নিভে যাচ্ছিলো আলো, আর নিভে যাওয়ার পর যখন পালাতে চাইছিলাম, তখন এসে পড়ছিলাম সম্পূর্ণ নতুন একেকটা রাস্তায়, যেখানে এর আগে আমি হাঁটিনি। কিন্তু এই নতুনত্বে কোনো কাজ হচ্ছিলো না, কারণ কোনো রাস্তারই শেষ পর্যন্ত আমি যেতে পারিনি; প্রত্যেক বারই রাস্তার মাঝখানে থেমে গেছি লাল আলো দেখে; এবং আমার নেশাগ্রস্ততা আমাকে বাধ্য করেছে আলোর কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু কেনো? আমি কি ততক্ষণে জেনে যাইনি যে, নতুন কিছু সেখানে পাবো না? হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। কিন্তু তবু যে থামতে পারিনি, তার কারণ এটাই যে, আমি নতুন কিছু খোঁজার জন্যে সেখানে যাইনি; গিয়েছি নতুন কিছু যে সত্যিই নেই, সেটা মিলিয়ে নেওয়ার জন্যে। এবং সাত সাতটা বার যখন সবকিছু মিলে গেলো, তখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, আমি এক গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছি। এখান থেকে আমাকে বেরোতেই হবে এবং এই লাল আলো যে আমাকে মোহগ্রস্ত করতে পারেনি, তার প্রমাণ আমাকে দিতেই হবে। আবার হাঁটতে শুরু করলাম। এবারও নতুন রাস্তা এবং বরাবরের মতোই আমি জানি, এই রাস্তাটি আগের রাস্তাগুলোর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।

আবারও আমি এগিয়ে চলেছি ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে। গায়ে কাঁটা ফুটছে অনেক, দুটো পা-ই আঁচড়ে ও আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। একবার একটা মাইল পোস্টের সাথে ধাক্কা খেলাম, এবং অনেকক্ষণ বসে থাকতে হলো। আক্ষেপ হলো টর্চের কথা ভেবে; সেটা এখন অচল; সুতরাং আমাকে এই পথের শেষ করতে হবে অন্ধকারেই, অথবা অপেক্ষা করতে হবে দিনের আলো ফোঁটার। এবার সত্যিই খুব হাসি পেলো! আমি কতক্ষণ ধরে হাঁটছি? কতটা পথ পেরিয়েছি? একটা রাত কি এত দীর্ঘ হতে পারে? না যদি পারে, তো এই অন্ধকারই সমাধান; কারণ যে সৌরচক্রের মধ্যে আজীবন আমি বাস করে এসেছি, তা এখানে কোনো কাজই করছে না। আর যদি এমন হয় যে, সত্যিই সূর্য উঠবে; তাহলেও আমি হাঁটতে বাধ্য; কারণ আমি জানি, লাল আলোটা ছিলো বিমান বন্দরের মাঝখানে, এবং পৃথিবীর সমস্ত নিয়ম যদি আগামীকাল পর্যন্ত সচল থাকে, তবে নিশ্চয়ই বিমানবন্দর থেকে আমি আবার ঘরে ফিরে যেতে পারবো। রাতের এই গোলকধাঁধা আমাকে পৌঁছে দেবে দিনের প্রশস্ত পথে।

জঙ্গলে হাঁটছিলাম এতক্ষণ। এবার পৌঁছলাম সমতল রাস্তায়। পায়ের নিচে পিচের স্পর্শ পাচ্ছিলাম, আর অন্ধকারের মধ্যেও যদি কিছু দেখা যায়, তো দেখতে পাচ্ছিলাম পরিচিত দিগন্তের রেখা। আবছা। কিন্তু এই সবই নিশ্চয়ই আমার ভুল ধারণা, কারণ, আমি হঠাৎ ট্রেনের হুইসেল শুনতে পাচ্ছি; এবং বিমানবন্দরের যে রাস্তা আমি চিনতাম; তার ধারেকাছে কোথাও কোনো রেললাইন ছিলো বলে আমার মনে পড়ে না। হ্যাঁ, ওই তো দেখা যাচ্ছে আলোর রেখা... ট্রেনটা আসছে... আসলো... থেমে গেলো ঠিক সেখানেই, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি... আমি!

