জনতা ও নির্জনতা

অ+ অ-

 

ওসিমুদ্দিন হোসেনের ব্যাংকে এখন আর কোনো টাকা নেই। শুধু হিসাব খুলতে যে টাকাটা লাগে সেটা রেখে গত চার মাসে কদনি পর পর সে মোটা অঙ্কের টাকা তুলেছে। গত তিন মাস ধরে সে কেবল তুলেই যাচ্ছিল। জমা দিচ্ছিল না কিছুই। এবার বাদবাকি সব টাকা তুলে সে কোথায় পালিয়েছে, সম্ভবত তার বৌ ছাড়া আর কেউ জানে না।

ওসিমুদ্দিন পুলিশের সহপরিদর্শক। কুকুরের নাকের মতো সে অনেক আগে থেকে যেমন মৌজমাস্তির গন্ধ পেত, তেমনি বিপদের গন্ধ পেতেও দেরি হতো না। মানুষের উপকার অপকার ক্ষতি-দুর্গতি করতে কোনো কিছুই তার বাদ নেই। কেবল আজ অব্দি সে গুলি করে বা পিটিয়ে কোনো মানুষ মারেনি। সে সব কাজ করত বোঝাপড়ার ভিত্তিতে, নয়তো টাকা খাইয়ে। চেহারা মারদাঙ্গা দেখালেও মারামারি খুনাখুনি রক্তারক্তি তার একদমই পছন্দ নয়। তার পছন্দ কড়কড়ে টাকার গন্ধ আর হলো সুযোগ পেলেই মেয়েমানুষ নরমমাংসের স্বাদ। একবার এলাকার এক বেমাক্কা সুন্দরী মহিলা ওয়ার্ড কমিশনারকে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে তার সঙ্গে সে সবদিক থেকে জড়িয়ে পড়েছিল; মানে তাদের দুজনের ভেতরে কিছুই আর বাকি ছিল না। যদিও বিরোধীপার্টির লোকজনের হাত থেকে ওই মহিলা কমিশনারকে শেষ অব্দি রক্ষা করতে পারেনি। ওসিমুদ্দিন জানত, মাগির যেমন ছিল কূটবুদ্ধি, তেমন রাগ আর তেমন ছিল খাঁই।

ওসিমুদ্দিনের ঘরভর্তি ছেলে আর এক তাগড়া সাঁইটেল বৌ। এত্তগুলি ছেলে, মানে সাত ছেলে। জোহানআরার পেটে এতগুলি ছেলে আসত না, যদি শুরুতেই দুটা ছেলের পর একটা মেয়ে হয়ে যেত।

জোহানআরা দেখতে বেশ সুন্দর। ওসিমুদ্দিনের জীবনের ইচ্ছা ছিল, সেই একটা সুন্দর মেয়ের স্বামী ও কমপক্ষে একটা সুন্দর মেয়ের বাপ হবে। মানুষের কত অদ্ভুত শখ থাকে, সেই শখের জন্য মরিয়াও হয়ে ওঠে কেউ কেউ। ওসিমুদ্দিন তেমন মরিয়া ছিল একটা মেয়ের জন্ম দিতে। আর জোহানআরা একটার পর একটা ছেলের জন্ম দিয়েই যাচ্ছিল।

ওসিমুদ্দিনের বৌ জোহানআরাকে যেদিন হাসপাতালে ভর্তি করে দিল পরের দিন একদল লোক লাঠিশোটা নিয়ে হুড়মুড় করে পুলিশ ফাঁড়িতে ঢুকে পড়ে। কেউ কেউ বোঝার আগে কয়েক মিনিটের মধ্যে ফাঁড়ির সব কিছু চুরমার। পুলিশ তো হুকুম ছাড়া গুলি চালাতে পারে না। ওসিমুদ্দিন প্রথম দফায় কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছে। ওয়ারলেসে খবর এসেছে, গাবতলি থেকে লীগের যতগুলো পার্টি অফিস ছিল সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, পালাও। তখনও সে পালায়নি। বাসায় ফিরে ভেবেছে, এখন তার কী করা দরকার।

ঢাকা উদ্যানের কাছে একটা বাড়িতে থাকে সে। মজার ব্যাপার তার বাড়ি বলতে গেলে কেউ চেনে না। কারণ পুলিশের পোষক পরে সে কখনো বাড়িতে ঢুকত না বেরুত না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে অলি-গলি পার হয়ে একটা মসজিদের মুয়াজ্জিনের ঘরে কাপড় বদলে তার পর সে অফিস যেত। ফেরার সময়ও তাই করত। মসজিদে প্রতিমাসে সে বড় অঙ্কের টাকা দান করত।