এখন কী করবো? ট্রেনে উঠবো? আমি ঈশ্বর-পরিত্যক্ত, প্রত্যাখ্যাত মানুষ। চারপাশে কেউ নেই। অতএব আমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কী করা উচিত এখন? একটু আগে যেমন ভেবেছি, যদি এই গোলকধাঁধা থেকে মুক্তি পেতে চাই, তাহলে অন্তত একবারের জন্যে হলেও পৌঁছাতে হবে গোলকধাঁধার কেন্দ্রে। এই শহরেরই কোথাও সেটা আছে। সুতরাং এই ট্রেনও যদি আমাকে সেই লাল আলোর কাছে নিয়ে যায়, তাতেও লোকসানের কিছু থাকবে না। আর যদি এমন হয় যে ট্রেন আমাকে গোলকধাঁধার বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, তাহলে তো হলোই। একই চক্রে বারবার ঘোরার হাত থেকে আমি রেহাই পাবো!

ট্রেনটা স্হির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে সামনের বগির আলোয় রাস্তা আলোকিত হয়ে উঠেছে; বোঝাই যাচ্ছে, ট্রেন থামবে আরো দূরে কোথাও, এটা নেহাতই এক জংশন। তাছাড়া বলা যায় না, হয়তো আমার জন্যেই এই ট্রেন। আমি উঠলেই সে আবার চলতে শুরু করবে। উঠলাম, এবং সত্যিই... ট্রেন ছেড়ে দিলো!

আশা বা দুরাশা কোনোটাই আমার নেই এখন। ভুলে গিয়েছি সেই প্রতিজ্ঞার কথা, যাকে সঙ্গী করে এই রাতের শুরুতে, সম্ভবত অনন্তকাল আগে, আমি রওনা হয়েছিলাম। শুধু এক অজানা আতঙ্ক এবং এক অতৃপ্ত কৌতুহল ছাড়া আর কোনো অনুভূতি আমার এখন নেই। আমি উঠেছি ট্রেনের সামনের দিকের এক বগিতে, যেখানে আর কোনো লোক নেই। হতে পারে, এবং এটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, যে, পুরো ট্রেনেই কোনো লোক নেই আমি ছাড়া। তাহলে ট্রেন কেনো আসলো এখানে? বোঝাই যাচ্ছে, আমার জন্যে। সবকিছু এখন চলছে অলৌকিক, অথচ ঈশ্বর-বহির্ভূত এক নিয়ম মোতাবেক; যেখানে আমার কাজ কিছুই নেই সহ্য করে যাওয়া ছাড়া। ঈশ্বর দাবি করেন শৃঙ্খলা; অথচ গোটা রাতের একটি মুহূর্তেও মনে হয়নি যে আমি কোনো সুশৃঙ্খল নিয়মের ভেতরে আছি। আমি না জানলেই কোনো কিছু মিথ্যে হয়ে যায় না, কিন্তু নিজের পথে তো নিজের পায়েই আমাকে চলতে হয়েছে; তাই অন্তত আমার কাছে আমি নিজে যেটা জানি, সেইটাই শুধু সত্য। মহা সত্য!

কোথায় তাহলে সময়? সবখানেই যদি সে থাকে, তো এই শহরেও তো তার থাকার কথা। সে নির্ঘাত বয়েই চলেছে, কারণ আমি বা কেউ কখনোই তাকে ধরতে পারিনি। নিজের ভেতরে যে গর্জন শুনে আমি ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম, সে-ও কি তবে মিথ্যে? তাহলে কেনো এই সন্ধানের অর্থ কী? জানি না। হয় কোনো অর্থই নেই, নয়তো সব অর্থ জানে এই ট্রেন।