তার থাকার বাড়িটা বেশ পুরোনো কায়দায় তৈরি। মাঝখানে ছোট একটা উঠান ঘিরে চারটা ঘর। একোণে একটা গেট দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে হয়। বাড়িটাকে তার খুব নিরাপদ মনে হতো না। কিন্তু আড়ালে থাকার জন্য একদম খাসা। অফিসের বাইরে ডিউটির বাইরে ওসিমুদ্দিন কাউকে নিজের পুলিশ পরিচয় দিত না।

কেউ কেউ বলে ওসিমুদ্দিন এই বাড়িটা দখল করেছে, কেউ বলে, এটা এককালের এলাকার টপ টেরর ধলা আকবরের বাড়ি। আকবর এখন দুবাই থাকে। আর আকবরই বলে তার এই বাড়ি ওসিমুদ্দিনের দখলে দিয়েছে বা ওসিমুদ্দিনকে দখলে রাখতে বলেছে।

ছোট চাকরি করলেও এত্তগুলি ছেলেপেলে পালতে অনেক টাকা লাগে। সেই টাকা জলের স্রোতের মতো না হলেও তাকে কামাতে হয়েছে। কাজের মধ্যে বসিলাতে চার কাঠার একটা জমি কিনেছিল বছর পাঁচেক আগে। এখন সেখানে সেমিপাকা বাড়ি মানে পাকাবাড়ি টিনশেড করে ভাড়া দিয়েছে। সেখানে লাইন দিয়ে আটটা ঘর। এক কোণে দুটো টয়লেট আর বাথরুম। একটা টয়লেট ও বাথরুম করলেই হতো। সেখানে কী মনে করে সে এক জোড়া এক জোড়া মিলিয়ে প্রতিটি জিনিস করল। তখন মনে হয়েছিল, একটু মানবিক হওয়া দরকার। রাজমিস্ত্রি সৈয়দ আলী বাড়িটা বানানোর সময় হঠাৎ করে কথাটা বলে, একটু মানবিক হলে ভালো হয়।

সৈয়দ আলী বিজলী মহল্লায় নিজে একটা বাড়িতে ভাড়া থাকে। সেখানে ছয়টা ঘরের জন্য সব একটা একটা। একটা রান্নাঘর, একটা গোসলখানা, একটা পায়খানা। যেকারণে সৈয়দ আলী কোনো কাজে গেলেই বাড়ি তৈরি করা লোককে এই কথা বলে, একটু মেহেরবানি করে রান্নাঘর, টয়লেট আর বাথরুম এক জোড়া করলে ভালো হয়। সৈয়দ আলী গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিল কাঁচা টাকার আশায়। শহরে এসে সে নতুন ফাঁদে পড়ল। এর চেয়ে অনেক কম খরচে গ্রামে সে চলত। শহরে এসে জিনিসপত্রের দামে ত্রাহী দশা। বাড়িভাড়ায় চলে যায় আয়ের অর্ধেক। সঙ্গে ছেলেমেয়ের লেখাপড়াতেও বাড়ি ভাড়ার সমান খরচ। ফলে হাতে কিছুই থাকে না। এত খরচের ঠেলায় শহরে সৈয়দ আলীর নিজের বলতে কিছু করা হয়ে ওঠেনি। এখানে জমির দাম কল্পনাতীত। অনেক কষ্ট করে এতদিনে সে গ্রামে আটশতাংশ জমি কিনতে পেরেছে। ইদানীং সে মানবিক কথাটা ব্যবহার করে। গলা নরম করে অনেক বিনয়ের সঙ্গে বলে, একটু মানবিক হলে ভালো হয়। যেমনটা সে ওসিমুদ্দিনকেও বলেছিল।