এইসব যখন ভাবছি, তখনও এক মুহূর্তের জন্যেও জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখতে ভুলিনি। কারণ আশঙ্কা হচ্ছিলো, সেই লাল আলোটা আমি দেখতে পাবোই। হয় আলো উপেক্ষা করে ট্রেন এগিয়ে যাবে, নয়তো আলোটাই হবে ট্রেনের গন্তব্য। আশঙ্কাটা মিথ্যে ছিলো না, কারণ আনুমানিক আধা ঘণ্টা পেরোতেই লাল আলোটা আবার দেখা গেলো... এবং ট্রেন এগিয়ে গেলো আলোর দিকেই। ব্যাপারটা বেশ মজার। এক রাতে এই দিয়ে দশ বার আমি এই জায়গায় আসলাম, অথচ এবারের আগে কোথাও কোনো রেললাইন চোখে পড়েনি। এগারো বারের বারও হয়তো এই রেললাইনের দেখা পাবো না। কিন্তু আপাতত আমি ট্রেনেই আছি। এটা সত্যি। কোনো স্বপ্ন নয়।

ট্রেন থামলো। আনুমানিক পঞ্চাশ গজ দূরেই সেই লাল আলোর স্তম্ভ। তাকে এখন সূর্যাস্ত, স্মৃতি কিংবা ব্যর্থ প্রেমের মতো মনে হচ্ছে না। বরং এখন সে আরো স্পর্শযোগ্, আরো বাস্তব। ট্রেন থেকে নেমে চারিদিকে তাকালাম, দেখলাম দূরে অন্ধকারে আচ্ছন্ন দিগন্ত; ভাবলাম আজকের রাত এবং আমার পুরো জীবনটার কথা। শৈশবের কথা। জোসেফিন আর তার প্রত্যাখ্যানের কথা। আজ অব্দি এই জীবন ছিলো এক অসমাপ্ত সন্ধান মাত্র, যার কথা ভেবে কখনো কখনো আমি সত্যিই এক ধরনের গর্ব অনুভব করেছি। কিন্তু আজ রাতের এই সমস্ত ঘটনার পর নিজেকে আমার মনে হচ্ছে, প্রৌঢ়, ঈশ্বরের চেয়েও পোড় খাওয়া কোনো সত্তা। আমার মৃত্যু অবধারিত, কিন্তু এই অভিজ্ঞতার কোনো মৃত্যু আছে কি? এইসব ভাবতে ভাবতেই দশম বারের মতো এগিয়ে গেলাম লাল আলোর দিকে; এক অলৌকিক সত্য যেনো ঝাঁকি দিয়ে উঠলো মনেএবার নতুন কিছু দেখবো! একা আমি, আদমের চেয়েও নিঃসঙ্গ, নতুন চমকের প্রত্যাশা ছাড়া আদিগন্ত জীবন্ত আর কিছু নেই।

আমার টর্চ অচল, কিন্তু লাল আলোটা এবার এত বেশি উজ্জ্বল যে, তাতেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চারদিকের সবকিছু। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম, আমি একই জায়গায় এসে পড়েছি। ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছি, এমন সময় মাথায় একটা আলতো স্পর্শ অনুভব করলাম। আচানক এমন একটা স্পর্শের পর আপাদমস্তক হিম হয়ে যাওয়াই আমার পক্ষে স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু সেই যে আমার কৌতুহল, তার উষ্ণতা আমাকে চাঙা করে রাখলো। উঁচু হয়ে দেখতে চাইলাম ব্যাপারটা কী... আর বরাবরের মতোই, আলোটা নিভে গেলো।

চারিদিকে অন্ধকার ঠিকই, তবে কেনো যেন সেই নিখাদ শূন্যতাটা নেই, যা আগের নয়বার আমাকে বাধ্য করেছিলো নতুন পথে ছুটে যেতে। উপরন্তু, অন্ধকারে একটা অট্টহাসির শব্দও যেনো শুনতে পেলাম মনে হলো। এর আগে এমন কোনো শব্দ আমি কখনো শুনিনি, তাই ওটা যে হাসিরই শব্দ, এই ধারণাটা নিতান্তই আমার আরোপ করে নেওয়া। বলাই বাহুল্য, এসবের জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না একদমই। শুনতে পেলাম, কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে!