ওসিমুদ্দিনকে অমানবিক লোক বলা যাবে না। রূপবতী বৌ জোহানআরাকে সে নিয়মিত ভালোবাসে। জোহানআরও বিনাবাক্যে ফি বছর নরমাল ডেলিভারিতে একটার পর একটা বাচ্চা বিইয়ে যাচ্ছে। সঙ্গমের সময় জোহানআরার বিশাল প্রশস্ত পাছায় গদাম গদাম করে চাপড় মারার সময় একদিন বলেছিল, কথায় বলে: মোটা পাছা যার/ বিহা কর তাক।এর মানে জানিস বৌ?মানে কী? জোহানআরা তখন বিপরীতবিহাররতওসিমুদ্দিনের ওপরে উঠে কাপটের মতো তার বুকের পেশি দুহাতে খামচে ধরে কোমর সাঁটিয়ে যাচ্ছে। আলিমুদ্দিন বলে, এর মানে হলো পাছামোটা হলে ছৈলপৈল হইতে সুবিধা হয় তাই এমন মাইয়ামানুষই বিয়া করা দরকার। এজন্যিই তো তোর এ পর্যন্ত সিজার লাগে নাই। কিন্তু এবারও যদি তোর মেয়ে না হয়, তো তোক আমি মাইরাই ফালাবু।ওসিমুদ্দির তিন নম্বর বাচ্চাটা ছেলে হওয়ার পর থেকেই প্রতিবার বৌয়ের পেট না হওয়া অব্দি এই কথা বলে এসেছে।

লম্বায় পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির ওসিমুদ্দিনের মতো এত চওড়া শরীর খুব কম লোকের দেখা যায়। অথচ সে মোটা নয়। ভুঁড়িও নেই। দোহারাগড়নের পেটনো শরীর। মাথায় চুল কম হলেও সজারুর মতো করে সারা বছর ছাঁটা থাকে। ঠোঁট ঢেকে দেওয়া এ্যায়া ঝোলানো গোঁফ চোয়াল পার হয়ে গেছে। মাথার চুলের কমতিটা সে গোঁফ দিয়ে পুষিয়ে নেয় কিনা বহু আগে থানায় আসা নতুন এক ওসি সাহেব জিজ্ঞাসা করেছিল। ওলসিমুদ্দিন উত্তরে অ্যাটানশান হয়ে একপা ঠুকে কেবল বলেছিল, স্যার!

ছোটবেলা থেকে সিনেমার নায়িকাদের ভালো লাগলেও বাংলা ছবিতে নূতন ছাড়া আর কোনো প্রতি সে তীব্র শরীরী টানবোধ করেনি। বলতে গেলে নূতনের একটা সিনেমাও সে বাদ দেয়নি। এখনও এত বছর পরও নাগিনী সাপিনী/ আয় তোরা আয়/ ভালোবেসে কাছে এসে/ ধরা দে আমায়’—গানটা সে গুনগুন করে ওঠে। একদিন দলিল মিয়া, তার সহকর্মী, বলে, কী গুনগুন করেন স্যার?

সেদিন হঠাৎ ওসিমুদ্দিনের মনে হয়, মেয়ে হলে সে নাম রাখবে নূতন বা গুনগুনদুটোর একটা। আসমান, ফারহান, জাহান, আম্মান, রোহান, সেজান,এই ছয়টা ছেলে বাড়িতে এলে তাকে এই কদিন আগেও ঘিরে ধরে নাচত আর লাফাত। সে এক দেখার মতো দৃশ্য! পেটে থাকা শাহানকে নিয়ে জোহানআরা ওই দৃশ্য দেখে সেই রকম কৌতুকবোধ করত: আব্বা আমার খাতা লাগবে। আব্বা আমার গাড়ি আনো নাই! আব্বা আমার জুতাটা ছিঁড়ে গেছে। আব্বা লাড্ডু!ছেলেরা বলছে, আর ওসিমুদ্দিনকে ঘিরে লাফাচ্ছে। আর ওসিমুদ্দিন বারবার বলত, ধ্যাত আরে ছাড় তো আমাকে! আনব আনব! আবার বাইরে গেল সব আনব!

আদ্ভুত ব্যাপার হলো শাহান হওয়ার আর কিছুতেই জোহানআরার পেট হচ্ছিল না।

তুই কিছু খাসটাসবড়িটড়ি? লাইগেশানটাইগেশান করাসনি তো!

কী মাথা খারাপের কথা কও!

আসলে ওই মহিলা ওয়ার্ড কমিশনারের সঙ্গে কাটানো সময়টা বেশ কিছু দিন তাকে বাড়ির বাইরে থাকতে হয়েছিল। এর ভেতরে জোহানআরা যদি এমন কিছু করে থাকে! নিজে সে পুলিশ; সন্দেহ করার একটা ধাত তো মজ্জাগত!

বাচ্চাকাচ্চাদের ভেতর সব ঠিকঠাকই ছিল। সবাইকে এলাকার ভালো স্কুলে পড়িয়েছিল বা পড়াত। যদিও কেউ লেখাপড়ায় তেমন কিছু করতে পারেনি। কেবল আম্মান ছাড়া। ছেলেটার মাথা খুব ভালো। যেমন ইংরেজিতে তেমন বাংলায় তেমন গণিতে। এটাকে নিয়েই আবার যত বিপদ। এই ছেলেটাকে কিছুতেই কব্জায় আনতে পারছিল না। ওর বড় তিনটাকে কায়দামতো অল্পবয়সে ব্যবস্থা করা গেছে। ওদের দিয়ে লেখাপড়ায় কিছু হবে না টের পেয়ে আর দেরি করেনি। আসমানকে মালয়েশিয়া, ফারহানকে দুবাই, আর জাহানকে ইতালি পাঠিয়ে দিয়েছে।

আম্মান পেয়েছে একদম ওসিমুদ্দিনের মায়ের স্বভাব। ওসিমুদ্দিনের নিজের আম্মা বাপের কোনো উল্টাপাল্টাতে ছাড় দিতে চাইত না। বাপের ছিল দুই বিয়ে। দুই ঘরে আট আট করে ষোলজন। গ্রামে বাপের বিপুল সহায়সম্পত্তি। বিঘা বিঘা জমি। পুকুরের মাছের ব্যবসা। আর কত যে দুধেল গরু ছিল দেশিবিদেশি। রীতিমতো বাথান আর কী। পরে, ছেলেমেয়েরা জমিজায়গা নিয়ে এর বিরুদ্ধে ও মামলা, হামলা করে সব নাশ করে দিয়েছে।

ওসিমুদ্দিন মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে এ চাকরিতে ঢোকে। গত কুড়ি বছরে ওই টাকার কয়েকগুণ আদায় হয়ে গেছে। প্রমোশানও বাগিয়ে নিয়েছে সময়মতো। সঙ্গে মুফতে কতগুলি মেয়েমানুষের স্বাদও পেয়েছে। দুহাতে ফুর্তি লুটে নেওয়া যাকে বলে। তবে একটা বিষয়ে সে খুব হুশিয়ার:  কারো সঙ্গে জোর করে সে কোনোদিন কিছু করেনি। একটা জিনিস সে টের পেয়েছিল: জগতের সবচেয়ে সেরা সুন্দরী এনে দিলেও যদি ন্যূনতম মনের টান যদি দুজনের মধ্যে না থাকে তার সঙ্গে শুয়েও কোনো কোনে মজাই কেউ পাবে না। একই তালে সে জোহানআরাকে কখনো বঞ্চিত করেনি।

ওসিমুদ্দিনের বাপ বলত, সুলক্ষণা দেখে বিয়ে করবি; আর যত পারিস বাচ্চা নিবি। ঘোড়ার পিঠ ও নারীর পেট কখনো খালি রাখতে নাই। এজন্য সে জন্মনিয়ন্ত্রণের ধার দিয়েও কোনোদিন যায়নি। জোহানআরার মধ্যে নাকি সে অনেক ছেলেমেয়ের মা হওয়ার লক্ষণ দেখতে পেয়েছিল। জোহানআর আবার এত ছেলেমেয়ের মা হতে চায়নি। কিন্তু ওসিমুদ্দিন বলেছিল, দুটো ছেলে ও দুটো মেয়ে হলেই বন্ধ। কিন্তু ছেলের পর ছেলে হতে থাকলে একটা মেয়ের জন্য রীতিমতো পাগল হয়ে উঠেছিল ওসিমুদ্দিন। সাত ছেলে হওয়ার পর জোহানআরা বলেছিল, এবার মেয়েই হবে।

ওসিমুদ্দিন ওর অটোম্যাটিক পিস্তলটা বের করে বলেছিল, না হলে এবার এবার শালি তোর পেটই ফুটা করে দেব! বাচ্চা হওয়ার দিন কাছিয়ে আসছিল। তখন শুরু হলো আন্দোলন। দিনে দিনে বাড়তেই থাকল। প্রথমে ছয় জনের মৃত্যুর পর ওসিমুদ্দিন মনে করেছিল এবার থেমে যাবে। এই পরিস্থিতিতেই সে জোহানআরাকে শহরের সবচেয়ে ভালো একটা ক্লিনিতে ভর্তি করে। আর বলে দেয়, নরম্যাল ডেলিভারির জন্যও সে সিজারের মতো টাকা দেবে। বাচ্চা যাতে ঠিকমতো হয়। এই প্রথম সে এমন ব্যবস্থা করল। নইলে সে যেখানে থাকে, সেখানে এতদিন ধরে মাতৃসদন থেকে প্রশিক্ষিত ধাত্রী নিয়ে কাজ সেরেছে।