কণ্ঠস্বরটা খুব হাস্যকর, যাত্রাপালার জোকারের মতো। তবু আমার কাছে সেটা খুব ভয়ঙ্কর মনে হলো। (চিড়িয়াখানায় বাঘের গর্জন শুনে কেউ আদৌ ভয় পায় না। কিন্তু অন্ধকারে একটা নির্বিষ সাপের আবছা হিসহিস শোনাও খুব ভয়ঙ্কর, প্রায় সহ্যের অতীত, একটা ব্যাপার)। তাছাড়া, এই শ্বাসরুদ্ধকর নির্জনতায় আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে, এটা কোনো ভালো খবর নয় আদৌ। কিন্তু যেমন আগেও বলেছি, আমি পিছিয়ে আসলেও আমার কৌতুহল সর্বদাই আমাকে টেনেহিঁচড়ে এগিয়ে নিয়ে যায়, এবারও ঠিক তাই হলো; যেনো তারই নির্দেশে আমি সাড়া দিলাম, কে? কে তুমি? কী বলতে চাও? আমাকে চেনো কিভাবে?

তোমাকে চেনা তো কোনো ঘটনার পর্যায়েই পড়ে না। আমি মানুষের কাছে তার নিজের চেতনার চেয়েও নিকটবর্তী। আমি তোমাকে চিনি। সবাইকেই চিনি, উত্তর দিলো কণ্ঠস্বর।

কে তুমি? পরিষ্কার করে বলো।

আমি সময়! আমার সন্ধানেই তুমি আজ বেরিয়েছিলে।

আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো, হিম হয়ে উঠলো আমার অস্তিত্ব, আমি হয়তো ভেসে গেলাম গলে যাওয়া বরফের মতো। সময় তাহলে কথা বলে! সময়! আমারই মতো? কথা না বাড়ানোই হয়তো এই মুহূর্তে জ্ঞানীর কাজ হতো, কিন্তু আমার ভেতরের সেই কৌতুহল এগিয়ে নিয়ে গেলো সংলাপ, ওহ, তাহলে তুই-ই। তুই-ই আমার জীবনকে, আমার চেতনাকে এক ভয়ঙ্কর ফাঁদ বানিয়ে রেখেছিস, যাতে আমি নিজেই বারবার ধরা খাই। তোর জন্যই আমার জীবনে বর্তমান বলে কিছু নেই। এমনকি ভবিষ্যতের দিকে তাকালেও তাকে সম্ভাব্য অতীত ছাড়া কিছু মনে হয় না আমার। তোর জন্যই আমার শৈশব হারিয়ে গেছে। তোর জন্যই হয়তো হারিয়ে যাবে জোসেফিন! ভাগ্যিস কাছে কিছু নেই, আর আমি তোকে দেখতেও পাচ্ছি না; নইলে এখনই তোকে শেষ করে দিতাম, বা পঙ্গু করে দিতাম চিরকালের জন্য।

এবার সত্যিই সে হেঁসে উঠলো। তার হাসি থামতে যে হিম স্তব্ধতা নামলো, তা আমাকে আবারো স্মরণ করিয়ে দিলো জোসেফিনের কথা, তার প্রত্যাখানের কথা। আহা! কালকের রাত! না যদি আসতো কখনো! কিন্তু এই ভাবনা তো আরোই অসহ্য; তাই প্রায় চিৎকার করে আমি বললাম, হাসি থামা, শুয়োরের বাচ্চা! আমি তোকে দেখতে চাই। দেখতে চাই সেই শক্তিকে, সেই দানবকে, যে নাকি কারো কাছে কখনোই হারে না!

মানুষ মাত্রই হাস্যকর, সে বললো, এমনকি তুমিও, কারণ তোমার ধারণা আমি হচ্ছি একটা হিংস্র দানব জাতীয় কিছু, একটা মহাশক্তি, বা একটা আগুনের চক্র, যার শিখা সবকিছুকেই স্পর্শ করে যায়, যাকে কেউ জয় করতে পারে না। তোমার কল্পনাশক্তি বেশ ভালো, কিন্তু আমি তো কারো কল্পনা মোতাবেক চলি না। আমাকে দেখে তোমার ভালো লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। যাই হোক, নিজের চোখেই দেখো আমি কে!

এ কথা বলার পরই লাল আলোটা জ্বলে উঠলো, আর সেই কম্প্র আলোয় যে-দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম, তা আসলে অবর্ণনীয়। একটা ঘোড়া, যার মুণ্ডকাটা ধড় আমার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে এবং এর নামই সময়এই ধারণা যেনো আমার কৌতূহলকেও ভীত করে দিলো। কাঁপতে লাগলাম, দেখলাম, ধড়ের যেখান থেকে মুণ্ডুটা থাকার কথা, অবিরাম ধারায় রক্ত ঝরছে সেখান থেকে; কিন্তু মাটিতে পড়েই যেনো মিশে যাচ্ছে মাটির সাথে, জমে থাকছে না, বা বয়ে যাচ্ছে না, যেমন সাধারণত হয়। নিদারুণ ভয়ের মধ্যে ওই অবস্থায়ও আমি ধারালো কিছু একটা খুঁজছিলাম; কিন্তু হঠাৎ মনে হলো, যে-ঘোড়ার মাথা না থাকলেও অমন ভয়ঙ্করভাবে হাসতে পারে, তাকে আসলে খুন করা সম্ভব না। হাত-পা কেঁটে তাকে অচল করে দেওয়াও হয়তো অসম্ভবই। হয়তো সে কখনো জীবন্ত ছিলো, সচল ছিলো। আমার আগেই হয়তো কেউ তার মুণ্ডু কেটে নিয়ে চলে গেছে। কে সে? এই সময় কি আদৌ সময়? নাকি সময়ের প্রেতাত্মা মাত্র? জীবিত সময় কি এই মৃত, হাস্যকর প্রেতাত্মার চেয়ে অন্য রকম ছিলো? নাকি সময় আদতেই একটা মুণ্ডুকাটা ঘোড়া! বলা যায় না, হতেও তো পারে! এতো দিন আমি জানতাম, সময় মানুষকে নিয়ে, সৌন্দর্যকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে; এখন জানলাম, সে নিজেকেও কম বিদ্রুপ করে না।

আমার অসহায় অবস্থা দেখে সে হেঁসে উঠলো হয়তোবা; আমি দেখতে পেলাম ঘোড়াটার কাঁপুনি। কাঁপুনি যতো বাড়তে লাগলো, তার ঘাড় থেকে রক্ত বের হতে লাগলো ততোই। একপাশে সরে গিয়ে আরো জোরে হাসতে লাগলো সে। শেষমেশ হাসি থামিয়ে বললো,