বাড়িতে কেউ না থাকায় সে তার শাশুড়ি চেমনআরা আর শালি জিন্নাতআরাকে নিয়ে আসে। এদিকে আম্মানকে কোনোভাবে ঘরে ফেরাতে পারছিল না। কলেজে পড়া বন্ধুদের সঙ্গে সে আন্দোলনে নেমে পড়েছে। চেমনআরা হাসপাতালে আর শালি জিন্নাতআরা বাসার দেখভাল শুরু করছে বলে রক্ষা। কিন্তু আম্মানকে ফেরাবে কীভাবে! এদিকে ছুটিছাটা সব বাতিল। দিনরাত ডিউটি।

শাশুড়ি আর শালির হাতেও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে ওসিমুদ্দিন সরকারি হুকুম পালনে ব্যস্ত। এর ভেতরেই বাজ পড়ার মতো খবরটা আসে: জুলাইয়ের চার তারিখ আম্মান কীভাবে যাত্রাবাড়ি গেল আর সেখানে গুলি খেয়ে মরল, এটা ওসিমুদ্দিনের মাথায়ই ঢোকে না। কোথায় ঢাকা উদ্যান, কোথায় যাত্রাবাড়ি!

ছেলে মরে যাওয়ার বিষয়টা ওসিমুদ্দিন নিজে যেমন পাথরচাপা দিয়ে রাখে, তার চেয়ে সর্তক থাকে যেন বাচ্চা হওয়ার আগে জোহানআরা কোনোভাবেই যেন এই খবর না পায়।

আম্মানটা সবসময় বাপের বিরুদ্ধে থাকত। ছেলের না মানতে চাওয়া কত কথা, নানান রকমের জিদ করার কত কত দৃশ্য কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি ঝরে পড়েছিল। ওসিমুদ্দিন দাঁতে দাঁত চেপে গাল থেকে সেই পানি মুছে ফেলেছিল।

জুলাইয়ের পাঁচ তারিখ কোনো কিছু ভাবার আগেই ওসিমুদ্দিন কেবল বুঝেছিলতাকে পালাতে হবে আর যেকোনোভাবেই বাঁচতে হবে। বেশি ভাববার সময় নেই। দ্রুত যা করার করতে হবে। জোহানআরা হাসপাতালে সেদিনও বলেছিল, দেখো, এত চিন্তা কইরো না। তুমি একশোটা ঘটনার কথা ভাবতে পারো, কিন্তু ঘটনা কিন্তু ঘটবে একটাই। যা থাকে কপালে, হবে।

সে বসিলার একটা গরুর খামারের পাশে একটা প্রায় পরিত্যক্ত দোতলা বাড়ির খোঁজ জানত। ঝিলের পাশে বাড়িটার দোতলায় গিয়ে সে লুকায়।

প্রথম রাতটা নিরাপদে কাটলেও পরের দিন কিছু লোক এসে ফিরে যায়। তারপরের দিন আবার কিছু লোক আসে। তারাও চলে গিয়েছিল; ঠিক তখন সাইলেন্ট মুডে থাকা ফোনটায় আলো জ্বলে ওঠে।

ইংরেজিতে বৌ কথাটা দেখেই সে ঝট করে ধরে। জোহানআরা প্রথমেই বলে, মাইয়া হইছে তোমার। তোমার মতো দেখতে হইছে। কীস্বাস্থ্য!

ওসিমুদ্দিন আনন্দে এত বিহ্বল হয়ে যায় যে, তার মনে হয় জগতের সবাইকে সে চিৎকার করে জানায়: আমার একটা মেয়ে হইছে।

সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে নামতে থাকা লোকগুলি, হঠাৎ দড়াম করে দরজা খোলা শব্দে চমকে সবাই একযোগে পেছনে তাকায়। দেখে, পুলিশের পোষাক পরা ওসিমুদ্দিনের আনন্দে চোখমুখ জ¦লছে। সে চিৎকার করে বলতে থাকে: আমার মেয়ে হইছে, আমার মেয়ে হইছে! ও আল্লাহ রহমানুর রহিম! শোনেন ভাইয়েরা, আমার মেয়ে হইছে।

লোকগুলির কারো কারো হাতে ধরা লাঠিতে মুঠি শক্ত হয়ে ওঠে, কারোবা মুঠি আরো ঢিলা হয়ে যায়।