তুমি হুট করে আমার উপর এতো খেপে গেলে কেনো বুঝতে পারছি না। পৃথিবীর সব অতীতই তো একদিন ভবিষ্যৎ ছিলো, সব মৃত্যুরই শুরু হয়েছিলো জীবন হিসেবে। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ সেটা জানে। কিন্তু কেউ কোনো দিন আমার কাছে কোনো নালিশ নিয়ে আসেনি। কারো কাছে এই মামুলি সত্যগুলো বেখাপ্পা মনে হয়নি। তাছাড়া ব্যর্থ প্রেমিক আমি আরো দেখেছি। ধরো, জোসেফিন যে তোমাকে কোনো পাত্তাই দিলো না, এতে আমারও একটু খারাপই লেগেছে বলতে পারো। কিন্তু তার জন্য তুমি এরকম উন্মাদের মতো ঈশ্বর, সময়, মানুষ, প্রকৃতিসবকিছুর উপর এইভাবে খেপে যাবে নাকি? আমি তোমার শৈশব কেড়ে নিয়েছি, এ কথা সত্যি। তা আমি আর কীইবা করতে পারতাম? তোমার জন্য তো আর আমি নিজেকে পাল্টে ফেলতে পারি না। একদিন জোসেফিনকেও আমি বাতিলের খাতায় ফেলে দেবো, একদিন তোমাকেও নিঃশেষে নিশ্চিহ্ন করে দেবো। এর জন্য হয়তো আমি ঘৃণ্য, আমি বধযোগ্য; কিন্তু মারতে তুমি আমাকে পারবে না, কারণ ইতিমধ্যেই আমি মৃত। পঙ্গু তুমি আমাকে করতে পারবে না, কারণ আমার এই চার পা দিয়ে আমি আদৌ ছুটতে পারি না। তাছাড়া আমি তোমার কাছে এসেছি তোমার জন্য বরাদ্দ সময়েরই রূপ ধরে। তার মানে, আমি নমুনা মাত্র। খুবই ক্ষুদ্র একটি নমুনা। আমাকে মারলে সবার আগে মরবে তুমি। কিন্তু এইরকম অজস্র মুণ্ডুকাটা ঘোড়া সারা পৃথিবীতে ছুটে বেড়াচ্ছে, তাদের তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না। আমি যে নিয়তি, এইটাই আমার নিয়তি। আমি বধযোগ্য নই, কারণ আমি মৃত, আমি বহু।

এরপর আর কী বলতে পারি আমি? প্রচণ্ড একটা ঘৃণা কাজ করলো নিজের ওপর, সময়ের ওপর। মনে হলো সব ছেড়েছুড়ে ঘরে ফিরে যাই। কিন্তু এই মুহূর্তে তো সেটা সম্ভব না। কারণ গোলকধাঁধা থেকে বেরোনোর পথ আমি এখনো খুঁজে পাইনি। গোলকধাঁধার ব্যাপারটা মনে পড়াতেই হয়তো মুণ্ডুকাটা ঘোড়াকে জিজ্ঞেস করলাম, তা, এই কথাগুলো বলার জন্য আমাকে এতো ঘোরানোর দরকার ছিলো না তো। তুই তো সবই জানতিস। তাহলে শুরুতেই কেনো দেখা করলি না আমার সঙ্গে? আমার তো আর কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না।

চাইলেই দেখা দিতে পারতাম। কিন্তু তুমি যে কতোটা অসহায়, এটা তোমাকে বোঝানোর দরকার ছিলো। তাই শুরু থেকেই আমি তোমাকে ইচ্ছেমতো ঘোরাচ্ছি। যেমন, আজ বাসা থেকে বেরোনোর সময় যে গর্জন তুমি শুনেছিলে, সে ছিলো আমারই গর্জন। যাকে মানুষের ছুটে আসার শব্দ বলে মনে করেছিলে, তা ছিলো আমার শব্দ। তুমি ভীতু না হলে সেই মুহূর্তেই আমাকে দেখতে পেতে। কিন্তু আমি জানতাম তুমি পালানোর চেষ্টা করবে। তারপরও আমি তোমার জন্যেই এসেছিলাম এবং আমিই তোমাকে বয়ে এনেছি এখানে। কিন্তু তবে একটা ব্যাপার খুব হস্যকর হয়ে গেলো, না? সময়ের মুখোমুখি হওয়ার সাহস তুমি দেখাতে পারো, অথচ একটা মানুষ খুনের দায় নেওয়ার মতো সাহস তোমার নেই।

খুনের দায়ে গ্রেফতার হতে পারি, ভয়ঙ্কর লাল আলোয় দাঁড়িয়ে এই কথা মনে হতেই আমার শরীর কেমন যেনো শক্ত হয়ে গেলো। দেখলাম, গত সন্ধ্যায় যে-ছুরি দিয়ে আপেল কেটে টেবিলে ফেলে রেখেছিলাম; সেই ছুরিটাই পড়ে আছে এখানে, আমার সামনে। এবং শুধু সেটাই নয়, পড়ে আছে সেই রক্তমাখা বন্দুকও, যেটা আমি দেখেছিলাম মৃত প্রহরীর হাতে। অবাক হলাম। প্রায় হিংস্র ভঙ্গিতেই যেনো বললাম, এই বন্দুক কোথায় পেলি তুই? তুই-ই তাহলে খুনী?

সে আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। তার সারা দেহে দেখতে পেলাম কাঁপুনি। কাঁপতে কাঁপতে কাঁপতে কাঁপতে কাঁপতে সে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

সে যদি আমার জন্য বরাদ্দ সময়ই হয়ে থাকে, তো আমার মৃত্যু নিশ্চয়ই তারও মৃত্যু। আমার মৃত্যু দিয়েই আমি তার উপর খানিকটা প্রতিশোধ নিতে পারি। ঘোরগ্রস্তের মতো খেপে গিয়ে ছুরিটা তুলে নিলাম, ততড়িঘড়ি বসিয়ে দিলাম নিজের বুকে। সবকিছু খুব অস্পষ্ট মনে হলো, ক্ষীণ হয়ে আসতে লাগলো সব দৃশ্য আর শব্দ, আর সেই অর্ধচেতন অবস্হায় আমি দেখলামলাল আলো নিভে গেলো!

জ্ঞান ফিরতে দেখলাম আমি হাসপাতালে; কোন হাসপাতালে, বলতে পারবো না। কেবিনের দরজায় দুজন পুলিশ দাঁড়িয়ে, আর শিয়রে বসে আছে আমার মা, আমার বোন। অস্পষ্ট হলেও দূরে ভেসে উঠলো একটি পবিত্র মুখ, জোসেফিনের মুখ। কী হয়েছিলো? জানতে চাইলাম। এটা সত্যিই যে, গত রাতের কোনো কিছুই আমার তখন মনে ছিলো না। মা যা যা বললেন, (তিনি কাঁদছিলেন, কথা বলতে বলতে ফোঁপাচ্ছিলেন), তার সরমর্ম এই যে, আজ সকালে, আমাকে ছুরিবিদ্ধ অবস্হায় পুরাতন বিমানবন্দরের ভেতরে পাওয়া যায়; আমি ছিলাম সম্পূর্ণ অজ্ঞান। দুজন প্রহরী আমাকে দেখতে পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমাকে শনাক্ত করার জন্যে প্রথমে মা আসে, তারপর একে একে সবাই; এবং যা দেখে আমি নিজেই অবাক, জোসেফিনও চলে আসে খবর পেয়ে। পুলিশ তদন্ত করে দেখছে ব্যাপারটা কিভাবে হলো। ততক্ষণে আমার সবকিছু মনে পড়ে গেছে। হুট করে মনে হলো, সেই লাশটার কী হলো? আমি জিজ্ঞেস করলাম মাকে, কিন্তু তিনি এতোটাই অবাক হলেন যে, বললেন, আমার মাথা ঠিক নেই। লাশ পাওয়া দূরে যাক, কোনো আহত ব্যক্তিকেও পাওয়া যায়নি ওখানে।

ঠিক সেই সময় দরজায় দাঁড়ানো এক লোক পেছন ফিরতে আমি দেখলাম, এ তো প্রহরীর মুখ! সেই প্রহরী! সে-ই!

অবাক হওয়ার ক্ষমতা তখন আমার নেই। শুধু এই ভেবে খারাপ লাগলো যে, আমি সময়কে বধ করতে পারিনি; সে পার পেয়ে গেছে; হারিয়ে গেছে অনন্তের আলখাল্লা পরে... আর... আমাকে দিয়ে গেছে এক তিক্ত শিক্ষা; এক বিষাক্ত আমলকী, যা আমি না পারবো কখনো গিলতে, না পারবো ফেলতে। সময় এতোটাই অবধযোগ্য যে, তার চিন্তা বাদ দিয়ে আমি আমার বাদবাকি শত্রুদের সাথে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিলাম।